হঠাৎ সফর,হঠাৎ শেষ
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১০ জুলাই, ২০১৩, ০৫:১৯:৫৩ বিকাল
সন্ধ্যার পূর্বে আমরা মোটরবাইক নিয়ে বের হলাম। সজিবদের বাড়ির সামনে পৌরসভার বাতি একটু বেশী আলোকিত করেছে কারণ ওর খালাতো ভাই ঝিনাইদহ জেলা শহরের মেয়র। ভদ্রলোকটা ছাত্রলীগের এক সময়কার অত্যন্ত ত্যাগী নেতা এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিল। কিন্তু তেল মারার অভ্যাস না থাকায় সুবিধার রাজনীতিতে খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। বাড়ির সামনের হাইওয়ে থেকে মাটি ভরাট করে মোটা একটি রাস্তা চলে গেছে সোজা ওদের বাড়ি। এই জমি অবশ্য সরকার অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করবে না রাস্তা ছাড়া।
আমরা গেলাম একটি নদীর ওপর। এই নদীর সৌন্দর্য্য আমাকে মোহিত করল। ব্রিজের ওপর দাড়িয়ে দুপাশে চোখ বোলালাম,আহ ! সত্যিই দারুন। নদীর দুপাড় ঘাসে ঢাকা এবং তার মধ্যদিয়ে অগভীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এমন দৃশ্য আমার ভাল লাগে। আমরা নদী পার হয়ে ওপারে গেলাম। এখানে সজিবের চাচাতো ভাই একটি বিশাল বাগানবাড়ী তৈরী করেছে। তিনি বর্তমানে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত আছেন। বাড়ি দেখাশোনা করে একটি পরিবার। ভেতরের রাস্তাধরে এগিয়ে গেলাম। ভেতরে ট্রাকটর দিয়ে জমি চাষ করা হয়। সেখানে কলাগাছ,বেগুন,টমেটোসহ নানান সব্জীর বড় বড় ক্ষেত রয়েছে। একপাশে রয়েছে বিশাল আমের বাগান। আরেক পাশে বিশাল পুকুর। এর মাঝে একটি অতি মাত্রায় সুন্দর বেশ বড় বাংলো। প্রচুর পয়সা খরচ করে দৃষ্টিনন্দন করে বানানো হয়েছে এটি। তবে এটি ব্যবহার করার লোক নেই। একদিন সব এভাবেই রেখে আমরা সবাই বিদায় হয়ে যায়। অবশ্য এসব চিন্তা বহু পূর্ব থেকেই নির্বাসনে আছে।
আমরা চলে আসলাম মূল শহরে। এখানে একটি বিখ্যাত মিস্টির দোকানে মালাই চপ নামক মিস্টি খেলাম। সাংঘাতিক মজা লাগল। পেটভরে খেয়েছি। পেটে শান্তি লাগল। এবার গেলাম আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেবের খোঁজে। এখানে উনাকে অধিকাংম মানুষই চিনে। প্রথমে তার তৈরী মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। এটা তিন তলা। এর সাথে আছে মাদ্রাসা। তার বাড়ির আয়তন অনেক বড়। রাস্তা ঘেষে আছে একটি চারতলা কমপ্লেক্স। এখানে আছে লাইব্রেরী এবং ছেলে-মেয়েদের জন্যে পৃথক মাদ্রাসা। যারা উঁচু স্তরের পড়াশুনা করতে চায় তাদের জন্যেও ব্যবস্থা রয়েছে।
তার পিতা ছিলেন প্রখ্যাত আলেম। তিনি এসবের অনেক কিছু চালু করেছিলেন। আমরা তার দ্বিতল বাড়িতে প্রবেশ করলাম। প্রফেসর সাহেব সদা হাস্যজ্জল। লুঙ্গি আর টি-শার্ট পরে এসে আমাদেরকে জড়িয়ে সম্ভাষন জানালেন,দিলখোলা আলোচনা করলেন। শুরুতেই আম খেতে দিলেন। সদ্য মিস্টি খাওয়া মুখে আম চালান করলাম। তিনি জেদ্দা থেকে হাদীস শাস্ত্রের ওপর পিএইচডি করেছেন,বর্তমানে তার পুত্র একই স্থানে একই বিষয়ে অধ্যায়নরত। স্বপরিবারে সেখানেই শিক্ষকতা করছিলেন কিন্তু দাওয়ার কাজের জন্যে দেশে ফিরে আসলেন। বহু সমজিদ,মাদ্রাসা এবং নানামুখী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান চালু করলেন। তিন নারী-পুরুষদেরকে কর্মজীবী করার মানষে সেলাইসহ বিভিন্ন হাতের কাজের ওপর প্রশিক্ষন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছেন এবং এখানে শিক্ষা শেষে তাদেরকে উপযোগী যন্ত্র ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। মাদ্রাসা শিক্ষা বিস্তারে তিনি ভাল মানের শিক্ষকদের সমন্বয়ে বেশ কিছু মাদ্রাসা গড়ে তুলেছেন এবং নিজের একখন্ড জমি দান করেছেন ইসলামী ইউনিভার্সিটি তৈরীর জন্যে।
ঝিনাইদহের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিছু বিদেশী এনজিও বিভিন্ন প্রতারণার মাধ্যমে সরলপ্রাণ মুসলিমদেরকে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করছে জানলাম। তারা ঈশায়ী ধর্মের অনুসারী বলে মুসলিমদেরকে ধোকা দিচ্ছে এবং একাজে আল্লাহরও অনুমোদন আছে বলে জানাচ্ছে। তারা আল-কুরআন খুলে হযরত ঈসা(আঃ) ,তার মাতা মরিয়ম সম্পর্কে আয়াত পেশ করে তারপর বাইবেল থেকে কিছু উদ্বৃতি দিয়ে সরলমনা মুসলিমকে কৌশলে খ্রিষ্টান বানাচ্ছে। জনাব আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার তৈরী করা ছাত্রগন অথবা অন্যান্য আলিমদেরকে পাঠিয়ে মুসলিমদের ঈমান আক্কিদা রক্ষার চেষ্টা করছেন বলে জানালেন। ইতিমধ্যে বেশকিছু ঈশায়ী পন্থীদেরকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। একই রকম কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং দারিদ্রপ্রবন এলাকায়। সেখানে টাকা ও কৌশলের মাধ্যমে খ্রিষ্টানরা মুসলিমদেরকে ঈমানহীন করার চেষ্টা করছে। সম্ববত একসময় এরা গোজামিল দিয়ে হলেও একটা খ্রিষ্টান সম্প্রদায় গড়ে তুলে তাদের জন্যে আবাসভূমির পৃথকীকরনের দাবী উত্থাপন করবে এবং আর্ন্তাতিকভাবে চাপ দিয়ে পাপুয়া নিউগিনি, দক্ষিণ সূদানের মত রাষ্ট্র ভাগ করে ফেলবে এবং নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অবশ্য খ্রিষ্টান মিশনারীগুলো ভিন্ন পন্থায় কাজ করে।
জনাব আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর ফুরফরা পীর সাহেবের(মূল পীরের পুত্র)জামাতা। ফুরফুরার ব্যাপারে আমার অভিমত ছিল এরা মানুষকে ধোকা দেয় এবং জাল হাদীস চর্চা করে। একই সাথে এরা মহা শিরকে নিমজ্জিত। হ্যা ঘটনা সত্যি তবে এর মধ্যে কিন্তু আছে। ফুরফুরা পীরের দুটি ধারা আছে। এক পক্ষ নানান অলৌকিক কর্মকান্ড নিয়ে মারেফতের রাজ্যে ফানাফিল্লাহ হয়ে বিচরন করে এবং শরিয়তের অনেক নিয়ম কানুনের উর্ধ্বে উঠে গেছে বলে মনে করে। আরেক পক্ষ সহিহ সুন্নাহ অনুসরনের চেষ্টা করে এবং চর্চা করে। সহিহ পক্ষের লোকের সংখ্যা শুনলাম ৯৫%,বাকীরা ভূয়া। তবে ভূয়াদের কথা’ই সমাজে বেশী ছড়িয়েছে। এসব কর্মকান্ডে কখনও কখনও বিদেশী সহায়তা যুক্ত থাকে ফলে তা দ্রুত ছড়ায়,আরও একটা ব্যাপার হল আমাদের জনতার ভেশীরভাগই অশিক্ষিত ও কু-সংষ্কারাচ্ছন্ন। বাস্তবতার চাইতে তারা অলৌকিকতাকেই বেশী প্রাধান্য দেয়।
একজন তাকে ফোন করে তারাবিহ নামাজের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন রসূল(সাঃ) মাত্র তিন দিন এই নামাজ আদায় করেছেন। আর তিনি(সাঃ) সেটা তারাবিহ হিসেবে পড়েননি। এটি কিয়ামূল লাইল বা রাতে দাড়িয়ে ঈবাদত বা সালাত। এটা রসূল(সাঃ) সারা বছরই করতেন। আর এখানে রাকাত সংখ্যার চাইতে নামাজের কোয়ালিটি বা কিরাতের দীর্ঘতা গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত বেশী রাকাত পড়ার চাইতে অতি মনোযোগের সাথে কম সংখ্যক রাকাত আদায় করা ভাল। রসূূল(সাঃ) দুই রাকাত পড়তেই বহু সময় ব্যয় করতেন।
সজিব জানতে চাইল,নামাজ আদায়ের সময় আল-কুরআনের সূরার সিরিয়াল অনুযায়ী তিলাওয়াত করার কোনো বিধান আছে কিনা ? তিনি বললেন এমন বিধান নেই। বরং রসূল(সাঃ) পরের দিকের সূরা আগের রাকাতে এবং আগের দিকের সূরা পরের রাকাতে তিলাওয়াত করেছেন এমন প্রমান রয়েছে। একইসাথে প্রথম রাকাতে বেশী সংখ্যক এবং দ্বিতীয় রাকাতে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক আয়াত তিলাওয়াত করার নিয়ম আছে কিনা জানতে চেয়ে বুঝলাম এটিরও বাধ্যবাধকতা নেই। হেফাজতে ইসলাম ইস্যুতে তিনি কিছু কথা বলে সরকারের খানিকটা বিরাগভাজন হন এবং অনেকে তার ক্ষতির চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে শুনলাম।
তিনি তার মোবাইল ফোন নাম্বারটি দিতে চাননা কারণ তিনি লেখালেখি করেন এবং ফোন করলে তাতে সমস্যা হয়। কিন্তু তিনি তার ব্যক্তিগত নাম্বারটি আমাদেরকে দিলেন। ঈশার আযান হয়েছে, জামাতের মাত্র ৫মিনিট বাকী। তিনি তটস্থ হলেন এবং একজন লোককে ডাকিয়ে আমাদেরকে নামাজ বাদ তার লেখা বই দিতে বললেন। আমরা নামাজের জন্যে মসজিদে গেলাম। এখানে ফরজ নামাজের পর সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা হয়না,এটাই সুন্নাহ।
নামাজ শেষে আমরা তার বাড়ির এরিয়া ঘুরে দেখলাম এবং মাদ্রাসা পরিদর্শন করলাম। তার লেখা বিভিন্ন পুস্তকাদী নিলাম। রাতে পড়ার পর সজিবকে যখন বললাম এই বইগুলো আমি নিয়ে যাব,আর অমনি সে সাপের মত ছোবল মেরে বইগুলো কেড়ে নিল। ছোবল না মেরে কি বা করবে ! ওর কাছ থেকে বই নিয়ে কবে যে ফেরত দিলাম সেটাই মনে করতে পারছি না ! আমারও বা কি দোষ, আমার বই লোকে নিয়ে কি ফেরত দিয়েছে ??
পরদিন সজিব সালাহউদ্দীন ভাই স্টাইলে নতুন এক এলাকার বয়ান করল এবং আমাকে বিকেলে যেতে বলল। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম, ফজরের নামাজ পড়ে ঝেড়ে দৌড় দেব,আঙ্কেলকেও জানানোর দরকার নেই,যা বলার রাতেই বলা হবে। সকালে ফজরের পর দ্বিতীয় ইনিংসের ঘুম জমালাম না,খানিক পড়েই দৌড় দিলাম।
বিষয়: বিবিধ
২৭২৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন