আমার জীবন এমনই চলছে

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০২ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:০০:১১ দুপুর



আমার গ্রামটার সৌন্দর্য্য বর্ণনা ভালভাবে করা কখনই সম্ভব হয়নি। তবে বড় বড় কবিগণ তাদের কবিতায় গ্রাম সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়ে মোহিত করেছেন,বিখ্যাত চিত্রকরগণ তাদের ক্যানভাসে গ্রাম সম্পর্কে মনের মাধুরী মেশানো রঙে যে কল্পচিত্র একেছেন সেটাই আমার গ্রাম।

আমি এক সাধারন কৃষক। বংশ পরম্পরায় আমরা কৃষিকাজ করি। এটা ছাড়া অন্য কিছু তেমন বুঝিনা। আমার পিতা ছিলেন খুব ভাল মানের কৃষক। তিনি তরকারীর চাষে বেশ পটু ছিলেন। তবে জমিদারের দাদন নেওয়াতে লাভ করতে পারতেন না। জমিদারের দয়াতেই তার জীবন পার হয়েছে। এভাবেই চলত যদি না আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত করতাম। এখন আর জমিদারী নেই। জমিদারে পুত্র আমাদের ক্ষেতের আইল দিয়ে হেটে গেলেও ফসলে হাত দেওয়ার সাহস এখন তার নেই। তিনি অবশ্য খারাপ লোক নন। নিজেও বড় কৃষক। গঞ্জে তার বড় মুদী দোকানও আছে। জমিদার বাড়ী থাকলেও মানুষিকতায় তিনি জমিদার নন।

বহু দূরের এক গঞ্জে মাদ্রাসা থাকাতে অতদূরে গিয়ে পড়তে আমার ভাল লাগত না। কিছুদূর পড়ে বেশ ভাল ফলই লাভ করেছি। কিন্তু আমার মন ছিল চাষে। আমার পিতাও সেটা চাচ্ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর বিপদগ্রস্ত হয়েছিলাম। তখন অল্প বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে আমার তরিতরকারী সরাসরি গঞ্জে নিয়ে বেচতাম। এতে অন্যদের তুলনায় ভাল লাভ পাচ্ছিলাম। আমার দেখাদেখী আরও অনেকে এপথে এসেছে। আমি তাদেরকে সাহায্য করেছি।

আমার একখন্ড জমি আছে,তাতে ধান-গম চাষ হয়। কিন্তু আমার তরকারীর খেত অসাধারন। আমি এবং আমার স্ত্রী সদা যত্ন নেই। আমরা ফসল ফলানোর সময় একে অপরকে সাহায্য করি। যেদিন ফসল ঘরে ওঠে সেদিন আমরা গরিবদেরকে তার একটা ভাগ দেই। আমরা কখনই বিষাক্ত কেমিকেল ব্যবহার করিনা। ওগুলোর নামও জানা নেই কিন্তু শুনেছি সেগুলো শরীরের জন্যে ক্ষতিকর। আমরা আমাদের জন্যে যা পছন্দ করি তা অন্যদের জন্যেও পছন্দ করি। আমরা গোপনেও ফাকি দেইনা। নায্য ওজন করার পর আরও কিছু বেশী দিয়ে দেই,এটাই আমাদের গ্রামের সাংষ্কৃতি।

আমার স্ত্রী খুবই সহজ সরল এবং সৎ। তিনি সর্বদা আমার পাশে থেকে সহায়তা করেন। আমি তার সকল অধিকার আদায় করার চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি আমার ব্যাপারে আমার চাইতেও বেশী খেয়াল রাখেন। তার এদিকটা আমার ভাল লাগে কিন্তু আমি তা প্রকাশ করিনা। সবকিছু প্রকাশ করার প্রয়োজনও নেই। আমি জানি তার কি পছন্দ,আমি সেটা করি। তার দাবী দাওয়া খুব সাধারন মানের,ফলে সেটা আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করেনা। আমি নিজে থেকে তাকে কিছু কিনে দিতে চাইলে সে সবসময় না করে,তাই আমি গোপনে তাকে লক্ষ্য করি এবং বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি তার প্রয়োজন কি হতে পারে। তারপর সেটা কিনে এনে তাকে উপহার দিলে সে সাংঘাতিক খুশী হয়।তার খুশীতেই আমার খুশী। সেও একই কাজ করে। ফসলের একটা অংশ তার অধীনে থাকে। সে সেটা বিক্রী করে আমার জন্যে লুঙ্গী,ফতুয়া,গামছা কিনে দেয়। বিয়ের পর আমি আমার নিজের জন্যে মাত্র কয়েকবার এগুলো কিনেছি। তার পছন্দই আমার পছন্দ।

আমরা এখানে সুখী। আমাদের প্রতিবেশীরাও অনেক ভাল। আমরা কিছু রান্না করলে একে অপরের জন্যে তা একটু হলেও পাঠানোর চেষ্টা করি। আর তরকারীর বাটিটি ফেরত আনার সময় প্রায়ই শুনি,ওটা পরে দিয়ে আসব,বাটি নিশ্চই হারিয়ে যাবেনা। আসলে এ কথার অর্থ ভিন্ন। তারা খালি বাটি ফেরত দিতে লজ্জাবোধ করে। কয়েকদিনের মধ্যে যখন তারা একটু স্বুসাদূ তরকারী রান্না করবে,তখন ওটা এই বাটিতে ভরে দিয়ে যাবে।

আমাদের কাছে নগদ টাকা না থাকলে আমরা তরকারী,মাছ ইত্যাদী বিনিময় করি। আর মসলাপাতি ধার করি প্রতিনিয়ত। পরে আবার তা শোধ দেওয়া হয়। বিকেলে পাড়া বেড়ানোর অভ্যাস আছে। তবে আমার ভাল লাগে বটের ছায়ায় বসে রাখালদের সাথে কথা বলতে। তারা খুব ভাল। ওরা সাথে করে ছিপও নিয়ে আসে। ছোট্ট নদীর ধারে বসে অনেকসময় মাছও ধরে। এখানে প্রচুর মাছ রয়েছে। তবে আমরা জেলেদের কাছথেকে মাছ কিনতে আগ্রহী। নতুন তরকারী আর নদীর তাজা মাছ খুবই স্বুস্বাদু। এলাকায় কোনো হাসপাতাল নেই কিন্তু ছোটখাটো ব্যাধী ছাড়া তেমন কিছু সমস্যা হয়না। ছলেমান ডাক্তারের হোমিও প্যাথিকেই আমাদের বেশ চলে যায়। তাজা জিনিস খাব,খেতে খামারে কাজ করব,পরের উপকার করব এর মদ্যে আবার রোগ ব্যাধী কিসের ? আব্বা বলত, মানুষ মানুষের ক্ষতি করলে,প্রতারনা করলে,আল্লাহর নাম কাম না করলে আসমানী বালা আসে। রোগব্যাধীও তাই।

আমি আমার ক্ষেতের চারিপাশ দিয়ে নারকেল গাছ লাগিয়েছিলাম। আমার পিতাও এটা করেছিলেন। সেটার ফল পাচ্ছি। এটা আমরা বিত্রীও করি। তবে গ্রামের গরিবরা বিনা পয়সার এটা নিয়ে যায়। অনেকে নারকেলের জন্যে মিথ্যাও বলে। আমি অবশ্য বলে দিয়েছি,মিথ্যা না বলে বরং সত্য বলে নারকেলটা নিয়ে যাও,না করব না কখনও। এখানে পিঠা উৎসবও হয়। নতুন ধান ওঠার পরই এটা হয়। তখন একে অপরকে দাওয়াত করি,অবশ্য বিনা দাওয়াতেও এখানে যে কেউ যার তার বাড়িতে গিয়ে খেতে পারে। তবে দুএকজন আছে যারা দাওয়াত পছন্দ করে। যেমন হারু শেখ। সে কোনো বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আওয়াজ করলেই বুঝে যায় তাকে এখন কিছু খাওয়াতে হবে। লোকটা বড্ড রসিক আর দিলখোলা। গ্রামের প্রায় প্রত্যেকেরই সে কোনো না কোনো সময়ে কাজে এসেছে। তার গায়ের শক্তি থেকে উপকৃত হয়নি এমন লোক কমই আছে।

অবসরে আমার ভাললাগে নৌকা চড়তে। আমার স্ত্রী এটা পছন্দ করে। অনেক বিকেলে আমরা নৌকা নিয়ে বের হই। আমি দুষ্টমি করে তাকে কয়েকবার নৌকা থেকে ফেলে দিয়েছি এবং নিজেও লাফ দিয়েছি। আমরা দুজনেই ভাল সাতারু। না হয়ে উপায় আছে ! এই নদীর ধারেই তো শৈশব কৈশোর কাটল। এটি অগভীর নদী। একানে এত বর্ষা হয়না যাতে বণ্যা হতে পারে। আর আমরা নদীর জমি দখলও করিনা যে সেটি সরু হয়ে মরে যাবে। ফলে অতিরিক্ত পানি দুকূল ছাপিয়ে প্রবাহিত হয় কিন্তু বন্যা হয়না।

আমি এই চমৎকার গ্রামকে ভালবাসি। এখানেই আমার ভাললাগে। শহরে দুবার গিয়েছিলাম কিন্তু থাকতে পারিনি। প্রথমবার গিয়েছিলাম আর সেটার গল্প স্ত্রীকে করতেই সে যাবার বায়না ধরল। এত করে বলি সেটা মোটেও থাকার মত জায়গা নয়,তোমার ভাল লাগবে না। কিন্তু তার সেই এক কথা একবার যেতে চাই। নিয়ে গেলাম ৭ দিনের জন্যে। কিন্তু দ্বিতীয় দিনেই বলতে শুরু করল,বাড়ি কবে যাব ? দ্যাখ কান্ড !! তার মতে এই চিড়িয়াখানায় লোক থাকে কিভাবে ? এখানে তো নিঃশ্বাসও নেওয়া যায়না। ৭দিনের ভ্রমন দুদিনেই মিটে গেল। আমার খালারা অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন সেখানে,তাই তারা পারে থাকতে। আমরা বাপু গাঁয়ের মানুষ,এসব ভাল লাগেনা। গ্রামে বাচতে চাই,গ্রামেই মরতে চাই।

বি:দ্র: আরোহী রায়হান প্রিয়ন্তী নামক একজন ব্লগার ওপরের ছবিটা ব্যবহার করেছিলেন তার লেখায়।ছবিটা ভাল লেগেছিল। সেটা দেখে গল্পটা লাইভ লিখলাম Happy। আর লেখাটা উক্ত ব্লগারকে উৎসর্গ করলাম।

বিষয়: বিবিধ

১৮১২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File