হঠাৎ সফর-২

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০২ জুলাই, ২০১৩, ০৭:১১:০৮ সকাল



তবে এখানে বেশ কয়েকটা খারাপ ঘটনাও শুনেছি। কিছু লোক হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করেছে এবং সম্পত্তি নেওয়ার জন্যে তাদেরকে নানাভাবে বিপদেও ফেরেছে। ক্ষতিগ্রস্ত সেসব পরিবারের পাশে সকলে দাড়ালেও অনেকের মন ভেঙ্গে গেছে এবং তারা সম্পত্তি বিক্রী করে ভারতে চলে গেছে। এদের সংখ্যা যদিও কম তারপরও এসব ঘটা খুবই দু:খজনক। কিছু খারাপ চরিত্রের নামধারী মুসলিমের জন্যে সকল মুসলিমের ওপর অপবাদ নেমে আসে। সালাহউদ্দীন ভায়ের বাড়ির পাশেই তার পিতা একটি হিন্দু পরিবারকে অনেক টাকা খরচ করে তিনতলা বাড়ী তৈরী করে দিয়েছেন। সেদিন সালাহউদ্দীন ভাই তাদের সাথে দেখা করতে গেলে তারা তাদের গাছের সফেদা দিয়েছিল। এমন সুমিষ্ট ও বড় সফেদা আমি আমার জীবনে আর খাইনি।

এই স্থানের নাম শ্রী-পুর। এটা সীমান্ত এলাকা। এখানে ইছামতী নদী রয়েছে যার সৌন্দর্য অনন্ন। পাশে এক বেড়ীবাধের ওপর দিয়ে হেটে গেলে নিরস মানুষের মনও রসে পরিপূর্ণ হবে। নদীর ওপারেই ভারত। এদিক দিয়ে প্রচুর পণ্য-দ্রব্য আদান প্রদান হয়। নদী সাতরে বা নৌযানে করে মালামাল পাচার হয়। ভারত থেকে প্রচুর পরিমানে গরু এবং মহিষ আসে। তবে আমি শতশত মহিষ দেখলেও একটাও গরু দেখিনি। এগুলো ঢাকা এবং চট্টগ্রামে চলে যায় কিন্তু কোনো মাংসের দোকানদারই মহিষের মাংস বিক্রী করেন না। আর আপনিও হয়ত কখনই মহিষের মাংস খাননি(?) আমার ধারণা বহু লোক গরু হিসেবে আজীবন(কুরবানীর সময় ছাড়া) মহিষ চালিয়ে আসছে।

এখানকার গরু-মহিষের দালালরা পশুর প্রতি খুবই নির্মম। এসব পশু বহুদূর অতিক্রম করে এখানে আসে। এদের তেমন খেতে দেওয়া হয়না। বেশীরভাগই দেখলাম ভগ্নস্বাস্থের অধিকারী। মূল স্থানে এরা হয়ত এমন ছিলনা। তবে দেশীয় দালালদের ভাষ্য অনুযায়ী এরা যথেষ্ট মানবিক। এপারে আসার পর এরা পশুদেরকে ভাল খেতে দেয়। কিন্তু এটা পুরোপুরি সঠিক নয়। এরাও নির্মম। একটি মহিষকে আমি মরে পড়ে থামতে দেখেছি। আমার খুব খারাপ লেগেছে এদের আচরনে। এরা লাঠি দিয়ে পেটায় যাতে পশুগুলো তাড়াতাড়ি পথ চলতে পারে। কখনও কখনও নাকের মধ্যে লাঠি ঢুকিয়ে অত্যাচার করে যাতে তারা দ্রুত চলমান হয়। পত্রিকায় পড়েছিলাম এক সীমান্তে গরুকে পাহাড়ের ওপর থেকে ফেলে দেয়,এতে তারা দ্রুত ধাবমান হয় এবং গড়িয়ে পড়ে অনেক গরু চরম আহত হয় বা মারাও যায়। একটা হাদীস মনে পড়ল। বনী ইসরাইলের এক পতিতা একটি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর কারনে আল্লাহ তার সকল পাপকে ক্ষমা করে জান্নাত দান করেছিলেন। আরেকটি হাদীসে দেখেছি,এক মহিলা একটি বিড়ালকে বেধে রাখে এবং ক্ষুধায় সে বিড়ালটি মারা যায়। সে নারীকে জাহান্নাম প্রদান করা হয়।

দুপুরে আমরা সালাহউদ্দীন ভায়ের বাড়ির সাথে থাকা শান বাধানো পুকুরে গোসল করলাম। আমি এবার যত আম খেয়েছি,তেমনটা ইতিপূর্বে খুব কমই খেয়েছি। যদিও ল্যাংড়া আমার পছন্দ তারপরও অন্য যেকোনো ভাল আমে আমার আপত্তি নেই। শুনেছি আন্টি গোপনে আম এবং মাঝে মাঝে মিস্টি খায় ,যদিও তার বায়াবেটিস। সালাহউদ্দীন ভাই তাকে হাসপাতালের ভয় দেখাচ্ছিল,কারণ আন্টি হাসপাতালে থাকতে ভয় পায়। আন্টি হলেন সহজ-সরল উন্নত চরিত্রের ভাল মানুষ। তিনি সাধারনত অবসরেই থাকেন। বই পড়ে ও দরিদ্র বাচ্চাদের আরবী পড়িয়ে তার সময় বেশ কাটে। আশপাশের দরিদ্র মানুষের সেবায় তিনি সর্বদা নিয়জিত।

সালাহউদ্দন ভায়ের বাড়িতে ৭/৮ জনের নীচে কাজের লোক দেখা যায় না। তারা পরিবারের সদস্যের মতই থাকে। একসাথে বসেই খায়। বাড়ির এরিয়া ৭একরের মত হবে। বাড়িটি দ্বিতল এবং বেশ মনোরম। এখানে শতাধিক নারকেল গাছ এবং প্রচুর আমগাছ রয়েছে। তার পিতা কোনো কিছু ছোট খাটোর মধ্যে করতে পারেননা। তিনি কোনো কিছু তৈরী করলে বিশাল করেই করেন,তবে তিনি নিজে সাদাসিধা জীবন যাপন করেন। দুপুরে আমরা পিরোজপুর গেলাম। এটা এখান থেকে প্রায় ২৫কি:মি: দূরে। এখানে আঙ্কেল একটি আধুনিক হ্যাচারী তৈরী করেছিলেন। এটা তৈরীতে অন্তত তিন কোটি ইট ব্যবহৃত হয়েছে। এটি ১৬বিঘার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব। একপাশে ২০ কক্ষ বিশিষ্ট দ্বিতল বাড়ি এবং এর সাথে হ্যাচারী। সকল কর্মকান্ড এখান থেকে পর্যবেক্ষন করা যায়। প্রচুর ইট এবং কংক্রিটের সাহায্যে এই স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এটি তৈরীর পর বোঝা গেল এখানে হ্যাচারী করা যাবেনা। কারণ পানিতে যে পরিমান লবন দরকার তা এখানে নেই। ফলে প্রজেক্টটি আর চালু হয়নি। এখানে ডজন খানেক লোক রয়েছে পাহারায়। তারা খায় দায় আর ঘুমায়। এখানে আম,ডালিম,পেপে ইত্যাদী ফলের গাছ রয়েছে। আমি একটি বিশালাকৃতির আমের ওপর হাত রাখাতে তা আপনা আপনি খসে পড়ল। এটা পাকা আম। আমি এখানে এসেছি কাচা আম খেতে। একটা ছুরি চেয়ে নিলাম এবং কাচা আম খেতে শুরু করলাম। সালাহউদ্দীন ভায়ের বড় ভাই ইউনেস্কোর জন্যে ডকুমেন্টারী ফিল্ম তৈরী করে। তিনি মাঝে মাঝে তার দলবল নিয়ে এখানে এসে শুটিংও করেন।

আমরা গেলাম সাতক্ষিরার হ্যাচারীতে। আঙ্কেলের বিশাল বিশাল চিংড়ী ঘের রয়েছে,যার পরিমান প্রায় সাড়ে চার হাজার বিঘা। এছাড়া তিনি অন্যান্ন মাছও চাষ করেন। তার এক ঘেরের ভেতর ১২শ ছাগলও পালিত হয়।

রাতে আমরা দেবহাটা বাজারে তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে সময় কাটালাম। তারা খুব চমৎকার মানুষ এবং পরহেজগার। বিশেষ করে রেজওয়ান নামক তার এক বন্ধু আছে যিনি সত্যের প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী। তাকে আমি খুব পছন্দ করি। রাতে তার নানা সালাহউদ্দীনের জন্যে একটা পাত্রী দেখতে বললেন,মনে মনে ভাবলাম কার কাছে কি কয় !! মুখে বললাম, ইনশাআল্লাহ !!

এদিকে আমার মা এবং ভাই বারবার ফোন করছে বাড়িতে আসার জন্যে,ওদিকে সালাহউদ্দীন ভাই নিত্য নতুন লোভ দেখাচ্ছে ওখানে আরও একদিন থাকার জন্যে। নফসের গলায় পা দিয়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আসার সময় দশ কেজী আমের একটা প্যাকেট সে বাসে উঠিয়ে দিল। এবার আমের ফলন হয়েছে ভাল,খেয়েছিও বেশ। লোকাল বাসের পেছনের দরজা দিয়ে উঠে দরজার পাশে কোনো রকমে ঝুলে থাকলাম। মনে হচ্ছিল পড়ে যাব,কিন্তু কষ্টে টিকে গেলাম। এটাই সরাসরি যশোরের বাস। খানিকপর বাস সাতক্ষীরা বাসস্টপে থামল আর আমি সর্ব পেছনে একটা সিট পেলাম। পাশে একটা বাচ্চা,তারপর এক ভদ্র মহিলা বসেছেন। তিনি তার স্কুল পড়–য়া ছেলেকে বিভিন্নভাবে উপদেশ দিচ্ছিলেন। বোধহয় মাত্র কয়েকদিনের জন্যে কোথাও যাচ্ছেন । বললেন, সোনা ভাল করে সাবান দিয়ে শরীর ধুয়ে ঠিক মত ভাত খাবি। আলমারিতে পরিষ্কার শার্ট রেখে এসেছি,ওটা পরে স্কুলে যাবি। দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমাবি,কারো সাথে মারামারি করবি না। কি কি খাবে,কখন ঘুম থেকে উঠবে,কি করবে ইত্যাদী একের পর এক বলে গেলেন এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এরপর তার আরেক আত্মীয়কে বললেন,ছেলেটাকে দেখে রাখার জন্যে। তিনি অন্তত পনের মিনিট তার ছেলেকে কঠিন মমতায় বিভিন্নভাবে উপদেশ,নসিয়ৎ করলেন। শেষে বাস ছাড়লে আচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন।

বিষয়: বিবিধ

৩৩৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File