চলুন রেপটাইল পার্কে(আমার তোলা ছবি আছে)

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৬ আগস্ট, ২০১৩, ০১:৩৪:৩৮ দুপুর



কয়েকদিন পর এক রবিবারে আমরা রেপটাইল পার্কের দিকে রওনা হলাম।সিডনীর রাস্তাগুলো সত্যিই সুন্দর বিশেষ করে মূল শহরের বাইরের রাস্তাগুলো। শুধু রাস্তার সৌন্দর্য দেখার জন্যে আমি গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়তাম না। ঢাকাতে আমি সাধারনত গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়েই থাকি,কারণ বাইরের ধুলো ধুসরিত এবং দুষিত পরিবেশ আর মারাত্মক ট্রাফিক জ্যাম কল্পনা করলেও বিরক্ত লাগে। এখানকার ট্রাফিক সিস্টেম সাংঘাতিক ভাল এবং গাড়ী চানানোয় সকলে খুব সহনীয়। অপরের অধিকারের প্রতি খেয়াল রাখে সর্বদা। রাস্তায় চলার সময় হর্ণ শোনা যায়না । এখানে হর্ণ বাজানো মানে বিশেষ কিছু ঘটা। কোনো চালককে তার ভুলের কারনে কেউ হর্ণ বাজিয়ে তাকে সতর্ক করে। আর সেই হর্ণটি তাকে চরম লজ্জায় ফেলে দেয়। রাস্তায় চলার সময় হর্ণ খাওয়া অপমানজনক। আমাদের দেশে রাস্তায় চলার সময় যদি কোনো চালক তার হেড লাইট জ্বালিয়ে দেয়,এর অর্থ হল-আমি আগে যাব এবং আমার যাওয়া জরুরী। কিন্তু এখানে এভাবে হেড লাইট জ্বালানোর অর্থ হল, আমি থামছি,আপনি আমার আগে যান। এ সাং®কৃতি প্রশংসার দাবী রাখে। কখনও কখনও দেখেছি রাস্তায় মানুষ দেখেই গাড়ী থেমে গেছে এবং হাসিমুখে হাতের ইশারায় তাকে রাস্তা পার হতে বলছে। অবশ্য জনসংখ্যা অধিক হলে এবং প্রচুর অসচেতন জনতা থাকলে এ সাং®কৃতি রক্ষা করা কষ্টকর হত।

আমরা যখন কেবল হাইওয়েতে উঠেছি তখন এক অঘটন ঘটল। তবে সেটা আমার নাতির ক্ষেত্রে। সে একটা পারফিউমের বোতল নিয়ে খেলছিল। পারফিউম স্প্রে করে আনন্দ উপভোগ করছিল কিন্তু যখন সে হাত দিয়ে চোখ ড়গড়াতে লাগল তখন চোখের মধ্যে সেটা চলে যাওয়াতে কাঁদতে আরম্ভ করল ,যতবার চোখ ডলাডলি করল ততবার আরও বেশী পরিমানে উভয় চোখে পারফিউম লেগে উচ্চস্বরে কান্না আরম্ভ করল। আমরা রাস্তার একটা পাশে ইমার্জেন্সী পার্ক করে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু চোখ জ্বলার ক্রিয়া অনেকক্ষন থাকার কারনে তাকে নিয়ে মুক্ত বাতাসে দাড়াতে হল এবং পানির ঝাপটা দিয়ে ঠিক করা হল। আমি বুঝলাম বাচ্চাদের হাতে যা তা দিয়ে দেওয়া উচিৎ নয়। শিশুদের সবসময় হ্যা বললে সমস্যা আছে। সামনের ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে আমরা ফ্রেশ হলাম,আইসক্রিম খেলাম। আইসক্রিমের মধ্যে কোক দিয়ে খাওয়া যায় এটা জানলাম। খারাপ লাগল না। সম্ভবত পিপাসার্ত থাকার কারনে বেশী ভাল লেগেছিল। সারা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে ম্যাকডোনাল্ডস রয়েছে প্রচুর। এদের খাবার তুলনামূলক সস্তা এবং মানসম্মত। লেবাননের বেশ কিছু বিখ্যাত খাবারের দোকান আছে এখানে। একটা লেবানিজ বার্গারের দোকান আছে নাম কিলা। এরা বিভিন্ন ধরনের বার্গার তৈরী করে এবং একটা বার্গার এত বড় যে একবার আমরা ৮ জন মিলে ৩টি বার্গার খেয়েছিলাম। তবে পেট ভরে গিয়েছিল। এদের দোকানে সর্বদা একটা উম্মুক্ত প্রতিযোগীতা থাকে। কেউ যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে(এক মিনিট বা দুই মিনিটের মত হবে সময়টা)শেষ করতে পারে তাহলে তার জন্যে বার্গারটা ফ্রি। যারা খেতে পারে তাদের নাম উক্ত শাখায় স্থাপিত একটি বোর্ডে লিখে রাখা হয়। সাথে সাথে তিনি কত সময়ের মধ্যে শেষ করেছেন সেই রেকর্ডও লেখা থাকে। আমরা দেওয়ালে বেশ কয়েকজন খাদকের নাম ঝুলানো দেখলাম। এখানে আমার ভাগনী এবং ভাগনী জামাই যে বাঙ্গালী কমিউনিটির সাথে যুক্ত,সেটা প্রতিষ্ঠায় এদের ভূমিকা প্রশংসার দাবী রাখে। এদের প্রত্যেকে হারাম-হালাল মেনে চলে। তাই বাইরে কখনও মাংস জাতীয় কিছু খেলে সেটা হালাল কিনা তা নিশ্চিত হয়। এদের বন্ধুরা কখনও মদ,বিয়ার স্পর্শ করেনা এবং এদের পারিবারিক বন্ধন খুবই মজবুত। এরা টগবগে যুবক অথচ এদের নীতি আদর্শ খুবই চমৎকার।

আমরা চলতে শুরু করলাম। বোধহয় মোট দুঘন্টারও কম সময়ে আমরা রেপটাইল পার্কে আসলাম। গেটের সামনে দেখলাম এক মহিলা আর এক পুরুষ দুটো সাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে মানুষকে স্বাগত জানানোর জন্যে। ভাবলাম এ জিনিস দিয়ে স্বাগত জানালে তো গেটের ওপাশে কবরস্থান থাকা জরুরী। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হল এরা বেশ নরম মেজাজের সাপ। কিন্তু সাপ তো সাপ’ই ওর আবার নরম-গরম কি ? এ জিনিস দেখে ভয় পায়না বা শিউরে ওঠেনা বা ঘৃণা করেনা এমন লোক বিশ্বে বিরল। দেখলেই গা ঘিনঘিন করে। এদের সাথে এমন মাখামাখি দেখলে তার কাছে যেতেও আমার ঘৃণা করে। এরা অতি যতনে সেগুলো ধরে আছে। মানুষের কাছাকাছি এসে সাপের গায়ে নির্ভয়ে তারা হাত দিতে বলছে। কেউ সাপের গায়ে হাত দিচ্ছে আর কেউ সরে যাচ্ছে। কেউ কেউ তাদের সাথে দাড়িয়ে ছবি তুলছে।



প্রবেশ করলাম। দেখলাম, বিশাল একটা কুমির তৈরী করা হয়েছে। সেটি হা করে আছে,আমি আমার মাথা তার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে ক্ষনিকের জন্যে তার খাদ্য হলাম কিন্তু খাওয়ার গুন তার নেই তবে পয়সা কামানোর গুণ ষোল আনা। কুমিরের নীচের দিকে একফুটের মত গভীর পানি রয়েছে,সেখানে প্রচুর কয়েন দেখলাম। মানুষ ওখানে পয়সা দিয়ে মনের কামনা বাসনা প্রকাশ করে,কেউ কেউ ট্রেডিশন অনুসরন করে এমনিতেই মজা করে পয়সা ফেলে। ব্যাপারটা বাগের হাটের খানজাহান আলীর মাজারের মত। তবে এরা একই কাজ খুব নিরবে করছে এটাই পার্থক্য। টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

একটি উঁচু বারান্দা থেকে সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলাম। এখানে কিছু সাপ দেখলাম পাথরের আশপাশে। এরা পাথুরে পরিবেশের সাপ তাই ওভাবে রাখা হয়েছে। এরা বিষাক্ত সাপ। আমার এক বোন বলেছিল,সাপে কামড়ালে তার বিষে মরব কিনা জানিনা তবে সাপ কামড়াচ্ছে সেটা যদি দেখী তাহলে মারা যাব। আসলেই সাপ একটা ভয়ঙ্কর জিনিস।



এ পার্কটা তেমন বড় নয়। অস্ট্রেলিয়ার সকল সরিসৃপ এখানে জড় করা হয়েছে। এক স্থানে দেখলাম একটা বিশাল কচ্ছপ চরে বেড়াচ্ছে। এদের চিড়িয়াখানা আর আমাদের চিড়িয়াখানার ভেতর পার্থক্য আছে। এরা প্রচন্ড পরিচ্ছন্ন। কোথাও এরা আবর্জনার চিহ্ন রাখেনা। কোনো পশু,পাখিকে খাওয়ানোর পর অবশিষ্ট খাবার এরা সযতনে পরিষ্কার করে রাখে। এতে দর্শনার্থীদের ভাল লাগে। আর এরা শুধু পশূ-পাখিকে বন্দী করেই প্রদর্শন করেনা। কারণ এরা জানে এতে এখানে আগত লোকের সংখ্যা কমে যাবে। এবং ব্যাপারটা তখন টেলিভিশনে দেখা কোনো বিষয়ের মত লাগবে। তাই এরা সরসভাবে কিছু জিনিস উপস্থাপন করে থাকে। মূলত এটাই মানুষকে বেশী আনন্দ দেয়। আর বাচ্চারা এসব কারনেই এখানে বারবার আসতে চায়,যতবার বাচ্চারা আসবে সাথে তাদের পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের আসতে হবে। আর এতে এদের উপার্জন বেশ ভালই হবে। আমাদের চিড়িয়াখানায় নাকে রুমাল চেপে যারা যারা প্রবেশ করেছে তারা দ্বিতীয়বার কত বছর পরে প্রবেশ করেছে তা তারা নিজেরাও হয়ত জানেনা। অথচ সেখানে বহু রকমের পশু পাখি রয়েছে।



(হুগো বস্)

কচ্ছপের খাচায় একজন প্রবীণ রসালো লোক প্রবেশ করল। তিনি শুধু কচ্ছপকে খাওয়াচ্ছিলেন না বরং তার সাথে মজা করছিলেন। এই লোকটি একজন প্রাণী বিশেষজ্ঞ। প্রাণী সম্পর্কে তার বিশেষ জ্ঞান রয়েছে। লোকটা এখানকার প্রাণীদের সাথে বেশ দারুন সখ্য গড়ে তুলেছেন। তাকে দেখলে মনেই হবেনা তিনি পয়সার জন্যেই মূলত একাজ করছেন। মনে হবে তিনি তার স্বাভাবিক মমত্ববোধ থেকেই একাজটি অত্যন্ত আনন্দের সাথে করে যাচ্ছেন। আসলে এটাকেই আমি প্রকৃত প্রফেশন বলি। আমরা আমাদের প্রফেশনকে উপভোগ করিনা আর এ কারনে ফলাফলের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

কচ্ছপটার নাম হুগো এবং এর বয়স ৬২ বছর। কচ্ছপরা দীর্ঘজীবী হয়। এরা তিনশত বছরেরও অধিক সময় বেঁচে থাকতে পারে। এরা খাবার-পানি ছাড়াই দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে এবং প্রাকৃতিক বা কৃত্তিম বহু বিপর্যয়েও এটা টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে। কচ্ছপের খাচায় তিনি কখন প্রবেশ করবেন তা আমরা আগেই জেনেছিলাম এবং সকলে আড়াই ফুট উঁচু লোহার নেটের তৈরী রেলিংয়ের চারপাশে দাড়ালো । হুগোর সাথে তার নানা রকম রঙ্গ তামাশা এবং মানুষের সাথে বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথন সবাইকে আনন্দ উপভোগে বাধ্য করল। কচ্ছপের মুখের ভেতর দাত দেখতে পেলাম না। এদের দাত আছে কিনা জানিনা তবে শুনেছি কচ্ছপের কামড় মারাত্মক শক্তিশালী। সে গাজর এবং অন্যান্য সব্জী যেভাবে কামড় দিয়ে খাচ্ছিল তাতে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে তার চোয়ালে প্রচন্ড শক্তি রয়েছে। এটা এতটাই বড় কচ্ছপ যে অবলীলায় রেলিংয়ের ওপর পা তুলে দিচ্ছিল।





খানিক পরে সবাই একটি তিনফুট উচু তারে ঘেরা গ্যালারিতে আসল। পূর্বোক্ত লোক এবং আরেকজন আসলেন। মাইক্রোফোন কানে লাগিয়ে স্পিকারের সাহায্যে সকলের সাথে তিনি আন্তরিকভাবে এবং মজা করে কথা বলছিলেন। তারপর অনেকগুলো সাপের বাক্স থেকে একটি সাপ বের করলেন এটা সাদা পাইথন। একেবারে ধবধবে সাদা নয় ,তবে দেখতে অনেকটা কোবরার মত। এটা লম্বায় চার ফুটের মত হবে। তিনি এটাকে তার টি-শার্টের নীচ দিয়ে পেটের সাথে পেচিয়ে রেখে টি-শার্টটি প্যান্টে ইন করলেন। তার এ দৃশ্য দেখে আমার ভাগনী স্থির থাকতে পারল না। সে ভাবছিল এটা তাকেই পেচিয়ে রেখেছে। সত্যি বলতে কি আমারও খুব অস্বস্তি লাগছিল। সাপটা খুব ভদ্রভাবে নিরবে পেচিয়ে ছিল। এবার তিনি একে একে বহু সাপ দেখালেন। র‌্যাটেল স্নেক এবং কিং কোবরার সময় তিনি আরেক জনের সাহায্য নিলেন কারণ এগুলো খুবই ভয়ঙ্কর সাপ। তিনি সকল সাপের সম্পর্কে বয়ান করছিলেন এবং আমাদেরকে নানাভাবে উপদেশ দিচ্ছিলেন। এতটা চমৎকারভাবে তিনি সাপগুলোকে উপস্থাপন করছিলেন যে ভাল না লেগে উপাই নেই। একসময় তিনি যখন আমাদের সাথে কথা বলছেন তখন আরেকজন লোক একটি কালো রঙের বিষধর সাপ তার পায়ের কাছে ছেড়ে দিল। কিন্তু তিনি যখন অনুভব করলেন তার পায়ের ওপর দিয়ে সাপ চলে যাচ্ছে তখন মুখের ভাব এমনভাবে পরিবর্তন করলেন যে মানুষ না হেসে পারল না। এরপরই তিনি বললেন, আমি আসলে আপনাদেরকে দেখালাম -যত বিষধর সাপই হোক না কেন সে আপনার পাশদিয়ে চলে যাওয়ার সময় যদি অপনি তাকে বিরক্ত না করেন (বা সে বিরক্ত না হয়) বা চুপচাপ থাকেন তাহলে সে এভাবে আপনার ওপর দিয়ে চলে যাবে ,মোটেও ক্ষতি করবে না। আমি একবার একটা বিচের পাথরের ওপর বসে সামনে তাকিয়ে ছিলাম হঠাৎ মনে হল কিছু একটা পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল। সেটা ছিল একটা গিরগিটি। তবে আমি আর সেখানে বসে থাকতে পারলাম না। মনে হল কোনো বিষধর সাপও এখানে থাকতে পারে। হয়ত আল্লাহ আমাকে একটা গিরগিটি দিয়ে সতর্ক করেছেন।





লোকটা বিশাল একটা গিরগিটি জাতীয় প্রাণী ইগুয়ানা প্রদর্শন করল। সেটাকে শরীরের সাথে পেচিয়ে রাখল,নানান তাল করল, এতে সেটার নখের আঘাতে লোকটা রক্তাক্তও হল। এতে বুঝলাম এটি বিষধর নয়। আমার ভাগনী আমার পাশেই ছিল,সে বারবার বলতে লাগল কিন্তু লোকটা ওই সাপটা তো নামালো না। ওটা এখনও তার পেটে পেচিয়ে ছিল। এবার কুমির নিয়ে আসল এবং তার সাথে নানান খেলা করতে লাগল। এরপর বিশাল এক অজগর নিয়ে আসল। একজন সাহসী শিশুকে ডেকে নিয়ে তার শরীরে অজগর পেচিয়ে রাখল। আমার ভাগনী আবারও তার পেচিয়ে রাখার সাপের ব্যাপারে আপত্তি জানালো। মনে হয় আরও অনেকে মনে মনে এ ব্যাপারটি নিয়ে শিউরে ওঠা অনুভূতিতে ভুগছিল। তাই লোকটি এ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলা শুরু করল। তিনি বললেন, আমার মনে হয় আপনারা এটা নিয়ে চিন্তিত। আসলে সাপটা খুব আরামে আছে। এরা শিতল রক্তের প্রাণী,সে আমার শরীর থেকে উষ্ণতা পাচ্ছে এবং আমি যে আপনাদের সাথে কথা বলছি এতে শরীরে কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে এবং সে এটা উপভোগ করছে। হঠাৎ লোকটা বলল,আপনারা পেছনে ওই গাছের দিকে তাকান। সবাই তাকালো,আমরা দেখলাম আমাদের পেছনের একটা মরা গাছের ডালে একটা বিশাল গিরগিটি বসে আছে। কেউ কেউ চিৎকার করে উঠল। ওটা ছিল বার/তের ফুট ওপরে। তিনি বললেন,ভয় পাওয়ার কারণ নেই,ওরা আক্রমনাত্মক নয়। অবশ্য এদের কিছু প্রজাতি আছে যারা মারাত্মক আক্রমনাত্মক,এর একটি হল বিশাল কমোডো ড্রাগন। সরিসৃপকে বন্ধু ভেবে কাছে যাওয়ার দরকার নেই, সতর্কতার সাথে দূরত্ব বজার রাখতে হবে।

আমরা হাটাহাটি করলাম। এখানে কোয়ালা রয়েছে। এদেরকে দেখলে মায়া না লেগে উপায় নেই। দেখতে একেবারে সুবোধ বালকের মত। এখানকার কর্মীরা এদেরকে কোলে করে নিয়ে বেড়ায়। আর তারা এদেরকে সংরক্ষনের জন্যে আবেদন জানায়। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীকূল নিরাপদেই আছে।

এখানে বহু রকমের পাখি রয়েছে। এদের পাখির খাচার বৈশিষ্ট্য হল এটার ভেতরে ঢোকা যায়। ভেতরে দুটি গেট। যেসব খাচায় পাখি আছে সেসব খাচার ভেতরে ঢুকলে পেছনের গেটটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন একটি নেটের কাছে এসে একেবারে কাছ থেকে তাদেরকে দেখা যায়। ছোট বড় বহু বাদুড়ও রয়েছে। একস্থানে রেইন ফরেস্টের মত পরিবেশ তৈরী করে কেশওয়ারী রাখা হয়েছে। এরা দেখতে অতি চমৎকার,অনেকটা উটপাখির মত তবে অত বড় নয়। কিন্তু এরা প্রচন্ড আক্রমনাত্মক। এরা লাফ দিয়ে নিজেদের শক্ত পা দিয়ে আঘাত করে ধরাশায়ী করতে পারে। কারো কারো মৃত্যুও হয়েছে কেশওয়ারীর আক্রমনে। দেখতে শান্ত শিষ্ট মনে হলেও এরা তা নয়। তবে বনের মধ্যে এমন বিশাল এবং রঙিন পাখি দেখতে সত্যিই ভাল লাগে।

পাশে একটা বড় পুকুর আছে। পুকুরের চারিপাশে তারের বেড়া,তার পাশে হাটার রাস্তা। আমি সেখানে যাবার জন্যে যখন হাটছিলাম ,দেখলাম রাস্তায় অনেকগুলো গিরগিটি হাটাহাটি করছে। আমাকে দেখে তারা দৌড় দিয়ে রাস্তা খালি করে দিল তবে বেশী দূর গেলনা। পুকুরটাকে দেখে মনে হয়েছে এখানে কুমিররা গাদাগাদি করে রয়েছে। আমার কাছাকাছি কয়েকটা কুমির দেখলাম। একস্থানে দেখলাম অন্তত ত্রিশটা কুমির জটলা করে আছে। কেউ সাতার কাটছে,কেউ পাড়ে বসে আছে,কেউ মাথাটা পানির ওপর ভাসিয়ে রেখে স্থির হয়ে আছে। কুমির দেখতে আমার তেমন ভাল লাগেনা। এটা দেখলে ঘৃণা করে।



আমরা গেলাম একটি সুড়ঙ্গ পথে। এপথ চলে গেছে অনেকগুলো ঘরের ভেতর। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন সরিসৃপ মৃত অবস্থায় সংরক্ষন করে রাখা হয়েছে এবং অনেক সরিসৃপ জীবিত রাখা হয়েছে। বিভিন্ন আকৃতির কাচের পাত্রে তাদের পরিবেশ তৈরী করে রাখা হয়েছে। আমরা একেবারে কাছ থেকে তাদেরকে দেখলাম। বহু রকমের সাপ রয়েছে এখানে। এক স্থানে হাসের মত ঠোটওয়ালা প্লাটিপাস দেখলাম। এরা পানির নীচে ও ওপরে থাকতে পারে এবং মাছ খায়। হাসের মত দেখতে হলেও এটি ডিম না পেড়ে বাচ্চা প্রসব করে। দেখলাম এটি খুবই চঞ্চল প্রকৃতির। তড়বড় করতে করড়ে সাতার কেটে বড় উম্মুক্ত এ্যাকুইরিয়ামের একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে যাচ্ছে।

দুপুরের বিরতির পর গেলাম কুমিরের গ্যালারিতে। দেখলাম বিশাল একটা কুমির হা করে শুয়ে আছে। এটা ১৭ফুট লম্বা এবং বেশ মোটা। খানিক পর এটাকে নিয়ে খেলা হবে তাই মানুষ জমতে শুরু করেছে। আমরা গ্যালারির একপাশে স্থান করে নিলাম। এখানে তিনজন লোক প্রদর্শনীতে থাকবে কারণ যে কোনো সময় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। কুমিরকে খাবার দেওয়ার সময় পরিচালনাকারী লোকটি সকলের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল এখানে কে আসতে চায় ? বহু লোক হাত তুলল। কিন্তু তিনি বললেন না,আমি একজনকে খুঁজছি সে বাংলাদেশী। লোকটি আমার ভাগনী জামাই মিতুলকে পছন্দ করল। আসলে এর পেছনে ঘটনা হল, আমার নাতির মাথার ক্যাপটা কচ্ছপের খাচার ভেতর পড়ে গিয়েছিল। তখন সে এক লাফে খাচার ভেতর গিয়ে ক্যাপটি নিয়ে এসেছিল। এ দৃশ্যটা তখন কুমিরকে পরিচালনাকারী লোকটি দেখে তাকে ডেকে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিল এবং বলেছিল যে,তুমি খুব সাহসী এবং আজ তোমার জন্যে একটা চমক আছে। সেই চমকটাই হল এই।



একটা লাঠির মাথায় একটা মুরগী ঝুলিয়ে সেটা কুমিরের ঠিক দু-চোখের মাঝে ধরতে বলল। লাঠির একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে অবশ্যই থাকতে হয়,নইলে কুমির ঝুলন্ত মুরগী না ধরে প্রচন্ড আক্রমনাত্মভাবে ধারনকৃত ব্যক্তিকে খাবার বানিয়ে ফেলতে পারে। কুমির একেবারে চুপ করে থেকে হঠাৎই প্রচন্ড আক্রমন করে। আমার ভাগনী জামাই মিতুল লাঠিতে ঝুলানো মুরগী ধরল কুমিরের নির্ধারিত স্থানে। হঠাৎই কুমিরটা প্রচন্ড লাফ দিয়ে ওপর থেকে সেই মুরগীটাকে মুখে পুরে নিল। এবার কুমির পানিতে নেমে গেল। পানি থেকে ওঠার জন্যে একটি সুন্দর সবুজ কার্পেট আছে ঘাসের মত। এর ওপর দিয়ে কুমির পানি থেকে সহজে ওপরে উঠে আসে। জলাধারটি বক্রাকারে তৈরী করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এটি ছোট এবং দর্শক গ্যালারির পাশদিয়ে প্রবাহিত। কুমিরটি পানিতে সাতারকাটা অবস্থায় পানির অনেক ওপরে লাফিয়ে উঠে ঝুলন্ত মুরগী গ্রহণ করল। বিশাল দু-চোয়ালে যে শব্দ তৈরী হল তাতে মনে হচ্ছিল মানুষকে এভাবে ধরলে তার হাড় গোড় চুর্ণ বিচুর্ণ হয়ে যাবে। বাচ্চারা খুব আনন্দ উল্লাশ করতে থাকল। সত্যিই এখানে আসা সার্থক হয়েছে। এরা জানে কিভাবে নিরস চিড়িয়াখানাকে সরস বানানো যায়।



এখানে প্রচুর ক্যাঙ্গারু রয়েছে। এদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যাতে মানুষ এদের সাথে মজা করতে পারে। এদের কোনো ভয়ভীতি নেই। একেবারে হাবাগোবা টাইপের প্রাণী এটি। প্রায়ই বন থেকে এরা রাস্তা পারাপারের সময় গাড়িচাপায় মারা যায়। গাড়ি দেখে এরা নির্ভয়ে দাড়িয়ে পড়ে অথবা গাড়ি নীচে লাফ দেয় কারণ এরা এসবের সাথে কোনোভাবেই পরিচিত নয়।

কেউ যেখানে থেকেই হোক কিছু ঘাস লতাপাতা ছিড়ে কাছাকাছি ধরে রাখলে ক্যাঙ্গারু তা খাওয়ার জন্যে তার কোলে উঠে যেতে পারে। আমি এর ঘাড়ে হাত রেখে ছবি উঠিয়েছি তাতে তার মোটেও আপত্তি ছিলনা। এই প্রাণীটাকে খুব ভাল লেগেছে। এরা মোটেও বিরক্ত হয়না। একটু হাভাতে প্রকৃতির আছে,কেউ খাবার দিলে একবারও আপত্তি করেনা। মাটি থেকে কিছু ঘাস তুলে মানুষ এদের গলায় গলা মিলিয়ে ছবি তুলছিল। এদের চারিপাশে সর্বদা উল্লসিত বাচ্চাদেরকে দেখেছি। ফিরে আসার সময় দেখলাম কুমির বা এলিগেটরের বড় ছযিুক্ত একটি বিলবোর্ডে ক্যাপশন লেখা-‘সি ইউ লেটার এলিগেটর ! ’ ফান করে ইংরেজী চর্চিত হওয়া বিশ্বে বিদায়ের সময় এটা অনেকে বলে থাকে। কিন্তু এলিগেটরের মুখথেকে বাক্যটি প্রচারিত হতে দেখে হাসি লাগল।

বিষয়: বিবিধ

৩৯৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File