বালমোরাল টু চওডার বে-২
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৬ জুন, ২০১৩, ০৫:৩০:৪৪ বিকাল
এ মাঠের চারিদিকে পাহাড়। মাঠটা খুবই সমতল এবং সবুজ ঘাসে ঢাকা। মাঠের চারিদিকের পাহাড়টা গাছে ভর্তী। মনে হয় সু-উচ্চ সবুজ বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে মাঠের চারিদিকে। গাছগুলো বিশাল বিশাল। আমি মাঠটি পার হলাম এবং এপাশে স্টিলের ফ্রেমে মোটা শক্ত কাঠের তক্তা বসিয়ে সিড়ি বানানো হয়েছে। কিছুটা ওপরে উঠে একটু সমতল করা হয়েছে আবার সিড়ি,এভাবে পাহাড়ের মাথায় উঠে গেছে। এখানে চলার সময় অন্যরকম অনুভূতী হল। বামে ঘন জঙ্গল যেটা আর্মীদের জন্যে বরাদ্দকৃত এলাকা।
সেখানে বড় বড় বৃক্ষ রয়েছে। সিড়ির পাশ ধরে উঁচু তারের নেট দিয়ে বনটি ঘেরা। দেখলাম কয়েকটা বুনো খরগোশ দৌড়াদৌড়ী করছে। গাছের ডালে বসে বহু রকমের পাখি ডকাডাকি করছে। তবে কাকের ডাক শুনে গা জ্বলে গেল। ডাকটা মোটেও ভাল লাগল না।
এই সিড়ি কাম ব্রিজটির নীচের অংশে স্টিলের চৌকো পাত ব্যবহার কর হয়েছে,তাই নীচের অংশ ফাকা ফাকা। নীচে তাকালে দেখা যায় স্যাতসেতে একটা এলাকার ওপর দিয়ে চলেছি। চারিপাশে ছায়াঢাকা পরিবেশ এবং শুনশান নিরবতা। একা চললে গা ছমছম করতে পারে। আমার এমন পরিবেশ ভাল লাগে। সিড়ি দিয়ে পাহাড়ের ওপরে ওঠার খানিক পূর্বে দেখলাম চমৎকার একটা বাড়ি। বাড়র সামনে বড় আকৃতির কিছু রঙিন পাখি হাটাহাটি করছে নিশ্চিন্তে। খুব লোভ হল বাড়িটা দেখে। আরেকটু ওপরে উঠে দেখলাম ঘাস,ঝোপঝাড় তবে তা সুবিন্যস্ত। ভাল লাগল দেখে। একদমে উঠে হাফিয়ে গেছি। পিপাসার্ত লোকের কথা চিন্তা করে অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যেক জনবসতীপূর্ণ এলাকায় খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্লান্ত পথিকের জন্যে রাস্তার বিভিন্ন বাকে পানির ট্যাপ কল রয়েছে। এখানেও একটা দেখলাম,এটি বিশুদ্ধ পানি। তবে আমার ব্যাগের ভেতর পানি রয়েছে। আমি এত সহজে পানি খাইনা, তবে সময় হলেই খাব।
বামে মোড় নিলাম,আমি মিডল হেড রোডে আছি। এটা দিয়ে সামনে অগ্রসর হলেই দেখলাম রাস্তাটি ঢালু হতে শুরু করেছে। ঢালের নীচে বাস স্টপ,আমার আবার কোনো কিছুর জন্যে অপেক্ষা করতে ভাল লাগেনা। তাছাড়া আমার রস একটু বেশী তাই হাটতে থাকলাম। বামে সাগরের উঁচু পাড়ের কাছে দুটি বিশাল সবুজ মাঠ এগুলো নেট দিয়ে ঘেরা। সেখানে কিছু লোককে মজা করে ফুটবল খেলতে দেখলাম। ওটা আসলে আর্মীদের এলাকা। ডানে নেমে দেখলাম একটি বড় মাঠ,সমতল করে রাখা হয়েছে আর চমৎকার সবুজ ঘাস তো অবধারিত। মাঠের শুরুতে একটি বিরাট গাছ ছায়া দিয়ে আছে। এর পাশেই একটি রেস্টুরেন্ট,সেখানে কোনো অনুষ্ঠান চলছিল। মানুষের সম্মিলিত হাসাহাসি,চিৎকার শোনা গেল। মাঠের মাঝ বরাবর হেটে মাঠ পার হলাম। এপাশে একটি রাস্তা চলে গেছে। এপথে দুই বা আড়াই কিলোমিটার হাটলেই ‘চওডার বে’। মনের আনন্দে হাটছি। পায়ে কেডস,গায়ে স্পোর্টস ড্রেস,পিঠে ব্যাগ। নিয়ে ঝোলা,চলল ভোলা।
হঠাৎ সাদা রঙের একটা হুন্ডাই কার আমার পাশে এসে থামল। বাম পাশের উইন্ডোর গ্লাসটা নামিয়ে এক প্রবীন ভদ্র মহিলা বললেন, কোথায় যাবে ? উঠে পড়,তোমাকে নামিয়ে দিচ্ছি। আমি যে কোথায় যাব সেটা আমারও ভাল জানা নেই। রাস্তা যতদূর গেছে ততদূর গেলেও আপত্তি নেই। বললাম সামনে যাচ্ছি। তুমি যাও,আমি হেটেই ভাল বোধ করি। তিনি বললেন,আরে আমিও সামনে যাচ্ছি ওঠ ! কিছু লোকের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা যায়না। ইতি হলেন তেমনই। ক্যাসী নামক ভদ্র মহিলা চায়নিজ বংশোৎভূত একজন অস্ট্রেলিয়ান। এখানে আছেন চল্লিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে। তার দুই ছেলে মেয়ে পড়াশুনা করছে। তিনি একজন স্কুল শিক্ষক। সম্ভবত একারনেই বকবক করার একটা বাতিক আছে। গাড়িতে উঠলাম এবং চলতে থাকলাম।
আমার বাড়ী বাংলাদেশ শুনে বললেন,ওহ ওখানে তো আমার ছেলে থাকে। চিন্তায় পড়ে গেলাম, উনার ছেলে বাংলাদেশে থাকে কি কারনে ! নাম জানতে চাইলাম তিনি একটি মুসলিম নাম বললেন। ধাধায় পড়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,আপনি মুসলিম ? তিনি বললেন, না আমি খ্রীষ্টান,তবে আমার ছেলে মুসলিম। ওহ ! আপনার ছেলে ইসলাম গ্রহন করেছেন ? তিনি বললেন,না। সে আমার ছেলের মত। সে আমাকে মা বলে আর আমি তাকে ছেলের মর্যাদা দিয়েছি।
এবার তিনি তার ছেলেকে ফোন করলেন,তিনি তখন ঢাকায়। খানিক কথা বলে তিনি আমার কাছে মোবাইল ফোনটি দিয়ে কথা বলতে বললেন। আমি তার সাথে কথা বললাম। বেশ ভদ্র ছেলে। সিডনীতে বিবিএ পড়ছে। আমরা চওডার বে’তে আসলাম। তিনি আমার ফোন নাম্বার নিলেন এবং নিজেরটা দিলেন। তার সাথে লাঞ্চ করতে বললেন। আমি সবিনয়ে অ-সম্মতি জ্ঞাপন করলাম। তিনি বললেন,এখানে আমার কাজ খুব বেশীক্ষনের নয়,খানিক পর আমার কাজ শেষ হবে। তারপর তুমি আমাকে ফোন করে তোমার অবস্থান জানাবে,আমি তোমাকে নিয়ে যাব। আর তুমি ফোন না করলেও আমি ফোন করব। তিনি আমাকে দিক নির্দেশনা দিলেন কোথা থেকে কোথায় গিয়ে কি দেখব ইত্যাদী। ঠিক আছে বলে নেমে পড়লাম।
আমি চওডার বেতে আসলাম। এটা খুব ছোট তবে দেখতে দারুন। পাড়ে গাছগাছালী ভরা। তবে আজ এখানে একটা মরা মানুষও আসেনি। এটা অনেক দূরের জায়গা তাই সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া এখানে মানুষ আসতে চায়না। এটা মসমানের শেষ অংশ। মানুষ সাধারনত বালমোরালে যায়। আমি এখানকার একটি স্কুভা ডাইভিং একাডেমীতে আসলাম। দেখলাম অনেকে পোষাক পরে সাগরে ডুব দিচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার খায়েশ মিটে গেল।
এবার মহা সতর্কতায় পা ফেলে ফেলে সামনে অগ্রসর হলাম(ঘুমন্ত কুত্তার পাশ দিয়ে টম যেভাবে সতর্কতারসাথে হাটে)। দেখার চেষ্টা করলাম সে মহিলার গাড়ী পার্ক করা আছে কিনা। দেখলাম গাড়ী যথা স্থানেই আছে। তারমানে আরও সতর্ক হতে হবে যাতে আমাকে না দেখে ফেলে। আমি বেশ দূর থেকে দেখলাম তিনি প্রায় ৭/৮ফুট ওপরে থাকা একটি রেস্টুরেন্টের খোলা বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছেন। এবার আমি রাস্তা থেকে সরে সেই রেস্টুরেন্টের বারান্দার নীচের দিকটাতে আসলাম মাথাটা নীচু করে আস্তে আস্তে কেটে পড়লাম যাতে তিনি আমাকে দেখতে না পান। পার হয়ে গেছি দেখে অন্তত ৩০০ মিটার জোরে দৌড় দিলাম। তারপর হাটতে থাকলাম। খানিক পর পেছনে গাড়ির শব্দ শুনে রাস্তার পাশের এক বাগানে ঢুকে গেলাম,কিন্তু না তিনি নন।
আমার মনে হচ্ছিল ভদ্র মহিলা আমাকে পেলে আমার দিনটা মাটি হবে। তার গল্পের ঠেলায় আমি হয়ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠব কিন্তু মুখে হাসি নিয়ে বিষয়টা চেপে যাব। আমি যখন রাস্তার মাথায় সেই সবুজ ঘাসের মাঠে উপস্থিত,তখনই আমার মোবাইলটা বেজে উঠল। ভদ্র মহিলা বললেন,আমার কাজ শেষ,তুমি কোথায় ? আমি বললাম,আমি তো বহু আগেই চলে এসেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। প্রকৃতি দর্শনের সময় না হয়ে অন্য কোনো সময় হলে আমি তার সাথে কথা বলতে রাজি ছিলাম। আমি এতটা অভদ্র নই যে,তাকে কোনোভাবে ছোট করব। তিনি নির্দিধায় একজন ভাল মনের মানুষ। সম্ভবত কথা বলার লোকের অভাবও তার থাকতে পারে। তবে অন্য কোনো দিন হলে আমি তার সাথে হয়ত কথা বলতে পারতাম। আর আমার গল্প করার অভ্যাস কম থাকার কারনে পালিয়েছিলাম। সেদিন আমার হাটতেই ভাল লাগছিল।
আমি বাসের জন্যে অপেক্ষমান থাকলাম না,কারন মনে হচ্ছিল তিনি চলে আসতে পারেন। আমি দ্রুত পায়ে হাটতে শুরু করলাম। আমার মনে হল আমি রাস্তার প্যাচের কারনে পথ ভুল করে অনেক দূর দিয়ে গন্তব্যে পৌছাচ্ছি। আমি একাধারে ঘন্টাখানিক হেটেও মসমান জংশনে পৌঁছাতে পারলাম না। কয়েকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে তবে আসলাম এবং এখান থেকে আবারও পচিশ মনিট হেটে তবে ফেরী ঘাটে আসলাম।
আমি খানিকক্ষন দৌড়েছিলামও,তখন আমার ব্যাগের ভেতরে থাকা কয়েনের সংস্পর্শে আমার ক্যালভিন ক্লেন ঘড়িটার কাচ ভেঙ্গে গেল। আরও পরে দেখলাম আমার সানগ্লাসটর এক অংশ ভেঙ্গে গেছে। দুঃখিত হলাম,আমার মনে ছিলনা ওগুলো ব্যাগের একই পকেটে ছিল।
সময় তখন বিকেল,যখন ফেরীঘাটে আসলাম। এক বুড়োকে ঘাটের এক বেঞ্চে বসে থাকতে দেখলাম। এই বুড়োকে সার্কুলার কীতে দেখেছি একই অবস্থায়। লোকটা পাড় মাতাল। সব সময় বোতল একটা পাশে রাখা আছে,চোখ তার লাল টকটকে। সর্বদা ক্লান্ত দেহে টলছে। সহসা ঘুমায় বলে মনে হলনা। বোধহয় বোতল ছাড়া ইহজগতে তার আর কেউ নেই। আজ সারাদিন এত হেটেছি যে ক্ষুধায় কাতর হলাম। এখানে খাবারের দাম এত বেশী যে সেগুলো দিয়ে পেট ভারানো যথেষ্ট বিলাসীতা। সাধারনত সস্তা জিনিসই কিনে খেতাম,অবশ্য সে সস্তা অতটা সস্তা নয়।
আমি এতটা না হাটলেও পারতাম,কারন প্রত্যেকটি স্থানে বাস ছিল। আমি পনের বা বিশ মিনিট অপেক্ষার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ঘন্টার পর ঘন্টা হেটেছি। ফেরীঘাটে এসে দেখলাম এক মধ্যবয়সী লোক এবং মহিলা দাড়িয়ে আছে। লোকটার গায়ে নীল শার্ট,ফেরীর লোকদের মত। উভয়ের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলাম টয়লেট কোন দিকে ? দুজনের মধ্যে ভদ্রমহিলা আমাকে সাথে নিয়ে টয়লেটের কাছে আসলেন এবং নিজে টয়লেটের কাছে এসে বললেন, আমাকে দেখতে দাও কন্ডিশন কেমন। তিনি ভেতরে ঢুকে বের হয়ে এসে বললেন,হ্যা মোটামুটি ভাল,তুমি যেতে পার। তার আচরনে মুগ্ধ হলাম। ফিরে এসে দেখলাম তিনি দাড়িয়ে আছেন। বললাম পরবর্তী ফেরী কখন ? তিনি আমাকে নিয়ে সময়সূচী লেখা আছে এমন একটি বোর্ডের কাছে আসলেন। ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন আজকের শেষ ফেরী কখন এবং পরবর্তী ফেরী কয়টায় ছাড়বে।
বেশ খানিকক্ষন পর ফেরী আসল। তখন আমি বুঝতে পারলাম এরা ফেরীর লোক নয়। আমি এতক্ষণ এদের সার্ভিস দেখে ভাবছিলাম এরা বুঝি এখানে কর্মরত এবং এভাবে সকল বিষয়ে সার্ভিস দেওয়ার জন্যে নিয়জিত। আহা ভাল মানুষ এরা। খুব উপকারী।
বিষয়: বিবিধ
২৫১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন