মধ্যযুগে বাগদাদ এবং ইউরোপের বিদ্যা চুরী

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৩ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:২২:৪৫ সকাল



বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে মুসলমানদের গৌরবময় সাফল্য ঃ

সাধাণভাবে মনুষ্য বুদ্ধিবৃত্তিক সর্বপ্লাবী সাহিত্য, নীতিশাস্ত্র, অধিবিদ্যা যুক্তিবিদ্যা, অলঙ্কার শাস্ত্রের ক্ষেত্রে মুসলিম লেখকদের সংখ্যা ছিল হাজারে হাজারে ,কাব্য জগতে মুসলিম মনীষীরা অদ্যাবধি অনতিক্রান্ত। আরব্য কবি মুতান্নবী (রসূলের সাঃ সময়কার কবিদের হিসাব না নিয়েও) থেকে ভারতীয় কবি হালি পর্যন্ত অগণিত মুসলমান কবি রয়েছেন। মুতান্নবী নবম শতাব্দীর কবি এবং তিনি আমির সায়েফ উদ দৌলার (আবুল হাসান আলী বিন হামাদানের) পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তার পরে এসেছিলেন ইবনে দুরাইদ, আবু উল, ইবনে ফারিদ, তানতারানি ও অন্যান্য সব। স্পেনের আরব কবি প্রকৃতির কবি ছিলেন, তারা বিভিন্ন ধরনের কবিতার জন্ম দিয়েছিলেন; পরে সেই কবিতা দক্ষিণ ইউরোপের খ্রিস্টান জাতিসমূহের দ্বারা মডেল হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। সে সব বিখ্যাত কবি স্পেনে হয়েছিলেন তাদের মধ্যে আহমদ ইবনে মুহম্মদ (আবু ওমর) নাম সর্বাপেক্ষা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মাহমুদের পৃষ্টপোষকতায় বহু কবি সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন। ফেরদৌসী ইবনের মৃত কবিদের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি যে সুলতানের প্রশংসাগীতি গেয়েছিলেন এবং পরে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছিলেন তারই সুখ্যাতির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছিলেন। পরবর্তী গজনবী ও সেলজুক সুলতানদের অধীনে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ফরাসী ছান্দনিক রীতির প্রর্বতক গীতিকবি সুজোন ও ওয়াত; ¯ু—তিবাদী কবি আনওয়ারী খাকানী ও জহির ফারিত্রবী মহান মিষ্টীক কবি সানাসী যার হাদিকা যেখানে ফারসী ভাষা জ্ঞাত ও খ্যাত সেখানে মূল্যবান সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত এবং ফরিদ উদ্দীন আত্তার আর রোমান্টিক কবি নিযামী খসরু ও শিরীন ও আলেকজান্ডার চারণকবি। সেলজুক বংশের পর আতাবেগ ক্ষমতাসীন হন তার শাসনামলে নীতিবাদী শেখ সাদী ও মিষ্টিক জালাল উদ্দীন রুমী সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তৈমুরের জমানায় পারস্যের অ্যানাক্রিয়ান সুকন্ঠ গায়ক কবি হাফিজ (সামশুদ্দিন) আবির্ভুত হয়েছিলেন। এসব কাব্যজগতের বিখ্যাত নামগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি। ইবনে খাল্লিকান ও লুৎফ আলী আজরের গ্রন্থে মুসলমান জাতির প্রতিভাবান কবিদের কথা বর্ণিত হয়েছে।

বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে এরুপ ছিল মুসলমানদের গৌরবময় সাফল্য আর এ সবই সম্ভব হয়েছিল একটিমাত্র লোক মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্য। তারা যে বর্বরতা ও অজ্ঞানতার গহীনে নিমজ্জিত ছিল, তার আহবানে বর্তমানের বা ভবিষ্যতের কোন আশা না করে আরবগণ জগতজনকে সমুন্নত করতে সকলকে সভ্য বা সংস্কৃত করতে এগিয়ে গেলেন। নির্যাতিত, অবহেলিত মানবতা নবজীবন লাভ করল। যখন ইউরোপের বর্বর জাতিসমূহ ক্ষীয়মান সাম্রাজ্য বিপর্যস্ত করে অজ্ঞানতা ও নিষ্ঠুরতা অন্ধকারের মধ্যে দিশেহারা হয়ে চলছিল সেই সময়ে মুসলমানরা এক মহান সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। ইউরোপে শতাব্দীর পর শতাব্দী যখন নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসন্নতা চলছিল তখন ইসলাম প্রগতির সারথ্য করছিল। সিজারের সাম্রাজ্যের উপর খ্রীষ্টধর্ম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, কিন্তু তা পৃথিবীর জাতিসমূহকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেনি,মুক্তির পথ দেখাতে পারেনি। খ্রীষ্টিয় চতুর্থ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত যে নৈরাশের অন্ধকার ইউরোপকে গ্রাস করেছিল তা আরও গভীরতর হয়েছিল। হিংস্র ধর্মান্ধতার যুগে যাজকতন্ত্র যে পথ দিয়ে জ্ঞান মানবতা বা সভ্যতা প্রবেশ করতে পারত সে পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। যদিও ঈর্ষাবশতঃ এই ধর্মান্ধ দেশে ইসলামী সংস্কৃতির হিতকর প্রভাব অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল তথাপি যথা সময়ে খ্রীষ্টানজগতের সর্বত্র অনুভূত হয়েছিল। স্যালারনো, বাগদাদ, দামেস্ক, গ্রানাডা ,মালাগার স্কুলসমূহের মাধ্যমে সুসলমানেরা বিশ্বকে দর্শনের পাঠ এবং কঠোর বিজ্ঞানের ব্যবহারিক শিক্ষা দান করেছিল। পাশ্চ্যাত্যে বুদ্ধিবাদের প্রথম অভিব্যক্তি ঘটেছিল সেই প্রদেশে, যে প্রদেশ মুসলিম সভ্যতার শক্তির বশবর্তী হয়েছিল। যাজকতন্ত্র এই সুন্দর ফুলটি অগ্নি ও তরবারীর সাহায্যে ধ্বংস করেছিল এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জগতের প্রগতিকে পিছু হটিয়ে দিয়েছিল। এ অবস্থায় মুসলিমরাই ইউরোপীয়দেরকে আলোর পথের দিকে নিয়ে যায় অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে। অ্যাবেলার্ড ইবনে রুশদের প্রতিভার শক্তি অনুভব করেছিলেন, যে শক্তির আলো সমগ্র ইউরোপে বিকীর্ণ হয়েছিল। অ্যাবেলার্ড স্বাধীন চিন্তার জন্য এমন আঘাত করেছিলেন যা শেষ পর্যন্ত যাজকতন্ত্রের বন্দীদশা থেকে খ্রিষ্টানজগতের মুক্তি দিয়েছিল। ইবনে বাজ্জা ও ইবনে রুশদ, দেকার্তে হবস ও লকের অগ্রদূত ছিলেন। অ্যাবেলার্ড ও তার সম্প্রদায়ের প্রভাব শীঘ্রই ইংল্যান্ডে প্রবেশ

লাভ করেছিল। ওয়াইক্লিফের চিন্তা ও স্বাধীনতার মনোভঙ্গীর মৌলিকতা পূর্ববর্তী চিন্তাবিদের বলিষ্ঠ ধারণা থেকে আসে। পরবর্তী জার্মান সংস্কারকগণ একদিক দিয়ে তাদের ধারণা পেয়েছিলেন কনস্ট্যান্টিনোপলের প্রতিমা ভঙ্গকারীদের কাছ থেকে এবং অন্যদিক দিয়ে পেয়েছিলেন অ্যালবিজিনীয় ওয়াইক্লিফপন্থীদের আন্দোলন থেকে। বিদেশী বুদ্ধিবাদীদের প্রভাবে যারা কাজ আরম্ভ করেছিলেন তাদের কাজের সমাপ্তি টেনেছিলেন তারা।

যখন খ্রিষ্টান ইউরোপ বিদ্যার্জনকে নির্যাতনের বিষয়ে পরিণত করেছিল, যিশুখ্রীষ্টের প্রতিনিধিগণ স্বাধীন চিন্তার কণ্ঠস্বর করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন পুরোহিত সম্প্রদায় হাজার হাজার নির্দোষ ব্যক্তিদেরকে চিন্তার ব্যতিক্রমের জন্য আগুনে পুড়িয়ে মারার পথ প্রশস্ত করেছিল, খ্রিষ্টান ইউরোপ যন্ত্রের সাহায্যে ভূত ছাড়াত এবং ছিন্নকন্থা ও অস্থির পূজা করত-তখন বিদ্যার্জন মুসলিম নৃপতিদের অধীনে সমৃদ্ধি লাভ করেছিল এবং অভূতপূর্ব সম্মানে ভূষিত হয়েছিল। মুহাম্মদের(সাঃ) প্রতিনিধিবৃন্দ সভ্যতার অগ্রগতির কাজে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন ও পবিত্রতা প্রতিপন্ন করেছিলেন তারা তার বিকাশে সাহায্য করেছিলেন। ধর্মের জন্য জুলুম ইসলামে অনুপস্থিত ছিল; শাসকদের সকল ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মমতের প্রতি পরিপূর্ণ সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে বিশ্বজগৎ তাদের চেয়ে উত্তম দৃষ্টান্ত কখনও দেখেনি। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহের চর্চা একটি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার মহান নির্দেশক মুসলমানদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় পেশায় পরিণত হয়েছিল।

বিদ্যা চুরিঃ

আমাদের বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো প্রথম হাতছাড়া হয়ে যায় রজার বেকনের মাধ্যমে। মুসলমানরা স্পেন বিজয় করার পর কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রজার বেকন এই কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হয় এবং মুসলিম বৈজ্ঞানিকদের নিকট থেকে মূল্যবান বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলো সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যায় ও বিখ্যাত দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের কাছে হস্তান্তর করে। রজার বেকনের গ্রন্থ Cepus Majusএর পঞ্চম ভাগ সম্পূর্ণভাবে ইবনে হায়সামের ‘আল মানাজির’ গ্রন্থের নকল। এই পথ ধরে ক্রয়োদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ফ্রেডরিকের সহায়তায় ইউরোপের ইহুদী ও খৃষ্টান পন্ডিতেরা বহু অংক শাস্ত্রের বিশাল মুসলিম জ্ঞানভান্ডার হস্তগত করেছে। এরা মুসলিম বিজ্ঞান হস্তগত করেই ক্ষান্ত হয়নি, অনেক মুসলিম কৃতিত্বকে নিজেদের বলে সারা বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেছে।

১. কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারঃ কলম্বাসের বহু পর্বেই আমেরিকা আবিস্কৃত হয় এবং আফ্রিকান মুসলমানরা কলম্বাসের অনেক আগেই আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকা পৌঁছেন। কলম্বাস নিজেও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক আফ্রিকান লোককে দেখতে পান যারা কয়েকশ’ বছর আগে থেকেই সেখানে বসবাস করে আসছিলো। এ স¤পর্কে দৈনিক ক্লারিয়ান অব বেলাইজ পত্রিকার একজন ক্যারিবীয় লেখক লিখেন, “ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন ১৪৯২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবিস্কার করেন তখন তিনি একটি জাতির সাক্ষাৎ লাভ করেন। যারা সমুদ্রে মৎস শিকার করতো এবং জমি চাষ করতো। তারা আগ্রাসনকে ঘৃনা করতো। তাদের ধর্ম ছিল মোহাম্মদানিজম এবং ভাষা ছিল আরবী। অথচ কলম্বাস ও তার অন্যান্য পশ্চিমা সহযোগীরা আমেরিকা আবিস্কারের প্রকৃত সত্যকে চেপে রেখে নিজেরা কৃতিত্বের দাবিদার হয়েছেন।

২. কলম্বাসের মতই আরেক মিথ্যা কৃতিত্বের দাবিদার পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা (১৪৯৮)। মূলতঃ জ্যোতির্বদ্যা জাহাজ পরিচালনা বিজ্ঞান, মহাসাগরের বৈজ্ঞানিক বর্ণনা এবং সাগরের প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পর্কে বহু গ্রন্থের প্রনেতা আহমদ বিন মজীদই ছিলেন ভাস্কো-ডা-গামা সমুদ্র পথে ভারতে আসার পথ প্রদর্শক। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রধান অধ্যাপক অম্বপ্রসাদ এ তথ্য আবিস্কার করেন। তাছাড়া আরবী, পর্তুগীজ, রুশ, ও ইংরেজীতে লিখিত প্রবন্ধাদি ও বিভিন্ন এলাকার জনশ্র“তি থেকেও জানা যায় যে, ভারতে আসার সমুদ্র পথ আবিস্কারক আহমদ বিন মজীদ ছাড়া অন্য কেউ নন।

৩. এখানেই শেষ নয়। নিচের ক্লাস থেকেই আমরা জেনে এসেছি যে, দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিস্কারক হচ্ছেন গ্যালিলিও। অথচ সর্বপ্রথম আবুল হাসান(৮৩৩খ্রিঃ) নামক একজন মুসলিম পদার্থ বিজ্ঞানী এটি আবিস্কার করে সারা বিশ্বে চমক লাগিয়ে দেন। ঘটনার ৮ শত বছর পর গ্যালিলিও এর আবিস্কারক ছিলেন না বরং উন্নত সংস্কারক ছিলেন মাত্র।

৪. স্যার আইজ্যাক নিউটনের মধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব সম্পর্কেও না বললেই নয়। Science Today’র নভেম্বর ১৯৮০ সংখ্যাতেই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, মধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের জন্য নিউটনকে পুরোপুরি কৃতিত্ব দেয়া ঠিক নয়, কারণ স্যার নিউটন ধারণাটি পেয়েছিলেন এক আরব মুসলিম বিজ্ঞানীর লেখা থেকে। অর্থাৎ মধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের ধারণাটি আসলে ঐ মুসলিম বিজ্ঞানীরই। তিনি ধারণা পান এ আয়াত থেকে। “নিশ্চয় আল্লাহ্ আসমানকে এমনভাবে ধরে আছেন যেন তা পড়ে না যায়।” -(আল্ কুরআন), নিউটনের অনেক আগে ধারণাটি দিয়েছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত সূফী,দার্শনিক,কবি, আল্লামা রুমি। তিনি তার কবিতায় ব¯ু—র পরস্পরকে আকর্ষণের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কবিতায় নয়, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় এ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেন বিজ্ঞানী ইবনুল হাইসাম তার “মাকালাতুল ফি মারাকাজুল আসকাল’ গ্রন্থে। অতএব দেখা যাচ্ছে, স্যার নিউটন এই ব্যাখ্যাটির নির্ভুলতা প্রমাণকারী মাত্র।(১৬৬৫)

৫. স্যার নিউটনের নামে আরেক জঘন্য কীর্তি হলো The formula of Interpolation' আবিস্কারের মিথ্যা দাবিদার সাজা। মূলতঃ সূক্ষ্ম ও শুদ্ধ গণনায় মুসলিম বিজ্ঞানী আল বেরুনী যে বিস্ময়কর পন্থা আবিস্কার করেন তারই বর্তমান নাম The formula of Interpolation' । যদিও নিউটনের জন্মের ৫৯২ বছর পূর্বেই আল বেরুনী এটি আবিস্কার করেন, তথাপি পাশ্চাত্য পন্ডিতগণ এটিকে নিউটনের আবিস্কার বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন(নির্লজ্জভাবে)।

৬. ‘বাইনোমিয়াল থিউরাম’ এর আবিস্কারক হিসেবে স্যার নিউটন বিখ্যাত হয়ে আছেন। অথচ নিউটনের জন্মের পূর্বেই সর্বপ্রথম বীজগণিতের ক্ষেত্রে ‘বাইনোমিয়াল থিউরাম’ আবিস্কার করেন মুসলিম কবি ও বৈজ্ঞানীক ওমর খৈয়াম। মূলতঃ এভাবে ইউরোপ মধ্যযুগের মুসলিম বিজ্ঞানীগন জ্ঞান ও বুদ্ধি বৃত্তিক উৎকর্ষ নিজেদের নামে চালিয়ে দিয়ে আজকের বৈজ্ঞানীক যুগের প্রতিষ্ঠাতা সেজে বসে আছে। তারা শুধু নাম বিকৃতিই নয় মুসলানদের গৌরবোজ্জল ইতিহাসকেও গোপন করেছে। শুধু তাই নয়,এ উদ্দেশ্যকে আরো সফল করার জন্য এবং মুসলিম বৈজ্ঞানীক সভ্যতার শেষ চিহৃটুকুও মুছে ফেলার জন্য ইউরোপীয় পন্ডিতেরা মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী আব্দুল্লাহ আল বাত্তানী (৮৫৮-৯২৯খ্রিঃ) এর নামকরণ করেছে বাতেজনিয়াস বা রেথেন। পদার্থ ইউসুফ আল ঘোরীর বিকৃত নাম লিপিবদ্ধ করেছে জোসেফ-টি প্রিজড। পদার্থ বিজ্ঞানী আল ফারাবী (৮৭০-৯৬৬খ্রিঃ) এর বিকৃত লিখেছে ফারাবিয়াস। চিকিৎসাবিদ ও বিজ্ঞানী ইবনে রুশদকে (১১২৬-১১৯৯খ্রিঃ) বিকৃতভাবে উল্লেখ করেছে এভেরুন বলে(তাদেরকে যখন নাম বিকৃত করার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল তখন তারা বলেছিল - আমরা তাদেরকে আদর করে এ নামে ডেকে থাকি)। অথচ তিনি ছিলেন বড়মাপের একজন বৈজ্ঞানীক ও অংকশাস্ত্রবিদ। বিকৃতভাবে উপস্থাপিত মুসলিম বৈজ্ঞানীকদের নাম ও পরিচয়ের এই তালিকা অনেক দীর্ঘ যা, স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।

৭. আমরা জানি ‘ফসিল বিদ্যা ’প্রথম চালু হয়েছিল ১৮ শতকে। কিন্তু এর ৮০০ বছর পূর্বে ইখওয়ানুস সাফা নামক একজন মুসলিম বিজ্ঞানী ভূমিতে জমাট বাঁধা সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিল নিয়ে গবেষণা করতেন। তিঁনি বলেছিলেন-একদা এ ভূমী সাগরগর্ভে নিমজ্জিত ছিল। তিঁনি ফসিল থেকে গবেষণালব্ধ বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছিলেন যা পরবর্তীদের পাঠ্যসূচী ছিল।

৮. আমরা জানি বা আমাদের জানানো হয়েছে যে,প্রথম আয়না তৈরী হয় ১২৯১ খ্রিষ্টাব্দে ভেনিসে। কিন্তু আয়না তৈরী হয় ১১ শতকের প্রথম দিকে মুসলিম স্পেনে। ভেনিসের বিজ্ঞানীরা কাঁচ তৈরী সংক্রান্ত বিদ্যা অর্জন করেছিল নবম ও দশম শতাব্দীতে খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত স্থান সিরিয়া থেকে।

৯. আমরা জানি ঘড়ী উদ্ভাবিত হয় ১৪ শতকে। সেটা ছিল-পানির সাহায্যে ব্যবহৃত ঘড়ী বা ওয়াটার ক্লক। প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ী তৈরী হয় ১৩৩৫ সালে ইটালীর মিলান শহরে। এটি ঠিক নয়। পৃথিবীতে যান্ত্রিক ঘড়ী সর্বপ্রথম তৈরী করেন স্পেনের মুসলিম বিজ্ঞানীরা। তারা ভারী,হালকা,ছোট,বড় সকল রকমের যান্ত্রিক ঘড়ী তৈরী করেন। মুসলিম বিজ্ঞানীদের ঘড়ী তৈরী সংক্রান্ত ফর্মূলার বই ইউরোপ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে। ইবনে ফিরনা নামক মুসলিম বিজ্ঞানী যিনি নবম শতাব্দীতে নিখুঁত ঘড়ী তৈরী করেছিলেন,তিঁনি আর আলোচনায় আসলেন না। ইবনে ফিরনা মহাকাশ গবেষণার জন্যও একটি নিঁখুত ঘড়ী তৈরী করেছিলেন। তাঁর বইটি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে নিজেদের নামে চালিয়ে ইটালী হয়ে গেল প্রথম নির্মাতা।

১০. আমরা জানি বিজ্ঞানী গ্যালিলিও পেন্ডুলাম তৈরী করেছিলেন ১৭ শতকে। কিন্তু পেন্ডুলাম তৈরী করেন একজন মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে ইউনুস আল মাসরী। তিঁনি ১০ম শতাব্দীতে এটি তৈরী করেন। এরপর পেন্ডুলামকে ঘড়ীর সাথে ব্যাবহার করেন একজন মুসলিম ডাক্তার ১৫ শতকে।

১১. স্থানান্তরযোগ্য টাইপ মেশিন এবং প্রেস উদ্ভাবন করেন জার্মান বিজ্ঞানী জন গুটেন বার্গ ১৫ শতকে। অথচ এর ১০০ বছর পূর্বে মুসলিম স্পেনে এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছিল। মূলতঃ গুটেনবার্গ এগুলির উন্নত সংষ্কারক ছিলেন। কাগজ তৈরীর ফর্মূলা প্রথমে মুসলিমরা আবিষ্কার করে,পরে চীনারা এটার কারিগরি দিকটির উন্নয়ন ঘটায়।

১২. স্যার আইজাক নিউটন চশমা শিল্পের উন্নয়নে লেন্স,লাইট এবং প্রিজম উদ্ভাবন করেন। কিন্তু চশমার জনক আল হাইসাম এ সংক্রান্ত বিষয়ে যেসব গবেষণা চালিয়েছেন ১১ শতকে,নিউটন তার উপর নির্ভর করে এগুলোর শ্রীবৃদ্ধি করেছিলেন। নিউটন হাইসাম দ্বারা দারুনভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ১৬ ও ১৭ শতকে ইউরোপের বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা ইবনে হাইসামের গবেষণালব্ধ বিষয়ের উপর ব্যপক পড়াশুনা করে। আল হাইসাম একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানীও ছিলেন। তাঁর এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিশ্লেষনী তত্ত্ব,তথ্য ইউরোপের বিজ্ঞানীরা সূত্র হিসেবে ব্যবহার করত। আল হাইসাম সর্ব প্রথম পিনহোল ক্যামেরা উদ্ভাবন করেন।

১৩. গণীত শাস্ত্রে দশমিক ভগ্নাংশের ধারণা সরবরাহ করেন একজন ডাচ- সাইমন স্টিভেন ১৫৪৯ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু তিঁনি এ ধারণা লাভ করেন মুসলিম গণীত শাস্ত্রবিদ আল কাছি’র Key to Arithmetic”নামক গ্রন্থ থেকে। সাইমন যখন তাঁর ধারণা লাভ করছেন তখন ইউরোপে আল কাছি’র দশমিক ভগ্নাংশের বই পড়ানো হচ্ছিল।

১৪. আমরা জানি প্রথম মহাকাশ বিজ্ঞানী ছিলেন গ্যালিলিও। তিঁনি ১৭ শতকে এ সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা চালিয়েছিলেন। কিন্তু আল বিরুণী ১০৫০ সালে মহাকাশ গবেষনায় লিপ্ত হন এবং যে সমস্ত তথ্য ও তত্ত্ব উল্লেখ করেন,এখনও তা বহাল আছে। অনেক গ্রহ,নক্ষত্র সম্পর্কে তিঁনি বিস্তারিত ও নির্ভুল বর্ণনা দেন,যা পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে ছিল,আছে। মহাকাশ সংক্রান্ত বিষয়ে তিঁনি দুই শতাধিক গ্রন্থ লেখেন। তার লেখা কোন কোন বই এর পাতা ১৩০০০(তের হাজার)এর অধীক ছিল।

১৫. চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্যাথলজির জনক বলা হয় জিওভ্যালী মরগাগ্নি’কে, কারণ তিঁনিই প্রথম রোগের প্রকৃতি বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাই একাজটি প্রথম করেছিলেন। ইবনে জহর রোগের কারণ,প্রকৃতি,প্রতিকার ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত এবং সঠিক বিশ্লেষণ করেন। পরবর্তীতে আল জাহরাবী এসংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা চালান এবং তিঁনি বহু নতুন রোগ সম্পর্কে বর্ণনা দেন। একই সাথে সেগুলোর চিকিৎসা পদ্ধতিও আবিষ্কার করেন। তিঁনি মস্তিষ্কে পানি জমা রোগের ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা দেন এবং তা অপরেশনের কৌশল উদ্ভাবন করেন। এর উপর নির্ভর করে পরবর্তী মুসলিম চিকিৎসকেরা এ রোগের অপারেশন করেন। এরপর ইবনে আল কুফ,ইবনে আল নাফ্স মস্তিষ্কের বিভিন্নরোগের চিকিৎসা ও অন্যান্য কঠিন রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। একই সাথে মুসলিম ডাক্তাররা এসকল বিষয়ে নির্ভুল চিকিৎসা করত ইটালীর উক্ত বিজ্ঞানীর শত শত বছর আগে।

১৬. রজার বেকন প্রথম বিমানের গঠন তৈরী করেন এবং এর পরীক্ষা চালান। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্জী বিমানের প্রটোটাইপ তৈরী করেন। কিন্তু এটি ঠিক নয়,ইবনে ফিরনাস প্রথম এটি স্পেনে উদ্ভাবন করেন এবং ফ্লাইং মেশিন টেস্ট করেন ৮০০ সালে। রজার বেকন ইবনে ফিরনাসের সূত্র ব্যবহার করেছিলেন।

১৭. নিউটন ১৭০০ সালে আবিষ্কার করেন সাদা আলো অনেকগুলো রঙিন আলোক রশ্মির সমষ্টি। কিন্তু ১১ শতকেই হাইসাম এ ব্যাপারটি নিষ্পত্তি করেন। এরপর ১৪ শতকে কামাল আদ দীনও এব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

১৮. এন্টনী ল্যাভোইজার বস্তুর সীমাবদ্ধতার কথা প্রথম উপস্থাপন করেন ১৮ শতকে। কিন্তু ১০৫০ সালে ইরানী বিজ্ঞানী আল বিরুনী প্রথম এ ব্যাপারটি বহু পরিক্ষা-নিরিক্ষার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। ল্যাভোইজার মুসলিম পদার্থ বিজ্ঞানীদের অনুসারী ছিলেন এবং তার সূত্র ছিল তাদের বই।

১৯. আমরা জানি গ্রীকরাই প্রথম ত্রিকোণমিতি উদ্ভাবন করে। মূলতঃ ত্রিকোণমিতি গ্রীকদের কাছে ছিল একটি তাত্ত্বিক বিষয়,এটার ব্যবহার তারা জানত না। মুসলিম বিজ্ঞানী আল বাত্তানী প্রথম এটির ব্যবহারিক কৌশল আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে বহু মুসলিম বিজ্ঞানীরা এটার সফল ব্যবহার করে।

২০. প্রথম বীজগণিতের প্রতীকগুলো ব্যবহার করেন ফ্রান্সের গণীত বিদ ফ্রান্সিস ভিয়েতা ১৫৯১ সালে। কিন্তু মুসলিমরাই প্রথম বীজগণিত উদ্ভাবন করে ৯ম শতকে,একইসাথে এটার ব্যবহারিক জ্ঞান দান করে।

২১. কিউবিক সমীকরণ ১৬ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত অপ্রমানিত ছিল। এটি প্রথমে সমাধান করেন ইটালীর বিজ্ঞানী নিকোলো তারতাগলিয়া। কিন্তু কিউবিক সমীকরণ এবং এর চাইতেও জটিল সমীকরনের সমাধান করেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা ১০ম শতাব্দীর প্রথম দিকে।

২২. নাম্বার যে, “০” এর থেকে নীচে হতে পারে অর্থাৎ -১,-২,-১০ ইত্যাদি এই কনসেপ্ট প্রথম প্রদান করেন জিরোনিমো কার্ডানো ১৫৪৫ সালে। কিন্তু এর চারশত বছর আগে মুসলিম গণিতবিদগণ বহু গণিতের ক্ষেত্রেই এই কনসেপ্ট ব্যবহার করে আসছিলেন,এমনকি এটি খিলাফত রাষ্ট্রের স্কুলগুলোতেও শেখানো হচ্ছিল।

২৩. ১৭ শতকে রেন ডিসকার্টেসমেড প্রথম ধারণা দেন যে বিজগণিত জিওমেট্রিক সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হতে পারে। অথচ ৯ম শতাব্দীতে এটি সমাধান করেন প্রখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ সাবিত বিন কুররা। এ সংক্রান্ত বিষয়ে তিঁনি একাধিক বই লিপিবদ্ধ করেন। এরপর আবুল ওয়াফা ১০ম শতাব্দীতে এসংক্রান্ত বিষয়ের আরও উন্নয়ন ঘটান।

২৪. প্রখ্যাত ইংরেজ বিজ্ঞানী রজার বেকন ১২৯২ সালে প্রথম চোখের লেন্স ব্যবহার করেন। এসময়ে ইউরোপ এবং চীনেও এটি প্রচলিত ছিল। কিন্তু ৯ম শতাব্দীতে ইসলামিক স্পেনে ইবনে ফিরনাস পৃথিবীতে সর্বপ্রথম চোখের লেন্স উদ্ভাবন করেন। শুধু তাই নয় এসময়ে স্পেন বানিজ্যিকভাবে চোখের লেন্স উৎপাদন করত এবং তা বহির্বিশ্বে রফতানী করত। মূলতঃ রজার বেকন যা করেছিলেন তা ছিল আরেকজন মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাইসামের(১০৩৯ খ্রিঃ)অনুকরণ।

২৫. গান পাওডার বিস্ফোরক হিসেবে ইউরোপে প্রথম ব্যবহৃত হয়; এসংক্রান্ত বিষয়ে রজার বেকনের ১২৪২ সালের গষণার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু এর শতাব্দীকাল আগে মুসলিম বিজ্ঞানীরা এটির ফর্মূলা আবিষ্কার করেন। মুসলিম আর্মিরা এটি ব্যবহার করত কামান,গ্রেনেড,পিস্তল এবং সালফার বোম্ব তৈরীতে। রজার বেকন গান পাউডারের ফর্মূলা নিয়েছিল আরব বিজ্ঞানীদের লেখনী থেকে,সেটি ল্যটিন ভাষায় অনুবাদ হবার পর এবং ততদিনে রজার বেকন ছাড়া আরও অনেকে এটি জেনেছিল।

২৬. প্রথম কম্পাস উদ্ভাবন করেন একজন চীনা বিজ্ঞানী সমূদ্রে দিক নির্ণয় করার জন্য। এটি আবি®কৃত হয় ১০ম থেকে ১১ শতকের মধ্যে। এটি প্রথম ব্যবহৃত হয় আলেকজান্ডার নেকাম কতৃক ১২ শতাব্দীতে। এটি টিক নয়,মুসলিম বিজ্ঞানীরা কম্পাস তৈরী করেন ৮ম শতাব্দীতে। শুধু তাই নয় মুসলিমরা সর্ব প্রথম চুম্বকীয় শক্তিকে কম্পাসের ক্ষেত্রে কাজে লাগায়। এ সত্যটি ইউরোপের বড় বড় বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেন। চীনারা ১১ শতাব্দীতে যে কম্পাস তৈরী করে তা তারা পেয়েছিল মুসলিম ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। নেকাম এর চার শতাব্দী পর মূলতঃ মুসলিম বিজ্ঞানীদের অনুকরনে কম্পাস ব্যবহার করেন। নেকামের বহু আগে থেকেই মুসলিম ব্যবসায়ীরা জাহাজে কম্পাস ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে গমন করতেন।

২৭. মানুষের বিভিন্ন বর্ণ যেমন সাদা,কালো,হলুদাভ,বাদামী,লাল ইত্যাদি সম্পর্কে প্রথম তথ্য দেন একজন জার্মান জন এফ ব্লুমেনবাচ ১৪ শতাব্দীর পর। অথচ মুসলিম পন্ডিতরা ৯ম শতাব্দীতে পৃথিবীর মানুষের বিভিন্ন বর্ণের বর্ণনাই দেননি,তারা পৃথিবীর বিভিন্ন জাতের,বর্ণের ,সাং®কৃতির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বহু কিতাব লিপিবদ্ধ করেন। তাদের এ সংক্রান্ত কিতাব ছিল হাজার হাজার পৃষ্ঠার।

২৮. ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞান পূনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ১৫-১৭ শতাব্দীতে। এর আগে এটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। কিন্তু মুসলিম ভূ-তত্ত্ববিদগণ এ সংক্রান্ত বিষয়ে বহু কিতাব রচনা করেন। তারা এশিয়া,আফ্রিকা,চাইনা,ইন্ডিয়াসহ বহু দেশের বিস্তারিত আলোচনা করেন তাদের রচিত কিতাবে। তারা এসমস্ত এলাকার নিখুঁত ম্যাপ তৈরী করেন ৮ম শতাব্দীতেই। আরব মুসলিমরাই ভূ-তত্ত্ববিদ্যাকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ক্রুসেডাররা মুসলিমদের এসংক্রান্ত বহু নথি পত্র পুড়িয়ে দেয়।

২৯. রবার্ট বয়েল প্রথম রসায়ন বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ঘটান ১৭ শতাব্দীতে। অথচ আল কেমী ছিলেন কেমিস্ট্রীর জনক। তিঁনিসহ বহু মুসসলিম কেমিস্ট-আর রাজী,আল জাবর,আল কিন্দী,আল বিরুনী প্রমূখ ১০ম শতাব্দীতেই কেমিকেল সাইন্স নিয়ে ব্যপক গবেষণা করে নির্ভুল সব তথ্য দেন এসংক্রান্ত বিষয়ে। তাদের কিতাব ছিল হাজার হাজার এবং ইউরোপে,ল্যাটিন আমেরিকায় এগুলো সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে পঠিত হয়েছিল,এখনও হয়।

৩০. ১৬ শতাব্দীর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্জীকে নৃ-বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। কিন্তু ১১ শতাব্দীতে আল বিরুনী এ সংক্রান্ত বিষয়ে বহু গবেষণা ও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে অসংখ্য কিতাব রচনা করেন। ভিঞ্জী ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা আরবী বই থেকে এসংক্রান্ত কনসেপ্ট নেন।

৩১. বিশুদ্ধ এলকোহল প্রথম তৈরী করেন আর্নো ডি ভিলানোভা ১৩০০ সালে। কিন্তু মুসলিম কেমিস্টরা এলকোহল তৈরী করেন ১০ম শতাব্দীতে। তারা ওষুধ তৈরীতে এটি ব্যবহার করতেন।

৩২. সর্বপ্রথম রোগী অজ্ঞান করে অপারেশন করেন আমেরিকার সি ডব্লিউ লং ১৮৪৫ সালে। এ চেতনা নাশকটি ছিল এক ধরনের ইনহেলার বিশেষ। কিন্তু ১৩ শতাব্দীতে আজ জাহরাবী এবং ইবনে জহর এটি তৈরী করেন। এসময়ে স্পেনের বহু হাসপাতালে রোগীকে অজ্ঞান করে অপারেশনের জন্য এটি ব্যবহৃত হত। চিকিৎসকেরা বিশেষ এক ধরনের ওষুধ,বিশেষ মাত্রায় রোগীর নাকের কাছে ধরলে রোগী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অজ্ঞান হয়ে যেত। এটি ছিল সম্পুর্ণ ঝুঁকিমুক্ত।

৩৩. রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য প্যারাসেলসাস্ ১৬ শতকে প্রথম অপিয়াম উদ্ভাবন করেন। এরপর অজ্ঞান করার আধুনিক ওষুধ উদ্ভাবন করেন হামফ্রে ড্যাভি এবং হোরেস ওয়েল্স ১৯ শতকে। কিন্তু এটি ঠিক নয়,১৩-১৪ শতকের মধ্যে মুসলিমরা অপিয়াম উদ্ভাবন করেন এবং খিলাফত রাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকার হাসপাতালে এটি ব্যবহৃত হত। প্যারাসেল্সাস ইবনে সীনার অনুবাদকৃত বই থেকে চেতনা নাশক ওষুধ সম্পর্কে ধারণা নেন। আধুনিক চেতনা নাশক হিসেবে ১৯ শতকে যা ব্যবহৃত হত, তা ১০ম শতাব্দী থেকেই ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহৃত হত। খিলাফত রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি এলাকার হাসপাতালের কিছূ বিশেষ বেড থাকত যেখানে জটিল অপারেশন করা হত বর্তমান কালের আধুনিক পদ্ধতির মত এবং রোগীকে নিরাপদে চেতনা নাশক দিয়ে অজ্ঞান করা হত।

৩৪. চিকিৎসা ক্ষেত্রে এন্টিসেপটিক আবিষ্কৃ®কৃত হয় ব্রিটিশ সার্জন জোসেফ লিস্টার কতৃত ১৮৬৫ সালে। এটি ঠিক নয়,কারণ-১০ম শতাব্দীতে মুসলিম চিকিৎস্যকেরা স্পেন,কর্ডোভা,সেভিল,বাগদাদ,কুফা,ইরান,ইরাকসহ বহু এলাকার চিকিৎস্যা কেন্দ্রে বিভিন্ন রোগী ও আহতদের ওপর এন্টিসেপটিক প্রয়োগ করতেন। তারা বিশুদ্ধ এলকোহল থেকে এন্টিসেপটিক তৈরী করেছিলেন এবং ঈর্শণীয় সাফল্য লাভ করেছিলেন।

৩৫. প্রথম ওষুধ সংক্রান্ত বই(Pharmacopeia)প্রকাশ করে জার্মান বিজ্ঞানী ১৫৪২ সালে। আধুনিক ওষুধ সংক্রান্ত বই প্রকাশিত হয় ১৯০০ সালে। ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন-“গ্রীকরা নয়,ইউরোপীয়রা নয়,আধুনিক Pharmacopeia তৈরী করে মুসলিমরা ৯ম শতাব্দীতে। এরপর বহু মুসলিম বিজ্ঞানী এসংক্রান্ত বিষয়ে হাজারেরও উপরে কিতাব রচনা করেন। ১৪ শতকে ইবনে বাইতুর কর্তৃক যে চযধৎসধপড়ঢ়বরধ প্রকাশিত হয়,তাতে ১৪০০ রকমের ওষুধের বিস্তারিত বর্ণনা ছিল,এগুলো কোন জাতীয় রোগের জন্য কার্যকরী তাও বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ ছিল।” ইবনে বাইতুরের বই অনুবাদ করে ইউরোপের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ান হত।

৩৬. রোগ নিরাময়ে প্রথম শব্দ তরঙ্গের ব্যবহার করেন জার্মান বিজ্ঞানী জন ওয়েগার ১৫০০ সালে। অথচ হার্ভাড জর্জ সারটন বলেন-“মুসলিম চিকিৎস্যা বিজ্ঞানীরাই ৯ম -১২ শতাব্দীতে রোগ নিরাময়ে শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করত খুবই সাফল্যজনকভাবে। তারা এটি বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিমাপে ব্যবহার করত। জন ওয়েগার সহ হাজার হাজার চিকিৎস্যক আর রাজী ও ইবনে সীনার বই অধ্যায়ন করেছেন ১৭ শতাব্দীতে।

৩৭. কেরোসিন প্রথম আবি®কৃত হয় একজন ইংরেজ আব্রাহাম জেসনার কতৃক ১৮৫৩ সালে। অথচ এর ১ হাজার বছর আগে মুসলিম গবেষকরা কেরোসিন আবিষ্কার করেন।(এ বিষয়ে এনসাইক্লেপেডিয়া ব্রিটানিকার পেট্রোলিয়াম অংশে দেখা যেতে পারে।)

এভাবে আরও অনেক আবিষ্কার পাশ্চাত্য নিজেদের বলে চালিয়ে দিয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে মুসলিমদের অবদানের কথা স্বীকার করলেও মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম বিকৃত করে পাঠ্য পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে বা প্রচার করে, ফলে মুসলিমদের পক্ষে তাদের পরিচয় বোঝার কোন উপায় থাকে না।

মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদানের কিছু স্বীকৃতি দান ঃ

তবে হ্যা, বর্তমানে কিছু কিছু পাশ্চাত্যবিদ নিজেরাই বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। যেমন- ‘দি ম্যাকিং অব হিউম্যানিটি’ গ্রন্থের লেখক মিঃ ব্রিফেল্ড লিখেছেন, “আজকের দুনিয়ায় আরব সভ্যতার সবচেয়ে বড় অবদান হলো-বিজ্ঞান। স্পেনে আরব সভ্যতার ফলে বিজ্ঞানের যে বীজ অঙ্কুুরিত হয়েছিল, ওই সভ্যতা বিস্মৃত হওয়ার বহু শতাব্দী পরে সে প্রস্ফুটিত হয়েছিল ইউরোপে। কেবল বিজ্ঞান ইউরোপকে পুনর্জীবিত করেনি, ইসলামী সভ্যতার অনেক কিছুই ইউরোপকে আলো দান করেছিল। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসু ইউরোপ পেয়েছিল মুসলিমদের কাছ থেকে। ” পাশ্চাত্যের অনেক ঐতিহাসিক ও বিজ্ঞানী যেমন- G. Sarton, Sir T. Arnold, R.A Nicholsion, Hitti, Pickthal, Lane Poole প্রমুখ মনে করেন যে, মুসলমানরাই পাশ্চাত্য সভ্যতার জনক,মুসলমানরাই অসভ্য ইউরোপকে সভ্যতার আলো দেখিয়েছিল(অবশ্য আধুনিকতার নামে তারা আবার সেই অন্ধকার যুগে ফিরে গেছে)। ‘দৈনিক

আমাদের সময়’ নামক একটি পত্রিকায় ২৯/০৬/২০০৭ তারিখে “সেই স্বর্ণ যুগ কি ফিরে আসবে না ?” নামক একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়,যার কিছু অংশ এমনঃ ‘...আরব বিশ্বসহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশগুলো ক্রমশ তাদের ঐতিহ্য ভুলছে। পিছিয়ে যাচ্ছে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়। অথচ আধুনিক বিশ্বটা যে ভিত্তির উপর দাড়িয়ে আছে তা গড়তে মুসলিম প্রাজ্ঞদের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশী। ...ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিমরা প্রতিষ্ঠা করে এবং এগুলো খলিফার কাছ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন দিনার অনুদান পেত। কলম্বাসের পৃথিবী গোলাকার প্রমান করার ৬ শত বছর আগে এক ইরাকী মুসলিম গণিতজ্ঞ(সম্ভবতঃ মহিউদ্দীন রইসের কথা বলা হচ্ছে-লেখক) এটি শুধু জানতেনই না,প্রমানও করেছিলেন। অষ্টম শতক থেকেই বাগদাদ বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত শহর হিসেবে সমৃদ্ধি অর্জন করে। ...বাগদাদের রাস্তাগুলো ছিল পাকা ও আলোক সজ্জিত অথচ প্যারিস ছিল ঠিক এর বিপরীত। ৭ম থেকে ১১ শতাব্দী পর্যন্ত জ্ঞান অর্জনের প্রধান ভাষা ছিল আরবী। ইউরোপের খ্রিষ্টানরা জ্ঞানার্জনের জন্য ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে আসত এবং আরবী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গর্ব বোধ করত। ...(একই প্রতিবেদনে ইবনে সাহলের ‘ল অব রিফ্যাকশন’ সংক্রান্ত গবেষণা লিপি,আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর জনক আল আজারির তৈরী পিস্টন পাম্পের নকশা,ইবনে হাইসামের তৈরী প্রথম পিনহোল ক্যামেরা ইত্যাদির চিত্র ছাপা হয়) ...এসব মুসলিম প্রাজ্ঞরাই আধুনিক রসায়ন,গণিত,ভূগোল,আবহবিদ্যা ইত্যাদির জনক। মুসলিম শল্য চিকিৎসকরাই প্রথমে মানব দেহে অপারেশন করেন। খ্রিষ্টানদের জন্য এটির উপর ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ছিল। ...মুসলিমদের হাত ধরেই ধীরে ধীরে এগিয়েছে ইউরোপের বিজ্ঞান ও সভ্যতা। ...আরবী অক্ষর ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান ও ব্যবসা কল্পনাই করা যায় না। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সূতী(এবং আধুনিক জিন্স কাপড়ও) ও মসলিন কাপড় মুসলিমদের তৈরী। বিশ্বের প্রতি মুসলিম বিজ্ঞানীদের বড় অবদান হচ্ছে কাগজ তৈরীর ফর্মূলা। চীনারা পরবর্তীতে এর কারিগরি দিকটির উন্নয়ন ঘটায়। বিশ্বকে পারফিউমের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় জাবির ইবনে হাইয়ান .....।’ বি.বি.সি, অবলম্বনে দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় ০৭/০১/২০০৯ তারিখে একজন প্রখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে হাইসাম সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়- ‘আল হাসান ইবনে আল হাইসাম(জন্ম ৯৬৫ সাল)তাকে বলা হয় আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জনক। পরিক্ষালব্ধ তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর সর্বপ্রথম গুরুত্বারোপ করেন তিনি। ইবনে হাইসাম’ই প্রথম নির্ভুল গবেষণার মাধ্যমে প্রমান করেন যে,কোনো বস্তু থেকে যখন আলো আমাদের চোখে এসে পড়ে তখন আমরা সে বস্তুকে দেখতে পাই। তার এই সফল গবেষণার মাধ্যমে নিক্ষেপন তত্ত্ব বা ইমিশন থিউরী বাতিল হয়ে যায়। প্লেটো,ইউক্লিড ও টলেমী বলতেন-চোখ থেকে আলো বস্তুতে পৌঁছালে আমরা দেখতে পাই। তথ্য ব্যাখ্যা ও প্রমান করতে তিনিই প্রথম গণিতের সাহায্য নেন। ইবনে হাইসামকে বলা হয় বিশ্বের প্রথম তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। তিনিই সর্বপ্রথম আবহাওয়া মন্ডলের উচ্চতা নির্ভুলভাবে মাপতে সক্ষম হন। তিনি উল্লেখ করেন আবহাওয়া মন্ডলের উচ্চতা ১০০কি:মি:। তার গবেষণার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে কোপারনিকাস,গ্যালিলিও,কেপলার,নিউটনের মত ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানীরা আলোর মুখ দেখে। আজ আমরা যেসব আধুনিক পদার্থবিদদের অবদান খুঁজতে মহা ব্যস্ত তারাই নিজেদের গবেষণার জন্য চীর ঋণী হয়ে আছেন হাজার বছর পূর্বের আরবীয় মুসলিম বিজ্ঞানীদের কাছে।’

এছাড়া আরও অনেকে অনেক ভাবে মুসলিমদের অবদানের কথা স্বীকার করেছে বিভিন্ন সময়।

বিষয়: বিবিধ

৩৩৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File