রানাপ্লাজা, সাভার থেকে বলছি !!!

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৬ এপ্রিল, ২০১৩, ০৫:৫৪:৩৩ বিকাল

সকল ছবি আমার মোবাইল সেটে তোলা







জুসের বোতল হাতে সজিব।

দুপুরে যখন অফিসে বসে ভাবছি কোন কাজটার পর কোনটা করব ঠিক তখন সজিবের ফোন আসল এবং বলল,মানুষকে প্রকৃত সার্ভিস দেওয়ার সুযোগ এসেছে আপনি তৈরী হন। আপনাকে সাভার রানাপ্লাজা যেতে হবে। আমি কোনোরকম চিন্তা ছাড়াই বললাম,আমি প্রস্তুত,শুধু বলেন কি করতে হবে। আমি আমার সকল অফিসিয়াল কর্মসূচী বাতিল করলাম। পারভেজকে প্রস্তুত রাখা হল।

সজিব তার অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রওনা হল। আজ মালিবাগ,রামপুরা,বাড্ডা,মগবাজার,টঙ্গী থেকে শালনা পর্যন্ত এবং সাভার,কোণাবাড়ী সকল স্থানে হাজার হাজার গাড়ি ভেঙেছে গার্মেন্ট কর্মীরা। কিছু সুবিধাবাদী শ্রেণী এদের ক্ষোভকে সর্বদা ভিন্নপথে প্রবাহিত করার চেষ্টায় রত থাকে । এদের ক্ষোভের পরিমান কমে গেলে কখনও কখনও তারা নতুন নতুন ক্ষোভ তৈরী করে। সজিবের মোটর বাইক কাজে দিল। দুপুরের পর আমরা দুজন পঙ্গীরাজের মত ছুটে চললাম সাভারের উদ্দেশ্যে। প্রচন্ড ধুলোয় আমরা তলিয়ে গেছি কিন্তু উচু নীচু রাস্তা ধরে আমরা প্রচন্ড বেগে ধেয়ে চললাম।

আমরা যখন সাভারের বিশ মাইল নামক স্থানে আসলাম,তখন ডানে বামে কোনো গাড়ি দেখিনি হাজার হাজার মানুষ ছাড়া। আশপাশের সব দোকানপাট বন্ধ। অনেকের হাতে লাঠি। তারা আমাদেরকে আটকালো না,কারণ বাইকের সামনে লেখা ছিল জরুরী উদ্ধার কাজে নিয়োজিত। আমরা আসলে সার্ভে করতে যাচ্ছি যাতে সঠিক স্থানে সঠিক জিনিসটি পৌঁছানো যায়। কারণ এজাতীয় পরিস্থিতিতে কিছুলোক মোটা দান মারার ধান্দায় থাকে। আমরা এটা হতে দিতে চাইনা।

রাস্তায় কিছু এ্যমিবুলেন্স এবং আর্মির গাড়ী ছাড়া আর কোনো কিছু চলছে না বা চলতে দেওয়া হচ্ছেনা। আমরা উত্তপ্ত গার্মেন্টস কর্মীদের ভেতর দিয়ে চলেছি। রাস্তার দুপাশ মানুষে ঠাসা। কয়েক কিলোমিটার পর আমরা এমন একটি ব্যারিকেডের ভেতর চলে আসলাম যেখান থেকে আমরা সামনে পেছনে আসতে পারছিলাম না। এখানে আমরা হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু কর্মীকে দেখলাম। আমরা আমাদের গন্তব্যস্থলের অবস্থান জানতে চাচ্ছিলাম এবং তারা নির্দেশনা দিচ্ছিল। একজন হেফাজত কর্মী একটি বাশের ব্যারীকেড উচু করে আমাদের যাওয়ার পথ করে দিল,আমরা গেলাম। খানিক পর বুঝলাম ওপাশে আর আগানো যাবেনা। কারণ আর্মীর গাড়ি,এ্যাম্বুলেন্স এবং লাখ লাখ মানুষ গাদাগাদি করে রয়েছে। আমরা আবার পেছনে এসে রাস্তার ডানদিক ধরে এগিয়ে গেলাম। লাঠিধারী জনতা আমাদেরকে পথ করে দিল।

আমরা রানাপ্লাজা পার হয়ে প্রথমে গেলাম এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে। পূর্বেই শুনেছি এখানে প্রচুর আহত লোক চিকিৎস্যা নিচ্ছে। এখানে আমাদের ঢুকতে সমস্যা হয়নি,যদিও পুলিশ এখানে ঘিরে রেখেছে। মোটর বাইকের সামনের লেখা এবং আমার গলার টাই,আর্মীকাট চুল খানিক সহায়তা করেছে। আমরা দেখলাম শতশত লোক এখানে ভীড় করে আছে। অনেকের আপনজন এখানে চিকিৎস্যা নিচ্ছে। সকল চিকিৎস্যা ফ্রি। আমরা জরুরী বিভাগের ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে একজন বাধা দিল,আমরা তাকে হটিয়ে ডুকে গেলাম। এখানে অনেকসংখ্যক মেডিকেল শিক্ষার্থী সাহায্য করছে। ডাক্তাররা আমাদেরকে জানালেন এখানে যারা এসেছে তারা ভাল চিকিৎস্যা পাচ্ছে এবং তাদের ব্যাপারে কোনো সহযোগীতার প্রয়োজন নেই। ব্যাপারটি সত্য,কারণ লাখ লাখ জনতা রাস্তায় এবং আশপাশে দাড়িয়ে আছে সহযোগীতা করার অভিপ্রায়ে কিন্তু তারা জানেনা কিভাবে তারা সাহায্য করবে। তাই দেখা যাচ্ছে যখনই কোনো আহত লোক উদ্ধার করা হচ্ছে মানুষ তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ছে সাহায্যের জন্যে। অনেক স্থান থেকে মানুষ এসে জিজ্ঞেস করছে সাহায্য প্রয়োজন কিনা এবং অনেকে বিভিন্ন ক্লিনিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে খোঁজ নিচ্ছেন সাহায্য করার মত কেউ আছে কিনা।

ডাক্তাররা আমাদেরকে বললেন, প্রকৃত সাহায্য দরকার রানা প্লাজার ভেতরে যারা এখনও আটকে আছে তাদের। আপনারা বরং বিল্ডিংয়ের পেছনে যাবার চেষ্টা করুন,সেখানে মানুষের অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু জীবিত লোক আছে কিন্তু তাদের অক্সিজেন সাপোর্ট দরকার। আর দরকার তরল খাবার।

আমরা ছুটলাম। এক দোকান থেকে কিছু জুসের বোতল কিনলাম এবং আবার জনসমুদ্র ঠেলে সামনে যেতে থাকলাম। এক স্থানে বাইক রেখে আমরা হাটতে থাকলাম কিন্তু একটা পর্যায়ে আর হাটা সম্ভব হলনা। মানুষ একটার পর আরেকটা এমনটি আশপাশের ছাদের ওপর এবং টিনের ওপরও দাড়িয়ে রয়েছে। এদের কারনে অনেক কাজে সমস্যা হচ্ছিল। তামাশা দেখা ছাড়া এই জনতার আর তেমন কিছু করার নেই। এখানে আমরা কিছু লোকের সাহায্য পেয়েছি এবং তারা আমাদেরকে খানিক পথ করে দিল। চিড়ে চ্যাপ্টা হয়েও শেষ পর্যন্ত আমরা রানা প্লাজার পেছনের গলিতে প্রবেশ করতে পারলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো ভাবেই আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছানো।









পেছন দিক দিয়ে বিল্ডিংয়ের কাছে গিয়ে আৎকে উঠলাম। হায় আল্লাহ ! বিশাল নয় তলা বিল্ডিংটি মাত্র দুই তলায় নেমে এসেছে ! একটা ছাদের ওপর আরেকটা ছাদ এমনভাবে ধ্বসে পড়েছে যে,ভেতরে মানুষের বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষিণ। শুনেছি এখানে পাঁচ হাজার লোক কর্মরত ছিল। তাই যদি হয় তাহলে চোখ বন্ধ করে বলা যায় অধিকাংশই মারা গেছে। এখানে যতগুলো লোক কাজে নিয়োজিত তার চাইতে বেশী লোক দাড়িয়ে দাড়িয়ে দৃশ্য দেখছে। আমি বিরক্ত হলাম প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত বাহিনীদের আচরনে। আর্মী তার বিশাল বিশাল সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হয়েছে বটে তবে সেগুলোর কোনো কাজ নেই এখানে। সেগুলো রাস্তার শোভা বর্ধন করছে। দমকল কর্মীরা রয়েছে কিন্তু তারা ছাদ থেকে মই দিয়ে মানুষ পাড়তে পটু,এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে কাজ করতে হয় সেটাই বোধহয় শেখার জন্যে অধিকাংশের আগমন। কিন্তু কিছুকাল পূর্বে যে বেশ কয়েকটি উঁচু ভবন ধ্বস হয়েছিল,তারা সেখান থেকেও তো ব্যাপারটা শিখতে পারত !

এখানে দরকার ছোট কিন্তু কার্যকরী যন্ত্রপাতি,যা দিয়ে দ্রুত কংক্রিট খুড়ে ভেতরে প্রবেশ করা যায় এবং ধবংশাবশেষ সরানো যায়। কিন্তু এদের হাতে রয়েছে বাঙ্গালীর সাবল,খুনতি,কোদাল। সম্ভবত ড্রিল মেশিন ছিল কিন্তু সেটা কাজের নয়। প্রশিক্ষিত সরকারী বাহিনীর ঢাল তলোয়ার নেই ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হল। এখানে একটি বড় টিনশেড গুদামকে ভেঙ্গে স্থান তৈরী করা হয়েছে যাতে উক্ত ভেঙ্গেপড়া ভবনে উদ্ধারকাজ সহজ হয়। এখানে মাঝারি সাইজের কোনো যান বা সরঞ্জাম নির্দিধায় ঢোকানো যেত। পৃথিবীতে এজাতীয় ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বহুদেশে এমনটা ঘটেছে এবং তারা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সেসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। আমাদের সরকার পকেটের টাকা দিয়ে পদ্মা ব্রিজ তৈরীর কথা ভাবে কিন্তু অতি নগণ্য দামের এসব জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম বারবার ভবন ধ্বসের পরও কেনা হয়না। এক ভবন ধ্বসে পুরো ঢাকা অচল হলে এমন কয়েকটি ভবন ধ্বসে পড়লে তো পুরো দেশ আচল হয়ে যাবে !



এখানে হাত দিয়ে যতটুকু করা যায় তাই করা হচ্ছে এবং ঘটনার চতুর্থ দিনেও একটি ফ্লোরও উম্মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কারখানাটি আয়তনে বেশ বড় আর মানুষকে উদ্ধার করা হচ্ছে যারা দেওয়ালের বাইরের অংশের কাছাকাছি ছিল তাদের। শুনলাম ভেতরে বেশ কিছু লোক জিবীত রয়েছে। তাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ফুটো করে তার ভেতর দিয়ে জুসের বোতল এবং পোর্টেবল অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। এমন এক বোতলে ২৮০ থেকে ৩০০ সেকেন্ড তারা নিঃশ্বাস নিতে পারবে। এটা তাদেরকে খানিকক্ষন চাঙ্গা রাখতে পারে বলেই দেওয়া।

আমি অবাক হলাম এখানে পরিচিত এবং টেলিভিশনে কথাবাজ লোক ও তাদের সংস্থাগুলোকে দেখতে না পেয়ে। সম্ভবত ওরা এমুহুর্তেও টেলিভিশনের পর্দা কাপাচ্ছে। এখানে কাজ করতে দেখলাম আর্মী,দমকল কর্মী,রেডক্রিসেন্ট,আল মুসলিম গার্ড,আল মুসলিমুন,ভিয়েনা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হোপ ৮৭,আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম এবং অন্যান্ন স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ। এলাকার যুবকরা এবং বিভিন্ন গার্মেন্টস কর্মীরা সার্বিক সহযোগীতা করছে। এদের অনেকে সাহস নিয়ে ছোট ছোট ছিদ্রপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকে ভেতরের খবর নিচ্ছে এবং সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। উদ্ধার তৎপরতা অত্যন্ত ভয়াবহ রকমের ধীর গতির। আমরা যে অংশে আছি সেখানে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছেনা। ফলে তারা সকল রিপোর্ট করছে রাস্তায় দাড়িয়ে। যেভাবে খুশি সেভাবে তারা দেশবাসীকে খবর জানাচ্ছে। তাদের রিপোর্টগুলো পরষ্পর বিরোধী। প্রতি দুই ঘন্টায় গড়ে প্রায় তিনজনকে উদ্ধার করা হচ্ছে বলে মনে হল। এটি অবশ্য সময় হিসেবের ব্যাপার নয় কিন্তু ব্যাপারটি এমনই ধীর গতির। তবে পত্রিকা-টেলিভিশন বলছে এখন পর্যন্ত নাকি দুই হাজার লোককে জীবন্ত উদ্ধার করা হয়েছে(???)। ভবনের ওপাশ থেকেও একইভাবে লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। আমার হিসেব মতে ১২/১৩ ঘন্টায় এপাশ থেকে ৩০ জনের বেশী উদ্ধার করা হয়নি(আমরা এখানেই ছিলাম)। বাকী লোকগুলোকে বোধহয় মিডিয়া উদ্ধার করেছে ! তবে কাওকে জীবিত উদ্ধার করা হলে তা দেখতে খুব ভাল লেগেছে,খুবই স্বস্তি পেয়েছি। উদ্ধারকৃতদের অধিকাংশই নারী।

আমি দেখলাম ওপরের একটি গর্ত থেকে এক মেয়েকে উদ্ধার করা হল। ভবনের কার্নিশে দাড়িয়ে সে অপলক তাকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল তার সমস্ত স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে এই ভয়াবহতায়। খানিক পরই সে জ্ঞান হারালো,তাকে হাসপাতালে নেওয়া হল। এভাবে বেশ কয়েকজনকে আহত হওয়া ছাড়াই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। একটি ঘরে পঞ্চাশজনের মত জীবন্ত লোক আছে জানা গেল। সে ঘরটিতে একটি বড় মেশিন ছিল আর ছাদ এসে সেটার ওপর পড়েছে,ফলে তার নীচের দিকে যে ফাকা স্থান তৈরী হয় সেখানে তারা আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আশপাশের লাশপচা গন্ধে এবং অক্সিজেনের স্বল্পতায় তাদের অবস্থা কাহিল। চেষ্টা চলছে উদ্ধারের(খালি হাতে)। অনেকে গত কয়েকদিন ধরে খুবই সংকীর্ণ স্থানে উপুড় হয়ে বা চিৎ-কাৎ হয়ে পড়ে রয়েছে। ভারী কংক্রিট তাদের ওপর এসে পড়াতে নড়তে পারছে না কিন্তু বেচে রয়েছে। অধিকাংশ মানুষের অবস্থা এরকম চাপাপড়া এবং এদের অধিকাংশই মারা গেছে। অনেকে এমন চাপা পড়ে বেচে আছে কিন্তু দেখেও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধার তৎপরতা দেখে যে কেউ’ই বুঝতে পারবে যে,আগামী ছয় মাসেও এরা পুরো ভবনটির ধবংশাবশেষ সরাতে সক্ষম হবেনা।

পাশের ভবনে বড় একটা ফাটল দেখলাম,সেটা যেকোনো সময়েই ভেঙ্গে পড়তে পারে উদ্ধার কর্মীদের ওপর। দেখলাম মাত্র পাচ ইঞ্চি গাথুনিকে প্রায় চল্লিশ ফুট পর্যন্ত উঁচুতে নিয়ে গিয়ে সেখানে টিন লাগানো হয়েছে। এ জিনিস এতদিন টিকে ছিল সেটাই বিশ্ময়। নয়তলা যে ভবনটি ভেঙ্গে পড়েছে সেটার কংক্রিটের দিকে তাকিয়ে যে কেউ বলে দিতে পারবে এখানে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি,অথবা শুভঙ্করও বোধহয় এত ফাকি দিত না। রড থেকে নিম্নমানের ইটের খোয়ার ঢালাই এমনিতেই যেন খসে পড়ছে। সিমেন্ট আদৌ ব্যবহৃত হয়েছে কিনা গবেষনার বিষয়।

আমরা এখানে এসে বুঝলাম এখন দরকার অক্সিজেন,তরল খাবার,তরল খাবার স্যালাইন,পানি,টর্চ লাইট ইত্যাদী। সজিব এইচ.এস এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার হেমা হেলালের সাথে যোগাযোগ করে সবকিছু জানালো। এরা স্নেহা ফাউন্ডেশন নামক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সকল সহযোগীতা পাঠাবে। তারা কোথা থেকে কি কিনবে,কোনটা ভাল সকল বিষয়ে সজিব নির্দেশনা দিল। আমরা এটা ডাক্তার, এনজিও কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জেনেছি। আমরা এ স্থানের বাইরে গেলাম। কারণ একশ মিটার দূর থেকেই পচা লাশের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে এয়ার ফ্রেশনার ¯স্প্রে করছে কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। আমরা মুখে মাস্ক ছাড়াই কয়েক ঘন্টা ছিলাম।

আমরা পারভেজকে ইতিমধ্যেই নির্দিষ্ট কিছু স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছি পিকআপ ভ্যান দিয়ে। এবং বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে আমরা সরঞ্জাম যোগাড়ে ব্যস্ত। আমরা আছরের নামাজের পর প্রিন্স ক্লিনিকের সামনে দাড়িয়ে ছিলাম,তখন তারা আমাদেরকে পানির বোতল দিল। এরা প্রচুর পানির বোতল ফ্রি বিতরন করছে যারা বিপদগ্রস্তদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। এখানে আমরা খানিক বিশ্রাম নিলাম। তারা আমাদেরকে একটি রুম খালি করে বসতে দিল। আমাদের মোবাইলে চার্চ দেওয়ার ব্যবস্থা করল।

রিসিপশনের স্থানে দেখলাম ৬০/৭০জন লোক টিভি দেখছে। হঠাৎ এন টিভিতে দেখলাম আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই দূর্ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করছেন। তিনি বললেন বিরোধী দলীয় লোকেরা ভবনের কলাপসিবল গেট ধরে নাড়িয়েছে আর এতে প্রথমে একটি পিলার ধ্বসে পড়ে এবং যেহেতু এতে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয় তাই সকল পিলার ভেঙ্গে পুরো ভবনটি ধবংশ হয়ে যায়। তার কথা শেষ হবার আগেই সম্মিলিত জনতা হো হো করে হেসে উঠল,একজন আবার তার মস্তিষ্ক বিকৃতির খবর দিল। আর আমি ভাবছিলাম পিলারগুলো নিশ্চয়ই বওলিং খেলার জন্যে সাজানো ছিল। বিরোধী দল এসে একটায় আঘাত করেছে এবং সফলতারসাথে সবগুলো পড়ে গেছে। এই বওলিং ঘুটি সদৃশ পিলারগুলো যিনি সাজিয়ে জ্যান্ত মানুষদেরকে ডেকে এনে মেরে ফেললেন তার ব্যাপারে তেমন আওয়াজ শোনা গেলনা। কেউ কেউ আওয়াজ দিয়েছে কিন্তু জনাব রানা নামক আওয়ামী নেতাটি আটক হননি। স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ‘অপরাধী যেই হোক শাস্তি তাকে পেতেই হবে,কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বললেও’ অপরাধী এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অতীতেও এমন হয়েছে এবং তখনও তাদেরকে ছাড় দেওয়া হয়নি। মূলত: প্রথমে তাদের জন্যে কোনো ছাড় থাকেনা,তারপর ধীরে ধীরে তাদের ছাড়ের হার বাড়তে থাকে এবং একসময় দেখা যায় শ্রমিকদের জীবনের মূল্যে তারা ১০০% ছাড় পেয়েছে।

মূলত: ভবনটি ঝুকিপূর্ণ তাই সেখানে অবস্থিত পাঁচটি গার্মেন্টসে কর্মীদের না যেতে প্রশাসন নির্দেশ দিয়েছিল বলে জানা গেছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনিক এক কর্মকর্তা সেখানে গমন করার ব্যাপারে অনাপত্তি জানিয়েছিলেন বলেও শুনছি। আর কারখানার মালিক শ্রমিকদেরকে জোর করে সেখানে নিয়ে আসে। তারা না আসলে বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হবে মর্মে হুমিয়ারী উচ্চারণ করা হয়,বলে আহত শ্রমিকরা জানিয়েছে। ফলে গরিব এবং চীর বঞ্চিত শ্র্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী সেই কর্মীরা সেখানে গমনে বাধ্য হয়। এরপরের ঘটনা সবার জানা।

নির্দিষ্ট কিছু দোকানে ক্যান অক্সিজেন পাওয়া যায় আর সেটা বন্ধ হওয়াতে আজ নেওয়া সম্বব হলনা। আগামীকাল কয়েক’শ অক্সিজেন ক্যান এবং মাস্ক নিয়ে আরেকটি গাড়ি রওনা হবে বলে শাহরিয়ারের সাথে কথা হল। বিডি সাইক্লিস্ট নামক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ওরা আগামী কাল সকালে পৌঁছাবে। পারভেজের ভ্যানে গ্লোব বেভারেজের এম.ডি সাহেব তার ব্রান্ডের পানীয় তুলে দিলেন নিজহাতে,রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালসের এম.ডি নিজ দায়িত্বে কিছু জিনিস কিনে দিলেন আর স্নেহা ফাউন্ডেশন দিল সবথেকে জরুরী কিছু সরঞ্জাম অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং খাবার।

রাত ১২টার পর আমরা প্রবেশ করলাম ভেতরে। আমি বড় কার্টুন মাথায় নিয়ে দৌড় দিলাম পেছনের পাশে,সজিব ভারী সিলিন্ডার মাথায় নিয়ে দৌড়াতে থাকল। রাস্তায় কাদা,তার মধ্যদিয়েই দৌড়। আমাদের সাথে আরও ৮জন তরুন ছিল সাহায্যের জন্যে। সজিব খেটেছে লেবারের মত। ওকে দেখে হিংসার জ্বলছিলাম কারণ আখিরাতের কল্যানের জন্যেই তো এখানে আসা। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমাকে পেছনে ফেলে সে ওদিকেই দ্রুতবেগে ধেয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মানুষের সাথে সেই’ই যোগাযোগ রক্ষা করছিল। মানুষকে প্রেরনা দিয়ে কাজ করাচ্ছিল। যারা উপস্থিত হয়নি তাদেরকে আহবান করছিল। যারা ধনী তাদেরকে সাহায্য করতে বলছিল এবং তারা সাড়া দিয়েছে এবং শিঘ্রই আরও দিবে। সজিব কোনো কাজে ঘাড় বাধালে সেটা ও ঠেলে নিয়ে যাবেই। দক্ষতা,নিষ্ঠা,একাগ্রতা,সততা,সহানুভূতিশীলতা এসব দিকে তাকালে ওকে সকলেই হিংসা করবে। আল্লাহর রহমত ওর ওপর। পারভেজকে ধন্যবাদ যে,সেই দুপুর থেকে না খেয়ে পিকআপ ভ্যান নিয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। স্নেহা ফাউন্ডেশনের কর্মীদেরকে ধন্যবাদ,এই রাতে তারা এসেছে মানবতার সেবায়। আর খানিক সাহায্যের জন্যে আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার মত ফাউল লোকটাকে তার রহমত থেকে বঞ্চিত করবেন না !

অবাক হলাম সরকারের পক্ষ থেকে বিপদগ্রস্তদের জন্যে এক বোতল পানিও সরবরাহ না করাতে। প্রচুর অক্সিজেনের দরকার হয়েছে কিন্তু তেমন কিছুই করা যায়নি। যেখানে সরকারের এক অর্ডারে ঘটনা ঘটে যায়,সেখানে অর্ডারের বাস্তবায়ন এখানে চোখে পড়ল না। সব অর্ডার হয়ত ক্যামেরার জন্যে। হায় ক্যামেরাগুলোর যদি জীবন থাকত ! একযোগে আত্মহত্যা করত। তারা বাহিনী প্রেরন করে সাহায্য করেছে কিন্তু এখানে আরও অনেক কিছু দরকার ছিল। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরকে প্রত্যক্ষ তদারকি বা অপ্রত্যক্ষ উন্নয়ন তদারকি চোখে পড়ল না।

সকল সাহায্য দিয়েছে ভিভিন্ন ব্যক্তি এবং ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান। অনেক যুবক বলেছে আমাদের পকেটের সব টাকা শেষ করেছি অসহায়দের জন্যে। সারারাত ধরে থাকবে তারা এবং অপরিচিত এই দুস্থদেরকে সেবা করবে। আল্লাহ তাদেরকে অতি উত্তম প্রতিদান প্রদান করুক ! মজলুমের সহায্যকারীকেই তো আল্লাহ পৃথিবী এবং আখিরাতে সফল করেন।





হঠাৎ ধোয়া দেখতে পেলাম এবং উদ্ধার কর্মীদের চিৎকার শোনা গেল পানির জন্যে। ভেতরে আগুন ধরে গেছে। এরমদ্যে দেখলাম অনেকে প্রবল বেগে এয়ার ফ্রেশনার ¯েপ্র করছে। চিৎকার করে বললাম থামান ! ওতে এ্যালকোহল থাকে,ওটাই আগুন ছড়াবে। অনেক পরে বুঝল। অদক্ষ লোকেরা গ্যাস-কাটার দিয়ে ভেতরের রড কাটার চেষ্টা করলে ভেতরে থাকা ফেব্রিকসে আগুন লেগে যায়। আমাদের অংশের দুপাশ থেকে প্রচন্ড ধোয়া বেরোতে থাকে। পানি চাইলেও দমকল কর্মী পানি দিতে পারেনি,অথচ গত চারদিন এরা ননস্টপ এখানে নানান কর্মকান্ডে লিপ্ত। পানি এসেছে তবে কমেডি শো শুরু হয়েছে। ইঞ্জিন স্টার্ট হয়েছে কিন্তু পাইপে পানি আসছে না। কয়েকজন ছুটল গাড়ির কাছে। খানিক পর আসল পানি তবে তেজ নেই। খানিকপর তেজ আসল তবে পাইপের মাঝামাঝি স্থান হতে পাইপটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ফলে পানি পড়তে থাকল। খানিকপর সেটা ঠিক করা হল কিন্তু সকলে যাদেরকে মারতে উঠে পড়ে লেগেছে,তাদের বাঁচানো কি এত সোজা ? পাইপের মাথার যে অংশটি পানি প্রবাহিত করে সেটাই খুলে পড়ে গেল। এদের দক্ষতা দেখে কেঁদে বুক ভাসানো ছাড়া উপায় নেই। এটাও একসময় ঠিক হল এবং পানি ছোড়া হল। তবে আমার মনে হচ্ছিল ভেতরে যেসব লোক আহত অবস্থায় অল্প অক্সিজেন নিয়ে ধুকে ধুকে বেচে ছিল এই ধোয়া তাদেরকে ওপারের রাস্তা পাকা করে দিল।

ভবনটি যেভাবে ধ্বসে পড়েছে তাতে অধিকাংশ মানুষই প্রথম প্রহরে মারা গেছে। পতিত ভবনের বিভিন্ন ফাকা স্থানে যারা সামান্য অক্সিজেনে বেচে ছিল ,এই ধোয়া সে অক্সিজেন নষ্ট করে ফেলেছে। আর এতে বহু আহত লোক প্রাণ হারাতে পারে। তবে এই আগুন লাগার পরও কয়েকজনকে জীবন্ত উদ্ধার করা হল এবং তারা মোটেও আগত হয়নি। এরা মূলত ওই মেশিন রূমের লোক,যাদেরকে মেশিনটি ছাদ হয়ে নিরাপত্তা দিয়েছে। ভেতরে এমন কিছু ফাকা স্থান থাকা বিচিত্র নয়। তবে তাদের কাছে কে যাবে ? কবে যাবে ??

পাশের ভবনে বিরাট ফাটল দেখা দেওয়ায় পুলিশ এবং আর্মীরা সেখান থেকে অনেককে সরিয়ে দিল। তারপরও আমরা সেখানে ছিলাম। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এগিয়ে দিচ্ছিলাম। জানি আমাদের সাহায্য খুবই অপ্রতুল কিন্তু আমাদের অন্তরের অনুভূতিতে কোনো খাদ নেই। জন্ম থেকে নির্যাতিত ওই অবাঞ্চিত শ্রেণীর প্রতি আমাদের অন্তরের ভালবাসা রয়েছে সেটা প্রকাশ করতেই এখানে আসা। আর যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানামুখী প্রতিকূলতায় এখানে আসতে পারেনি,তাদের অন্তরের ইচ্ছা আল্লাহ নিশ্চয় কবুল করবেন। শেষ রাতের দিকে বাড়ি ফিরলাম।

ইয়া আল্লাহ ! তুমি জান,এই পৃথিবীতে ওরা জন্ম থেকেই কষ্টে আছে। তোমার প্রতি যাদের ঈমান আছে,তাদেরকে তুমি ক্ষমা করে দাও এবং জান্নাত দান কর ! ওদের কোনো রাষ্ট্র নেই,সমাজ-সরকার নেই, শুধু আছে জালিম শাসক ! মজলুমকে তুমি উদ্ধার কর ! তাদের প্রতি তোমার অশেষ রহমত বর্ষণ কর !!!

বিষয়: বিবিধ

৪০৯১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File