আজকের দিনটি একান্তই আমার
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ৩০ জুলাই, ২০১৩, ১০:৩৫:৪৭ সকাল
এক মেঘলা দিনে ভাবছিলাম কি করব। হঠাৎ মনে হল যেভাবে হাওয়া বইছে তাতে সমুদ্রে ঢেউ উঠবে। আমি তখন ট্রেনে চেপে চলে গেলাম সার্কুলার কীর ফেরী ঘাটে। সেখান থেকে একটা ফেরীতে উঠলাম সেটা যাচ্ছিল ওয়াটসন বে।
প্রথম স্টপেজ গার্ডেন আইল্যান্ড। এখানে সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ থাকে। এদিক দিয়ে আরও কয়েকবার আমি ফেরীতে যাতায়াত করেছি আর ভেবেছি গার্ডেন আইল্যোন্ডে যাব। কিন্তু ওটা আর্মীদের দখলে। অস্ত্রধারী নিরাপত্তা রক্ষী দ্বারা দ্বীপটি পুরোপুরি রক্ষিত। দেখলাম ওখানে মাত্র একজন লোক দাড়িয়ে আছে। প্রচন্ড ঢেউ উঠেছে সাগরে। ঝড়ো বাতাস বইছে। ঢেউয়ের তোড়ে পানির ঝাপটা পড়ছে ফেরীর পাশের উইন্ডো গ্লাসে। তারপরও ওখানে ফেরী ভেড়াতে হবে কারণ যদি একজন যাত্রীও ওঠে বা নামে তাহলে ফেরীকে থামতেই হবে। কিন্তু যাত্রীটি যখন বুঝতে পারল তাকে নিতে ফেরীটি কষ্ট করে ঘাটে ভিড়তে চাচ্ছে তখন সে ইশারায় ফেরীটিকে যেতে বলল। সে আসলে আরেক গন্তব্যের যাত্রী ছিল। হাতের ইশারায় তিনি তা জানালেনও। ফেরীর মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া হল।
এখান থেকে ফেরীটি বেশ গতি নিয়ে চলতে শুরু করল। কিন্তু উথাল পাতাল ঢেউয়ে আসলে সামনে তেমন এগুনো যায় না। আমি জানালার পাশে বসেছিলাম। যাত্রী তেমন ছিলনা। আমার খুব ভাল লাগল। আমি পানির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। প্রবল বাতাসের তোড়ে পানিতে বড় গর্ত তৈরী হচ্ছিল। ফেরীটি টলমান অবস্থায় বড় বড় ঢেউয়ের ওপর উঠছিল এবং নামছিল। ভেতরে থাকা সকল মানুষই বেশ উপভোগ করছিল। অবশ্য ভেতরে তেমন বেশী লোক ছিলনা।
ডাবল বে তে আসলাম। এখানে বীচের এক পাশে নেট দিয়ে ঘেরা থাকে নিরাপদে সাতারানোর জন্যে আজ কোনো লোক দেখলাম না। বেশ ঠান্ডা লাগছে। বাইরে ঝোড়ো বাতাস। অন্যদিন ফেরীর সামনে অনেকে বসে থাকে সাগরের রূপ দেখার জন্যে কিন্তু আজ কেউ নেই। তবে কয়েকজন ওখানে বসতে চাচ্ছিল কিন্তু ক্যাপ্টেনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমন আবহাওয়ায় বাইরে বসতে নিষেধ করা হয়। আবার চলতে শুরু করল। আমরা ওয়াটসন বেতে আসলাম।
এটা খুব দারুন এলাকা। অতিরিক্ত সুন্দর। মূল ভূখন্ড থেকে একটি ব্রিজ এসেছে এই ঘাটে। এখানে ত্রিশ মিনিট পরপর সার্কুলার কী থেকে ফেরী আসে। ফেরী থেকে নামলাম। বেশ ঠান্ডা ,কারণ ঝোড়ো হাওয়া। ব্রীজের ওপর দিয়ে এগিয়ে গেলাম।
ব্রীজের সাথেই ডয়েল স্নাক্সের দোকান এবং সামনে এগিয়ে গেলে ডয়েল রেস্টুরেন্ট। এই দ্বীপের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই রেস্টুরেন্ট। বহু বছর ধরে এরা মানুষদেরকে সামুদ্রীক টাটকা মাছসহ নানান রকমের মজার খাবার খাইয়ে আসছে। এখানকার খাবারগুলো স্পেশাল এবং খুব দামীও বটে। এখানে বিশাল আকৃতির গলদা চিংড়ী পাওয়া যায়। বিভিন্নভাবে চিংড়ীমাছ উপস্থাপন করা হয়। অনেক রকমের সামুদ্রীক মাছ এখানে পাওয়া যায়। সাগরের তীর ঘেষে এরা অনেকগুলো ছাউনীযুক্ত বসার স্থান তৈরী করেছে। সেখানে বসে দুদণ্ড গল্প করে সময় কাটানো আর মজার মজার খাবার খাওয়ার ব্যাপারটি সত্যিই উপভোগ্য। রেস্টুরেন্টটি দুতলা এবং এর ছাদের অংশটাও অনেক সুন্দর করে তৈরী করা। সেখানেও চমৎকার শেড তৈরী করে মানুষকে আকর্ষণ করা হয়েছে। তবে আজ শেডগুলো গুটিয়ে রাখা হয়েছে। ভেতরে মানুষও অনেক কম দেখলাম। সিডনীতে একটা ব্যাপার খুব ভাল বুঝেছি যে,এরা রৌদ্রজ্জল দিন বেশ উপভোগ করে। কিন্তু আজকের দিনটি আমার।
ডয়েল রেস্টুরেন্টের পাশেই একটি সুন্দর পার্ক রয়েছে। পার্কের একপাশে বীচ। এখানে খুব প্রাচীন একটি বটগাছ আছে যা আমার খুব ভাল লেগেছিল। একপাশে ব্যায়ামের বিভিন্ন সরঞ্জাম। সবুজ ঘাসের বুক চীরে ওপাশে গেলেই বাসস্টপ। সার্কুলার কী থেকে এখানে বাসে করেও আসা যায় তবে সময় লাগে ফেরীর তিনগুন বেশী।
এখানে অনেক ধনী মানুষের বসবাস রয়েছে। সাগরের তীরবর্তী কিছু বাড়ি অনেক দামে কেনা। আমি রেসিডেন্সীয়াল এলাকার ভেতর দিয়ে হেটে চললাম। খানিকক্ষন হেটে ওয়াটসন বে'র বীচে পৌছলাম। কয়েকজন স্কুভা ডাইভার ছাড়া কেউ নেই। এখানে নতুন ডাইভারদেরকে প্রশিক্ষনও দেওয়া হয়। নিয়মিত এখানে ডাইভাররা ডাইভ দেয়। তবে এক লোককে দেখলাম এই ঠান্ডার মধ্যেও তীরে বসে আছে। এ বীচটি সুন্দর। এখানে বীচটি পার হয়ে কাঠের সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। এখানে একটি খুব বড় আকারের বটগাছ রয়েছে। যেটা থেকে অনেকগুলো লম্বা রশী ঝুলে পড়েছে। এটি একটি উঁচু জায়গা। এখান থেকে আরও উঁচুতে উঠে গেছে। এটি একটি ছোট পাহাড় এবং এর পাথুড়ে খাড়া পাড় রয়েছে।
সরু রাস্তা ধরে ওপরের দিকে এগিয়ে গেলাম।
পথের ডানে একস্থানে দেখলাম বড় পাথরের খন্ড ক্ষয়ে ওপরের দিকে ছাদের মত তৈরী হয়েছে। এখানে বৃষ্টির সময় দাড়িয়ে ভেজার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে নিশ্চিত। তবে সেই ক্ষয়িষ্ণু পাথরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি থেকে আশ্রয় খোজার পায়তারা করিনি,সেটি যে শিল্পের সৃষ্টি করেছিল সেটা দুচোখ ভরে দেখছিলাম। আজ এদিকে কেউ নেই। আমি ওপরের দিকে উঠলাম। দেখলাম সাগরের দিকে একটি কামান তাক করা আছে। ইংরেজ শাসনামলে এটি স্থাপন করা হয়েছিল শত্র“ বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাবার আশায়। কামানটা দেখতে বেশ। আর তাক করা আছে বেশ চমৎকার স্থান থেকে। এখান থেকে সামনে তাকালে ওপাশে বড় একটি পাহাড়। মাঝে হয়ত এক কিলো মিটার বা তারও কিছু বেশী দূরত্ব রয়েছে। সাগর দিয়ে কোনো শত্র“ জাহাজ এদিকে ঢুকলে তারা বুঝতে ব্যর্থ হবে যে পাহাড়ের এ অংশে একটি কামান বসানো আছে।
কামানকে বায়ে রেখে আরো ওপরের দিকে গেলাম। এখানে পিচঢালা পাকা রাস্তা রয়েছে মোটামুটি প্রশস্ত। ডানে আর্মীদের ক্যাম্প আরোও উঁচুতে অবস্থান করছে। ক্যাম্পটি স্টিলের নেট দিয়ে ঘেরা। বায়ে কিছু গাছপালা,ঝোপঝাড়। খোলা এই স্থান থেকে সাগরের যে রূপ দেখা যায় তা এক কথায় অসাধারণ। এখানে একটি বড় ঝাউগাছকে দেখলাম পাহাড়ের কিনার ঘেষে সাগরের দিকে ঝুকে রয়েছে। এই ঝাউগাছটি বয়সের ভারে নীচের দিকে সফেদ রং ধারণ করেছে, ওপরে সবুজ। ঝাউগাছটি আমার হৃদয় হরণ করল। আমি তাকিয়ে থাকলাম। বিস্তির্ণ সাগরের জলরাশি,ওপরে পাহাড় আর এই ঝাউগাছ,অসাধারণ। এমন আরও ঝাউগাছ এখানে আছে।
আমি সামনে চললাম। রাস্তার পাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের কিনারা,এরপর খাড়া পাড়,নীচের দিকে তাকালে পাথরের ধারালো কিনারা চোখে পড়ে। এখান থেকে কেউ কেউ পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে আনন্দে। তবে বিষয়টি জানতে পেরে সরকারী নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে যে,এখান থেকে লাফ দেওয়া বিপজ্জনক,আর লাফ দিলে ১৫০ ডলার জরিমানা। তবে এই সাইনবোর্ডের পাশ থেকেই পাহাড়ের খাড়া কিনার থেকে কিছু সাতারু লাফ দিয়ে আনন্দ উল্লাস করে থাকে। এরা এসব জরিমানার তোয়াক্কা করেনা। অবশ্য জরিমানা আদায়ে কোনো পুলিশি টহল চোখে পড়েনি। মাঝে মাঝে দু একজন পুলিশ এদিক ওদিক একটু হেটে ফিরে যায়। এখানকার সি বীচে নানান রঙের শামুক ঝিনুক পড়ে থাকে। অবশ্য এটা খুবই স্বাভাবিক যে সাগর তীরে এগুলো থাকবে। তবে এগুলো সংগ্রহ করলে বাইশ হাজার ডলার জরিমানা করা হবে মর্মে একটি বড় নোটিশ লাগানো আছে। এরা অবশ্য এসব আইন ভাঙতে চায়না,তবে একজনকে দেখেছি আরেক সি বীচে শামুক ঝিনুক কুড়াতে। এ এলাকাটি অবশ্য বিশেষ নিরাপত্তায় মোড়া। অন্য সি বীচে দেখেছি একই কারনে কয়েক’শ ডলার বা দু-এক হাজার ডলার জরিমানা করার নোটিশ টাঙ্গানো হয়েছে। এখানে বেশী ডলার জরিমানা করার বিধান রাখার কারণ এখানে অনেক মূল্যবান সম্পদ রয়েছে।
সামনে দেখলাম রাস্তা নীচের দিকে চলে গেছে এবং খানিক সমতলে গিয়ে একটি কাঠের সিড়ি বেয়ে আবারও ওপরের দিকে চলে গেলাম। ডানে আর্মী ক্যাম্প।কাঠের সিড়িগুলি খুব সুন্দর। এ অংশে প্রচুর গাছপালা রয়েছে। আমি ওপরে উঠে দুপাশে চমৎকার গাছপালা সমৃদ্ধ রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। খানিক পরে দেখলাম বায়ে বিশাল বিশাল পাথরের স্তুপ আর তার ওপর শাওলা জমে আছে। আমি সেগুলোর ওপর উঠলাম এবং সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ দেখলাম বিশাল একটা জাহাজ চলে যাচ্ছে। এগুলো সত্যিই বিশাল। পৃথিবীর সবথেকে বিশাল বিশাল জাগাজগুলো এদিক থেকে ধনীদেরকে তুলে নিয়ে যায় নানান কিসিমের আরাম আয়েশের ভেতর তাদেরকে ডুবিয়ে রাখার জন্যে। তারা সেখানে ঢুকে তামাম দুনিয়ার সকল দু:খ ভুলে থাকার চেষ্টা করে এবং আনন্দের সাগরে অবগাহন করে।
এখানে দাড়িয়ে সাগরের ভেতর অবস্থিত কয়েকটি পাহাড় চোখে পড়ে। এগুলো স্থলভাগের শেষ অংশ। দূর থেকে সাগরের ওপর দাড়িয়ে থাকা পাহাড়ের খাড়া ঢাল দেখতে খুব ভাল লাগে। আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। ডানে বাঁক নিলেই এখানে একটি বাতিঘর। সমুদ্রে জাহাজের চলাচল সহজ করতে বাতিঘরগুলো তৈরী। বাতিঘরের নীচের অংশটা পাহাড়ের খাড়া অংশ। আমি সেদিক দিয়ে খানিকটা নীচে নেমে গেলাম। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সতর্কতার সাথে পা রেখে নীচে নামলাম। সত্যিই অসাধারণ। অশান্ত সাগরের বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে বিশাল পাথরের চাকের ওপর। পানি ছিটকে পড়ছে চারিদিকে। পাহাড়ের খাড়া ঢালের গায়ে লাখ লাখ বছরের প্রাকৃতিক অত্যাচারে যে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে তা পাহাড়কে আহত করলেও আমাকে আনন্দিত করল। এটা আগ্নেয় কঠিন শিলার সৃষ্টি নয় এটি স্যান্ডি স্টোন। একেক স্থানের রং একে রকম। কোথাও কোথাও লাল,সাদা আর মসৃন পাথর দেখলাম। পাথরের ওপর হেটে বেড়ালাম। খুব ভাল লাগল। আরও সামনে গেলাম। স্থানটি বেশ ভাল লাগল। এখানে খুব ঘন ঝোপঝাড় রয়েছে। তার ভেতর দিয়ে যে সরু রাস্তা চলে গেছে সেখানে হাটলাম। নিরব পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করল। আজ আমি ছাড়া কেউ নেই এ উপদ্বীপে।
এ অংশের ওপাশে যাওয়া নিষেধ,তাই ফিরে আসলাম। আমি পূর্বোক্ত সেই কামানের কাছে আসলাম। সেটার ওপরের দিকে বিশেষ ধরনের পাম গাছ রয়েছে। আমি একটি গাছের নীচে বসলাম। এটি প্রচন্ড মোটা আর এর ডগাগুলো খুব ধারালো। আমি এখানে খানিকক্ষণ বসে সাগরের দিকে তাকালাম। এখান থেকে সিডনী ব্রিজ দেখা যায় আর শহরের বড় বড় বিল্ডিংএর মাথা দেখা যায়। এখান থেকে শহরকে দেখতে খুব ভাল লাগে। খুব ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আমার ঠান্ডা ঠান্ডা লাগল কিন্তু ভালও লাগল। আমি পুরো দ্বীপে একা। যদিও এটি দ্বীপ নয় কারণ এর একপাশ স্থল ভাগের সাথে যুক্ত। তারপরও এটি দ্বীপের মতই। নির্জন দ্বীপে আমি একা বসে আছি এমন অনুভূতি কাজ করল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এখানে দুটি বসার বেঞ্জ রয়েছে। আমি একটিতে বসলাম। খানিকপর আমার পিঠে ঝোলানো ব্যাগটি মাথার নীচে দিয়ে শুয়ে থাকলাম। পাতলা একটি স্পের্টস জ্যাকেট গায়ে,বাতাস ঢুকে একটু ঠান্ডা লাগছে তাই ব্যাগ থেকে একটা তোয়ালে বের করে গায়ে চাপালাম। আকাশের দিতে তাকিয়ে আছি,আকাশ মেঘলা। দেখার কিছুই নেই তারপরও মনে হল ওদিকে তাকাতেই আনন্দ। মনে হল আজকের এই দিনটি আমার জীবনের শ্মরনীয় দিন এবং এটি আমি ভুলব না। আমি চোখ বন্ধ করে বহু কথা ভাবতে থাকলঅম। আমি আকাশ ,প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে স্রষ্টার বিশালতা ভাবতে থাকলাম। আল্লাহ কত মহান। তিনি কত সুন্দর আর বিশাল !
চলমান...
বিষয়: বিবিধ
২৬৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন