আমার শৈশব রোজা-ঈদ

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৬ আগস্ট, ২০১৩, ১০:০৫:২৩ সকাল



আমি আপনাদেরকে বুঝাতে পারব না যে, আমার শৈশবের ঈদ কতটুকু আনন্দময় ছিল। সেখানে আনন্দের উৎস্য ছিল অন্তরের ভেতরের স্পন্দন। কেনাকাটায় ঝোক ছিলনা তা নয় কিন্তু সে আনন্দ কেনাকাটাসংক্রান্ত ছিলনা। ওটা ছিল নিখাদ ঈদ আনন্দ। একটি দিনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া আনন্দ।

রমজান আসলে সর্বত্রই এক ধরনের উৎস্যবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হত। আমার মনে পড়ে, অধিকাংশ সময়ই আমি রমজানের চাঁদ দেখেছি। আমরা সন্ধ্যার কিছু পূর্বে বাড়ির সামনের তিন রাস্তার মোড়ে সকবেত হতাম। ছেলে বুড়ো সকলেই দীগন্ত রেখায় চোখ রেখে চাঁদ খোঁজার চেষ্টা করত। আমি চাঁদ দেখতে না পেলেও জনতার দৃষ্টি আকর্ষনের জন্যে উচ্চস্বরে বলে উঠতাম ওই যে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তখন সকলে আমার কাছে আসত সেটার সঠিক অবস্থান জানার জন্যে। যেহেতু প্রথম চাঁদের অস্তিত্ব থাকত খুবই সরু তাই অনেকে তা ভাল করে দেখতে পেতনা। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধোকা দিতাম। আঙ্গুলী নির্দেম করে বলতাম-ওই তো দেখা যাচ্ছে। ওই গাছের ঠিক ডান পাশে তাকাও....আরেকটু ডানে...বাশ গাছের ঠিক ওপরের অংশে...দেখতে পাচ্ছ ? তারা বলত না, দেখতে পাচ্ছিনা। আমি তখন বলতাম,দেখতে না পেলে তো কিছু করার নেই। অনেক সময় আরো কয়েকজনকে পূর্বেই আমার পক্ষে ফিট করতাম,তারা আমাকে সমর্থন করত। কিন্তু আমাদের কথা সচরাচর কেউ বিশ্বাস করত না। আমরা অন্য একাধিক মোড়ে গিয়ে একই কাজ করতাম। এরই মধ্যে কেউ কেউ চাঁদ দেখে ফেলত,তখন আবার তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, চাঁদ ঠিক কোন দিকে ?

কয়েকবার আমি প্রথমেই চাঁদ দেখেছি,অবশ্য বিষয়টি বিতর্কিত। কারন আরও দু-একজন বলত তারাই সেটা পূর্বে দেখেছে,এমনকি সালামও দিয়েছে। নতুন চাঁদ দেখলে তাকে নাকি সালাম দিতে হয়। সেই ছোটবেলায়ই বুঝতে পারতাম এসব জড় বস্তুকে তোয়াজ করার কোনো মানে নেই এবং এটি পবিত্র বা অপবিত্র হতে পারেনা। তাচ্ছিল্যের স্বরে জানতে চাইতাম- চাঁদ তোর সালামের উত্তর দিয়েছে ?

চাঁদ সত্যি সত্যি দেখতে পাওয়ার পর আমরা সমস্বরে চিল্লাতাম। এমনকি চিল্লানিতে মানুষের কান ঝালাপালা করে,বকা না শোনা পর্যন্ত ক্ষ্যান্ত হতাম না। আর কেউ বকা দিলে ঝুঝতাম এখন তাকে বেশী বিরক্ত করতে হবে। তবে কিছু লোককে অবশ্যই এড়িয়ে চলতাম। সকলের ক্ষেত্রে একই নীতি ভাল না ,তা বুঝতাম। কিছু লোক মোটেও রসিক ছিলনা। নইলে এলাকার মেম্বার অমনটা ভাবে কিভাবে? এক ঈদের পূর্ব রাতে দলবল নিয়ে নদীর ধারের রাস্তার দিকে যাচ্ছিলাম,ওদিককার ছেলেদের সাথে হই-হুল্লোড় করার জন্যে। অন্ধকার রাতে চলার সময় সামনে পড়ল মেম্বার। সে আমাকে চিনত না। আমার মাসুদ নামে এক বন্ধুকে সে জিজ্ঞেস করল এত রাতে কোথায় যাস ? আমি উত্তর দিলাম , চুরী করতে যাই। লোকটা আমার দিকে একবার তাকালো,তারপর কোনো কথা না বলে সোজাসুজি মাসুদদের বাড়িতে চলে গেল। মাসুদের পিতাকে বলল-আপনি জানেন,আপনার ছেলে কি করছে ? তিনি বললেন,না। মেম্বার বলল-সে তো চুরী করতে গেল আমার সামনে দিয়ে...আমি তাকে ফেরত আনতে পারলাম না। পরদিন সকালে এই ঘটনাটা শোনার পর হাসতে হাসতে একে অন্যের ওপর গড়িয়ে পড়লাম। ভাবলাম এতবড় আহাম্মক আর হতেই পারেনা।

রমজানের শুরুতে আনন্দের ছোট কারন ছিল পাল্লা দিয়ে রোজা রাখা,মজাদার ইফতার,সেহরী খাওয়া এবং ঈদের দিন গণনা করা। সেসময় আমরা একে অপরের সাথে প্রতিযোগীতামূলকভাবে রোজা রাখতাম। তবে বরবরই আমি আগে তাদের সংখ্যা জেনে নিয়ে বলতাম; আমি আরও বেশী সংখ্যক রোজা রেখেছি। বিকেলের দিকে অন্যকে শুনিয়ে বলতাম,আজ রোজায় খুব বেশী কষ্ট হচ্ছে(সেদিন আসলে রোজা রাখতাম না,ওটা একটা আওয়াজ মাত্র)। এলাকার বড়রা ছোটদেরকে বাহবা দিত রোজা রাখলে। যারা রোজা রাখত তাদের কদর বেড়ে যেত। তাই বাচ্চারা রোজা রাখতে চাইত। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক পিতা-মাতা সন্তানের প্রতি দরদের কারনে রোজা রাখতে নিষেধ করত অথবা দু-একটা রাখতে দিত। আর আমার আব্বা বলত, সকাল থেকে ১২টা পর্যন্ত তোমার হাফ রোজা,আবার ১২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আরেক হাফ। তুমি দুদিনে এক রোজা রাখতে পার ,তবে প্রতিদিন না। প্রথম দিকে সেহরী খেতে নিষেধ করত। কিন্তু সেহরীর সময় এলাকায় কেমন জানি উৎসব উৎসব ভাব থাকত। চারিদিকে লোকজন জেগে যেত। মসজিদে সাইরেন বাজানো হত,ইয়াতিমখানার শিশু-কিশোররা হামদ-নাত পড়তে পড়তে রাস্তা প্রদক্ষিন করত,একাধিক মসজিদ থেকে ঈমামগন বা মুয়াজ্জিনগন ডাকাডাকি করত,বা কুরআন তিলাওয়াত করত। প্রতিবেশীরাও ডাকত। এরপর কারো পক্ষে ঘুমানো তেমন সম্ভব হতনা। আর সেসময়টি ছিল আমার কাছে কাঙ্খিত। আমি উঠে দেখতাম আব্বা বারান্দায় আছে কিনা। সেখানে থাকলে আমি ঘরের দরজার আড়ালে ওৎ পেতে থাকতাম। যখনি তিনি ঘরের ভেতরে যেতেন ,এক দৌড়ে উঠানের পাশে থাকা রান্নাঘরে ঢুকে পড়তাম। মা জানত আমি আসব,তাই আমার সেহরী প্রস্তুত থাকত।

সেহরীতে থাকত দুধ,কলা,আম,মিস্টি ইত্যাদী। প্রথমে নিয়মানুযায়ী তরকারী দিয়ে ভাত খাওয়ার পর এসব খাওয়া হত। এ রীতি অবশ্য এখনও মোটামুটি টিকে আছে কিন্তু জৌলুস হারিয়েছে। তবে বেশীরভাগ সময়ই দুপুরের আগে ইফতার করে ফেলতাম। তাতে আমার পিতা খুশীই হত। আর অনেক সময় পুরো রোজা রাখতাম। সেসব দিনে ইফতারী খেতে খুব ভাল লাগত। আমাদের বাড়িতে ইফতারী আয়োজন হত বিশাল। রমজানের পূর্বে বড় রকমের বাজার করা হত। পিতা ভোজনরসিক হওয়াতে নানান খাবারের আয়োজন থাকত। পুরো রোজা রাখার দিনে মনে হত ,আজ সবকিছু খেয়ে তছনছ করে ফেলব। একবার রোজার দিনে আমার গৃহ শিক্ষক একটা কাচা আম নিয়ে আসল এবং বলল,রোজা ভাংলে এটা তোমাকে দিব। অনেক লোভ হওয়া সত্তেও আমি রোজা ভাঙিনি। তবে তিনি সম্ভবত ইফতারীর পর সেটা আমাকে দিয়েছিলেন। আমি যখন মনে করতাম,এটা করতে হবে,তখন অনেক কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আমি তা করতাম। আমার মনে পড়ে,আমি নদীতে সাতার কাটতাম এবং শিতলতা অনুভব করার জন্যে নদীতে থাকা নৌকায় চড়ে পানিতে পা ডুবিয়ে রাখতাম।

নদীতে দিনের অর্ধাংশ কাটানোর চেষ্টা করতাম। তবে খেয়াল রাখতাম কানে যেন পানি না ঢোকে,কারন তখন জানতাম এটা রোজা ভঙ্গের কারন। কানে কাঠি ঢোকানো, বেশী গোসল করা,শরীরের কোথাও কেটে রক্ত বের হওয়া,থুথু গিলে ফেলাও তখন রোজা ভঙ্গের কারন ছিল। আমরা সতর্ক থাকতাম। তবে দুপুরে আমার সাংঘাতিক কষ্ট হত। আশপাশে খাবার থাকা সত্ত্বেও খেতে পারছি না,এটা এই হাভাতে লোকটার জন্যে যে কতটা কষ্টকর ছিল তা বোঝানো যাবেনা। দুপুরে ক্ষুধার কারনে তেমন ঘুমও আসত না। তবে খেলাধুলা করে সময় পার করতাম। কিন্তু তাতেও সময় পার হতে চাইত না। বিকেলে কুরআন তিলাওয়াত করতাম। শয়তানি যুগে আমি কয়েকবার কুরআন খতম করেছি,যেটা পরবর্তীতে হয়নি। আমি মাত্র কয়েকদিনে কুরআন পড়া শিখেছিলাম। আমার স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যধিক প্রখর। এখনও মনে পড়ছে, স্কুলে একটা গানের অনুষ্ঠানে এক শিল্পীর গান ভাল লাগাতে তার সেই গান হুবহু মুখস্ত করেছিলাম,যদিও তিনি একবারই গেয়েছিলেন। কোনো দিকে মনোনিবেশ করলে তা করতে পারতাম। সহপাঠীরা না পারলে ভাবতাম এটা পারাটাই তো স্বভাবিক, না পারাটাই তো অস্বাভাবিক।

ইফতারির মুহুর্তটা যে চরম খুশীর,আনন্দের তা তখন ভাল বুঝতাম। বড় মসজিদ থেকে বিশেষ পটকা ফোটানো হত এখনও হয়। এরপর আমি রাক্ষসের মত খাওয়া শুরু করতাম। আমার পিতা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত এবং হাসত। আমি একসাথে অনেকগুলো আইটেম মুখে পুরে চিবাতে থাকতাম,আমার পিতা আরও কিছু আমার প্লেটে তুলে দিত। এরপর সারাদিন জমিয়ে রাখা বিভিন্ন রকমের খাবার খেতাম। বিভিন্ন টক জাতীয় ফল থাকত প্রধান। এরপর আমরা দলবেধে মসজিদে তারাবিহ পড়তে যেতাম। আমরা ছোট ছিলাম বলে আমাদেরকে বড়রা পেছনে পাঠিয়ে দিত। আর আমরা তাদের ওপর প্রতিশোধ তুলতাম।

আমি মাঝে মাঝে মুখের মধ্যে টক-ঝাল চকলেট পুরেও নামাজ পড়তাম,তাতে দীর্ঘ তারাবিহ পড়তে সুবিধা হত। হাফেজ সাহেবরা রকেট গতিতে কি পড়তেন তা বুঝতাম না কিন্তু তারা অনেক এক্সপার্ট সেটা বুঝতম। তাদের দক্ষতা প্রকাশিত হত উচ্চ গতির কারনে। আমি মাখানো তেতুলের ছোট ছোট অংশও মুখে পুরে নামাজ পড়তাম,ভাল লাগত। তবে কেউ যাতে না চাইতে পারে তাই নিরবে খেতাম। আর খানিক পরই ধুম-ধাম আওয়াজ শুরু হয়ে যেত। আমরা কয়েকজন একে অপরের পিঠে এবং আশপাশের অন্য বাচ্চাদের পিঠে চড়,ঘুষি লাগিয়ে দিতাম,সাথে থাকত উচ্চ আওয়াজের মুখবন্ধ হাসি,একে জনের একেক আওয়াজ। কিন্তু দু-রাকাত শেষে সালাম ফেরানোর পর কিছু বেরসিক চাচা শ্রেণীর মানুষ প্রচন্ড বকাবকি করত। আমাদের সামনের কাতারে দাড়ানোর অধিকার নেই কেন তা বুঝতাম না। জামাত দাড়ালে আবারও ধুমধাম শুরু হত। আমি কিছু নিয়ম পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছিলাম। যেমন অন্যদের পূর্বেই দাড়িয়ে পড়া এবং কনুইটা পাশের জনের পিঠ বরাবর সেট করে রাখা। এতে সে সোজা হয়ে উঠে দাড়ানোর সময় কনুই দ্বারা বেশ আহত হত। আর আমি হেসে উঠতাম। তারপর সে হয়ত আমার পিঠের ওপর ধুমধাম লাগিয়ে দিত আর আমি পাশের জনের ওপর,,,,, । পরবর্তী দুরাকাত পর বয়োজেষ্ঠরা আমাদের কাওকে কাওকে কড়া ধমক দিত। তখন আমরা আরও পেছনে দেখিয়ে বলতাম, এরা এখনও মানুষ হলনা ! সব শয়তানের দল।

অনেক সময় কাওকে কাওকে মসজিদ থেকে বের করে দেওয়া হত কিন্তু জামাত শুরু হয়ে গেলে তারা আবারও আসত। আমাকে সাধারণত ধরতে পারত না,কারণ আমি ছিলাম কড়া কৌশুলী। বড়রা কখনও কখনও ছোটদেরকে তাদের কাতারের মাঝে মাঝে দাড় করাত। তখন আর এ সমস্যা হতনা। কিন্তু আমরা খানিক পর সেখান থেকে বের হয়ে পেছনের কাতারে জড় হতাম। একবার পরিকল্পনা করলাম সেজদা থেকে যখন অন্যরা বসবে ঠিক তখনই তার পায়ের খাজে বাঁশ বা কাঠের খন্ড রাখব ,তবে এতে সে মারাত্মক ব্যাথা পেতে পারে ভেবে এ পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। আসলে সেসময় নামাজের মর্যাদা বুঝতাম না। আর আমরা বয়সেও ছোট ছিলাম। আমাদের বড়রা আমাদেরকে ধমক ছাড়া তেমন কোনো শিক্ষা দিতনা। আর আমাদের পিতা-মাতারা আমাদের এসব আচরন তেমন জানত না। তারা ভাবত আমরা খুবই নম্র-ভদ্র ইত্যাদী। আমার বাড়িতে অবশ্য নিয়মিত অভিযোগ আসত।

শেষের রোজাগুলোতে মারাত্মক আনন্দ লাগত। কারণ ঈদ সন্নিকটে। লায়লাতুল কদরে কখনই শয়তানী করতাম না। এই রাতে আমি একশত রাকাত নামাজ আদায় করতাম এবং সারারাত মসজিদে থেকে জিকির আসগার করতাম,আমার সাথে অন্যরাও থাকত। তারা না আসতে চাইলে জোর করে ধরে আনতাম। সেসময় মসজিদে এ রাতে ওয়াজ মাহফিল হত। ওয়াজ মাহফিল আমার খুব ভাল লাগত। আলেমদের মুখ থেকে কথা শুনতে খুব ভাল লাগত এবং সে অনুযায়ী চলতামও কিন্তু কয়েক দিন পর ভুলে যেতাম। লায়লাতুল কদরে মসজিদে মিলাদ মাহফিল হত এবং মিস্টি,খিচুড়ী-মাংসও খাওয়ানো হত। এসব আমার খুব ভাল লাগত। সেসময় আজকের চাইতে বেশী পরিমানে বিদয়াত চালু ছিল সমাজে।

আমার মা আমাকে ইসলামিক বিভিন্ন তথ্য দিত,তবে তার সবটাই সঠিক ছিলনা ,যা অনেক পরে জেনেছি। আসলে তখন মানুষ ট্রেডিশন অনুসরণ করত। প্রচুর জাল,জয়িফ হাদীস আলোচিত হত এবং তার ওপর আমল করা হত। কি কি করলে রাতে স্বপ্নযোগে আল্লাহর রসূল(সঅঃ)এর সাক্ষাত লাভ হয় তা শুনতাম। আমি কথিত সেসব আমল প্রচুর করেছি। আমি স্বপ্নযোগে রসূল(সাঃ)এর সাক্ষাত লাভে খুবই আগ্রহী ছিলাম। আমি শুনতাম তাকে(সাঃ) স্বপ্নে দেখলে নাকি পাপ মাফ হয়ে যায়(এটি সত্য নয়,তবে তাকে স্বপ্নে দেখা ভাগ্যের ব্যাপার বটে),তাই আমার পাপ মাফ হবার জন্যে এই সাক্ষাতে আমি চরম আকাঙ্খিত থাকতাম। আমি শয়তান হলেও ঈমানদার ছিলাম।

একটি ঘটনা শোনাচ্ছি:- আমি রোজা রাখতে অলসতা করতাম। আমার কষ্ট হত তাই দুপুরে রোজা ভঙ্গ করতাম। এমনই এক রোজায় আমি আমার মেঝো বোনের বাড়িতে ছিলাম। সেখানেও রোজা না রেখে মহা শয়তানী করে বেড়াতাম পুরো এলাকায়। গোটা এলাকা আমাকে এক নামে চিনত-শয়তান ! তো এক রাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম, আমি রসূল(সাঃ)এর সাথে বসে সেহরী খাচ্ছি। আমার বামে হযরত আবু বকর(রাঃ) এবং তারপর হযরত ওমর(রাঃ)। আমি তাদের গল্প ইতিপূর্বে অনেক শুনেছি। রসূল(সাঃ)এর পুরো চেহারা এখন আমার মনে নেই কিন্তু তাকে বয়ষ্ক মনে হল এবং দাড়ির অধিকাংশই পাকা। তিনি আমাকে বেশ যতœ করে খাওয়াচ্ছিলেন। আমি ওমর(রাঃ)কে দেখে তেমন একটা পছন্দ করলাম না, কারন আমার কল্পনায় তার যে চিত্র ছিল সেটার সাথে মিল পেলাম না। তার শরীর অনেক বড় মনে হল এবং গায়ের রং পুরো সাদা নয় মনে হল। আবু বরক(রাঃ) এর কথা মনে নেই। এরপর আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি দেখলাম তখন সত্যই সেহরীর সময়। আমার মধ্যে প্রবল আবেগের সৃষ্টি হল। আমি আমার বোনের কাছে গেলাম। তাকে এসব কিছু না বলে শুধু বললাম-আমি রোজা রাখব। সে বলল-কিরে হঠাৎ রোজা রাখবি ? ভাল হয়ে গেলি ? কিছু বললাম না। তারপর সে আমাকে সেহরী করালো। পরবর্তী অংশ খুবই করুন। পাঠক ইচ্ছা করলে আমাকে জুতা মারতে পারে। দুপুর ১২টার সময় রোজা ভঙ্গ করলাম। এমন স্বপ্ন আরও দেখেছি এবং তা আরও চিত্তাকর্ষক...কোনো একদিন জানাব সেসব। (আল্লাহ যেন আমার সকল পাপ ক্ষমা করে দেন !)

ঈদের কথা বলছিলাম। আমার সবথেকে বেশী আনন্দ হত ঈদের পূর্ব রাতে। কারণ ঈদ সমাগত। ঈদের দিবাগত রাত অনেক আনন্দের হত কিন্তু বেদনাও থাকত কারণ সেটা চলে যাচ্ছে। মাত্র একটি দিন কিন্তু সেই দিনটিকে ঘিরে মনের মধ্যে যে অনুভূতির সৃষ্টি হত,তা আজকের দিনে কোনো কিশোর-তরুনের হয় কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

ইদের পূর্ব রাতে মেহেদী বাটা হত। কখনও তা লাল হত কখনও হতনা কিন্তু মেহেদী বাটাও একটা উৎসব। আমরা চারিদিকে হৈ-হুল্লোড় করতাম। এলাকা মাতাতাম। নানান রকমের পটকা বাজি ফোটাতাম। অনেকের ঘরের কোণায় চকলেট বোম ফিট করে আসতাম মশার কয়েলের সাথে ,যাতে নির্দিষ্ট সময় পর ফাটে। নানান রকমের খেলা করতাম। আমার ফুফাত ভাই বোনরা থাকলে আনন্দ অনেকগুন বেড়ে যেত। আত্মীয়স্বজনকে আমি খুব পছন্দ করতাম। রাত একটু বাড়লে আমরা হাতে মেহেদী দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। রাতে মেহেদী স্থানচ্যুত হয়েও এবড়ো থেবড়ো রং ধারন করত,সেটাতেও আনন্দ ছিল। সকালে দলবেধে নদীর ঘাটে যেতাম। সেখানে ভিড় লেগে থাকত। একে অন্যের সাবান মাখতাম। সেদিন সকলে ভাল বা দামী সাবনটা নিয়ে আসত। আমরা অনেকবার অনেকের সাবান মাখতাম। এরপর নতুন পাঞ্জাবী,পাজামা পরতাম । আব্বা বিশেষ এক আতর ব্যবহার করত। কোনো রাস্তা দিয়ে গেলে মানুষ বুঝতে পারত একটু আগে কে এখান দিয়ে গেছে। আব্বা সেই বিশেষ আতর তুলোয় মাখিয়ে কানে গুঁজে দিত। এরপর আমরা আব্বা-মাকে সালাম করতাম,সালামী নিতাম। ছোটরা বড়দের সালাম করত এবং সালামী নিত। আমরা সেমাই-সুজী ইত্যাদী খেয়ে দলবেধে ঈদগাহের দিকে রওনা হতাম। প্রচুর মানুষ আসত ঈদগাহে। ওহ ! আর ভাবতে পারছি না, সেসময় বুকের মধ্যে আনন্দ নামক এক বস্তু দাপাদাপি লাফালাফি করত। জীবনেও ঈদের দিন ঘুমাতাম না। এদিনটি যেন তারাতাড়ি শেষ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতাম। যদিও চেষ্টা করলেও আটকানো যাবেনা কিন্তু মনে হত সব আনন্দ দিনের আলোর মধ্যেই করে ফেলি। চারিদিকে থাকত উৎসবমুখর পরিবেশ।

একে অপরের সাথে কোলাকুলি করতাম। এর মধ্যেও আমি এক শয়তানী আবিষ্কার করে ফেললাম। কেউ কোলাকুলি করলে আমরা দুজনে তাদের উভয়ের পেছন দিক থেকে দুহাতে ধাক্কা দিতাম যাতে দুটো বুক এক হয়ে দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়। একারনে আমার সামনে অনেকে কোলাকুলি করতে চাইত না(বাচ্চাদেরকে দুহাতে শূণ্যে তুলে বুকের ডানে-বামে লাগিয়ে কোলুকুলি করতাম)। আর আমার সাথে কেউ কোলাকুলি করলে,তার কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করতাম। এমনকি নতুন মানুষ হলেও এমন করতাম। বিষয়টি বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করত। এমনকি চরম নিরস মানুষকেও আমি হাস্যরসে বাধ্য করতাম। তারা হেসে বলত, তুই সত্যিই একটা শয়তান !!! হেহেহে ,,,,,

বিষয়: বিবিধ

২৩০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File