থ্রী-সিস্টার
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৩ মে, ২০১৩, ১০:০৩:৫৪ সকাল
আমরা উত্তম প্রকৃতিকে উত্তম রূপে দেখতে থাকলাম। এবার কিছুদূর ড্রাইভ করে ইকো পয়েন্ট লুকআউট আসলাম। এখান থেকে যে তিনটি পর্বত শৃঙ্গ একসাথে দেখা যায় সেটিই হল আজকের মূল আকর্ষণ “থ্রী সিস্টার”। আমি পূর্বে বিভিন্ন ভিউ কার্ড,কালেন্ডারে এই থ্রি-সিস্টারের ছবি দেখেছি। সে সময় থেকেই এই জিনিস এবং এজাতীয় জিনিস দেখার শখ জন্মেছিল। সেই ছবিটি যে বাস্তবে দেখব,তা ভাবিনি। এ এক অসাধারণ দৃশ্য। তিনিটি শৃঙ্গ দাড়িয়ে আছে পরষ্পরের সাথে সন্ধী করে। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম আকর্ষণ এটি।
কথিত আছে বহু কাল আগে এখানকার আদীবাসী সর্দারের তিন মেয়ে ছিল আর নিয়ম অনুযায়ী এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের বিয়ে-শাদী হতে পারত না। কিন্তু শত্র“ গোত্রের ছেলেদের প্রেমে তারা হাবুডুবু খায় এবং এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক চরম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় এমনকি কণ্যাদের পিতাও সে সংঘর্ষে মারা যায়। অবস্থা যখন ভয়াবহ, তখন তিন বোন এই তিনটি শৃঙ্গের মাথায় উঠে নীচে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। সেই থেকে এর নাম হয় থ্রি-সিস্টার।
আমার বক্তব্য হল- এই তিনটি পাহাড়ের মাথায় উঠতে গিয়েই তো আত্মহত্যার স্বাদ পাওয়া যাওয়ার কথা। খালিহাতে কোনোভাবেই এই খাড়া পাথরের ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠা সম্ভব নয়। সু-দক্ষ পর্বতারোহী ছাড়া ওখানে ওঠা অসম্ভব। এত কষ্ট করে আত্মহত্যা করার কি দরকার ! তার চাইতে আমাদের এলাকার এক লোকের মত করে মরলে হত। সে লোক ১০০ গ্রাম গু আর ১০০ গ্রাম চিনি খেয়ে মরেছিল শুনেছিলাম। সম্ভবত তার বিষ কেনার পয়সা ছিলনা। আহারে বেচারা ! বাংলাদেশের মত জায়গায় মরা কোনো ব্যাপার ? কিছু না পারিস; অন্তত সরকারের নামে খানিক গালাগালি করলেও তো চলত !
ইকো পয়েন্ট লুকআউট নামক স্থানটি যে কি চমৎকার করে তৈরী করা হয়েছে তা আর কি বলব ! পুরো পাহাড়ের মাথাটা শৈল্পিকভাবে তৈরী করা। নানামুখি রাস্তা এবং বিশ্রামাগার রয়েছে। রেস্তোরা রয়েছে। রাস্তাগুলো অতি মনোরম করে তৈরী করা। এই লুকআউট থেকে বিশেষ দূরবীনের সাহায্যে দূরের দৃশ্য অবলোকন করা যায় তবে ২ ডলারের কয়েন প্রবেশ করালে এটি সচল হয়। আমরা তিন বোনের পাহাড় দেখলাম। মনে হচ্ছে পাহাড়রা তিন বোন এবং তাদের পিরিত গলায় গলায়। তিন বোন একই মায়ের পেটের হলেও তারা যে একসাথে জন্মায়নি এবং তাদের বয়স যে সমান নয় তা বোঝা যায় তাদের উচ্চতা দেখে। প্রথমটার উচ্চতা এক হাজার মিটারের বেশী,পরেরটা আরেকটু নীচু,তার পরেরটা আরেকটু নীচু। সোজা হয়ে সকলে আসমানে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে। বহুদিন ধরে দাড়িয়ে থাকার কারনে গায়ে শাওলা জমেছে এবং গাছপালা, ঝোপঝাড়ও। শ্যাওলা এবং বোপঝাড়গুলোই যেন মূল আকর্ষণ। সকলে এখান থেকে দেখেই খ্যান্ত হয় কিন্তু আমি সে চিজ নই।
আমি আর ভাইগনা হাটতে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য তিন বোন পাহাড়ের কাছে যাওয়া। তবে এই তিনটা পাহাড়ের একটিতে যাওয়া যায় ,অন্যদুটোতে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ সেগুলোর সাথে এই পথের কোনো সংযোগ নেই। আমরা যে পথ ধরে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছি সে পথের কথা কখনই ভুলব না। এ এক অতি অসাধারন রাস্তা। এটি বেশী চওড়া নয় কিন্তু রাস্তার বামপাশে পাথুরে মাটির যে শৈল্পিক রূপ দেখেছি তার বর্ণনাও করতে পারছি না। কোথাও সাদা পাথর(সম্ভবত স্যান্ডী স্টোন) কোথাও একটু নরম,কোথাও মনে হচ্ছে পোড়া মাটি। সুদীর্ঘ সময়ের আবর্তে এটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে আর সেই ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের বিভিন্ন অংশে বুনো গাছপালা জন্মেছে এবং সেগুলোর শেকড় চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। কোথাও পাথরের সাথে শেকড়গুলো এমনভাবে মিশে আছে ,যেন পাথুরে শেকড়। কোথাও গুচ্ছ গুচ্ছ শেকড় ঝুলে আছে ছোট ছোট গুহার ওপর। কোথাও কোথাও পাথরের দেওয়াল গর্তের রূপ নিয়েছে এবং কোথাও মনে হচ্ছে কেউ খোদাই করে ছাদ তৈরী করেছে। স¤পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে তৈরী এ রাস্তাটা আমাকে প্রবল আকর্ষণ করল। এটা দেখেই আমার মনে ধরেছিল এবং তখনই ভাবছিলাম এ দৃশ্য আমি ভুলতে পারব না। এটি একটি পাথরের দেওয়ালের মত। এর কোনো অংশ উজ্জ্বল ঘি রঙের,কোনো অংশ লাল,কোনো অংশ একটু কালো মত। এর ওপর যেসব গাছপালা জন্মেছে সেটাও যেন প্রাগৈতিহাসিক। কোনো কোনো গাছের শেকড় বিভিন্ন ধারায় নীচে ঝুলে পড়েছে। ওহ, সত্যিই মুগ্ধ হবার মত ব্যাপার।
আমরা একটা পাথরের তৈরী গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম। এটা উক্ত তিন পাহাড়ের প্রথমটার একেবারে কাছে। যে পাহাড়ে আছি সে পাহাড়টি খানিক নীচে গিয়ে উক্ত পাহাড়ের আরও কাছে গিয়ে মিশেছে। সেখানে প্রায় ১৫ফুটের মত লম্বা স্টিলের ব্রিজ রয়েছে ,যেটা পার হয়ে তিন বোন পাহাড়ের একটি অংশে পৌঁছানো যায়। সেখানে একটি গুহার মত স্থান রয়েছে। পর্যটকরা সেখানে গিয়ে খানিক বিশ্রাম করে। আমরা সেখানে না থেমে খাড়া নামছি। এখানে খাড়া সিড়ি বেয়ে নীচে নামতে হয়। আমাদের উদ্দেশ্য হল সিড়ি বেয়ে নীচে নামব তারপর ওঠার সময় তিন বোন পাহাড়ের উক্ত গুহা সদৃশ স্থানে যাব।
দেখলাম এদের দেশের বুড়ো বুড়িও এই খাড়া পাহাড় বেয়ে নীচে নামছে। এদের শক্তি আছে বেশ। এই বয়সে আমাদের লোকেরা প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী। আমরা যে খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলেছি তা সুবিধার নয়,তারপরও আছে নানান ভেজাল এবং বিষের উপস্থিতি। সম্ভবত নীচ পর্যন্ত সাড়ে নয়’শ সিড়ির ধাপ রয়েছে। আমরা নীচে নামতে থাকলাম প্রবল বেগে। নীচে নামতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল,তাছাড়া খানিক আগেই বিশাল পাহাড়ে ওঠা-নামা করেছি। একেবারে নীচে নামলাম না,তবে অনেক নীচে নেমেছি। আমার মনে হল এখানে দেখার কিছু নেই। শুধু ‘নীচে নেমেছি’ এই কথাটা বলা ছাড়া আর কোনো কৃতিত্ব দেখলাম না। নীচে ঘন জঙ্গল বেশ কাছে দেখা গেল। একেবারে খাড়া পাহাড় বেয়ে আবার উঠতে শুরু করলাম। এবার বুঝলাম কষ্ট কাকে বলে। কিন্তু পাত্তা দিলাম না। এক নিঃশ্বাসে শুধু ওপরে উঠেই চলেছি। একস্থানে এসে আর এগুতে পারলাম না। একটু ফোঁস ফোঁস করতেই হল। এক বুড়ি আবার তা দেখে হো হো করে হেসে উঠল। মনে হচ্ছিল খানিক ঘুমিয়ে নিলে ভাল লাগত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভাল লাগছিল ,কষ্টের কারনে অনুভূতি ভোতা হয়ে যায়নি। এর থেকে ঢের কষ্ট আমি করেছি নেপালে স্পেশাল ক্যাম্পিংএ। সেসময় প্রতিদিন বিরতিছাড়া প্রায় আড়াই ঘন্টা করে কঠোর কসরত করতে হত। সিড়ি দিয়ে বিভিন্নভাবে ওঠা নামা,লাফানো,স্টেডিয়ামের গ্যালারীতে দ্রুত লাফিয়ে ওঠা-নামা,পা ওপরে হাত নীচে দিয়ে সিড়ি বেয়ে দ্রুত নীচে নামা,মাটিতে গড়ানো,দ্রুত দৌড়ানো,ঝোলা,ডিগবাজি খাওয়া,প্রচন্ড জোরে কিক করা,কিক ব্যাগের ওপর প্রতিশোধ পরায়ন হওয়া,অন্যদের সাথে ফাইট করা ইত্যাদীকে বিবেচনায় আনলে বলতে পারি,এ কষ্ট কোনো কষ্টই নয়।
তারপর আবার দ্রুত উঠলাম। এবার তিন বোন পাহাড়ে আসলাম। খানিক দাড়িয়ে আবার ওপরে উঠে আসলাম। এই পাহাড়ের ওপরের অংশটা খুবই দারুন। এটা নীচ থেকে সরু হতে হতে ওপরে এসে খুব অল্প জায়গার মধ্যে শেষ হয়েছে। আর সেখানে ছোট ছোট গাছপালা দেখে মনে হল বনসাইএর বাগান। অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলাম। মনে মনে ভাবছিলাম ওখানে যদি আমার একটা কুড়ে ঘর থাকত,তাহলে কিছুদিনের জন্যে খাবার নিয়ে বসে থাকতাম আর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতাম। ভাল লাগার আরও একটি কারন হল ,এরা সবকিছু পরিচ্ছন্ন করে রাখে আর সৌন্দর্য্য সংরক্ষন করতে বোঝে। থ্রী-সিস্টারের দিকে একটু সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম,কারণ আবার কখনও আসা হবে কিনা জানিনা। এত সুন্দর দৃশ্য দেখা বেশী লোকের কপালে জোটেনা।
কিছুদূর ড্রাইভ করে আমরা আরেকটি লুকআউটে আসলাম। এখানথেকে দেখলাম কিছু এলাকা ভালভাবে দেখার জন্যে ক্যাবল কার রয়েছে। এটা দারুন একটা জিনিস। ক্যাবল কারে চড়ে ওপর থেকে সৌন্দ্যর্য উপভোগ অতি উৎকৃষ্ট ব্যাপার কিন্তু আমরা উঠলাম না। আমরা এপাশ থেকে যা দেখলাম তা মোটামুটি ক্যাবল কারে চড়ে দেখার মতই। একটা বনের গাছপালা দেখলাম গোড়ার দিকে কালো। বাহ দারুন তো ! পরক্ষনেই বুঝলাম নীচের বুনো ঝোপঝাড়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সে আগুনের লেলীহান শিখায় গাছটি তার গোড়ার অংশে কালো রং ধারন করে গর্ব প্রকাশ করছে। গাছের বোধজ্ঞান থাকলে তাকে বলতাম,গর্ব করা কবীরা গুনাহ।
.......................................
বিষয়: বিবিধ
৩৩৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন