মধ্যযুগে বাগদাদ...পর্ব ৪
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৭ এপ্রিল, ২০১৩, ০৭:৩৭:৫৫ সন্ধ্যা
ইতিহাসে প্রথম পরিক্ষক ঃ
সিনান ইবনে সাবেত ইবনে কোররা হলেন মেডিকেল সাইন্সের প্রথম পরিক্ষক। ৯১৩ সালে খলিফা মুকতাদির সর্বপ্রথম চিকিৎসকদের উপযুক্ততা সম্বন্ধে সরকারীভাবে পরিক্ষা নেয়ার জন্য তাকে পরিক্ষক হিসেবে নিয়োগদান করেন। খলিফা জানতে পারেন একজন বেসরকারী চিকিৎসকের ভুলের জন্য এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি তখন মুহতাসিব ইবরাহীম মুহাম্মদ ইবনে আবি বাতিহাকে আদেশ দেন, এরপর যেন কেউ সিনান ইবনে সাবেত ইবনে কোররার সনদ ছাড়া চিকিৎসা করতে না পারে। যারা আগে থেকে চিকিৎসা পেশায় রয়েছে, তাদেরকেও সিনান পরিক্ষা করবেন। খলিফা নিজের হাতে এই মর্মে আদেশ লিখে সিনানকে পরিক্ষক নিযুক্ত করেন। অতঃপর সিনান চিকিৎসকদের পরিক্ষা নিয়ে সনদ দানের ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয় চিকিৎসকের কে কোন শাখায় পেশাগতভাবে উপযুক্ত তাও ঠিক করে দিতেন সিনান। কিফতীর মতে, সিনান প্রথম বছরই বাগদাদে ৮৬০ জন চিকিৎসককে এই সনদপত্র দেন। সিনানের ইন্তেকালের পর তার পুত্র ইবরাহীম বাগদাদের প্রধান চিকিৎসক নিযুক্ত হন। তবে তিনি নিজে প্রধান পরিক্ষক না হয়ে বসরার আবু সাইদ ইয়ামীনকে বাগদাদের বেসরকারী চিকিৎসকদের পরিক্ষা নিয়ে সনদ দিতে বললেন। ইয়ামীন ৬মাস পরিক্ষা চালিয়ে ৭০০জনকে সনদ দেন। অতঃপর বাগদাদের মত খিভাতেও পরিক্ষা সংসদ গঠিত হয়। খারেজম শাহ তার অন্যতম প্রধান চিকিৎসক ইবনুল আম্মারকে পরিক্ষা চালানোর একটি বিধিবদ্ধ নিয়ম কানুন বানাতে বলেন এবং সে নিয়ম অনুসারেই পরিক্ষা নিয়ে চিকিৎসকদের সনদ দেয় হতো। খলিফা মুসতাজিদের সময় প্রধান চিকিৎসক ও পরিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনুত তিলমিজ। বাগদাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত সব ক্ষমতা দেয়া ছিল প্রধান চিকিৎসক ও মুহতাসিব তথা ইন্সপেক্টর জেনারেলের উপর।
মুসলিম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা (এখানে শুধু বাগদাদের হাসপাতালের বর্ণনা লক্ষ্যনীয়)
মুসলমানরা কেবল চিকিৎসা গবেষণা, উদ্ভাবন এবং এ বিষয়ে গ্রন্থ রচনায় ব্যাপৃত থাকেননি; এসময় সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে নির্মিত হয়েছিল অসংখ্য হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র। উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান এর সময়কালের পূর্ব পর্যন্ত এ ধরনের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। অনেক ভ্রাম্যমান হাসপাতাল ছিল। মূলতঃ ইসলামের এসব ভ্রাম্যমান হাসপাতালই পরবর্তীকালে মুল হাসপাতাল স্থাপনের সুতিকাগার ছিল। এ ধারায় খলীফা আব্দুল মালিক সর্বপ্রথম বিপুল অর্থ ব্যয় করে অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত এক বিশাল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালিন প্রথিতযশা চিকিৎসকগণকে তথায় চিকিৎসা সেবায় নিযোগ করা হয়। হাসপাতালে রোগী শ্রেণী বিন্যাস অনুযায়ী পৃথক পৃথক বিভাগ ছিল। প্রত্যেক বিভাগে থাকতো আলাদা চিকিৎসক। উম্মাদ এবং স্বল্পবুদ্ধির লোকের জন্য এতে পৃথক বিভাগ ছিল। পরবর্তীতে ইসলামী শাসনের বিভিন্ন সময়ে বাগদাদ, কার্ডোভা, দামিশ্ক, কায়রো প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ শহরে অনেক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব হাসপাতালে যুগশ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিদগণ চিকিৎসা করতেন। পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য পৃথক পৃথক বিভাগসহ চর্ম, কলেরা ও বসন্ত রোগের চিকিৎসার জন্য এসব হাসপাতালে ছিল স্বতন্ত্র বিভাগ। তাছাড়া রোগীদের চিত্তবিনোদনের জন্যও আলাদা বিভাগ পরিচালিত হতো। চিকিৎসা সচেতনতা, রোগ সচেতনতা ইত্যাদি সম্বন্ধে এবং ধর্ম, সমাজ সংস্কৃতি ইত্যাদির বিষয়ে বক্তৃতার জন্য হাসপাতালের আলাদা হলে বক্তৃতা মঞ্চের ব্যবস্থা থাকত। সাদা ধবধবে রেশমী বস্ত্র আচ্ছাদিত মনোরম পরিবেশে হাসপাতালের শয্যাগুলো থরে থরে সাজানো থাকতো।
প্রতিটি কক্ষেই প্রবাহমান বিশুদ্ধ পানির সুবন্দোবস্ত থাকতো। গোছলখানা সমূহে রোগীদের উপযোগী ঠান্ডা ও গরম পানির ব্যবস্থা ছিল এবং প্রত্যেক রোগীকে হাসপাতালে অবস্থানকালীন সময়ে দেয়া হতো জীবানুমুক্ত পরিস্কার পরিধেয় এবং তোয়ালে। এসব হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার সাথে আজকের অত্যাধূনিক হাসপাতাল গুলোরও তুলনা করা যায় না,কারণ প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত হওয়া সত্ত্বেও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারনে উভয়ের সেবার মান ভিন্ন। তখন চিকিৎস্যা ছিল মুসলিম-অমুসলিম,খিলাফতভূক্ত নাগরিক,বাইরের নাগরিক নির্বিশেষে সকলের জন্য সম্পুর্ণ ফ্রি। খিলাফত রাষ্ট্রের হাতে এত সম্পদ ছিল যে,হাসপাতালগুলো রোগীদেরকে পোষাক,খাবার,চিকিৎস্যা ফ্রি দিতে পারত এবং চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা করত।
খলিফাগণ আল্লাহর ভয়ে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একাজগুলো করতেন। সে সকল হাসপাতাল সমূহে রোগীদের প্রয়োজন এবং চাহিদানুযায়ী বিভিন্ন হালাল পশু পাখীর গোশত, ফলফলাদিসহ বিভিন্ন উপাদেয় খাদ্য সরবরাহ করা হত। কুলীন ,অকুলীন, গরীব, ধনী, মুসলিম ,অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেই হাসপাতাল সমূহ হতে সমানভাবে সুবিধা ভোগ করতো(কখনও কখনও হাসপাতালের সেবা নেওয়ার জন্য কিছু সুস্থ্য মানুষ অসুস্থ্যতার ভান করত,ডাক্তারগণ কখনও কখনও তাদের চালাকি বুঝতে পেরে উপহার সামগ্রী দিয়ে বিদায় করতেন)। অভিজ্ঞ চিকিৎসক মন্ডলীর ব্যবস্থাপনায় এবং খুব মনোযোগ এবং হৃদ্যতা সহকারে চিকিৎসা হতো বলে অতি দ্রুত রোগীরা আরোগ্য লাভ করতো (উল্লেখ্যঃ খিলাফতের শাসনামলে খিলাফতভূক্ত সকল এলাকায় চিকিৎস্যা বিনা মূল্যেই প্রদান করা হত)।
ইসলামী খিলাফতের যুগে হাসপাতাল প্রতিষ্টায় শুধু শাসকদের অবদান ছিলো না । একাজে সমকালীন চিকিৎসকরা ক্ষমতাসীনদের সাহায্য সহযোগিতা দাবী করতেন। ফলে যেখানে সেখানে গড়ে উঠতো হাসপাতাল। শাসকরাও অকৃপণ হাতে সার্বিক সাহায্য দিয়ে হাসপাতাল স্থাপনের পৃষ্টপোষকতা করতেন। ইতিহাসের পাতায় সে কাহিনীসমূহ আজো সযতেœ রক্ষিত আছে। ইসলামী খিলাফত যুগে হাসপাতালের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত ওরিয়েন্টালিষ্ট ডঃ ডানল্ড ক্যম্বল লিখেছেন; একমাত্র কর্ডোভায়’ই ইসলামী শাসনামলে প্রায় ৫০০ চিকিৎসা কেন্দ্র ছিলো। হাসপাতাল সমূহের মধ্যে আল জেকিরাজ ছিল অন্যতম। সরকারী ব্যয়ে পরিচালিত উঁচু দরের চিকিৎসকরা এটি পরিদর্শন ও পরিচালনা করতেন। এর কার্যনির্বাহী পদে মুসলমান হওয়ার কোন প্রয়োজন পড়তো না। অভিজ্ঞ চিকিৎসক, কৌশলী ও পরিশ্রমীদের এখানে নিয়োগ করা হতো।
অনেক ইহুদী, খৃষ্টান চিকিৎসকও এতে কাজ করতো। উপযুক্ত এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা এক এক করে প্রত্যেক রোগীর শয্যাপার্শ্বে বসে মত বিনিময় করত। চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলমানরা কতটুকু অগ্রসরমান ছিল তার প্রমান মেলে ঐতিহাসিক হিট্টির ভাষায় ঃ ‘৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে শুধু বাগদাদেই ৮৬০ জন চিকিৎসক ডিগ্রী নেন। প্রখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী সাবিত বিন কুররা তার গ্রন্থে মানব দেহের যাবতীয় রোগের বর্ণনা দেন। আর রাযী হাম ও বসন্তের চিকিৎসা আবিস্কার করেন।’
জ্যোতির্বিজ্ঞানে বাগদাদ ঃ
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যের উন্নতির পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানেরও উল্লেখযোগ্য উন্নতি ও উৎকর্ষ সাধন করে। এখানে আমি তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করছি। ৭৬২ সালে খলীফা আল মুনসুর বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় বাগদাদ হয়ে পড়ে ইসলামী সংস্কৃতি ও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রভূমি। এ সময় মাশাআল্লাহ ও নওবখত নামক দুইজন জ্যোতির্বিদ বাগদাদের মানচিত্র নকশা তৈরী করেন। খলীফা মনসুরের দরবারের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম আল ফাজারী। তিনি এ বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা সহ বেশকিছু দরকারী যন্ত্রপাতি আবিস্কার করেন। আল নিহওয়ান্দী প্রথম যুগের একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তিনি স্বীয় গবেষণাসিক্ত মুশতামাল’ নামক যে নির্ঘন্ট প্রণয়ন করেন তা গ্রীক ও হিন্দু উভয় জ্যোতির্বিদ্যার দিশারী হিসাবে সম্মান প্রাপ্ত হয়েছে। খলিফা মামুনের শাসনামলে সরকারী প্রচেষ্টায় বহু গ্রীক গ্রন্থ অনুদিত হয়। ব্যাপক অনুবাদ কাজের জন্য প্রতিষ্টিত হয় বায়তুল হিকমা। জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর নিয়মিত গবেষণার জন্য সামাসীয়া ফটকের নিকট স্থাপিত হয় একটি মানমন্দির। সিনাদ ইবনে আলী এবং ইয়াহিয়া বিন আবু মনসুর নিযুক্ত হল এর তত্ত্বাবধায়ক। মুসা ভ্রাতৃদ্বয়ও নিজেদের জন্য স্থাপন করেন আরেকটি মানমন্দির। শরফূদ্দীন মানমন্দির স্থাপন করেন ইরানের জ্যোতির্বিদদের একান্ত পরামর্শে। মিসরে ফাতেমীয় শাসনামলে রাসাদ ই হাকামী নামক একটি মানমন্দির ছিল। মুসলমানদের মানমন্দির প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি ইউরোপীয়রা অনুকরণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানে যথেষ্ঠ উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়।
ইসলামের ইতিহাসের অনন্য সাধারণ বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আল খারেজমী (৭৮০-৮৫০ খৃ.) জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কেও অসাধারণ আলোচনা করেন। দশম শতকের শেষ দিকে বহু মুসলিম জ্যোতির্বিদ বাগদাদে বাস করতেন। এদের মধ্যে আলী বিন আমজুর, আবুল হাসান আলী, আল খুজান্দি, মাসলামা বিন আহম্মদ উল্লেখযোগ্য। গাণিতিক ও কবি ওমর খৈয়ামও একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তিনি নিশাপুরে মানমন্দির স্থাপন ও পারস্যপঞ্জিকা সংস্কার সম্মেলনে যোগ দেন। মঙ্গোলীয় যুগে নাসীরউদ্দিন তুসী প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন। মুসলিম বিশ্বে জ্যোতির্বিদ হিসেবে আরো অবদান রোখেছিলেন কুতুবদ্দীন সিরাজী, আল হাসিব, বলখী, নাইরিজা, সাহল কুহি, আদুর রহমান সুফী, ইবনে হাতিম, খাজিনী, ইবনে তোফায়েল, বিতরুজী, উর্দী মহিউদ্দীন, মাগরিবী, গিয়াসুদ্দীন জামশেদ, উলুঘ বেগ, কাদিজাদা রুমী, ইবনে আমাজুর এবং আবুল হাসান প্রমুখ বিজ্ঞানী মনীষীরা। এদের আবিস্কার গবেষণাগ্রন্থ ও সূত্রের মাধ্যমে আধুনিক ইউরোপ আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করে। যদিও মুসলমানদের কৃতিত্বের অনেক কিছু ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদের করতলগত কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুসলমানরাই আধুনিক সফল পথিকৃত, ইউরোপীয় পন্ডিতরাই একথা স্বীকার করেছেন।
এই যুগে যেসব বৈজ্ঞানীক ও বিদগ্ধজন আবির্ভূত হয়েছিলেন তাদের বিবরণ দিতে হলে কয়েক খন্ড গ্রন্থ প্রণয়নের প্রয়োজন। তারা নানাভাবে অগ্রগতির ইতিহাসে তাদের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। আরব জ্যোতির্বিদদের মধ্যে প্রাচীনতম মনীষী, মাশা আল্লাহ এবং আহমদ ইবনে আল নেহাবন্দী মনসুরের খিলাফতকালে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মাশা আল্লাহকে ঐতিহাসিক আবুল ফারাজ তার কালের ফিনিক্স বলে অভিহিত করেছেন। তিঁনি গোলকের মডেল(পৃথিবীর আকার সংক্রান্ত ধারনা,যা এখনকার সাথে হুবহু মিল), গ্রহ -নক্ষত্রের প্রকৃতি ও গতি সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, এসব গ্রন্থ আজও বৈজ্ঞানিকদের বিস্ময় উৎপাদন করে। আহমদ আল্ নেহাবন্দী তার নিজস্ব নিরীক্ষণের উপর নির্ভর করে জ্যোতিস্কের একটি ছক আল্ মুস্তামাল তৈরী করেছিলেন যা গ্রীক ও হিন্দু পন্ডিতদের ধারণাসমূহের উপর অবিসংবাদিতভাবে অগ্রগামী পদক্ষেপ ছিল। মামুনের তত্ত্ববধানে টলেমির আল ম্যাজেষ্ট পূণরায় অনূদিত হয়েছিল এবং সেন্দ ইবনে আলী, ইয়াহিয়া ইবনে আবি মনসুর ও খালিদ ইবনে আব্দুল মালিক পরীক্ষিত ছক তৈরী করেছিলেন। বিষুব, গ্রহণ ও ধুমকেতুর আবির্ভাব এবং অন্যান্য খ-গোলীয় ঘটনাবলীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ সমূহ বহুলাংশে মূল্যবান ছিল; আর তা অনেক পরিমাণে মানুষের জ্ঞানের সীমা সম্প্রসারিত করেছিল।
মামুনের আদেশে মুহম্মদ ইবনে মূসা আল খাওয়ারিজমী (বিজগণীতের জনক) টীকা ও নিরীক্ষণ সহকারে সিদ্ধান্ত বা ভারতীয় ছকের নতুন অনুবাদ করেছিলেন। গণিত, জ্যামিতি, দর্শন, আবহাওয়া-বিজ্ঞান, আলোক-বিজ্ঞান, চিকিৎসা-বিজ্ঞান, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলকিন্দি দু’শ গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। গ্রীক ভাষায় সম্যক পারদর্শী আলকিন্দি এথেন্স ও আলেকজান্দ্রিয়ার পন্ডিত সমাজ থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তা তিনি তার মূল্যবান গ্রন্থসমূহে বিধৃত করেছিলেন। সেডিলট বলেছেন- তার গ্রন্থাবলী কৌতুহলোদ্দীপক ও চিত্তার্কষক তথ্যে পরিপূর্ণ। আবু মা শার (মধ্য যুগের ইউরোপীয় পন্ডিতগণ যাকে আলবুমাফরে পরিণত করেছেন) খ-গোলীয় ঘটনাসমূহকে তার গবেষণার বিষয় করেছিলেন, আর জিযআবি মা শার বা আবু মা শারের ছক সব সময়ে জ্যোর্তিবিদ্যা বিষয়ক জ্ঞানের অন্যতম প্রধান উৎস বলে বিবেচিত হয়েছে। মামুন ও তার অব্যবহিত পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের শাসন আমলে কর্মরত মুসা বিন শাকিরের পুত্রদের (মুহাম্মদ, আহম্মদ, হাসান) আবিস্কারসমূহ বিশেষ করে সূর্য এবং অন্যান্য জ্যোতিস্কের মধ্যম গতি সম্পর্কীয় মূল্যায়ন ইউরোপের সাম্প্রতিক আবিস্কারসমূহের মতোই যথাযথ, তাদের যেসব যন্ত্রপাতি ছিল তা বিবেচনা করলে তারা বিস্ময়কর যথার্থ্যরে সঙ্গে ক্রান্তিবৃত্তের তির্যক গতি নিরুপণ করেছিলেন এবং সর্বপ্রথম সমুদ্রপৃষ্ট থেকে চন্দ্রের উচ্চতার বিভিন্নতার লক্ষ্য করেছিলেন, তারা উল্লেখযোগ্য যথার্থের সঙ্গে বিষুবের পূর্বগমণ ও সৌর দুরত্বের গতি (যা গ্রীকদের নিকট সম্পুর্ণ অপরিজ্ঞাত ছিল) নিরীক্ষণ ও নিরুপণ করেছিলেন। লোহিত সাগরের তীরের উপর এক ডিগ্রি পরিমাপক থেকে পৃথিবীর আকার নির্ধাণ করেছিলেন যে,পৃথিবী গোল, এটা এমন এক সময়ে করা হয়েছিল যখন খ্রিস্টান ইউরোপ পৃথিবীর সমতলত্ব ঘোষণা করেছিল। আবুল হাসান দুরবীক্ষণ যন্ত্রের উদ্ভাবন করেছিলেন যে বিষয়ে তিনি বলেছেন ‘দু’ প্রান্তে বিস্তারিত নল যার সঙ্গে সংকেতের বাহু সংযুক্ত। এই নলের উন্নতি সাধন করা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তা মারাঘা ও কায়রোর মানমন্দিরে প্রভূত সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছিল। আল্ নায়েরেজি ও মুহম্মদ ইবনে ঈসা, আবু আব্দুল্লাহ মুসা ইবনে শাকিরের পুত্রদের (মুহম্মদ ইবনে মুসা ইবনে শাকির ২৫৯ হিযরীতে ৮৭৩ খ্রি. মৃত্যুবরণ করেছিলেন।) মহতী কার্য অব্যাহত রেখেছিলেন। ইতোমধ্যে আল্ বাত্তানীর আবির্ভাব ঘটেছে মুসলিম বৈজ্ঞানিকগণ প্রাচীন জাতিসমুহের স্থূল জ্যোতির্বিদ্যাকে নিয়মিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বিজ্ঞানে পরিণত করেছেন। যুদও জ্যোতির্বিদদের মধ্যে উচ্চ পদমর্যদার অধিকারী হয়েছিলেন।
একজন যথোপযুক্ত বিচারক তার ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, গ্রীকদের মধ্যে যেমন টলেমি আরবদের মধ্যে তেমনি আল্ বাত্তানী। তার জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক ছক ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয়েছিল এবং তা বহু শতাব্দী ধরে ইউরোপের জ্যোতির্বিদ্যার ভিত্তি প্রদান করেছিল। তিনি গণিতের ইতিহাসে জ্যামিতিক ও
ত্রিকোণমিতি পরিমাপের জ্যার আবিস্কারকের পরিবর্তে সাইন ও কোসাইনের প্রবর্তক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। দশম শতাব্দীর শেষের দিকে বহুসংখ্যক জ্যোতির্বিদ বাগদাদে কর্মরত ছিলেন। তাদের মধ্যে দু’জন আলী ইবনে আমাজুর এবং আবুল তাসান আলী ইবনে আমাজুর। তারা তাদের চান্দ্রগতি গণনার জন্য সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ফেজ, মিকনাসা, সেগেলমেসা, তাহার্ত, টেলেমসেন , কায়রোওয়ান, সর্বোপরি কায়রো কৃষ্টি ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। খোরাসানে তাহেরীয়গণ, ট্রানসোকিসয়ানায় সামানীয়গণ, তাবারিস্তানে পরে, পারস্যে ও বাগদাদে প্রাসাদের মেয়র হিসেবে বুয়াইদগণ বিজ্ঞানী ও পন্ডিতদের প্রতি অকৃপণ পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। সে যুগের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুর রহমান সুফী ছিলেন বুয়াইদ আমির আজাদ উদদৌলার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাকে যথোপযুক্তভাবেই আরবদের দ্বিতীয় অগাস্তাস বলা হয়। আব্দুর রহমান তারকার আলোকমান যন্ত্রের উন্নতি সাধন করেন। আজাদ উদ দৌলা নিজে একজন পন্ডিত ও গাণিতিক ছিলেন; তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাগদাদে সমাগত বিদ্বান ব্যক্তিদেরকে তার প্রাসাদে সম্মানিত অতিথি হিসেবে অভ্যর্থনা জানাতেন এবং তাদের মধ্যকার বৈজ্ঞানিক মতবিরোধ আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন। খলিফা মুতাফিক বিল্লাহর পুত্র জাফর ধুমকেতুর অনিয়মিত গতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ চালিয়েছিলেন এবং সে বিষয়ে একখানি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। অন্যান্য যুবরাজগণও পাঠ্যবিষয়ের পাশা পাশি বিজ্ঞান চর্চা করতেন। বুয়াইদদের অধীনে একদল জ্যোতির্বিদ, পদার্থবিদ ও গণিতবিদ খ্যাতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে মাত্র দু’জন আলকোহি এবং আবুল ওয়াফা। আল্ কোহি গ্রহের পতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এবং সে সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। উত্তর অয়নান্ত ও শরৎকালীন বিষুব সম্পর্কে তার আবিস্কার মানব জ্ঞানের সীমারেখা বৃদ্ধি করেছিল। আবুল ওয়াফা খোরাসানের বুজ যান নামক স্থানে জন্মগ্রহন করেছিলেন ৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে; তিনি ৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ইরাকে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সেখানে তিনি গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনুশীলনে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তার জিয্-উশ্-শামিল’বা ‘একত্রিত/সাধারণ ছক’ পরিশ্রম, সূক্ষè ও যথাযথ পর্যবেক্ষণের স্মৃতিস্তম্ভ। তিনি ত্রিকোণমিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিরীক্ষণের ক্ষেত্রে ছেদক রেখা ও স্পর্শকের ব্যবহার করেছিলেন। এম. সেডিলট বলেন, “টলেমির চান্দ্র বিষয়ক মতবাদের ভ্রান্তি দ্বারা নীত হয়ে তিনি প্রাচীন পর্যবেক্ষণ যাচাই করেছিলেন এবং স্বতন্ত্রভাবে কেন্দ্র ও বহিঃস্থের সমীকরণের মধ্যে এক তৃতীয় অসাম্য আবিস্কার করেছিলেন যা ছ’শ বছর পর টাইকো ব্রাকে নিরুপণ করেছিলেন।”
চলবে...
বিষয়: বিবিধ
৩১৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন