বন্ডাই বীচ ও জন বুড়ো
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৪ আগস্ট, ২০১৩, ১১:৩৪:৪৭ সকাল
একদিন সিটিতে একটা মিটিং ছিল সেটার পর দেখলাম হাতে অনেক সময়। সবে বাজে ১২টা। আকাশ মেঘলা এবং ঠান্ডা পড়ছে। খানিকপর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল। কোথায় যাওয়া যায় ভাবছিলাম। তারপর ট্রেনে উঠে বন্ডাই চলে গেলাম। আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে উঠলেই ওপরে রেলওয়ে স্টেশন। সিডনীতে ট্রেন কখনও মাটির নীচে কখনও মাটির ওপর দিয়ে চলেছে। শহরের ভেতরে বহুদূর জুড়ে ট্রেন লাইন মাটির নীচে। স্টেশনগুলো বিভিন্ন শপিং সেন্টারের সাথে যুক্ত,এছাড়া বিভিন্ন রাস্তার সাথেও যুক্ত। বন্ডাই থেকে বাসে উঠলাম সি-বীচে যাওয়ার জন্যে। আজ বীচ ফাঁকা থাকবে সন্দেহ নেই।
আধাঘন্টা বাসে চড়ে বীচে আসলাম। এখানে বাসগুলো একেবারে বীচের পাশেই নামায়। কিছুদূর পরপর বাসস্টপ,এর একটা অসুবিধাও আছে,আর সেটা হল বার বার বাস থামে। এ কারনে বাসে যাতায়াত যথেষ্ট সময় নষ্ট করে। রাস্তা পার হয়েই দেখলাম এক সুন্দর সবুজ মাঠ ক্রমেই ঢালু হয়ে নেমে গেছে। সাথে বড় বড় ঝাউগাছসহ অন্যান্য গাছ এবং ফুলের গাছও আছে কয়েকটা। এটি সিডনীর অন্যতম বিখ্যাত বীচ। পুরো বীচটি অর্ধ চন্দ্রাকার এবং কংক্রিটের একটি উচু পাড় রয়েছে। দৈর্ঘে এক কি:মি: বা তার চাইতে একটু বেশী হবে। সেখান থেকে সিড়ি নেমে গেছে বালুকাময় ভূমীতে। প্রথমেই বীচে না নেমে আমি ডানদিক ধরে হাটতে থাকলাম। এখানে একটি সাতার ক্লাব আছে। রাস্তা চলে গেছে এই ক্লাবের তিন তলা বরাবর। সেটার বারান্দায় খানিক দাড়ালাম। এখান থেকে সাগরের সৌন্দর্য অপূর্ব লাগে। যারা প্রকৃতির সান্নিধ্যে মনোরম পরিবেশে থাকতে চায় তাদের জন্যে ক্লাব-ভবনটি একটি আদর্শ স্থান।
ঠান্ডা বাতাশ বইছে এবং সাথে একেবারে ধীর গতির বৃষ্টি। এতে শরীর তেমন ভিজবে না। বীচে মানুষ দূরে থাক কুত্তাও নেই। আমি এই বারান্দা ধরে এগিয়ে গেলাম। এরপর একটি সিড়ি,যেটি স্টিল এবং কাঠের তৈরী। এটা অত্যন্ত সুন্দর করে তৈরী করা হয়েছে। আমি কয়েক ধাপ নেমে নীচে নামলাম। আর এখানে অবাক হলাম সাগরের কিনার ধরে যে পাথরস্তুপ রয়েছে তার ওপর দিয়ে তৈরী স্টিল-কাঠের তৈরী ব্রীজ দেখে। এটি ব্রীজ না সিড়ি তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কারণ এটা খানিক ওপরে যাচ্ছে আবার শৈল্পিকভাবে কিছুটা নীচে নামছে। সাগরের পাড়ের সাথে সঙ্গতি রেখে এটি তৈরী করা হয়েছে। এদিকে কয়েকজন লোককে দেখলাম হাটছে। দূর থেকে এটা দেখতে খুব ভাল লাগে। এটি ছয়/সাত ফুট চওড়া হবে এবং দুপাশে রেলিং আছে। আমি হাটতে থাকলাম। এটা তৈরীতে এরা প্রচুর কাঠ ব্যবহার করেছে। নীচের দিকে স্টিল এবং ওপরে চলার পথে কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। বেশ খানিকটা দূরে এসে আমি সাগরের দিকে তাকালাম। আজ স্যুট পড়ে এসেছি। এ পরিবেশে এ পোষাক একেবারে বেমানান। কিন্তু পূর্ব পরিকল্পনা না থাকার দরুন এমনটা হয়েছে।
আমি আরও হাটতে থাকলাম। দু-একজনকে এটার ওপর দৌড়াতে দেখলাম হাফপ্যান্ট পরে। এখানে লোকজন যখন খুশি তখন দৌড়ায়। এদের সময়সূচী গৎবাধা নয়। সকলে কর্মব্যস্ত,তাই তারা যখন সময় পায় তখন দৌড়ায়। সকাল বা বিকেলের সময়সূচীতে এদের কিছু এসে যায় না। বহুলোক কুকুর নিয়ে দৌড়ায়। যান্ত্রিক জীবনে কুকুর ছাড়া উত্তম বন্ধু পাওয়া মুশকিল। অতিরিক্ত ভালবাসায় কেউ কেউ কুকুর বিড়ালের নামে সম্পত্তি উইল করে যায়। কারণ অনেকের তিনকূলে কেউ নেই অথবা থেকেও নেই। থেকেও নেই এর পরিমান বেশী। যেমন আমাদের প্রতিবেশী জন বুড়ো। বয়সের ভারে চামড়া একেবারে কুচকে গেছে,কানে কম শুনে। গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে দেওয়ালে জোরে ধাক্কা দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। পুলিশ এসে তার মোবাইল ফোন চেক করে কারও নাম্বার সেভ করা দেখতে না পেয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল এবং খানিকপর যখন তার মোবাইলে তার স্ত্রী ফোন করল তখন তাকে ঘটনা জানানো হল। এরপর থেকে কর্তৃপক্ষ তার ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করেছে।
নিঃসঙ্গ মানুষের অবস্থা কি, তা মি: জনকে দেখে বোঝা যায়। তার স্ত্রী সারাদিন বাইরে কাজে থাকে। সে প্রত্যেক সকালে আমাদের বাসার দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দেয় এবং দরজা খুলতে বলে। ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু করলেও লাভ নেই। জনের সাথে এক কোমর গল্প না করে কোনো উপায় নেই। প্রসঙ্গ প্রতিদিন প্রায় একই রকম থাকে। আর একটু বেশী মনোযোগী হলে তার অতীত ইতিহাস শোনায়। তার প্রথম প্রেম হয়েছিল ১৭বছর বয়সে এবং আরও যত ঘটনা তার মনে আছে সব বলে। লোকাটার অস্থায়ী স্মৃতিতে বিভ্রাট ঘটেছে তাই সে যা বলে তা সহজে ভুলে যায়। কয়েক বছর আগে তার অবস্থা এরকম ছিলনা। হারিয়ে যেতে পারে বলে তার ঘরে থাকা বাধ্যতামূলক করেছে তার স্ত্রী। তবে বাড়ির আশপাশটা সে বেশ চিনতে পারে। আমার নাতীর চাচা রাতুলের সাথে তার দহরম-মহরম সম্পর্ক। মাঝে মাঝে সকালে সে আমাকে পরবর্তী বুধবারে কফি খাওয়ার দাওয়াত করে। তার সাথে আমার কফি খাওয়া হয়নি,কারণ তার বুধবার কখনও আসে না।
যাইহোক আমি সাগরের সৌন্দর্য্য অবলোকন করে মুগ্ধ। আবার হাটতে থাকলাম,তবে বীচের দিকে। একধাপ নীচে নেমে হেটে চললাম বীচের পাশ ধরে। শুরুতে বড় বড় কিছু পাথর খন্ড রয়েছে তারপর বালুকারাশি। একা একা হাটতে থাকলাম। বীচের দুপাশে দুটি সুইমিং পুল রয়েছে। সমুদ্রে জোয়ার আসলে পানি সুইমিং পুলের সমান্তরালে চলে আসে এবং সে পানিতেই মূলত পুল ভর্তি হয়। পুলের পাশে সরু তার দিয়ে ঘেরা,ফলে ঢেউয়ে ছিটকে ওপাশে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রকান্ড ঢেউ পুলের ওপর আছড়ে পড়লে সেটা বেশ দর্শনীয় হয়ে ওঠে।
আমি ওপরে চলে আসলাম। বীচের মাঝের অংশটি বেশ দর্শনীয় করে তৈরী করা হয়েছে। এখানে ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে যেখান থেকে দেখা যায় কেউ বিপদগ্রস্ত হল কিনা। বীচে দক্ষ্য সাতারুদের সমন্বয়ে একটি লাইফ গার্ড রয়েছে। তারা মোটর বাইক নিয়েও কখনও কখনও টহল দেয়। জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জামই এখানে রয়েছে,যদিও দূর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়না। আমি আসলাম এখানকার সুভ্যেনীরের দোকানে। এখানে জিনিসপত্রের ক্রেতা দেখলাম না,কারণ আজ এখানে আমি ছাড়া আর মাত্র কয়েকজন এসেছে,তাও দেখার জন্যে।
ফেরার পথে পাশেই দেখলাম তিনটি ট্যাটু শপ। শপের সামনে একটু দাড়ালাম। কারণ এ জিনিস দেখতে ইচ্ছে করে। খুব দারুনভাবে একটি কলম সদৃশ যন্ত্রের সাহায্যে মানুষের শরীরে আল্পনা আঁকা হয়। এরা খুব নিখুঁত শিল্পী। মানুষের শরীরের যে কোনো অংশে অবলীলায় এরা ট্যাটু আকে। এখানে ট্যাটু ফ্যশন বেশ চলে। অনেকেই শরীরে এগুলো আঁকে। এটা স্থায়ী হয় কারণ ত্ত্বকের ওপর খোদাই করে এগুলো অঙ্কণ করা হয়। যারা ট্যাটু করে তাদের নিজেদের শরীরে প্রচুর ট্যাটু আঁকা দেখলাম। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকে এটা করে তা প্রদর্শন করে। অনেকে সারা দেহে এমন অঙ্কন করে,এদের দেখে আমার কেমন জানি ঘৃণা করে। অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি কিছু লোক শরীরে বিভিন্ন ধরনের ট্যাটু একে,নাক,কান,ভ্রু,চোয়াল,জিহবা,ঠোট,থুতনি,কপাল,গলা ইত্যাদী অংশে বিভিন্ন রকমের রিং অথবা নানান ধরনের মেটাল ফুড়ে নিজেদেরকে অতি স্মার্ট (অথবা উদ্ভট)হিসেবে প্রদর্শন করে থাকে। কেউ কেউ চুল সজারুর কাটার মত স্টাইল করে তাতে নানান রং লাগায় এবং ট্যাটু সমৃদ্ধ দেহের নানান স্থানে মেটাল ফুড়ে প্রদর্শন করে। এতে মানুষ স্বাভাবিকভাবে তাদের দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকায় এতেই তাদের আনন্দ। এক যুবককে দেখলাম সারা গায়ে ট্যাটু এবং শুধু প্যান্ট পরে রাস্তা ধরে হাটছে। এমন সময় বিপরীত দিক থেকে আগত দুটি মেয়ে তার গায়ে হাত দিয়ে ট্যাটুটা উপলব্দী করে হিহি করে হেসে উঠল। প্রথম ধাক্কায় ছেলেটা একটু চমকে উঠলেও সেও উচ্চস্বরে হেসে উঠল। আমি মনে মনে বললাম-বেহায়ার দল। চলে আসলাম।
বিষয়: বিবিধ
২৭০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন