ওলংগং ২
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৫ জুলাই, ২০১৩, ০৯:৫৬:০৫ সকাল
বুল্লী পার্কে ঢুকলাম। এটা খুব সুন্দর ছোট্ট একটি পার্ক এখানে পুরোনো মত দেখতে একটজাতীয় গাছকে আমার খুব ভাল লাগল। তার পাশে খানিকনক্ষণ দাড়ালাম। গাছগুলির গায়ে আরও লতাপাতা জড়ানো ছিল। আমার সব সময় প্রাচীন ধরনের বৃক্ষ ভাল লাগে। পুরোনো বৃক্ষ দেখলে আমি যেন স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যায়।
আমরা ওপর থেকে দেখা ওই ওলংগং সিটিতে যাবনা। আমরা এই এলাকায় অবস্থিত একটি চায়নিজ বৌদ্ধ মন্দীরে যাব। এটা যে কি চমৎকার এবং ভালবাসা থেকে বানিয়েছে তা না দেখলে অনুমান করা যাবেনা। এরা খুবই পরিচ্ছন্ন। এটা হল ‘নান তিয়াং’ টেম্পল। একটা পাহাড় ও সাগর পরিবেষ্ঠীত একটি বিশাল এলাকা জুড়ে টেম্পলটি প্রতিষ্ঠিত। এলাকায় প্রবেশের বেশ পূর্বেই একটি জাকজমকপূর্ণ গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। রাস্তাগুলো সুন্দর।
এখানে এরা বিভিন্ন রঙের চমৎকার বৃক্ষের বাগান তৈরী করেছে। কোনো গাছের পাতা লাল,কোনোটা হলুদ আর সবুজাভ। এর ভেতর দিয়ে তাদের বিভিন্ন রকমের স্থাপনা তৈরী করা হয়েছে। চায়নারা প্রাচীন যে রীতিতে বাড়িঘর বানাতো এখানেও তাই। এটি একটি বিরাট আশ্রমও। এখানে অনেক ধর্ম যাযক রয়েছেন এবং অনেককে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে নিয়মিত তালিমের মাধ্যমে।
আমরা গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ একটি সুউচ্চ মন্দীরে প্রবেশ করলাম। এখানে অনেক দামী দামী বৌদ্ধ মুর্তী রয়েছে। এই মন্দীরটির ছাদ আট তলা। অনেক দূর থেকে এটি দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়ার চায়নিজরা এখানে ব্যপক অর্থ সাহায্য করে থাকে। এর সামনের অংশে বৌদ্ধের বিভিন্ন বয়সের কর্মকান্ডের ওপর ভিত্তি করে মুর্তী নির্মান করা হয়েছে। এখানকার সকল মুর্তীই তার শৈশবকে কল্পনা করেই তৈরী।
আমরা এখান থেকে বেরিয়ে ভেতরের অংশে প্রবেশ করলাম। রাস্তার দুপাশে ফুলের বাগান,বড় গাছ,রঙিন পাতা সমৃদ্ধ গাছপালা এবং লনের পাশে সবুজ ঘাস। লনে বসার ইচ্ছা হল,কিন্তু সতর্ক বাণী দেখলাম। সাবধান এখানে বিষাক্ত সাপ রয়েছে। এ ঘোষনায় এখানে কেউ বসবে বলে মনে হয়না। বিশ্বের বেশীরভাগ মানুষই সাপকে ভয় পায় বা ঘৃণা করে।
আমরা একটি বিশাল স্থাপনায় আসলাম। একটি দুতলা বিশাল অট্রালিকায় ধর্ম চর্চা চলছে। এখানকার বারান্দায় একটি বিশাল ঘন্টা ঝুলানো আছে। তারা বিরক্ত হতে পারে ভেবে সেটাতে আঘাত করলাম না। ভেতরে দেখলাম বুদ্ধের বিশাল বিশাল পাচটি মুর্তী স্থাপন করা হয়েছে। সেগুলোতে বুদ্ধ বিভিন্ন ভঙ্গীমায় বসে আছে। কয়েকজন ভক্তকে দেখলাম নীচে বসে অবনত মস্তকে আরাধনা করছে।
এই বৌদ্ধমঠটি চারকোণাকৃতির,এর চারকোণায় চারটি একই রকমের বাড়ি রয়েছে। দেখতে হুবহু একই রকম এবং মাপেও সমান। এগুলোর ওপরে লাল টালী ব্যবহৃত হয়েছে। চারটি বাড়িরই দ্বিতল বিশিষ্ট। এর মাঝের অংশে সবুজ ঘাসে ঢাকা একটি মাঠ। সেখানে বহু সংখ্যক কবুতর দেখলাম। এদেরকে খেতে দেওয়া হয়। এটার সৌন্দর্য্য নজর কাড়ার মত।
আমরা এক তলায় নেমে আসলাম। এখানে জুতা খুলে প্রবেশ করতে হয়। নীচের তলাটি এখানে শিক্ষানবিশদের জন্যে; যারা মংক হতে চায়। আমি একটি ঘরে উকি দিয়ে দেখলাম পিন পতন নীরবতার মধ্যে একজন বৃদ্ধ ধর্মগুরু অন্তত চল্লিশজন চায়নিজ ও অস্ট্রেলীয় মানুষকে ধ্যান শিক্ষা দিচ্ছেন। প্রত্যেতে মেরুদণ্ড সোজা করে ভদ্রতার সাথে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। তাদের মন এখন কেন্দ্রীভূত। তারা মেডিটেশনে রয়েছেন। এখানকার অসুখী অস্ট্রেলীয়রা কেউ কেউ যুক্ত হয়েছে জীবনকে এখানে কাটিয়ে দেওয়ার জন্যে।
বিশ্বে মেডিটেশনের জন্যে অনেকে কাজ করে থাকে। অনেকে এ ব্যাপারে তালিম দিয়ে থাকে। সিলভা,কোয়ান্টাম এবং আরও অনেক নামে অনেকভাবে তারা মেডিটেশন শিখিয়ে থাকে। এমনকি আমিও একবার আগ্রহী হয়েছিলাম কিন্তু বেশীদূর এগুতে পারিনি। এর কারণ ছিল সোজা। এরা অনেক থিওরী আউড়িয়ে যা করার কথা বলত,তা একজন ভাল মানের মুসলিম হলে আবশ্য কর্তব্য হয়ে দাড়ায়। এরা বিক্ষিপ্ত মনকে কেন্দ্রীভূত করার যে প্রক্রিয়ার কথা বলত,আমি লক্ষ্য করলাম আমরা নামাজের মাধ্যমে আরও বেশী সাফল্যজনকভাবে এই বিক্ষিপ্ততা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে এক মহা শক্তিশালী স্রষ্টার কাছে সপে দিয়ে মানুষিক তৃপ্তী লাভ করতে পারি। আর এভাবে ধ্যানের মাধ্যমে শরীর,মনকে চাঙ্গা করা বা নব উদ্দমে নিজেকে উদ্দীপ্ত করার কথা বলা হয়,তা কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে আরও ভালভাবে অর্জন করা যায়। সৎ জীবন যাপন,পরোপকার করে,শরীর চর্চা,নিয়মিত ঘুম ইত্যাদীর মাধ্যমে যা অর্জন করা সম্ভব ,মেডিটেশন সেটাই শিখিয়ে থাকে।
তবে মেডিটেশনের ফলাফল সমাজকে আমূল বদলে দিতে পারেনা। কারণ এখানে মানুষকে একতরফাভাবে চিন্তা করা হয়েছে। এসব ব্যবস্থাপনা মূলত মানুষকে সমাজ বিচ্ছিন্ন প্রাণীতে পরিণত করে নির্বিষ ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করে, আর সঙ্গত কারনেই তার পক্ষে অন্যের ক্ষতিসাধন করা সম্ভব নয়। জলে থাকব কিন্তু জল স্পর্শ করব না,এটি এমনই নীতি। কিন্তু ইসলাম ব্যক্তিকে নরম এবং প্রয়োজনে গরমও করে। শুধুই নরমের ফলাফল হল নিজেকে এমন একটি অবস্থায় ঠেলে দেওয়া যেখানে কেউ তাকে অত্যাচার করার সুযোগ পাবেনা অত্যাচারীর সীমার বাইরে থাকার কারনে এবং সেও কাউকে অত্যাচার করার তেমন সুযোগ পাবেনা। নরম আর গরমের ভারসাম্যের অর্থ হল-‘সৎ কাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ’। একজন মানুষ সর্বদা নিজে ভাল হওয়ার চেষ্টা করা মানে হল সে স্বার্থপর এবং সামাজিক দায় এড়াতে সচেষ্ট। একজন প্রকৃত সৎ ও নিষ্ঠাবান লোক নিজে অত্যাচার করেনা এবং অপরকেও অত্যাচার করতে দেয়না। ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সে যেমন দৃঢ় প্রত্যয়ী,তেমনীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী। তার এই আচরণ সমাজকে সঠিক পথ দেখায় এবং সকলের কল্যানে ভূমিকা রাখে। কিন্তু ব্যক্তি নানান কৌশলে সমাজ বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করলে সমাজের লোকদেরকে শয়তানের কবলে রেখে নিজে সিন্দুকে ঢোকার মত হয়ে যায়।
ঐতিহ্যগতভাবেই মেডিটেশন বুদ্ধদের তৈরী ধর্মীয় বিষয়। তাদের বিষয় তাদের। অবশ্য অনেকে এই অংশটা নিয়ে বিভিন্ন বয়ান মুখস্ত করে আমাদেরকে গেলানোর চেষ্টা করে থাকে। নিজের মনের ওপর বিশাল নিয়ন্ত্রনের মহা কৌশল শেখানো হয়। অনেকে আবার নিজের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতেও পারে। মজার ব্যাপার হল, মানুষের তৈরী মেডিটেশন থেরাপী না নিয়েও মানব জাতির একটি বিশাল অংশ নিজেদের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এখানে একজন মানুষকে চারিত্রিকভাবে বদলে দেওয়ার পেছনে তার মেডিটেশন যতটা না কাজ করে,তার চাইতে অনেক বেশী কাজ করে সৎ জীবন যাপনের নিয়ম কানুন মেনে চলা। যাইহোক বুদ্ধ ধর্মের লোকেদের সমালোচনা করা আমার কাজ নয়,সঙ্গতও নয়, আমি সমালোচনা করেছি মেডিটেশনবীদদের,যারা মেডিটেশনের মাধ্যমে সমাজ বদলাতে চায়।
চলবে.....
বিষয়: বিবিধ
১৮০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন