মুবাহালাহ
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৫ অক্টোবর, ২০১৩, ০৩:১০:৩৬ দুপুর
ইয়েমেনের অন্তর্গত ‘নাজরান’ একটি প্রসিদ্ধ শহর ছিল। এই শহরেই রোমের অধীনে এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ গীর্জা ছিল খ্রিষ্টানদের। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর রসূল(সা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান,সরকার প্রধান,ধর্ম প্রধান,প্রভাবশালীদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন তখন নাজরানের প্রধান খ্রিষ্টান পাদ্রীর কাছেও দূত মারফত পত্র প্রেরিত হয়। নাজরানের গীর্জার অধীনে তখন ৭০এর অধিক নগর বা গ্রাম ছিল। তাদের ছিল লক্ষাধিক স্বেচ্ছাসেবকের সমন্বয়ে তৈরী একটি সেনাবাহিনী,যারা যুদ্ধের জন্যে যে কোনো সময় প্রস্তত হতে পারত। কিন্তু তার পরও তারা ইহুদীদের কটুবাক্যের ভয়ে ভীত থাকত। কারণ তারা নানা রকম কুৎসা রটনা করত। তারা ঈশা(আ সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করত। এবং তার মাতাকে দুশ্চরিত্রা বলত। এবং বলত ঈশা পাপিষ্ট ছিল ফলে তাকে শূলে চড়িয়ে অবমাননাকর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার জন্মের ঠিক নেই ইত্যাদী।
সেইন্ট পল ছিল ছন্দবেশী ইহুদী। সে খ্রিষ্টান ধর্মকে বিকৃত করেছিল [ইঞ্জীল কিতাব বা বাইবেল প্রথম বিকৃত করে “সেইন্ট পল”। তিঁনি ইহুদী ধর্ম,ইরানের অগ্নী উপাসনা,আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্ম প্রভৃতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। প্রথমে তার নাম ছিল “সল” খ্রিষ্টান হওয়ার পর তার নাম হয় পল। তিঁনি বাইবেলে তাঁর নিজস্ব মতাদর্শ সংযুক্ত করেন। তিনি ঈশা(আঃ)কে কখনও দেখেননি এবং তাঁকে তিঁনি মানতেন না। তাঁর অনুসারীদের উপর তিনি চরম অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছেন। ( ‘অ ংযড়ৎঃ যরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ’ চধমব হড়.১৪৪: ঐ.এ.বিষষং )]
সে ইহুদীদের এসব কথার উত্তরে বলেছিল-ঈশা বা যীশু মারা গেছেন কিন্তু তিনি সকল অনুসারীদের পাপ নিজের কাধে তুলে নিয়ে তার পিতার(স্রষ্টা)কাছে গমন করেছেন। এটি অপমৃত্যু ছিলনা বরং অনুসারীদের পাপের প্রায়:চিত্র ছিল। তার এসব কথা সেসময়ে খ্রিষ্টানরা পছন্দ করে। কারণ ইহুদীদের কটাক্ষের বিপরীতে তাদের কাছে উত্তম কোনো যুক্তি ছিলনা। কারণ ঈশাকে আল্লাহ অলৌকিকভাবে উঠিয়ে নিয়েছিলেন ,সেটা অনুসারীদের জানা ছিলনা। তারপরও ইহুদীদের বাক্যবানে তারা জর্জরিত ছিল। সেইন্ট পলের উদ্দেশ্য ছিল খ্রিষ্টানদের পক্ষ নিয়ে কিছু মতবাদ ঢুকিয়ে ভেতর থেকে তাদেরকে পঙ্গু করা।
মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে নাজরানের চৌদ্দ গোত্রের প্রধান প্রধান পাদ্রীগণ,তার সাথে সর্বোচ্চ তিনজন নেতাসহ মোপ ৬০ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল মদীনায় উপস্থিত হয় এবং রসূল(সাএর সাথে সাক্ষাত করেন। তাদের প্রধান নেতা ছিল আব্দুল মছিহ ওরফে আকেব,প্রধান ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ আবু হারেছা,পথ প্রদর্শক ছিল আইয়াম ওরফে ছাইয়েদ।
তারা আইয়াম ও ছাইয়েদকে রসূলের(সাসাথে কথা বলার জন্যে মনোনিত করল। রসূল(সাতাদেরকে ইসলাম গ্রহনের জন্যে আহবান করলে তারা বলেন-আমরা তো পূর্ব হতেই মুসলিম। তখন রসূল(সা বলেন-অপনাদের দাবী মিথ্যা। আপনারা ইসলাম পরিপন্থী কাজে লিপ্ত। আপনারা ঈশাকে আল্লাহর পুত্র মনে করেন,ক্রুশকে পুজনীয় রূপে গ্রহণ করেছেন এবং শুকর খান। (শুকর কোনো নবীর জন্যেই হালাল ছিলনা)
তারা যুক্তি পেশ করল ঈশা আল্লাহর পুত্র না হলে ঈশার পিতা কে ? যেহেতু কোনো মানুষ তার পিতা ছিলনা তাই আল্লাহই তার পিতা,নয়ত তাকে জারজ বলতে হয়। কিন্তু অবশ্যই তিনি তা নন। অর্থাৎ তারা পিতা ছাড়া সন্তান জন্ম লাভের বিষয়টি চিন্তাই করেনি।
তারা ঈশার খোদা হওয়ার দাবী করে বলে যে, তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারতেন,অন্ধকে অন্ধত্ব দূর করতে পারতেন,গায়েবের খবর বলে দিতে পারতেন।
আল্লাহ তায়ালা নাজরানের খ্রিষ্টান প্রতিনিধিদের যুক্তি খন্ডন করে সূরা আল ইমরানের ৮৪টি আয়াত নাযিল করেন। এতে আল্লাহ তার নিজের সম্পর্কে জানিয়েছেন যে, তার সাথে অন্য কারো তুলনা হতে পারেনা। তার কোনো শরিক নেই,কেউ তার সমকক্ষ নয়। তাকে ছাড়া কারো ইবাদতও গ্রহণযোগ্য নয়। তিনিই সকল কিছুর একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি অনাদী,অনন্ত। তিনিই একমাত্র স্রষ্টা,মহাপরাক্রমশালী। সকল বিষয়ের জ্ঞান একমাত্র তারই আছে। এমন কোনো বিষয় নেই ,যা তার অজানা বা গোপন। তিনিই পূর্বর্বর্তী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন,তাওরাত,ইঞ্জীল নাযিল করেছেন,আল কুরআন তার সমর্থক। সকল কিছুর তিনিই একমাত্র অধিপতি।
আল ইমরানের ৩১-৩২ নং আয়াতে বলা হয়েছে- “বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমামীল এবং পরম দয়ালু। বল, আল্লাহর রসূলের অনুগত হও,যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখ, আল্লাহ কাফিরদের পছন্দ করেননা। ”
এর পরবর্তী আয়াতগুলোতে ঈশা (আএর জন্ম বিবরণ বিবৃত হয়েছে। এবং তিনি যে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক আদেশ বলে জন্মলাভ করেছেন তা বিবৃত হয়েছে। সূরা আল ইমরানের ৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে-“আল্লাহ নিকট নিশ্চয় ঈশার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্তের মত। তিনি তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন তারপর বলেছেন হও,আর তা হয়ে গেছে।” দোলনায় থাকা শিশু বয়সে তিনি কথা বলবেন তাও লিখিত হয়েছে। এবং সেখানে ঈশার মাতা মারইয়ামের উত্তম চরিত্রের বিবরণ রয়েছে। একইসাথে পাদ্রীদের দাবী খন্ডন করে বলা হয়েছে ঈশা মৃতকে জিবীত করাসহ যেসব ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল,তা ছিল আল্লাহর আদেশে ঘটিত। অর্থাৎ সেখানে ঈশার(আ কোনো ক্ষমতা ছিলনা ,সকল ক্ষমতা আল্লাহর। ফলে যীশু বা ঈশা(আ স্রষ্টা হতে পারেন না। এছাড়া তিনি যে ক্রুশ বিদ্ধ হননি ,তাকে আসমানে তুওলে নেওয়া হয়েছিল তাও জানানো হয় সূরা আল ইমরানে।
“সত্য আপনার প্রতিপালকের নিকট হতে সুতরাং আপনি সংশয়বাদীদের অন্তর্ভূক্ত হবেন না। আপনার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ আপনার সাথে এ বিষয়ে বিতর্ক করে,তাদেরকে বলুন-এস আমরা আহবান করি আমাদের পুত্রগণকে এবং তোমাদের পুত্রগণকে,আমাদের নারীগণকে এবং তোমাদের নারীগণকে,আমাদের নিজগিকে এবং তোমাদের নিজদিগকে,অত:পর আমরা বিনীত নিবেদন করি-মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক। নিশ্চয়ই এটি সত্য বৃত্তান্ত। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই,নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা প্রতাপশালী,প্রজ্ঞাময়। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ ফাসাদকারীদের সম্বন্ধে সম্যক অবগত।”-(আল কুরআন,৩: ৬০-৬৩)
নাজরানের খ্রিষ্টান প্রতিনিধরা উপযুক্ত জবাব পেয়েও ইসলাম গ্রহণ করল না,বরং নিজেদের ধর্মের ওপর অটল থাকল। কিন্তু তারা যেমন মনোবল নিয়ে এসেছিল ,তা ঠিক সেভাবে অটুট ছিলনা। আল্লাহর রসূলের(সা সামনে এসে এবং কুরআন থেকে বাণী শুনে তাদের ভেতরে চরম তোলপাড় চলছিল। এরপর নিজ ধর্মের প্রতি অনড় অবস্থান দেখে রসূল(সা তাদেরকে আহবান করলেন-উপরোক্ত আয়াত অনুযায়ী। এটা ছিল একটি উম্মুক্ত চ্যালেঞ্জ গোটা খ্রিষ্টান জাতির প্রতি। মুসলিম শরীফের হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী ,এরপর রসূল(সা তার কণ্যা ফাতিমা,জামাতা আলী(রা,পৌত্র হাসান ও হোসায়েন(রা তাদেরকে ডেকে একত্রিত করলেন মোবাহালার জন্যে এবং বললেন, হে আল্লাহ এরা আমার পরিবার পরিজন। তাদেরকে নিয়ে তিনি(সা বাড়ি থেকে বের হলেন এবং পরিবার পরিজনকে বললেন,আমি দোয়া করা শুরু করলে তোমরা আমিন বলতে থাকবে।
তারপর তিনি নাজরানের খ্রিষ্টান প্রতিনিধিদেরকে আহবান করে বললেন তোমরাও তোমাদের সন্তান সন্ততি,পরিবার পরিজনকে নিয়ে এস এবং বল-আমাদের মধ্যে যে দল মিথাবাদী তাদের ওপর আল্লাহর লানত !
এ বলিষ্ঠ চ্যালেঞ্জের কারনে নাজরানের প্রতিনিধিরা ঘাবড়ে গেল। তারা বুঝতে পারল এটা করলে তারা নিজেরাসহ পরিবার পরিজন এবং বংশধারাও ধবংশ হয়ে যাবে।
“হুযাফা (রা বর্ণনা করেন যে, আকেব এবং ছাইয়েদ তাদের সঙ্গীসহ উপস্থিত হয়ে এমন ভাব দেখাল যে,তারা মুবাহালা করতে প্রস্তুত। অত:পর তাদের একজন অপরজনকে বলল-খবরদার ! এই ব্যক্তির সঙ্গে মুবাহালায় অবতীর্ণ হয়ো না। যদি তিনি নবী হয়ে থাকেন আর আমরা মুবাহালায় অবতীর্ণ হই তাহলে আমরা রেহায় পাব না এমনকি আমাদের বংশধররাও রেহাই পাবেনা। এরপর তারা দমে গেল এবং রসূল(সাএর নিকট এই আবেদন করল যে-আমরা আপনার অনুগত্য স্বীকার করলাম। সে মতে আপনি আমাদের ওপর যিযিয়া কর হিসেবে যা ধার্য করবেন,আমরা তা মেনে নিব। আপনি আমাদের জন্যে আপনার পক্ষ থেকে পূর্ণ বিশ্বস্ত একজন লোককে পাঠাবেন,এটা আমাদের দাবী। রসূল(সা বললেন-নিশ্চয়ই পূর্ণ বিশ্বস্ত লোককেই মনোনিত করব। এরপর সাহাবীরা আল্লাহর রসূলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন,কাকে মনোনিত করা হয় তার জন্যে। রসূল(সা হযরত আবু ওবায়দাকে(রা মনোনিত করলেন। তিনি যখন যাত্রা করবেন তখন তিঁনি(সা ঘোষনা করলেন-আবু ওবায়দা আমার উম্মতের মধ্যে বিশ্বস্ততায় বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী।-(বুখারী)
নাজরানের খ্রিষ্টানদের জন্যে যিযিয়া নির্ধারিত হল বাৎসরিক ২০ হাজার জোড়া কাপড়,৩৩টি লৌহ বর্ম,৩৩টি উট,৩৪টি ঘোড়া-(তাফসীর রুহুল মায়ানী,বুখারী),এবং ৮০হাজার দিরহাম নগদ অর্থ(ফুতহুলবারী,বুখারী)। রসূল(সা তাদেরকে একটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পত্র লিখে দিলেন। -(বুখারী,তাবাকাত ইবনে সাদ)
বিষয়: বিবিধ
১৪২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন