ফিরতি পথে
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০২:২৬:০৯ দুপুর
আমি সিডনীতে চার সপ্তাহের স্থলে পাঁচ সপ্তাহ থাকতে চেয়েছিলাম। শেষের দিনগুলো একটু একঘেয়ে লাগল। তবে একেবারে খারাপ লাগেনি বা আমি লাগতে দেয়নি। তাছাড়া নাতির সাথে একটা ভাল বোঝাপড়া তৈরী হওয়াতে বিকেলের সময়টা বেশ উপভোগ করতাম। ভালবাসা নামক বিষয়টি সকল প্রাণীর ক্ষেত্রেই ঘটে। সকল প্রাণী ভালবাসা বুঝতে পারে,সচেতনভাবে না বুঝলেও তার প্রবৃত্তির অংশ হওয়াতে এটি বুঝতে পারে।
আজ এ অংশটি যখন লিখছি তখন আমার ভাগনী সিডনী থেকে ফোন করে জানালো অর্ভিককে যখন ডে-কেয়ার থেকে নিয়ে বাড়ির গেটে আসল তখন গড়নে ও পোষাকে অনেকটা আমার মতই এক লোককে দেখে প্রচন্ড চিৎকার করে নানা নানা করতে থাকল এবং সে লোকটির দিকে দ্রুত ধাবমান হল। আমার ভাগনি সেদিকে তাকাতেই সে উক্ত লোকটিকে নির্দেশ করে নানা নানা করতে থাকল। ভদ্রলোকটি চলে গেছে কিন্তু তার পথধরে তাকে খানিকদূর নিয়ে যেতে হয়েছে। ভালবাসা সত্যিই কঠিন জিনিস।
আমি বাচ্চাদের মন বুঝি আর এটাই অনেক সময় সুখকর এবং একইসাথে কিছুটা বিব্রতকর অথবা বেদনাবিধূর পরিবেশের সৃষ্টি করে। তার প্রতি আমার ভালবাসা প্রবল।
২০১৩ সালের জানুয়ারীর ১৩ তারিখ সকালে মিতুল আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল। আজ আবার রবীবার,তার খেলা আছে। সকলে গেল মাঠে। আমি সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্সের কাউন্টারে গিয়ে জানতে পারলাম আমি মাত্র ২০কেজী ওজন নিতে পারব। মাথায় আমার আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমি আমার ভাগনীকে ফোন দিলাম,কারণ অতিরিক্ত ওজন বাদ দিয়ে সেটা কোথায় রেখে যাব তার ঠিক নেই। সে বলল কোনো চিন্তা নেই,তুই ওখানে থাক,আমি ব্যবস্থা করছি। খানিকপর মিতুল জানালো এখানে তার বন্ধুর মানি এক্সচেঞ্জ এর ব্যবসায় রয়েছে,একই ফ্লোরে একটু দূরে তার অফিস।
আসলে ভুল হয়েছে টিকেটটা পরিবর্তনের সময়। স্বাবাবিকভাবে বিশ কেজী নেওয়া যায় ইকোনমী ক্লাশের জন্যে কিন্তু ওদেরকে অনুরোধ করলে আরও বাড়িয়ে দেয়। এই অনুরোধটা টিকেট পরিবর্তনের সময় করা হয়নি ফলে বিশ কেজী বহাল রয়েছে। আমি তাদেরকে বললাম আসার সমতয় আমি ৩৫কেজী পেয়েছিলাম এবং হাতে ৭কেজী। তারা বললেন,এখানে যেটা লিখিত আছে তার বাইরে আমরা কিছু করতে পারব না। আমি অতীতে এমন সমস্যায় পড়েছি তাই একে একে পদ্ধতি অবলম্বন করলাম এবং ম্যানেজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম ,কারণ আমার উপায় নেই। অতিরিক্ত প্রতি কেজীর জন্যে ত্রিশ ডলার দিতে হবে। এটা দেওয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনোটাই নেই। কারণ আমার কাছে প্রায় ৪৫কেজী। প্রচুর পারফিউমের বোতল রয়েছে। প্রায় দশ কেজী চকলেট। আমি অনেকক্ষন কথা বলার পর বিশ কেজীর স্থলে পচিশ কেজী পেলাম। ভাবলাম বরফ গলছে। এবার আবারও অক্টোপাশের মত ধরলাম। খানিকপর ত্রিশ কেজী পেলাম। কিন্তু তিনি বললেন,‘এর বেশী আর এক কেজীও দিব না,আর সেটা এক ব্যাগে নেওয়া যাবে না’,বলেই তিনি উঠে চলে গেলেন।
এবার আমি দুটি ব্যাগে ত্রিশ কেজী ঢুকালাম সে-দুটি পার করে দিলাম। হাতের ব্যাগটি নিলাম বড় এবং সেখানে মাত্র ছয় কেজী ঢুকালাম এবং স্টিকার মেরে তিনি বৈধ করে দিলেন এবং আমি আমার বসার বেঞ্চের নীচে রাখা আরেক ব্যাগ থেকে আরও পাচ কেজী এই ব্যাগে ঢুকালাম। তারপরও যা থাকে সেটি মানি এক্সচেঞ্জে রেখে আসলাম। এবার এগার কেজী ওজন সমৃদ্ধ ব্যাগটি এমনভাবে উঠাতে হবে যাতে মনে হয় এটি একেবারে হালকা এবং ওজন মাত্র সাত কেজী।
কিন্তু এ জিনিস আমি প্রথম ধাক্কায় তুলতে পারলাম না। কারণ এটি একটি মাউন্টেন ব্যাগ,যা সিডনী থেকে কিনেছি। এর দাম ছিল চার’শ বিশ ডলার আর আমি কিনেছি ৪০ ডলারে। জিনিসটা আমার তেমন একটা দরকার ছিল না কিন্তু বিশাল মূল্যহ্রাস দেখে বাঙালী হিসেবে সহ্য করতে পারিনি। এটার নিজস্ব ওজন প্রায় পাচ কেজী। সব মিলিয়ে যা দাড়ায় তা হল এই জিনিস নিয়ে ৭ কেজীর মহড়া অসম্ভব। স্যুট পরে এমন একখান জিনিস নিয়ে অবলীলায় হেটে চলা কষ্টসাধ্য। বহুদূর পর্যন্ত ট্রলির সাহায্য পেলেও একটি সীমানা থেকে আমাকে এটা কাধের ওপর তুলতে হল। লক্ষ্য রাখছিলাম কষ্টে মুখ বিকৃত যাতে না হয়,কারণ এরা ওজন চ্যালেঞ্জ করে।
আমার সাথে থাকা এক ভারতীয় ভদ্রলোক তিনটি পাগলা বোতল নিয়ে চলেছেন। সেগুলো রেখে দেওয়া হল এবং তিনি যেভাবে বিরক্তি প্রকাশ করলেন তাতে মনে হচ্ছিল লোকটার একটি কিডনী খুলে নেওয়া হয়েছে। বোধহয় ওগুলো বেশ দাম দিয়ে কেনা। দু-তিনটি বড় ডাস্টবিনের ভেতর নিরাপত্তা কর্মীরা পানির বোতল,মদ,পারফিউমের বোতল এমনভাবে ফেলে দিচ্ছিল যা দেখে মায়া হতে পারে। দামী দামী তরল পদার্থগুলো তারা কতটা নির্দয়ভাবে ফেলে দিচ্ছিল তা দেখে রাগও লাগছিল। আমি কষ্টে কাহিল এবং ভেতরে ঘেমে উঠেছি। প্লেনের ভেতরে ওঠার সময় ক্রুরা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল কিন্তু মুখে হাসি নিয়ে কষ্ট চেপে রেখে ঢুকে পড়লাম এবং সত্যিই সকাল থেকে কিছুই না খেয়ে ব্যাগের কষ্টে কাহিল হয়ে পড়েছি। পকেট থেকে এনার্জী বের করে খেতে থাকলাম। এই এনার্জীর নাম হল চকলেট,এটি একটি টাইট বার,এর ভেতর ক্যারামেল আছে। বাজারে এই চকলেটটির তেমন মূল্যহ্রাস দেখা যায়না। এ জিনিস অমৃত।
উড়লাম। আকাশের যে স্থানে এসে আমার বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হল সেখানে এসে পাইলট ঘোষনা করলেন অনিবার্য কারণ বশত এখন বাথরুমে যাওয়া যাবেনা। আমি বুঝে গেলাম কোনো ঝামেলা হয়েছে। প্লেন স্বাভাবিকের চাইতে আরও একটু উঁচুতে উঠে গেল। হালকা ঝাকা লাগতে শুরু করেছে। বুঝলাম টর্নেডো চলছে নীচে। এরকম টর্নেডোতে বেশ কিছু প্লেন ধবংশ হয়ে গেছে। এমনকি কিছুদিন আগে একটির কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের ওপর দিয়ে চলার সময় এমনটা হল।
এসময় আমার মৃত্যুকে কাছে মনে হচ্ছিল এবং আমি আল্লাহর কাছে আমার জীবনের সকল পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। আমি সারা বিশ্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম এবং তাকে চরম নির্মমতায় পরিত্যাগ করলাম যদিও খুব একটা মায়া তার প্রতি আমি তৈরী হতে দেইনি। যদিও আমার তেমন প্রস্তুতি নেই তারপরও আল্লাহর অসিম ক্ষমার ওপর নির্ভর করে আমি মৃত্যুর জন্যে তৈরী হতে থাকলাম। এ প্রস্তুতি ভয়াবহ। তখন মৃত্যু ব্যাপারটি এতটাই বাস্তব মনে হচ্ছিল যেটা ইতিপূর্বে কখনই মনে হয়নি। টয়লেটের প্রয়োজনীয়তার কথা আমি ভুলে গেলাম। কল্পনায় মৃত্যুর ওপারের বিষয়গুলো একে একে চলে আসতে থাকল। মনে হচ্ছিল পেছনে ফেরার রাস্তা নেই। আর কতটা নির্মম এবং বাস্তব এই বিষয়টি ! আমার মাথা নষ্ট হবার জোগাড় হল। কোনো হিসাব মেলাতে পারলাম না। এক নতুন অভিজ্ঞতার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলাম কিন্তু সে প্রস্তুতিটা কি তা বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মনে পড়ছিল আমি সর্বদা আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসেবে মরতে চেয়েছি,কিন্তু আমি কি আমার কাজের মাধ্যমে তা প্রমান করেছি ! আল্লাহ যেন আমাকে ক্ষমা করেন এবং কখনই শাস্তি প্রদান না করেন। আমি মৃত্যুর পূর্বে আয়াতুল কুরসী পড়ার মত সময় চেয়েছি আল্লাহর কাছে,কারণ এই আয়াতে মহান আল্লাহর পরাক্রমশালীতা,তার এককত্ব,তার অহংকার দারুনভাবে ফুটে উঠেছে। মূত্যুর পূর্বে সেটাই ঘোষনা করতে চাই। হয়ত এই ছোট্ট অছিলায় আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিবেন। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন,যাকে খুশী তাকে ক্ষমা করেন,কেউ তাকে প্রশ্ন করার কোনো রকম অধিকার,ক্ষমতা রাখে না। সকল বিষয়ে তিঁনি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী,তিনি মহান,প্রজ্ঞাময়,মহা পরাক্রমশালী।
বেশ কিছুক্ষন পরে বুঝলাম বিপদ কেটে গেছে। ঘোষিত হল কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা অবতরণ করতে যাচ্ছি। তখন মনে হল মৃত্যু যতটা বাস্তব,ততটাই উপেক্ষিত। আবারও চকলেট বের করে খেতে থাকলাম,যেন মরার কোনো কথাই ছিলনা। মানুষ এমনই । ঘরে ফিরে মানত করা নফল নামাজগুলো আদায় করতে হবে।
অস্ট্রেলিয়া ভাল লেগেছে তার প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্যে। মানুষেরা পরিচ্ছন্ন এবং তারা পরিবেশের যতœ নেয়। তারা খুবই বন্ধুবৎসল,অমায়িক। এটি হল এক দিক। আরেকদিকে আছে ভোগ প্রবণতা,নিজেকে নিয়ে ব্যবস্ততা,অতিমাত্রায় স্বাধীনচেতা। এগুলি আবার তাদেরকে খুবই ছোট পরিসরে বন্দী করে রেখেছে যদিও পৃথিবী উম্মুক্ত। আত্মকেন্দ্রীকতা মানুষকে মানুষিকভাবে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে। একমুখী হতে শেখায়। অন্যের জন্যে ছোট খাট ত্যাগ স্বীকার করা কঠিন নয় তবে যখন অন্যের উপকারে নিজের জীবন,সম্পদ,সম্মান ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে তখন আত্মকেন্দ্রীক মানুষ সেখানে উপস্থিত থাকতে সক্ষম নয়। যখন পুরো সমাজ-রাষ্ট্র প্রবল এবং সার্বিক সমর্থন দেয় তখন এজাতীয় সমাজে অনেক সমস্যা চোখে পড়েনা। কিন্তু রাষ্ট্রের ভারসাম্যহীনতা এসকল মানুষকে খুব দ্রুত চরম অপদার্থে পরিণত করতে পারে। যারা চরম প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের আদর্শ ঠিক রাখতে সমর্থ্য হন,তারা সুযোগ্য। তবে এদেরকে আমি কোনোভাবে অযোগ্য বলতে পারিনা। চরম অর্থনৈতিক,সামাজিক ভারসাম্যহীনতায় পড়লে এরা কি আচরণ করত সেটা নিয়ে গবেষণার ইচ্ছা আপাতত নেই। তবে অস্ট্রেলিয়ার মানুষগুলোকে ভাল লেগেছে। খোলা চোখে যা দেখেছি তা ভাল। সমালোচনা না করে বরং নিজের চরকায় তেল মারি,এটাই ভাল।
বিষয়: বিবিধ
১৬৮৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন