জনাব পিটার মুরাদ
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৩ মে, ২০১৩, ১২:২৪:২৫ দুপুর
একদিন ট্রেন স্টেশনে বসে ট্রেনের অপেক্ষা করছি। প্রথম ট্রেনটা মিস করলাম। পরেরটা আসতে প্রায় ২০ মিনিট লাগবে। পাশেই এক ভারতীয় মনে হওয়া বুড়ো ভদ্রলোককে দেখলাম। তিনিই কথা বলা শুরু করলেন। জানতে পারলাম তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত খ্রীষ্টান তবে জীবনের অধিকাংশ সময় মালেশিয়াতে কাটিয়েছেন। লোকটা সাংঘাতিক কথা বলতে পছন্দ করে। আমি মুসলিম তা জানার পর সে মালয়েশিয়াকে কেন ভাল লাগে তা বলতে গিয়ে বলল,আসলে সেখানকার সবকিছুই হালাল। আমি খুবই পছন্দ করি। আইন কানুনও খুব ভাল। মানুষেরা খুবই চমৎকার। সেখানে আমার সকল বন্ধুই মুসলিম। তারা আমার নাম দিয়েছে মুরাদ,যদিও আমার নাম পিটার। ভাল লাগল তার সাথে কথা বলে। অস্ট্রেলিয়াতে সে আসলে কিছু করছে না। তার ছেলের সাথে আছে। তার হাতে অফুরন্ত সময় তা বুঝতে পারলাম। অস্ট্রেলিয়ার অনেক প্রশংসা করল। তবে দূর্নাম যে কিছু নেই তা নয়। তিনি মুসলিম কমিউনিটির কথা,তাদের কালচার ইত্যাদীর কথা এমনভাবে বলতে শুরু করলেন যে আমি ভাবলাম সে বোধহয় দীর্ঘদিন মুসলিমদের সাথে থাকার কারনে ইসলামের রীতি নীতির প্রতি ঝুকে পড়েছে।
সে বারবার হালাল জিনিসের প্রশংসা করাতে ভাবলাম সে হয়ত হারাম হালাল মেনে চলে। তার হাতে তসবিহ সদৃশ একটি মেটালের মালা ছিল এবং তিনি বললেন এটা তিনি জপেন,জিজ্ঞেস করলেন-তোমাদের আলিমরাও তো এটা জপে। বললাম-জি হ্যা অনেকে তসবিহ জপে। এক সময় কোনো একটা পার্টির বিশেষ বিশেষ খাবারের কথা বলতে শুরু করল,আমি ফাঁকে বলে ফেললাম আপনি শুয়োর খান ? একটু চমকে উঠলেন,তারপর মুখের হাসির রেখা মুছে ফেলে বললেন-হ্যা ,একটু আধটু খাই। বললাম মদ ? অনুরূপভাবে বলনে-হ্যা,তাও একটু আধটু খেতে হয়। গল্প এমনভাবে চালালাম যাতে তিনি আমার অনুভূতী বুঝতে না পারেন,অবশ্য তার প্রতি আমার অনুভূতী খারাপ হওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা।
গল্প করতে করতেই ট্রেন চলে আসল। তিনি মাসকট নামবেন আর আমি যাব টাউন হল। আমরা ট্রেনে বসে প্রচুর গল্প করলাম। ব্যবসা বানিজ্য,রাজনীতি,সমাজ,পরিবার,ভারতীয় কালচার বহু বিষয়েই কথা হল। আমি এক সপ্তাহেও এত কথা বলিনা। আর কারো সাথে আমি কথা বলার সময় তিনি না চাওয়া পর্যন্ত আমি কথা বন্ধ করিনা। তার স্বার্থের দিকে খেয়াল রাখি এবং আমার দ্বারা তিনি আঘাত না পান; সেটা খেয়াল থাকে। ফলে আমিও তার সাথে তাল মেলাতে থাকলাম। চল্লিশ মিনিট পর তিনি তার স্টেশনে নেমে গেলেন এবং আমিও বেশ হালকা বোধ করলাম। তার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে এবং গায়ের রং কালো। স্ত্রী জীবিত নেই। এদেশে এ বয়সে এই চেহারায় সঙ্গী জোটানো সহজ হবে বলে মনে হলনা। অবশ্য এ ব্যাপারটি জোর দিয়ে বলা যায় না। পাশের বাসার ৮০ বছর বয়ষ্ক, কানে খাটো মি: জন তো ঠিকই বেশ উত্তম একজন স্ত্রী বা মেয়ে বন্ধু জুটিয়ে নিয়েছেন। তাদের মিলও চমৎকার। ফলে তিনিও হয়ত পেয়ে যাবেন। তবে এখানে সাংবিধানিকভাবে সাদা কালো কোনো ব্যাপার না হলেও মানুষিকভাবে এটা এখনও ব্যাপার। এমনকি ট্রেনে চলার সময়ও বেশ কয়েকবার খেয়াল করেছি। আমার পাশের সিটটা যদি খালি থাকে আর অন্য একজন সাদা লোকের পাশের সিটটা খালি থাকে ,তাহলে কোনো সাদা যাত্রী বেশীরভাগ সময়ই অপর সাদা লোকটির পাশে বসতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। অনেকে আবার এসব সাদা কালোর ধার ধারেন না। তবে যখন সীটের প্রয়োজন তখন সাদারা কালোর পাশে বসতে দ্বীধা বোধ করেনা। এখানে সাদা অর্থ গায়ের চামড়ার ঐজ্জ্বল্য নয় বরং এটি একটি শ্রেণী। তাদের মতে সকল এশিয়ানও কালো শ্রেণীর মধ্যে পড়ে।
ট্রেনে বেশীরভাগ সীট খালিই থাকে। আমি প্রায় প্রতিদিনই বের হয়েছি এবং একাধিকবার ট্রেনে চড়েছি। প্রতিদিন গড়ে এক শত কি:মি: এরও বেশী ট্রেন ভ্রমন করেছি। শুধুমাত্র অফিসে গমন ও অফিস ছুটির সময় ছাড়া অন্য সময়য়ে ট্রেনের ভেতর তেমন লোক থাকেনা। কখনও কখনও একেক বগীতে মাত্র দুই-তিন জনও থাকে। কয়েকবার নিজেকে একা আবিষ্কার করেছি। যাত্রী থাকুক আর না থাকুক বাস/ ট্রেনের কর্মসূচীতে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনা।
আরেক দিন যখন আমি ট্রেনের অপেক্ষা করছি তখন এক বেঞ্চে দেখলাম মি: পিটার একজন সুন্দরী মেয়ের সাথে তুমূল আড্ডা জমিয়েছে। এদেশের মানুষেরা দিল খোলা টাইপের। কথা বললে কেউ সাধারনত বিরক্ত হয়না। আমি পাশের বেঞ্চে বসলাম। ভাবলাম পিটার আমাকে দেখে পূর্বের দিনের মত আনন্দের সাথে কথা বলবে। কিন্তু না,আমার দিকে একবার তাকিয়ে চিনল ঠিকই তবে মুখটা ঘুরিয়ে সুন্দরীর সাথে গল্পে মনোনিবেশ করল। মনে হয় তিনি ভেবেছেন তার এ মূল্যবান সম্পদটি আমি নিয়ে ভেগে যাব। তার ভাবখানা সেরকমই ছিল। সে গল্প চালাতেই থাকল। আমি তার দিকে আর তাকাইনি। অনেকক্ষন পর আবার তার দিকে তাকালাম এবং তখন তিনি বলনে,হে ম্যান ! কেমন আছ ? আমিও তার মত করে বললাম ,হ্যা ভাল আছি।
ওরে বুড়ো, তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনেছি। বুঝলাম সে আমার সাথে কথা বলতে মোটেও আগ্রহী নয়। আমিও নই। সে আবার গল্পে মনোনিবেশ করল। বুঝলাম ভদ্র মহিলা উঠে গেলেই সে হয়ত আবারও আমার সাথে খানিক ঘনিষ্ঠ হবে। ট্রেন আসলে তাকে অতি ভদ্রতার সাথে বিদায় জানিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। বুঝলাম তার আসলে একজন উত্তম সঙ্গী দরকার। কিন্তু যাকে সে পেয়েছিল,সে বড় জোর ২০ মিটিনের সঙ্গী হবে,তাও আবার ট্রেনের জন্যে অপেক্ষমান অবস্থায়।
বিষয়: বিবিধ
২০০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন