মধ্যযুগে বাগদাদ....পর্ব ৫

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৮ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:৫৮:৫৬ রাত



ইবনে ইউনুস ঃ

খিলাফতের অধীনে কায়রো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার নতুন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। খলিফা আযীয বিল্লাহ এবং হাকীম বি আমরিল্লাহর শাসনামলে এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক পেন্ডুলামের উদ্ভাবক ও তার দোলনের সাহায্যে সময়ের পরিমাপক, ইবনে ইউনুস সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার পৃষ্টপোষক ও নৃপতির নামানুসারে যে বৃহৎ গ্রন্থ জিয উল আকবর আল্ হাকিমী প্রকাশ করেছিলেন তা সত্ত্বর ক্লডিয়াস টলেমির আবিস্কারকে মিথ্যা প্রমাণ করেছিল।

পারসিকদের মধ্যে জ্যোতির্বিদ কবি ওমর খৈয়াম (১০৭৯) এই তত্ত্ব পূণরুজ্জীবিত করেন। গ্রীকদের মধ্যে ক্রাইসোফোকার সিইনট্যাকসের মধ্যে মোঙ্গলদের মধ্যে নাসিরউদ্দীন তুসী জিয ইল খানীতে এবং চীনাদের মধ্যে ১২৮০ দে চো চিয়ো কিং এর জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই তত্ত্ব পূণরুজ্জীবিত করেছিলেন। এরুপে যা চীনদেশের প্রাচীন সভ্যতার প্রতি আরোপিত হয়েছিল তা শুধু ছিল মুসলামনদের নিকট থেকে ধার করা আলো।

ইবনে ইউনুস ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে ইহলীলা সংবরণ করেন এবং তার আবিস্কার ইবনুন নাবদী যিনি ১০৪০ খ্রিস্টাদে পর্যন্ত কায়রোতে বসবাস করেছিলেন এবং সাধারণভাবে ইউরোপে আলহাজেন হিসেবে অভিহিত এবং আবহাওয়া বিষয়ক আলোর প্রতিসরণ আবিস্কারের জন্য বিখ্যাত হাসান ইবনে হায়সাম এই দুব্যক্তি চালু রেখেছিলেন। তিনি একাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও আলোকবিজ্ঞানী। তিনি স্পেনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং প্রধানতঃ মিশরে বসবাস করতেন। তিনি তার আলোক চশমা সম্পর্কীয় রচনার জন্য ইউরোপে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। এ জাতীয় তার একটি গ্রন্থ রিসনার লাতিনের অনুবাদ করেছিলেন।

দর্শনের প্রকৃতি বিষয়ক গ্রীকদের ভ্রান্ত ধারণাকে তিনি সংশোধিত করেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম প্রদর্শন করেছিলেন যে, আলোরশ্মি বাহ্যবস্ত থেকে চোখে আসে; চোখ হতে নির্গমন করে বাহ্যবস্ততে আসে না এবং তার উপর আঘাত হানে না। তিনি অক্ষিপটকে দর্শনের কেন্দ্র বলে নির্ধারিত করেছিলেন এবং প্রমানিত করেছিলেন যে অক্ষিপটে সৃষ্ট উদ্দীপনা দৃষ্টিবাহী øায়ূ দিয়ে মস্তিস্কে বাহিত হয়। তিনি অদ্বৈত বা একটিমাত্র দার্শনকে দুই অক্ষিপটের প্রতিসম অংশের উপর পতিত দৃষ্টিগত প্রতিরুপের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি আবিস্কার করেছিলেন যে আলোর প্রতিসরণ বায়ুমন্ডলের ঘনত্বের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় এবং বায়ুমন্ডলীয় ঘনত্ব পূণরায় উচ্চতার সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। তিনি যথাযথভাবে ও পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কিভাবে এই প্রতিসরনের ফলস্বরুপ তারকা নক্ষত্র তাদের প্রকৃত উদয় ও অস্তের পূর্বেই দৃষ্ট হয় এবং প্রদর্শন করেছিলেন যে,গোধূলীর সুন্দর দৃশ্য বায়ুমন্ডলের প্রতিসরণের সঙ্গে আলোকরশ্মির চলাচলের উপর বায়ুর প্রতিফলিত ক্রিয়ার সম্মিলিত ফল।

তিনি তার ব্যালান্স অব্ উইজডাম (জ্ঞানের ভারসাম্য) নামক গ্রন্থে গতিশীল নীতিসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করেন যা সাধারণভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের একচেটিয়া অধিকার বলে অনুমিত হয়। তিনি বায়ুমন্ডেলের ভারত্ব ও তার ঘনত্বের সম্পর্ক এবং কিভাবে হালকা ও ভারি বায়ুমন্ডলে বস্তুর ওজন পরিবর্তিত হয় তা সূক্ষ্মভাবে বর্ণনা করেন। ভাসমান বস্তুর জলমগ্ন হওয়া এবং হালকা কিংবা ভারী মাধ্যম নিমজ্জিত করলে যে শক্তিতে তারা উপরিভাগে উঠে আসে সে সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেন; তিনি মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব পরিপূর্ণভাবে বুঝতেন এবং মাধ্যাকষর্ণকে একটি শক্তি হিসেবে অনুধাবন করতেন। তিনি পতনশীল বস্তর গতিবেগ, পতনস্থান ও পতনকালের মধ্যকার সম্পর্ক সঠিকভাবে জানতেন।

কৈশিক আকর্ষণ সম্পর্কে তার অত্যন্ত সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। স্পেনে পিরেনীজ পর্বতমালা থেকে মালাক্কা প্রনালী পর্যন্ত ভূভাগে একই ধরনের মানসিক সক্রিয়তা চালু ছিল; সেভিল, কর্ডোভা, গ্রানাডা, মুর্সিয়া, টলেডো এবং অন্যান্য স্থানে অসাধারণ সব গ্রন্থাগার ও কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্টিত হয়েছিল।

এখানে মা এবং মেয়ে একইসাথে বিজ্ঞানী ছিল। নারীরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ছিল। মেয়েরা এখানে শিক্ষার সুযোগই শুধু পেতনা, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতো অথচ এসময়ে ইউরোপের নারীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হত। তাদের কোন অধীকারের স্বীকৃতি ছিলনা। লেখা-পড়া দূরে থাক তারা মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি পায়নি। ইসলামী খিলাফতভূক্ত অঞ্চল সমূহে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে অবৈতনিক প্রশিক্ষণ দেয়া হত। সমস্ত ব্যয়ভার ছিল রাষ্ট্রের।

কর্ডোভা সম্পর্কে একজন ইংরেজ লেখক লিখেছেন, “কর্ডোভার প্রাসাদ ও উদ্যানসমূহ যেমন সুন্দর ছিল তেমনি জ্ঞান বিজ্ঞানের উচ্চতর বিষয়েও তার দাবী কম শক্তিশালী ছিল না। পার্থিব বিষয়ের মতো মানসিক বিষয়ও পরিপাটি ছিল। কর্ডোভার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ও শিক্ষকমন্ডলী কর্ডোভাকে ইউরোপীয় সাংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করেছিল।

কর্ডোভার বিখ্যাত পন্ডিতদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষাগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীগণ ইউরোপের বিভিন্ন অংশ থেকে আসত।

সেখানে বিজ্ঞানের প্রত্যোক শাখা নিষ্ঠার সঙ্গে অনুশীলিত হত; আর চিকিৎসাশাস্ত্র আন্দালুসিয়ার(স্পেন) চিকিৎসক ও অস্ত্রোপচারকগণের আবিস্কারের দ্বারা এত অধিক সমৃদ্ধি লাভ করেছিল যে গ্যালেনের পর বহু শতাব্দী অতিবাহিত হলেও সে সময়ের মধ্যে তেমন কিছু অর্জিত হয়নি। জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, রসায়ন, প্রাকৃতিক ইতিহাস সব বিষয়ই কর্ডোভায় উৎসাহের সঙ্গে অনুশীলিত হত। সাতিত্যের এতই উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল যে, ইউরোপে কোন কালেই কবিতা প্রত্যেক মানুষের মুখের ভাষায় পরিণত হয়নি ,যখন সকল শ্রেণীর মানুষ ঐসব আরবী কবিতা রচনা করত যা সম্ভবতঃ স্পেনের চারণ কবিদের ব্যালাড ও ক্যানজোন্টে এবং প্রভেনস ও ইতালীর ট্রুবেডার্সের নমুনা নির্দেশ করত। কোন ভাষণ বা বক্তৃতার সঙ্গে তাৎক্ষনিকভাবে রচিত কোন কবিতার পংতি জুড়ে না দিলে বা স্মৃতির মাধ্যমে কোন বিখ্যাত কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি না দিলে সে ভাষণ বা বক্তৃতা সম্পূর্ণ হত না।

এর সঙ্গে আমরা রেনানের কিছু কথা যোগ করতে পারি: “খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দীতে পৃথিবীর এই বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত অঞ্চলে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ যে সহনশীলতা প্রতিষ্ঠিত করেছিল আধুনিক জগৎ আদৌ সেরুপ কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। খ্রিষ্টান, ইহুদী ও মুসলমান একই ভাষায় কথা বলত, একই গান গাইত এবং একই সাহিত্যি ও বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করত। যেসব প্রতিবন্ধকতা জনগণের মধ্যে বিছিন্নতার ভাব আনয়ন করত তা মুছে দেয়া হয়েছিল। সকলে এক ঐকমত্য, একটি অনন্ন সাধারণ ইসলামী সভ্যতার উজ্জীবনে কাজ করতেন। কর্ডোভার মসজিদসমূহ দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের সক্রিয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল যেখানে সমবেত ছাত্রদের সংখ্যা হাজারের মাধ্যমে গণনা করা হত।

ইউরোপের প্রথম মানমন্দির আরবরা নির্মাণ করেছিল। এটি ১১৯০ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল আকাশসমূহের পর্যবেক্ষণের জন্য। মুরাদের বিতাড়নের পর একে গির্জার ঘন্টা ঘরে পরিনত করা হয়েছিল; স্পেনবাসীরা একে দিয়ে কি করবে তা জানত না।

ওমর ইবনে খালদুন, ইয়াকুব ইবনে তারিক, মুসলিমা আল্ মাঘরিবি এবং প্রখ্যাত অ্যাভের্রোজ (আবুল ওয়ালিদ মুহম্মদ ইবনে রুশদ) কয়েকজন পদার্থবিজ্ঞানী যাদের কথা আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি। এ যুগে পাশ্চাত্য আফ্রিকা নিস্ত্রি“য় ছিল না; সিউটা ও তাঞ্জানিয়া, ফেজ ও মরোক্কো কর্ডোভা, সেভিল এবং গ্রানাডা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করত। তাদের কলেজ,বিশ্ব বিদ্যালয়সমূহ গবেষণার কাজে অধ্যাপকদেরকে সর্বোচ্চ সহযোগীতা দিয়েছিল ফলে তাদের রচিত অসংখ্য পান্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ জ্ঞানের সকল বিভাগে মুসলিম মনের অফুরন্ত উদ্দীপনার সাক্ষ্য বহন করেছিল। একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিলো।

মহান গজনভী অভিজেতা সুলতান মাহমুদ(৯৯৬-১০৩০ খ্রি.) ইয়েমিত উদ দৌলা এবং আমিরুল মিল্লাত অর্থাৎ সাম্রাজ্যের দক্ষিন হস্ত এবং ধর্মের সংরক্ষক উপাধী লাভ করেন খলিফা কর্তৃক। তিনি ট্রানসোসিয়ানা, আফগানিস্তান ও পারস্যকে গজনী শাসনের অধীনে আনয়ন করেছিল (তিনি ১৭ বার ভারত অভিযান করে প্রত্যেক বারই বিজয়ী হয়েছিলেন এবং ভারতে ইসলামের ভিত্তিকে মজবুত করেছিলেন। বারবার গজনী আক্রান্ত হওয়ার কারনে তিনি ভারতে স্থায়ীভাবে অবস্থান করতে পারেননি)। তিনি তার চারপাশে একদল পন্ডিত ও সাহিত্যিক সম্মিলিত করতে সমর্থ্য হয়েছিলেন যাঁরা তার উজ্জ্বল রাজত্বের গৌরবদীপ্ত আভা বিকীর্ণ করেছিলেন। আবু রায়হান মুহম্মদ ইবনে আহমদ, আলবেরুনীর মতো দার্শনিক গাণিতিক ও ভৌগোলিকদের প্রতিভা অনুধাবন করবার দুরদর্শিতা তার ছিল এবং ছিল কবিদের যুবরাজ ফেরদৌসী, দাকিকি ও উনসুরীর মতো প্রতিভাধর উদ্ভাবকদের উৎকর্ষ হৃদয়ঙ্গম করার।

আল বেরুনীর মন ছিল সর্ববিদ্যাসংগ্রাহী। তার জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ তার পৃষ্টপোষক সুলতান মাহমুদের নামানুসারী আল কানুনুল মাসুদী ক্যানন মাসুদিকাস জ্ঞান ও গবেষণার এক বড় নিদর্শন।

তিনি ভারতবর্ষে ভ্রমণ করেছিলেন হিন্দুদের ভাষা শিখেছিলেন, শিখেছিলেন তাদের বিজ্ঞান দর্শন ও সাহিত্য এবং তার পর্যবেক্ষনের ফল তিনি একখানি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন যা বাংলাতে অনুবাদ হয়েছে “আল্ বিরুনীর ভারত দর্শণ” নামে। আল বেরুনীর ইভোইকা তার বিখ্যাত গ্রন্থ আসারুল বাকিয়াহ বা অতীতের নিদর্শন। ইংরেজী অনুবাদক ডঃ সাছাউ নির্দেশ করে কি পরিমানে মুসলমানেরা জ্ঞান বিজ্ঞানের ব্যবহার করেছিলেন এবং তাকে ফলপ্রসূর উদ্দেশ্যে কাজে লাগিয়েছিলেন। এই দুইটি বিখ্যাত গ্রন্থ ছাড়া তিনি গণিত বংশতালীকা, গাণিতিক, ভূগোল, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের উপর গ্রন্থ রচনা করেছেন।

আলবেরুনী হিন্দুদের ধারণা ও ঐতিহ্যের প্রত্যুত্তরে বাগদাদে অনুশীলিত জ্ঞান বিজ্ঞানের বিষয় তাদের নিকট ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি তাদের মধ্যে গ্রীক বিজ্ঞানের রেশ দেখতে পেয়েছিলেন যা খ্রিস্টীয় শতাব্দীগুলির প্রথমদিকে আনীত হয়েছিল, কিংবা সম্ভবত: তারও পূর্বে গ্রীকব্যাকট্রিয় বংশের আমলে আনীত হয়েছিল। হিন্দুরা জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কীয় কোন উচ্চতর জ্ঞানের অধিকারী ছিলো বলে প্রতীয়মান হয় না। যদি থাকত তবে আমরা নিঃসন্দেহে তা আলেকজান্ডার ও সেলুসিডা বংশের গ্রীক গ্রন্থকারদের কাছ থেকে জানতে পারতাম। চীনাদের মত তারা বাইরের উৎস থেকেই বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহ ধার করেছিলেন এবং জাতীয় বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টিকোন অনুসারে তা রুপান্তরিত করেছিলেন।

পদার্থ বিদ্যায় বাগদাদ ঃ

পদার্থবিদ্যাসমূহ একইরুপ নিষ্ঠার সঙ্গে অনুশীলিত হত। তত্ত্ব গঠনের পরিবর্তে পরিক্ষণ পদ্ধতি চালু হয়েছিল। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে রসায়ন, উদ্ভিদবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, প্রাকৃতিক ইতিহাস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং শ্রেষ্ঠতম, শক্তিশালী ব্যক্তিদেরকে ক্ষমতার অনুশীলনে ব্যাপৃত করেছিল।

আধুনিক পদার্থবিদ্যার জন্ম ইংল্যান্ডে এবং কৃতিত্বের দাবীদার রবার্ট হুক। অথচ মুসলমানদের নাম গোপন করা হয়। বিজ্ঞান হিসেবে রসায়ন নিঃসন্দেহে মুসলমানদের উদ্ভাবন। আবু মুসা জাবির (খ্রীষ্টান গ্রন্থকারদের ভাষায় জেবের) আধুনিক রসায়নের প্রকৃত জনক। তার নাম রসায়নের জগতে স্মরণীয় হয়ে আছে। কেননা প্রিষ্টিলী ও লাভোসিয়ারের যুগের ন্যায় সমান গুরুত্বের এক যুগের দ্বারোদঘাটন তিনি করেছিলেন। তার পরে আরও অনেকে এসেছেন যাদের মৌলিকতা ও অধ্যাবসায় জ্ঞানের গভীরতা ও নিরীক্ষণের সূক্ষ্মতা শিক্ষার্থীদের হতবাক করেছিল। আদ্দামিরি (আলডেমরি) তার প্রাণী বিষয়ক ইতিহাসের জন্য মুসলিম জাহানে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল। এই গ্রন্থখানি সাত শ’বছর পূর্বেই বাফনের গ্রন্থের পরিকল্পনা ফাঁস করে দিয়েছিল। মৃৎবিজ্ঞান ইলম-ই-তাশরিছুল আরদ (মৃত্তিকা বিশ্লেষণ বিদ্যা) নামে অনুশীলিত হত।

ব্যবসা বাণিজ্যে বাগদাদ ঃ

আরবের নাবিকরা কম্পাস উদ্ভাবন করেছেন আর জ্ঞানের অন্বেষণে এবং বাণিজ্যের সন্ধানে জগতের সর্বত্র জলপথে ভ্রমণ করেছেন। তারা আফ্রিকায় ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সুদূর দক্ষিণে ভারতের তীরবর্তী অঞ্চলসমুহের মালয় উপদ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। এমনকি চীন দেশও তার ঔপনিবেশিক উপদ্বীপে উপনিবেশ ও সৈনিকদের কাছে তার বন্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছিলো। মুসলিমরা অ্যাজোর (azores) আবিস্কার করেছিলেন, এবং আমেরিকায় প্রবেশ করেছিলেন(কলস্বাসের বহু শতাব্দী পূর্বেই)। প্রাচীন মহাদেশসমূহের সীমারেখার মধ্যে মানবিক প্রয়াসের প্রত্যেক দিকে তারা নজিরবিহীন ও অতুলনীয় গতিবেগ সঞ্চার করেছিলেন।

রসূল (সাঃ) শ্রমকে কর্তব্য হিসেবে নিরুপিত করেছিলেন, তিঁনি শৈল্পিক সাধনার প্রতি ধর্মীয় নিষ্ঠা আরোপ করেছিলেন। তিঁনি অনুমোদন দিয়েছিলেন যে, বাণিজ্য ও কৃষিকার্য আল্লাহর দৃষ্টিতে প্রশংনীয়। এসব উপদেশের স্বাভাবিক ফল ফলেছিল; ব্যবসায়ী, বণিক, শিল্পকর্মে নিয়োজিত শ্রেণীসমুহকে সাধারণভাবে সম্মানের চোখে দেখা হত। শাসনকর্তা, সেনাধ্যক্ষ ও বিদগ্ধ সমাজ তাদের পেশার নাম ধরে তাদের প্রতি বিতৃষ্ণার ভাব দেখাতেন না। শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বণিকদল রাষ্ট্রের সর্বত্র বিচরণ করত; রাস্তাঘাঠের পথিপার্শ্বে চৌবাচ্চা, জলাশয় ও জলাধার এবং বিশ্রামাগার বিদ্যমান ছিল। সরাইখানা সর্বত্র বিরাজ করত এসব ব্যবসা বাণিজ্য কলা ও শিল্পজাত দ্রব্যের দ্রুত বিকাশে সাহায্য করেছিল। আরবরা যে দেশে বসতিস্থাপন করত সেখানে খাল কেটে জলের সুবন্দোবস্ত করত। স্পেনে তারা বন্যা প্রতিরোধ গেট, চাকা ও পাম্পের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার প্রচলন করেছিল। এখন যেসব বিরাট অঞ্চল অনুর্বর ও উষর হয়ে পড়ে আছে তা জলপাইয়ের বাগান দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। মুসলমানদের শাসনামলে একমাত্র সেভিল এলাকায় কয়েক হাজার তেলের ফ্যাক্টরী ছিল। তারা প্রধান প্রধান কাঁচামাল, চাউল, চিনি, তুলা এবং প্রায় সব ধরনের সুন্দর ফলের বাগানের প্রচলন করেছিলেন এবং সেই সঙ্গে আদা, জাফরান ও সুগন্ধি নির্যাস ইত্যাদিরও প্রচলন করেছিলেন।

তারা তামা, গন্ধক, পারদ, লৌহের খনি উন্মক্ত করেছিলেন। তারা শিল্পের কর্ষণ, কাগজ ও বয়নশিল্প, চীনামাটির বাসন মৃৎশিল্প, লৌহ, ইস্পাত ও চামড়া শিল্প স্থাপন করেছিলেন(মুসলিমরাই প্রথম সূতি,মসলিন,জিন্স কাপড় উদ্ভাবন করেন,ওসমানীয় খিলাফতের আর্মীরা ডেনিম ব্যবহার করত)। চিত্রিত দেওয়ালের পর্দা মুরসিয়ার পশমী বস্ত্র, গ্রানাডা, আলমেরিয়া ও সেভিলের সিল্ক টলেডোর ইস্পাত ও স্বর্ণের কারুকার্য সেলিভার কাগজ পৃথিবীর সবদেশের চাহিদার বস্তু ছিল। মালাগা, কার্থাজেনা, বার্সেলোনা ও কাদিজ ছিল আমদানী রফ্তানির বিরাট বাণিজ্য কেন্দ্র।

সমৃদ্ধির কালে স্পেনের আরবগণ সহস্রাধিক নৌ-জাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন, দানিউবে ছিল তাদের ফ্যাক্টরীসমূহ ও প্রতিনিধিবৃন্দ। কন্সট্যান্টিনোপলের সঙ্গে ছিল তাদের বিরাট বাণিজ্য সম্পর্ক, আর এ বাণিজ্য সম্পর্ক ভূমধ্যসাগরের পূর্ববর্তী থেকে এশিয়ার মধ্যবর্তী এলাকায় বিস্তৃত ছিল এবং তা পৌঁছেছিল ভারতবর্ষ ও চীনদেশের পোতাশ্রয়ে ও আফ্রিকার কূল ধরে মাদাগাস্কার পর্যন্ত। দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি কাসেমের ন্যায় আলোকপ্রাপ্ত মুরগণ ব্যবসা বাণিজ্যের উপর গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করছিলেন। বাণিজ্যিক তৎপরতায় উৎসাহ প্রদানের জন্য ও পর্যটনের ক্ষেত্রে প্রেরণা দানের জন্য সরকারের কর্তৃত্বাধীনে ভৌগোলিক বিবরণ গেজেট ও ভ্রমণতথ্য সম্বলিত পুস্তক প্রকাশিত হত, এসবে থাকত নির্দেশিত স্থানসমূহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, পথ নির্দেশ ও অন্যান্য প্রয়োজণীয় বিষয়। ইবন বতুতার ন্যায় পর্যটকগনের তথ্যের খনিজপদার্থ এবং জলবায়ূ ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ বিস্ময়কর প্রাঞ্জলতা ও নিরীক্ষণের সূক্ষ্মতা সহকারে বিশালকার গ্রন্থসমূহ রচনা করেছে।

চলছে.....

বিষয়: বিবিধ

২১২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File