দ্য বন্ডিং
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০১ জুন, ২০১৩, ১১:০৪:০০ সকাল
বিকেলে বাসায় ফিরলাম। প্রতিদিন বিকেলে আমার নাতীর ডিমান্ড হল- গাইছ। সে যেসকল কথা বলে তার মধ্যে অযাচিতভাবে ই যোগ করে। এতে বাক্যটি ব্যকরনের নিয়ম অনুযায়ী ভূল হলেও অসাধারণ শিল্পগুণ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তখন মনে হয়, এই অতিরিক্ত ই ছাড়াই বরং বাক্যটি অচল। বিকেলে সে নিজের জুতো জোড়া নিয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করে এবং বলে-‘নানা গাইছ’। এর অর্থ হল,বাইরে গিয়ে গাছপালা,পশু-পাখি দেখবে।
যেদিন বিকেলে ফিরতে পারিনা সেদিন শুনি,সে জুতো জোড়া নিয়ে অস্থির হয়ে আমার ঘরের সামনে পায়চারী করেছে। কখনও কখনও সে বিরক্ত হয়ে নীচে নেমে আসার চেষ্টা করে। তবে একবার সিড়ি দিয়ে পড়ে ব্যাথা পাওয়ার কারনে সিড়ির দুমাথায় বিশেষ দরজা লাগালো হয়েছে যাতে সে সেটা বেয়ে নামনে বা উঠতে না পারে। বেশ কয়েকবার দেখেছি আমার অপেক্ষায় থেকে বিরক্ত হয়ে শেষটায় সে তার মাকে নিয়ে বাড়ির সামনে চলে এসেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে আমাকে খোঁজার চেষ্টা করছে। আর যখন দেখত আমি আসছি। ছোট ছোট পায়ে সর্বোচ্চ গতি নিয়ে দৌড় দিয়ে আমার কাছে আসার চেষ্টা করত। আমি তখন তার চেয়ে বেশী জোড়ে দৌড়ে তাকে কোলে তুলে নিতাম। সে জানে আমি তার পছন্দের স্থানে নিয়ে যাব,আর আমি জানি তার কি ভাল লাগে।
আমরা প্রথমে বাড়ির কাছের হাল্লিনান পার্কে যেতাম। এ পার্কের মাঝে বিশাল একটা গাছ আছে। তার ছায়ায় রয়েছে কিছু খেলার সরঞ্জাম। যারা দড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে চায় তাদের জন্যে এখানে স্টিলের বড় একটি ফ্রেমের সাথে মোটা শক্ত সিনথেটিক দড়ি স্টিলের ক্লাম্পের সাথে যুক্ত করে জাল তৈরী করা হয়েছে। দড়িগুলো ছোটছোট অংশে একটার সাথে আরেকটা যুক্ত। যেকোনো দিক থেকে দড়ির ওপর দিয়ে একেবারে ওপরে ওঠা যায়। বাচ্চাদের ব্যায়ামের জন্যে এটা ভাল। মাকড়শার জাল তৈরী করা হয়েছে একই রকম দড়ি দিয়ে। তার মাঝে একটি মাকড়শাও তৈরী করা হয়েছে। বাচ্চারা এটাতে উঠে। এক পাশে ট্রেন স্টেশন তৈরী করা আছে এবং সেখানে তারা খেলনা ট্রেনে বসে খেলা করে। বিভিন্ন রকম বল কয়েকটি লোহার শিকের মধ্যে গাথা রয়েছে,একটি সুড়ঙ্গ তৈরী করা হয়েছে এবং ছোট ঘরও তৈরী করা হয়েছে। ছোট এবং বড়দের জন্যে দোলনাও রয়েছে। কেউ পড়ে গিয়ে যাতে ব্যাথা না পায় তার জন্যে মেঝেতে নরম এক ধরনের ম্যাট ব্যবহার করা হয়েছে,যা দেখলে মনে হবে কংক্রিট কিন্তু আসলে রাবার জাতীয়।
পার্কের একপাশে একটি বড় লাইব্রেরী রয়েছে এটির ডিজাইন খুবই চমৎকার। যে কেউ দেখলে এখানে ঢুকতে চাইবে। এটির ডিজাইন করেছে একজন বাঙ্গালী। এখানকার সকল লাইব্রেরীতে যে কেউ ঢুকতে পারে এবং পড়াশুনা করতে পারে। বিশাল শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই লাইব্রেরীটির ভেতরের অংশ মূল্যবান কাঠ,স্টিল ও কংক্রিটের তৈরী। সেখানে থরে থরে সাজানো বহু রকমের বই এবং ভিডিও সিডি। আরামে পড়ার জন্যে রয়েছে সোফা এবং চেয়ার। রয়েছে অতি নিরিবিলি পরিবেশ। যে কেউ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে ,এটি ফ্রী। তবে প্রতি পাতা প্রিন্ট নিতে দশ সেন্ট করে দিতে হয়। লাইব্রেরীর সিড়ির থেকে পার্ক শুরু। এটি ছোট পার্ক।
এই পার্কে আরও বেশ কয়েকটি শিশু খেলতে আসত। অন্য শিশুদের দেখে তার আনন্দের সীমা থাকত না। আমি স্টিলের বার ধরে ঝুলতাম,পুশআপ করতাম,সে আমাকে অনুকরণ করে ব্যর্থ হত। কিছু ম্যাগপাই এখানে ঘুরত,সে পাখিগুলোর কাছে গিয়ে ধরতে চাইত। পার্কের পাশে পার্ক করে রাখা গাড়িগুলোর চাকা ধরে ঘোরানোর চেষ্টা করত। বাড়িতে সে খাবার টেবিলের ওপর বসে ফল,খেলনা,মগসহ ছোট ছোট যেকোনো কিছু দারুনভাবে ঘুরাতে পারে। ছোট হাতের তালুটা চমৎকারভাবে একদিকে নিয়ে জোরে কব্জীটা ঘুরিয়ে ছেড়ে দেয়,এতে কাপটা টেবিলের ওপর ঘুরতে থাকে। এটা দেখতে তার ভাল লাগে। একই চিন্তাকে প্রশস্ত করে সে গাড়ির চাকা ঘুরাতে চায়। বাচ্চাদের দেখলে তার হুশ থাকেনা,সে তাদের কাছে যায় এবং দারুনভাবে তাদের হাত ধরে এবং মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।
এরপর আমরা রেলওয়ে স্টেশনের কাছের রাস্তা ধরে হাটতাম। তাকে ট্রলীতে বসিয়ে আমি ঠেলতাম আর বিভিন্ন জিনিস দেখাতাম একইসাথে সেগুলোর নাম বলে তার মুখ থেকে জানার চেষ্টা করতাম। সেসব জিনিজের নামের মধ্যে ই না থাকলেও সে নিজ দায়িত্বে তা বসিয়ে দিত। চলন্ত ট্রেন দেখে সে মজা পেত। আমি ছোটবেলায় এসব জিনিস দেখিনি। দেখলে আমি খুব মজা পেতাম। আমরা মূল সড়কের পাশের চমৎকার ফুটপাথ ধরে চলে যেতাম যতদূর ভাল লাগে। হাটতে আমার ভাল লাগে তাই থামতাম না। কয়েক কি:মি: চলে যেতাম। কখনও কখনও ভেতরের কোনো সরু রাস্তা ধরে হেটে যেতাম। চমৎকার মসৃন সেসব রাস্তায় হাটতেও ভাল লাগে। দেখতাম রাস্তার ওপর কারো বাড়ির ফলবান বৃক্ষ থেকে কিছু ফল এসে ঝুলছে। বেশ কয়েকবার লাফ দিয়েও ধরতে পারিনি। সরু চমৎকার কোনো ড্রেনের পাশ দিয়ে,বাগান,পার্কের পাশ দিয়ে হেটে যেতাম।
হাটতে হাটতে চলে আসতাম আদীবাসীদের ঘোড়ার খামারে। কয়েকটি ঘোড়ার খামার রয়েছে এখানে। খামারের পাশে খানিক দাড়ালে বহু দূর থেকে কোনো একটা বিশাল আকৃতির ঘোড়া অবোধ বালকের মত তাকিয়ে থাকত। এরপর কোনো এক দূর্বোধ্য কারনে আমাদের বরাবর হাটতে থাকত। লোহার বারের সাথে সরু তারের সাহায্যে বেড়া তৈরী করা হয়েছে,যাতে ঘোড়ারা বের হয়ে না যায়। প্রথমবার আমি বিশ্ময়ে আবিভূত হয়েছিলাম ,কারন একটা জন্তু মানুষ দেখে কয়েকশ মিটার পথ হেটে কাছাকাছি আসতে পারে ! মজার ব্যাপার হল,প্রথম ঘোড়াকে অনুসরন করল তার কাছাকাছি থাকা অন্যান্ন ঘোড়াগুলো। তারা খুব কাছে চলে আসছে দেখে আমার নাতি সমৃদ্ধ ট্রলিটাকে বেশ দূরে রেখে আসলাম যাতে ঘোড়া তার নাগাল না পায় এবং তারও ঘোড়াগুলোকে দেখতে অসুবিধা না হয়। তবে এজাতীয় ক্ষেত্রে আমি মাত্রাতিরিক্ত সাবধান। আমি যেখানেই থাকি ট্রলির চাকা লক করি এবং ট্রলি এমন স্থানে রাখি যাতে সমস্যা না হয়।
ঘোড়াগুলো আমার কাছে এসে মাথা এগিয়ে দিত। আমি একটু ভয়ে ভয়ে মুখের সামনে না থেকে বরং মাথার পাশের দিকটাতে এসে মাথায়,ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিতাম। তারা এটা উপভোগ করত। আমার মনে হত এরা কামড় দিতে পারে আর সেটা মারাত্মক হতে পারে। কিন্তু মানুষের মত এরা আচরনে মারাত্মক নয়। কখনও কখনও তারা এমন আচরণ করত,যেন বাইরে বের হয়ে আসবে। সবগুলো ঘোড়া মাথা যতদূর সম্ভব বাইরে বের করে দাড়িয়ে থাকত। ঘোড়াগুলোর পিঠের উচ্চতা প্রায় আমার মাথার সমান।
আমি কল্পনা করতাম এরা যদি আমাকে আক্রমন করে বা কোনোভাবে বাইরে বের হয়ে আসে,তাহলে আমার ভূমিকা কি হবে ? এখানে কোনো লোকজন চোখে পড়ত না। পাশের প্রশস্ত রাস্তা ধরে অনেক সময় পরপর গাড়ি চলে যায় দ্রুত বেগে। তখন নিজের মনেই ভাবতাম,ঘোড়া আক্রমন করলে যুদ্ধ করে যাব যতটুকু সাধ্য আছে। আর সর্বপ্রথম ট্রলিটাকে ঠেলে দূরে রেখে আসব আর আমি অনেক দূরে এসে ঘোড়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হব। তবে ঘোড়ারা মানুষের স্বভাবের নয়। এরা আক্রমন করে না,যতক্ষন না প্রচন্ড বিরক্ত হয়,তবে প্রচন্ড বিরক্ত হলেও বেশীরভাগ সময় পালিয়ে যায়। আর ঘোড়ার সে রাগ প্রদর্শনে বড় জোর একটা লাথি বা কামড় দেয়। এরা রেসলারদের মত যুদ্ধে লিপ্ত হয়না। আর ফার্মের ঘোড়াগুলো ফার্মের মুরগীর মত বোকাসোকা হয়ে থাকে। এরা কখনও কারো দ্বরা খারাপ আচরনের মুখোমুখি হয়নি,ফলে এরা শত্র“তার ব্যাপারটি এখনও জানেনা। এ কারনেই মানুষকে দেখে কৌতুহলী হয়ে এরা গায়ের সাথে গা মেলাতে আসে। আমি যতক্ষণ দাড়িয়ে থাকতাম ততক্ষনই তারা আমার কাছাকাছি দাড়িয়ে থাকত। এমনকি ঘাস খাওয়া ছেড়ে তাকে ওভাবেই দাড়িয়ে থাকতে হবে। শেষে আমি বেড়ার পাশ দিয়ে হাটতে থাকলে তারাও ওপাশ দরে হাটতে হাটতে অগ্রসর হত। আমি দাড়িয়ে পড়লে তারাও দাড়িয়ে পড়ত। দারুন মজার ব্যাপার।
শিশুরা নতুন নতুন জিনিস দেখতে পছন্দ করে। আমি আমাকে দিয়ে তাদেরকে বিচার করি। ছোটবেলায় আমি এসব খুব পছন্দ করতাম। আর বারবার একই জিনিসে তারা অনেক সময় বিরক্ত হয়। তাই আমি নানামুখী বৈচিত্র আনতাম। যেদিক দিয়ে যেতাম সাধারনত সেদিক দিয়ে ফিরতাম না। ভিন্ন রাস্তা ধরে ফিরতাম। আমি লক্ষ্য করেছি আমার নাতি আমার ছোট খাট এসব নিয়ম কানুনে বেশী মজা পেয়েছে। বাচ্চাদের সাথে যখন আপনার সুন্দর একটা বোঝাপড়ার সৃষ্টি হবে,তখন আপনি সত্যিই আনন্দ পাবেন।
সব ভাল জিনিসের মধ্যে খুঁজলে কিছু খারাপ ব্যাপার তো পাওয়া যায়। সব লাভের মধ্যে কিছু লস তো মেনে নিতে হয়। সব আনন্দের মধ্যে কিছু নিরানন্দেরও বসবাস। নাতিকে নিয়ে ইয়াং নানা হেটে চলেছে। রাস্তাঘাট,পার্কের লোকেরা ভাবত পিতা তার পুত্রকে নিয়ে হেটে চলেছে। এর বিকল্প চিন্তা তাদের মাথায় আসা সম্ভব ছিলনা। তাদের আচরন দেখে বুঝতে কষ্ট হতনা। আমার দিকে অবিবাহিত মেয়েদের তাকানো দেখে বুঝতাম তাদের দৃষ্টিতে কোন ধার নেই। অবশ্য আমি এদেশে দৃষ্টি শক্তির যথেষ্ট হেফাজত করেছি। আল্লাহ আমাকে দেখছেন,এ অনুভূতী আমার মধ্যে সদা সর্বদা জীবন্ত।
বিষয়: বিবিধ
২৬৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন