ইসলামে ব্যভীচারের শাস্তি !!!

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৫ মে, ২০১৩, ০৯:৪১:১৬ সকাল



২. ব্যাভীচারের শাস্তিঃ

“আর ব্যাভীচারের কাছেও যেওনা। নিশ্চয়’ই এটি অশ্লিল এবং নিকৃষ্ট আচরণ।”

(আল-কুরআন,১৭ঃ৩২)

ব্যাভিচারী ব্যক্তি অবিবাহিত হলে ১০০ বেত মারা হয় এবং এক বছরের নির্বাসন। আর বিবাহিত হলে তাকে রজম (বিশেষভাবে দেওয়া মৃত্যু দন্ড) দেয়া হয়। ইসলামী আইনে প্রত্যেকটা শাস্তির উদ্দেশ্য থাকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যাতে এজাতীয় ঘটনা পূণরায় না ঘটে। জনগণকে শাস্তি দেওয়াটা উদ্দেশ্য নয়। শাস্তি দেওয়ার মধ্যে খলিফার কোন কৃতিত্ব নেই। ইসলাম মানুষকে শাস্তি দিতে আসেনি, সে এসেছে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য শেখাতে। আর শাসক শ্রেণীর চরিত্রের ব্যাপারে পূর্বেই বলা হয়েছে যে, শাস্তির বিধান শাসকের নিজের ক্ষেত্রে যেমন, জনগনের ক্ষেত্রেও তেমন। তাই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অন্যায় খুব কম মাত্রায় ঘটতে দেখা গেছে বা যায়। আর স্বজনপ্রীতি না থাকার কারনে জনগণও সদা তটস্থ থাকে।

ইসলামে অন্যায়ের পরিমান ও সমাজে এর প্রভাব দেখে প্রকাশ্যভাবে শাস্তি দেয়া হয়, যাতে অন্যরা এটা দেখে এ জাতীয় অন্যায় করতে সাহস না করে। আর একই সাথে আত্মীক শুদ্ধির ব্যাপারটা এর সাথে যুক্ত থাকে, যা অন্য জাতির মধ্যে দেখা যায় না। অর্থাৎ শাসকের পক্ষ থেকে শাস্তির ভয় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে (যিনি প্রকাশ্য এবং গুপ্ত উভয় অবস্থাতে কৃত কর্ম প্রত্যক্ষ করেন) শাস্তির ভয় কাজ করে। আর অপরাধ থেকে বিরত থাকলে আল্লাহর পক্ষ থেকে অপরিসীম পুরষ্কার প্রাপ্ত হবে। এসব বিষয় জনগণকে একদিকে অপরাধের ব্যাপারে সাবধান করে অন্যদিকে অপরাধ না করার ফলে চিরস্থায়ী শান্তির ব্যাপারটা তাকে আত্মিক শান্তি দান করে আর এর ফলাফল হচ্ছে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শান্তি ও সমৃদ্ধি।

পূর্বের সময়ে দেখা গেছে আল্লাহর শাস্তির ভয়ে ভীত হয়ে অপরাধী কঠিন শাস্তির বিধান জেনেও বিচারকের কাছে এসে নিজের শাস্তি দাবী করেছে যেমন ঃ

“আবু হোরায়রা(রাঃ)থেকে বর্নিত,একদা এক ব্যক্তি রসূল(সাঃ) এর কাছে আসলো, রসূল(সাঃ) তখন মসজিদে ছিলেন। সে এসে চিৎকার দিয়ে বললো ,ইয়া রসূলুল্লাহ ! আমি ব্যাভীচার করে ফেলেছি। রসূল(সাঃ)তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ঐ ব্যক্তি পূণরায় রসূলের মুখের কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে বললো, ‘ইয়া রসূলুল্লাহ ! আমি ব্যাভীচার করে ফেলেছি।’ এবারও রসূল (সাঃ) তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, তখন সে একই ভাবে স্বীকার করলো। এভাবে সে চার বার উচ্চস্বরে তার পাপের কথা স্বীকার করে নিজের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করলো। এরপর রসূল(সাঃ) বললেন,তোমার মধ্যে পাগলামী ও উম্মাদনার কোন রোগ আছে কি ? সে বললো ,না। তুমি কি বিবাহিত ? সে বললো, হ্যাঁ । রসূল(সাঃ) তখন বিভিন্ন ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, সে সত্যিই ব্যাভীচার করেছে কিনা তা নিশ্চিত হবার জন্য। উক্ত ব্যক্তি বার বার স্বীকার করলো তার পাপের কথা। এরপর তাকে রজমের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় । (সহীহ্ বুখারী)

মায়াজ (রাঃ) ব্যাভীচার করেছিলেন কিন্তু এর কোন সাক্ষী ছিলনা। কিন্তু এ পাপের ভয় তার কাছে অসহনীয় ছিল। তিঁনি হযরত আবুবকর(রাঃ)এর কাছে এসে বললেন ,‘আমি ব্যাভীচার করেছি।’ আবুবকর (রাঃ) বললেন ,‘আমি ছাড়া অন্য কারো কাছে এটা প্রকাশ করেছ কি ?’ সে বললো ,‘না’। আবুবকর(রাঃ) বললেন, ‘তবে তুমি বাড়ী যাও এবং আল্লাহর কাছে তওবা কর, আল্লাহ এটি গোপন থাকার যে সুযোগ দান করেছেন সে সুযোগ গ্রহন করে তুমি তা গোপন রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ তার বান্দার তওবা কবুল করে থাকেন।’

এ কথায় মায়াজের মনে শান্তি আসলো না। তিঁনি হযরত ওমর(রাঃ)এর কাছে গেলেন এবং একই রকম বললেন। ওমর(রাঃ)ও আবু বকরের মত পরামর্শ দিলেন। কিন্তু মায়াজের মনে শান্তি আসলো না। তিঁনি স্বয়ং রসূল(সাঃ) এর কাছে গেলেন এবং বললেন,‘আমি ব্যাভীচার করেছি,আমাকে পবিত্র করুন ! ইয়া রসূলুল্লাহ ! আমি ব্যাভীচার করেছি আমার উপর কুরআনের বিধান প্রয়োগ করুন ! ইয়া লাসুলুল্লাহ ! আমি আমার সর্বনাশ করেছি,আমার আকাঙ্খা- এখন আপনি আমাকে পাক পবীত্র করবেন।’রসূলকে(সাঃ) অনড় দেখে তিঁনি রসূলের(সাঃ) হাতে হাত রেখে বললেন ,আমাকে রজমের শাস্তি দিয়ে পবীত্র করুন !

রসূল(সাঃ) বললেন,‘ধিক তোমার প্রতি ! চলে যাও এখান থেকে !! আল্লাহর কাছে এব্যাপারে তওবা কর।’ এই বলে রসূল(সাঃ)তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং তাঁকে তাড়িয়ে দিলেন (যাতে তাঁর মধ্যে অপমান বোধ প্রবল হয়ে ওঠে এবং সে চলে যায় আর তাঁর জীবন রক্ষা হয় তওবার মাধ্যমে) । কিন্তু মায়াজ (বেশ কিছুদিন) পরে আবার উপস্থিত হয়ে নাছোড়বান্দার মত একই আরোজ করলো। এবারও রসূল(সাঃ)তাকে তাড়িয়ে দিলেন যাতে সে ফিরে গিয়ে তওবা করতে পারে। এরপর যখন মায়াজ আবার আসলো তখন সাহাবারা বললেন ,তুমি ফিরে না গেলে তোমাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হতে পারে। কিন্তু কোন ভয় ভীতিই মায়াজকে দমাতে পারলো না। সে আবার একই আরোজ করলো।

রসূল(সাঃ)বললেন, ‘কি ব্যাপারে তোমাকে পাক করবো ?’(তিঁনি এমনভাবে বললেন, যেন তিনি একথা প্রথম শুনলেন) মায়াজ বললো,ব্যাভিচারের পাপ হতে পাক করবেন। রসূল(সাঃ)বললেন,তুমি কি উম্মাদ ? সে বললো ,না। রসূল(সাঃ) তখন যাচাই করলেন যে, সে নেশাগ্রস্থ কিনা। তার নির্দেশে একজন পরিক্ষা করলো কিন্তু বোঝা গেল- সে নেশাগ্রস্থ নয়। রসূল(সাঃ) তখন তার সাথে পরিচিত এমন লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন ,সে উম্মাদ কিনা। তারা বললো ,সে উম্মাদ নয়,সে বিবাহিত। এর পর রসূল(সাঃ) নিশ্চিত হয়ে রজমের শাস্তি দিলেন।

তাঁকে ঈদগাহের খোলা ময়দানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং তার উপর পাথর নিক্ষেপ করা হলো। সাহাবারা পাথর নিক্ষেপ করে অপেক্ষা করছিলেন যে, সে তার স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করে কিনা। কিন্তু পাথর নিক্ষিপ্ত হওয়া সত্বেও মায়াজ উচ্চস্বরে তার ব্যাপারে স্বীকৃতি দিচ্ছিল ফলে আর কোন উপায় থাকলো না। অথচ সে একবার তার এ দাবী প্রত্যাহার করলেই শরীয়াতের বিধান মতে এ শাস্তি স্থগিত করা হতো। কিন্তু মায়াজ তা করেননি। এভাবে সে মৃত্যুবরণ করে।

মায়াজের মৃত্যুর পর রসূল(সাঃ)বলেন ,‘তোমরা মায়াজের জন্য দোয়া কর,সে এমন তওবা করেছে যে,তার তওবা সমাজের সকল লোকের মধ্যে বন্টন করে দিলে তাদের সকলের পাপ

মাফ হয়ে যেত।’ এরপর তিঁনি বললেন “মায়াজের সকল গোনাহ মাফ হয়ে গেছে এবং তাকে বেহেশ্তে প্রবেশ করানো হয়েছে। আমি তাকে বেহেশতের নহর সমূহের মধ্যে অবগাহন করতে দেখেছি। তাকে মন্দ বলোনা,সে আল্লাহর কাছে মেশ্ক ও কস্তুরীর সুগন্ধি অপেক্ষা প্রিয়।”( সহীহ্ বুখারী)

“নবম হিজরীতে গামেদ গোত্রের এক নারী রসূল(সাঃ)এর কাছে এসে বললেন,ইয়া রসূলুল্লাহ(সাঃ) ! আমি ব্যাভীচার করেছি,আপনি আমাকে পাক করুন। রসূল(সাঃ)তাকে তিরষ্কার করে বললেন,চলে যাও এবং তওবা কর। উত্তরে মহীলা বললেন,আমি জানি আপনি আমাকে এড়িয়ে যেতে চান,যেরুপ মায়াজকে এড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার ব্যাপারটি অতি জটিল,আমি ব্যাভীচারের মাধ্যমে গর্ভবতী হয়েছি। এই মহিলাটিকে রসূল(সাঃ)তিন বার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু সে চতুর্থবার এসে একইভাবে স্বীকার করলো এবং নিজের শাস্তি দাবী করলো। রসূল(সাঃ)বললেন,গর্ভধারণ অবস্থায় তোমার কিছুই করা যাবে না,তুমি চলে যাও ,ক্ষ্যান্ত থাক,সন্তান প্রসব কর। নির্ধারিত সময় শেষে তাঁর সন্তান হলো,তখন সেই মহিলা সন্তানকে কাপড়ে জড়িয়ে আবার রসূল(সাঃ)এর কাছে আসলেন এবং নিজের শাস্তি দাবী করলেন। রসূল(সাঃ)তাকে বললেন চলে যাও এবং সন্তানকে দুধ পান করাতে থাক। এ মহিলাটি তার পরও ক্ষ্যান্ত হলো না, তিনি দীর্ঘদিন পর আবার আসলেন তখন তার সন্তানের হাতে এক টুকরো রুটি ছিল। তিনি রসূল(সাঃ)কে বললেন এই দেখুন,তার দুধ পানের সময় শেষ হয়েছে,সে এখন খাবার খেতে পারে। রসূল(সাঃ)বললেন,এখন চলে যাও এবং এই শিশুকে কারো আশ্রয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। অতঃপর শিশুটিকে একজনের দায়িত্বে দিয়ে উক্ত মহিলা আবার আসলেন এবং নিজেকে পাক করে দিতে বললেন। এ সূদীর্ঘ সময়ের মধ্যে মহিলাটি তার সিদ্ধান্ত বদলায়নি। অথচ তিনি তার স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করলে তার শাস্তির আদেশ বলবৎ হতো না। তার বার বার স্বীকারোক্তির কারনে তাকে রজমের শাস্তি দেওয়া হয়। তাকে প্রস্তর বর্ষনের সময় এমন ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করা হয়, যাতে সে তার স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের চিন্তা করে,কিন্তু উক্ত মহিলার মধ্যে ভয়ের কোন চিহ্ন দেখা গেল না। রজমের শাস্তি কার্যকর হলো।

রসূল(সাঃ) জানাজা পড়ালেন। সাহাবারা বললেন আপনি এমন একজনের জানাজা পড়লেন,যে ব্যাভীচার করেছে। রসূল(সাঃ)বললেন(ধমকের সাথে) থাম ! সে এমন তওবা করেছে ,যা মদীনা বাসির মধ্যে বন্টন করা হলে এবং পাপীর সংখা সত্তুর(অসংখ্য অর্থে) হলেও তাদের পাপ মাফ হয়ে যেত।”

( সহীহ্ বুখারী)

ব্যাভীচারীর শাস্তি সংক্রান্ত বিধানঃ

১.ব্যাভীচার সাক্ষী সূত্রে প্রমানিত হওয়ার জন্য চার জন পুরুষ প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ প্রয়োজন হয়(এ সাক্ষ সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম,কারণ সাধারনতঃ কোন বিষয়ে সাক্ষ দেওয়ার জন্য দুই জন পুরুষ অথবা চার জন নারীর সাক্ষ প্রয়োজন হয়)।

২. স্বীকৃতি সূত্রে দোষী সাব্যস্তের জন্য ব্যাভিচারকারী চারটি পৃথক বৈঠকে চার বার উক্ত পাপের কথা স্বীকার করবে।

৩. শাসনকর্তা বা বিচারক তিনবার পর্যন্ত ব্যাভিচারকারীকে এড়ানোর চেষ্টা করবে,এমনকি স্বীকারকারির স্বীকৃতিকে অন্য দিকে,অন্য অর্থে গ্রহন করার চেষ্টা করবে(অর্থাৎ সম্ভবতঃ তোমার ব্যাভীচার হয়নি,তুমি মিথ্যা বলছো,অথবা তোমার মাথায় কোন সমস্যা আছে,অথবা তোমার কাজ ব্যাভীচারের কাছাকাছি গেছে সম্ভবতঃ ব্যাভীচার হয়নি ,তুমি আরও ভালভাবে ভেবে দেখ ইত্যাদি।)

৪. চার বার স্বীকারোক্তির মধ্যে যদি একবারও স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে তবে রজমের শাস্তি মওকুফ হবে। এমনকি যদি মুখে স্বীকার না করে শাস্তির ভয়াবহতায় পালাতে চেষ্টা করে এবং সেটা যদি শাস্তির আঘাতজনিত পালানো না হয়ে স্বীকৃতি প্রত্যাহার বা এড়ানোর চেষ্টা হয়,তবে অবশ্যই তাকে পালানোর সুযোগ দেওয়া হবে। অবশ্য প্রত্যক্ষদর্শীর মাধ্যমে সাক্ষের ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমানিত হলে এ সুযোগ দেওয়া হবে না।

৫. এ শাস্তি দেওয়া হবে প্রকাশ্যে,জনসম্মুখে।

মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তি ঃ

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “যারা সতী নারীদের প্রতি অপবাদ দেয়,অতঃপর চার জন সাক্ষী উপস্থিত করতে সক্ষম হয় না,তাদেরকে ৮০(আশি) ঘা বেত্র দন্ড প্রদান কর এবং আর কখনও কোন ক্ষেত্রে তাদের সাক্ষ গ্রহন করো না। এই লোকগুলি সত্যত্যাগী।”

(আল-কুরআন,২৪ঃ৪)

তিনি আরও বলেন ঃ “ নিশ্চয় যারা সাদাসিদা,ঈমানদার সতী নারীদের উপর ব্যাভীচারের অপবাদ আরোপ করে তাদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ,দুনিয়াতে এবং আখিরাতে। আর তাদের(মিথ্যা অপবাদ দানকারীর) জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়ানক আজাব যা ঐদিন প্রয়োগ হবে, যেদিন তাদের বিরুদ্ধে তাদের জবান,হাত,পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য প্রদান করবে। ঐদিন(আখিরাত) তাদেরকে ভোগনীয় প্রতিফল আল্লাহ তায়ালা পুরোপুরি প্রদান করবেন এবং তারা জানবে আল্লাহ’ই সত্য,স্পষ্ট প্রকাশক।”(আল-কুরআন,২৪ঃ২৩-২৫)

“যারা নিজেদের স্ত্রীদের উপর (ব্যাভীচারের) অপবাদ আরোপ করে অথচ নিজেরা ব্যতীত অন্য কোন সাক্ষী নেই,তাহলে তাদের প্রত্যেকের সাক্ষ্য হবে এই যে, সে আল্লাহর নামে চার বার শপথ করে বলবে যে, সে অবশ্যই সত্যবাদী(অর্থাৎ এ পাপ তার স্ত্রী করেছে) এবং পঞ্চমবারে বলবে, সে মিথ্যাবাদী হলে তার নিজের উপর নেমে আসবে আল্লাহর লানত।

তবে স্ত্রীর শাস্তি রহিত হবে যদি সে চার বার আল্লাহর নামে শপথ করে সাক্ষ্য দেয় যে,তার স্বামীই মিথ্যাবাদী এবং পঞ্চমবারে বলে ,তার স্বামী সত্যবাদী হলে তার নিজের উপর(অর্থাৎ স্ত্রীর উপর)নেমে আসবে আল্লাহর লানত।

তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ না থাকলে কেউই অব্যাহতি পেত না এবং আল্লাহ তওবা গ্রহনকারী ও প্রজ্ঞাময়।( আল-কুরআন,২৪ঃ৬-১০)

“যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লিলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়ঙ্কর শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন ,তোমরা জান না।”(আল-কুরআন,২৪ঃ১৯)

(বিঃদ্রঃ ধর্ষণ এবং ব্যাভীচার সমান নয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রে সাক্ষ্যদানের এমন জটিল নিয়ম নেই। ধর্ষক ধরা পড়লে তার ভবলীলা সাঙ্গ হবে,এতে সন্দেহ নেই।

“একজন নারী নামাজে যাওয়ার জন্য অন্ধকারে বের হল। পথিমধ্যে এক ব্যক্তি তাকে ধরে ফেলে এবং জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। মহিলাটির চিৎকারে চারিদিক থেকে লোক জড়ো হয় এবং ধর্ষককে আটক করে। অতঃপর রসূল(সাঃ) তাকে রজমের(প্রস্তরাঘাতে হত্যা) নির্দেশ দেন এবং উক্ত মহিলাকে সম্মানের সাথে গৃহে পাঠানো হয়।” -তিরমিযী,মুওয়াত্তা,দারু কুতনী,ইবনে মাজাহ,বায়হাকী ।

অনুরূপভাবে কোনো পুরুষ ধর্ষনের শিকার হলে তাকে ক্ষমা করা হবে এবং নারীর শাস্তি হবে বলে মত দিয়েছেন ইমামগণ এবং মুস্তাহিদগণ। তবে ইসলামিক খিলাফত রাষ্ট্রে অথবা কোনো মুসলিম নারী কর্তৃক এমন ঘটনা ঘটার ইতিহাস নেই)

প্রত্যেকটা শাস্তির বিধান পুরুষ নারী উভয়ের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। ব্যাভীচারের কারণে আমাদের দেশে এক শ্রেণীর গেঁয়ো মোল্লা বা গ্রাম্য শালিসের বলদসম নেতা গোছের কর্তারা নারীকে জুতাপেটা করে বা সামাজিকভাবে বয়কট করে। আর পুরুষটিকে হয় ছেড়ে দেয়া হয়, নয়তো কয়েক পয়সা জরিমানা করা হয়।

সু-স্পষ্টভাবে জেনে রাখুন- ইসলামের আইন কানুন ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আর ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা খিলাফত- সেই সমস্ত ব্যাক্তিদেরকে বিচারক হিসাবে নির্বাচিত করে যারা ফিকাহ্ (ইসলামী আইন) সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ জ্ঞান রাখেন। আর তিনি এ ব্যাপারে পন্ডিত বা বিশেষজ্ঞ। বিভিন্ন পরিস্থিতি সর্ম্পকে বিশ্লেষণের যোগ্যতা তার আছে বা থাকতে হয়। এমনকি অপরাধী সনাক্তকরণের জন্যে অপ্রচলিত কৌশলও তার জ্ঞানের সীমার মধ্যে পড়ে। এরকম একজন বিশেষজ্ঞ হন বিচারক এবং তিনি যেকোন শ্রেণীর মানুষের বিচারের ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। এখানে গ্রাম্য শালিসের পাগলদেরকে এমন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়নি। আর ব্যাভীচারের শাস্তি পুরুষ নারী উভয়ই সমান ভাবে পাবে। এখানে ধর্ষণ’কে উক্ত পুরুষ ব্যাভীচার হিসাবে চালানোর চেষ্টা করছে কিনা তা অনুসন্ধান,পর্যালোচনা করা হয়। এছাড়া এর সাথে জ্ঞানের একটা সম্পর্ক আছে যা, সকল লোকের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।

পত্রিকাতে এমন রিপোর্ট অনেকবার এসেছে যে, ধর্ষণ করা হয়েছে নারীকে আবার ব্যাভীচারের শাস্তি স্বরূপ তাকে পেটানো হয়েছে, সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়েছে। খিলাফত ব্যবস্থায় এমন ঘটনা সংঘঠিত হলে ঐ গ্রাম্য শালিসের কর্তা বা কর্তাদেরকে এমন দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেয়া হত, যাতে এমন ঘটনার পূণরাবৃত্তি না হয়।

তাছাড়া ব্যাভীচারের অভিযোগ আনার জন্য কমপক্ষে ৪ জন পুরুষের সাক্ষ্য প্রয়োজন হয়। আর ব্যভীচারের ঘটনা একাধিক মানুষ তখনই প্রত্যক্ষ করতে পারে যখন, এটি রেওয়াজ হয়ে যায় অর্থাৎ সামাজিকভাবে প্রচলিত হয়ে পড়ে। ব্যাভীচারের পরিনতি ভয়াবহ। এটি সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়(আজকের পাশ্চাত্য সমাজ তার জলজ্যান্ত প্রমান)। এতে পারিবারিক,সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়, তাই ইসলাম সমাজকে সুন্দরভাবে গঠনের জন্য,পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্থ হবার জন্য, সামাজিক বন্ধন অটুট রাখার জন্য ব্যাভীচারের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করে। এখানে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়,যাতে শাস্তির ভয়াবহতার কারনে নতুন করে কেউ আগ্রহী না হতে পারে,তাছাড়া চারিত্রিক শুদ্ধির জন্য রাষ্ট্র যাবতীয় কল্যানকর পদক্ষেপ নিয়ে থাকে ।

শিশুর বেড়ে ওঠার সময় থেকে শুরু করে তার মৃত্যুর সময়কাল পর্যন্ত রাষ্ট্র বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে তাকে আাদর্শ ,চরিত্রবান ও শ্রেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পরিবেশ সৃষ্টি করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “অশ্লীলতার ধারের কাছেও যেওনা” “ব্যাভীচারের কাছেও যেও না,এটি বড়ই নির্লজ্জ কাজ এবং অতি জঘন্য পন্থা”। আবার তিনিই মানুষের প্রতি দয়ালু হয়ে বলেন - যে অন্যের দোষ ঢেকে রাখবে আখিরাতে আমি তার দোষও গোপন করে রাখবো। এ জন্য ইসলামিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের কাজ এটা নয় যে, তারা অন্যের দোষ অনুসন্ধান করে বেড়াবে।

সে যদি অন্যের মধ্যে দোষ (ব্যক্তিগত দোষ ত্র“টি যা সরাসরি অন্যের স্বার্থকে আঘাত করেনা)দেখতে পায় তাহলে সে গোপন করবে এবং একইসাথে সংশোধনের জন্য গোপনে চেষ্টা চালাবে(গোপনে সংশোধনের চেষ্টা করা অতি উত্তম এমনকি তার দোষ উপস্থাপনের সময় সে যেন লজ্জা বা কষ্ট না পায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে,সরাসরি না বলে কৌশলে দোষ উপস্থাপন করে সংশোধনের চেষ্টা করা অধিক শ্রেয়)। বহুভাবে চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলে সে তখন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ পেশ করবে তার অপরাধের জন্য, এরপর আদালত ব্যবস্থা নিবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে। একটি পাপ যখন গোপনে ঘটে তখন তার জন্য ব্যক্তি সরাসরি আল্লাহর কাছে দায়ী থাকে। এখানে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে অনুসন্ধান চালায় না যে, - কে ঘরের মধ্যে পাপ করছে। একই পাপ যখন সাংস্কৃতিতে পরিনত হয় এবং জনসম্মুখে ঘটতে থাকে তখন ইসলামিক রাষ্ট্র দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য (সমাজকে পাপ মুক্ত করার মানসে) শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এছাড়া ঘরের মধ্যেও যাতে মানুষ আল্লাহকে ভয় পায় তার জন্যে জনগণকে ইসলাম দ্বারা অনুপ্রাণিত করা হয়।

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “মুমিনদেরকে বল তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জা স্থানের হেফাজত করে(আল-কুরআন,২৪ঃ৩০)“মুমিন নারীদেরকে বল তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং লজ্জা স্থানের হেফাজত করে।”(আল-কুরআন,২৪ঃ৩১)।

এতে কাজ না হলে সে ব্যক্তিকে আল্লাহ শাস্তি দিবেন। এখানে রাষ্ট্র তার দায়ীত্ব পালন করলো কিন্তু ব্যক্তি তার কর্তব্য পালন না করার ফলে আল্লাহর কাছে দায়ী। আর রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ আল্লাহর কাছে কৈফিয়ৎ দেওয়ার হাত থেকে বাঁচলো। ইসলামিক রাষ্ট্রে পাপীকে শাস্তি দেওয়ার থেকে তার সংশোধনের ব্যবস্থা রাখা হয় বেশী। আর এ উদ্দেশ্যে রাষ্টীয় ব্যবস্থাপনাকে এমনভাবে ঢেলে সাজানো হয় যাতে ব্যক্তি অপরাধ করতে ভয় পায়।

এছাড়া স্বজনপ্রীতি না থাকার কারনে এবং শাসক ও শাসিতের একই শাস্তি হবার কারনে অপরাধ প্রবনতা কমে যায়। আবার ইসলামিক সং®কৃতি হলো অন্যের দোষ গোপন করা বা গোপনে সংশোধনের ব্যবস্থা করা যাতে সে লজ্জা না পায়, গিবত(কারো অনুপস্থিতিতে অন্যের কাছে তার এমন কোন দোষের কথা বলা,যা শুনে সে কষ্ট পায়) না করা, ক্ষমা করে দেওয়া, আমানতের খিয়ানত না করা এবং অন্যের উপকারে এগিয়ে আসা ইত্যাদি।

[রসূল(সাঃ)এর সময় ব্যাভীচারের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৪ জনকে। হযরত ওমর(রাঃ)এর সময় মাত্র এক জনকে। তার পরবর্তী সময় থেকে আজকের দিন পর্যন্ত ব্যাভীচারের শাস্তি হিসেবে রজম দেওয়া হয়েছে মাত্র কিছু সংখ্যক লোককে। সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য,বড় বড় অন্যায়ের পথ বন্ধ করার জন্য ইসলাম ব্যাভীচারের জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করেছে এবং এটি আল্লাহর আদেশ।

আজকের সমাজের দিকে তাকালে দেখা যাবে রাষ্ট্র ব্যাভীচারকে জায়েজ করার কারনে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে শুধু তাই নয় ,ধর্ষণ করে হত্যা করা হচ্ছে, এ উদ্দেশ্যে অপহরণও বেড়ে গেছে আশংকাজনক হারে। এসিড নিক্ষেপ করে সুন্দর মুখশ্রী ঝলসে দেওয়া হচ্ছে। চুরির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং মন থেকে আল্লাহর ভয় উঠে যাওয়ার ফলে রাষ্ট্র দূর্নীতিতে আষ্টে-পিষ্টে জড়িত হয়ে পড়েছে। ইসলামের প্রত্যেকটা আইনই মানুষের জন্য সর্বাপেক্ষা কল্যানকর এবং যুক্তিনিষ্ঠ। ইসলামী আইন শাশ্বত, কারণ এটি মহান আল্লাহর তৈরী। এ আইন অন্য আইনের মত কিছুদিন পর পর সংশোধন করতে হয় না। এটি কিয়ামত পর্যন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবেই বহাল থাকবে এবং ইসলামী শরীয়াহ পৃথিবীর সকল মানব রচিত আইনকে যৌক্তিকভাবে যেকোন সময় চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষমতা রাখে।]

বিষয়: বিবিধ

৩৬৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File