মধ্যযুগে বাগদাদ.... পর্ব ২
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৫ এপ্রিল, ২০১৩, ০৮:৫৬:৪৩ সকাল
জ্ঞান বিজ্ঞানে বাগদাদের অগ্রসরতা
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বাগদাদের অবস্থা ঃ
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের উন্নয়ণের ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য অংশের চাইতে বাগদাদ কোন ভাবেই পিছিয়ে ছিল না। ৮ম থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যে সর্বদিক দিয়ে বাগদাদ পৃথিবীর সবথেকে উন্নত শহরের মর্যাদা লাভ করে। ইতিহাস প্রমাণ করে বাগদাদ রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোর্তিবিজ্ঞান, আইন তত্ত্ব,গণিত, ভূ-বিজ্ঞান, দর্শণ, ইতিহাস,সমাজ-বিজ্ঞান, সমর বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেছিল। শুধু তাই নয়, প্রযুক্তি ও সাংষ্কৃতির ক্ষেত্রে বাগদাদ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে তন্মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে, প্রযুক্তি উন্নয়নে, স্থাপত্য শিল্পে, হস্তলিখন শিল্প, চিত্রশিল্পে, গ্রন্থাগার সংগঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান স্মরণ করা যেতে পারে(বাগদাদসহ ইসলামী ভূখন্ডের অন্যান্য অংশের বড় বড় লাইব্রেরীতে যখন ৬ লক্ষাধীক পর্যন্ত মূল্যবান কিতাব সংরক্ষিত থাকত ,তখন ইউরোপের প্রসিদ্ধ লাইব্রেরীগুলোর কিতাবের সংখ্যা সাড়ে ৫ হাজারের বেশী ছিলনা।)। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতি বছর ৬ হাজারেও বেশী শিক্ষার্থী বাগদাদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসত। বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য,মুসলিমদের কৃষ্টি সাং®কৃতি শেখার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু কষ্ট স্বীকার করে বাগদাদে আসত। অমুসলিম বিশ্বের রাজপুত্রদের স্বপ্নের নগরী ছিল বাগদাদ। এখানকার প্রত্যেকটি রাস্তা ছিল পাকা এবং রাস্তায় রাতে বাতির ব্যবস্থা ছিল। এ সময় লন্ডন,প্যারিসে ধুলা,কাদা,অপরিচ্ছন্নতা,মূর্খতা,অসভ্যতা,ব্যপক সামাজিক অপরাধ ইত্যাদীর জন্য জনজীবন ছিল অতিষ্ঠ। খলিফারা শিক্ষা বিস্তারের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন দিনার ব্যয় করত অকাতরে। শিক্ষা ছিল অবৈতনিক। তখন জ্ঞানার্জনের প্রধান ভাষা ছিল আরবী।
ইহুদী,খ্রিষ্টান,মুশরিক,মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই এ ভাষাতে শিক্ষা গ্রহন করত। খলিফা মনসুরের আদেশেই বিদেশী ভাষার সাহিত্যি ও বৈজ্ঞানিক গ্রন্থসমূহের প্রথম আরবীতে অনুবাদ হয়েছিল। খলিফা মনসুরের আদেশে উঁচুদরের পন্ডিতগণ ভারতীয় উপকথা (হিতোপদেশ), জ্যোতির্বিদ্যার উপর ভারতীয় গ্রন্থ, ক্লডিয়াস টলেমির টি আল ম্যাজেস্ট ইউক্লিডের গ্রন্থসমূহ এবং বহু প্রাচীন গ্রীক, বাইজান্টাইন, পারসিক ও সিরীয় গ্রস্থ আরবীতে অনুবাদ করেছিলেন। ঐতিহাসিক মাসুদি বলেন যে এই অনুদিত গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হতে না হতেই অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে সেগুলো পঠিত হয়েছিল(স্পানিশ অনুবাদকগণ ৮৭টি বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ আরবী থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, এভাবে আরও অনেক বিষয়ের উপর লিখিত মৌলিক কিতাবের অনুবাদ হয় এবং তা ইউরোপকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ধাবিত করতে থাকে)। মনসুরের উত্তরাধিকারীগণও কেবল বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিদ্বান ও জ্ঞানীদের অনুরাগী পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন না, তারা নিজেরাও অত্যন্ত পরিশ্রম সহকারে জ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখার অনুশীলন করতেন। তাদের অধীনে আরবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, অন্য কথায় বিশাল সাম্রাজ্যের সম্মিলিত জাতি সমূহ, যা নিয়ে খিলাফত গঠিত ছিল তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বিশ্ময়কর দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হয়েছিল।
কলা ও বিজ্ঞানে উৎকর্ষতা ঃ
কলা ও বিজ্ঞানের কর্ষণে খিলাফত রাষ্ট্রের প্রত্যেক শহর অন্য শহরকে অতিক্রম করার চেষ্টা করত। মহান শিক্ষাগুরুর নীতি অনুসারে জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে দেশ পর্যটন ছিল একটি পবিত্র কর্তব্য। বিশ্বের প্রত্যেক জায়গা থেকে শিক্ষার্থী ও গবেষক আরব্য পন্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের বাণী শ্রাবণ করার জন্য কর্ডোভা,আলেকজান্দ্রিয়া,কুফা,কায়রো, বাগদাদ,সেভিল প্রভৃতি এলাকার পৃথিবী বিখ্যাত বিদ্যাপীঠে ভিড় জমাতেন। এমনকি খ্রিষ্টানগণ ইউরোপের সুদূর প্রত্যন্ত সীমা থেকে মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার জন্য আসতেন। যে সব মণীষী পরবর্তী জীবনে সুবিখ্যাত হয়েছিলেন তারাও মুসলমান শিক্ষকদের নিকট থেকে পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। আল মুয়িজ লি দিন ইল্লাহের শাসনাধীনে কায়রোর অভ্যূত্থান আব্বাসীয় ও ফাতেমীয় বংশের খলিফাদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্টপোষকতার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব যোগ করেছিল। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে পূর্বদিকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত এমন কি প্রশান্ত মহাসাগর থেকে দূরবর্তী অঞ্চলসমূহে মুসলমানদের তত্ত্বাবধানে ও অনুপ্রেরণায় দর্শন ও শিক্ষার বাণী অনুরণিত হয়েছিল।
এই যুগে খ্রীষ্টান বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবস্থা কি ছিল ? কনস্ট্যানটাইন ও তাঁর গোঁড়া উত্তরাধিকারীদের শাসনামলে এসকেলিপিউন চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল; আদিম পৌত্তলিক সম্রাটদের উদারতার ফলে যেসব পাঠাগার প্রতিষ্টিত হয়েছিল তা ছিন্নভিন্ন বা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল; “শিক্ষাকে ম্যাজিক হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছিল বা রাজদ্রোহিতা বলে গণ্য করা হয়েছিল” দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পূর্ণরুপে নির্মূল করা হয়েছিল। “অজ্ঞানতা ধর্মনিষ্ঠার জননী” এই যাজকীয় নীতিবাক্যের মধ্যে মানবীয় শিক্ষার প্রতি যাজকতন্ত্রের ঘৃণা গ্রেগলি রোম থেকে সব বৈজ্ঞানিক পঠন-পাঠনকে নির্বাসিত করে ও আগাস্তাস সিজার প্রতিষ্টিত প্যালেস্টাইন পাঠাগার ভস্মীভূত করে এই জ্ঞানবিরোধী নীতিকে কার্যকর করেছিলেন। তিনি গ্রীস ও রোমের প্রাচীন লেখকদের রচনা পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি পৌরাণিক খ্রীষ্টধর্মের প্রবর্তণ ও পুতকরণ করেছিলেন যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইউরোপের প্রভাবশালী ধর্মমত হিসেবে চলেছিল সাধকদের স্মৃতিচিহ্ন ও ধ্বংসাবশেষ পূজা ছিল এর অর্ন্তভূক্ত। গোঁড়া খ্রীষ্টধর্ম সাহিত্য ও বিজ্ঞানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। যখন স্বাধীনতা চিন্তা মানবমনের অগ্রগতি রোধ করার জন্য তৈরী প্রাচীর ভেঙ্গে দিয়েছিল একমাত্র তখনি তারা নিজেদের মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিল। আব্দুল্লাহ আল্ মামুন সঠিকভাবেই আরবদের অগাসতাস বলে অভিহিত। “তিনি এ বিষয়ে অজ্ঞ ছিলেন না যে, তারা আল্লাহর মনোনীত তাঁর শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে কল্যাণকামী দাস, যাদের জীবন তাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের প্রতি নিবেদিত আর জ্ঞানের অন্বেষণকারী মহান শিক্ষকেরা জগতের প্রকৃত জ্যোতিষ্ক।” মামুনের উত্তরাধিকারী যুবরাজগণ তার কর্মধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর এবং তাঁর উত্তরাধিকারী শাসনামলে বাগাদাদের পঠন-পাঠনের প্রধান বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক ধারা ছিল প্রকৃতপক্ষে প্রবল বৈজ্ঞানিক মানসিকতা, আর এই বিশিষ্টতা তার সমুদ্বয় সাফল্যের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। যে অবরোহ পদ্ধতিকে আধুনিক ইউরোপের উদ্ভাবন ও একমাত্র একচেটিয়া অধিকার বলে বিবেচিত হত তা মুসলমান পন্ডিতেরা নিখুঁতভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। “জ্ঞাত বিষয় থেকে অজ্ঞাত বিষয়ে উত্তরনের মধ্যদিয়ে বাগদাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কার্য থেকে কারণে উন্নীত হওয়ার জন্য ঘটনাবলীর যথাযথ পরিক্ষা-নিরিক্ষা করেছিল এবং কেবল অভিজ্ঞতা প্রদর্শিত বিষয়েই গ্রহণ করেছিল; মুসলিম শিক্ষাবিদেরা এই ধরনের মূল নীতিসমূহ শিক্ষা দিয়েছিলেন।” “নবম শতকের আরবগণ সেই উর্বর পদ্ধতির অধিকারী হয়েছিলেন যে পদ্ধতি বহু পরে আধুনিক চিন্তাবিদদের হাতে তাদের সুন্দরতম আবিস্কারসমূহের হাতিয়ার হয়েছিল।”
রসায়নে বাগদাদ ঃ
আরবদের পূর্বে রসায়ন বিদ্যা বিজ্ঞান হিসাবে পরিচিত ছিলো না; উপায় উপকরণের কারণ হিসাবে এ চর্চা পরিচালিত হতো। রসায়নকে বিজ্ঞান হিসাবে মুসলমান সাধকরাই প্রতিষ্ঠিত করেন। হাম-বোল্ট উল্লেখ করেছেনঃ “আধুনিক রসায়ন শাস্ত্র মুসলমানদের উদ্ভাবন এবং এই বিষয়ে তাহাদের কৃতিত্ব অতুলনীয়রুপে চিত্তাকর্ষক। ” মূলতঃ প্রাচীন রসায়নের অসারতা প্রমাণ করে, শিল্প রসায়নের প্রচলিত (ওহফঁংঃৎরধষ ঈযবসরংঃৎু) দৌড়কে থামিয়ে দিয়ে তত্ত্বীয় রসায়ন তাদের হাতেই জন্মলাভ করে। ঝরৎ ঋফঁধৎফ ঞযড়ৎঢ়ব তাঁর ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঈযবসরংঃৎু গ্রন্থে উল্লেক করেছেনঃ ঊীঢ়বৎরসবহঃধষ অষপযবসু ধং ফরংঃরহমঁরংযবফ ভৎড়স ওহফঁংঃৎরধষ ঈযবসরংঃু সধু ধং ধষৎবধফু ংঃধঃবফ, নবংরফব ঃড় যধাব ড়ৎরমরহধঃবফ রিঃয ঃযব অৎধযনরধহং. ঐতিহাসিক রেজা-ই করীম এ প্রসঙ্গে লিখেনঃ “জ্যোতির্বিদ্যা, অংকশাস্ত্র এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের পরেই আরবদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রসায়ন শাস্ত্রে। বিজ্ঞান অধ্যায়নের ক্ষেত্রে গ্রীকদের মতো অস্পষ্ট অনুমান ও কল্পনার উপর নির্ভরশীল না হয়ে আরবগনই প্রথম হতে নিরীক্ষণ পদ্ধতির (বীঢ়বৎরসবহঃ) প্রবর্তন করেন। সূক্ষè পর্যবেক্ষণ (ড়নংবৎাধঃরড়হ) এবং সত্য উদঘাটনের প্রবল ইচ্ছা আরবদিগকে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করত। রসায়নের ইংরেজী প্রতি শব্দ কেমিষ্ট্রী (ঈযবসরংঃৎু); শব্দটি যে আরবী ‘আল-কিমিয়া’ থেকে উদ্ভূত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ষষ্ঠ ও সস্পম শতাব্দী থেকে আল কিমিয়া শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
খালেদ বিন ইয়াজিদ ঃ
হযরত আলীর তৈরী রসায়নিক পরিকল্পনার উত্তরাধিকার বহন করেন হযরত মুয়াবিয়ার পৌত্র খালেদ বিন ইয়াজিদ। উমাইয়া যুগের বিরল বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম গ্রীক বৈজ্ঞানিক গ্রন্থসমূহের অনেকগুলো আরবীতে অনুবাদ করেন। ঐতিহাসিক ফিহরিস্তের মতে, ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম অন্য ভাষা থেকে আরবীতে গ্রন্থ অনুবাদ করেন। এ দৃষ্টিতে তাঁকে আরব প্রাকৃতিক বিজ্ঞান আলোচনার প্রবর্তক বলা যেতে পারে। তিনি চারটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন বলে ইবনে নাদিম ফিহরিস্তে উল্লেক করেছেন। সেগুলো হলো ‘ কিতাবূল হারারাত’ ‘সাহিফাতিল কবীর’ ‘সাহিফাতিস্ সগীর’ এবং ‘ওয়াসিয়াতিহি ইলা ইবনিহি ফিস্ সান আ’।
রসায়ন বিজ্ঞানের জনক- আবু আবদুল্লাহ জাবির ইবনে হাইয়ান ঃ
এম আকবর আলী লিখেছেন ঃ ‘জাবির ইবনে হাইয়ানকে বলা চলে পৃথিবীর সর্বপ্রথম রসায়ন বৈজ্ঞানিক। তাঁর পূর্বে যে রসায়নের চর্চা হয়নি তা নয়, কিন্তু সে চর্চার মধ্যে ঠিক বর্তমানে চর্চা বলতে সাধারণতঃ যে ধীরস্থির নিয়মানুগতিক সুবোধ্য ধারার কথা মনে হয় তেমন কোনো নিয়মানুগতিক ধারার অস্তিত্বই ছিলো না। রসায়ন ছিলো তখন যাদু বিদ্যার অন্যতম প্রতীক। সাধারণ সমাজ একে দেখতো ভয়ের চোখে, বিদ্বান সমাজ একে বিজ্ঞান হিসাবে আমলই দিতেন না। রসায়নের যখন এমনি অস্বাস্থ্যকর অবস্থা সেই সময়েই জাবিরের আবির্ভাব। এই সময়ে তিনি যে কঠোর অধ্যাবসায় ও পরিশ্রমের ফলে রসায়নকে তার অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ভার করে দর্শন অংক ও চিকিৎসা শাস্ত্রের সমতুল্য পরিপূর্ণ বিজ্ঞান হিসেবে উন্নতি করতে পেরেছিলেন, তার জন্যেই বিজ্ঞান জগত তাঁর কাছে চীর কৃতজ্ঞ। আবু আবদুল্লাহ জাবির ইবনে হাইয়ান আল কুসী আরব বংশোদ্ভূত, কুফা ভিন্নমতে তূসে জন্মগ্রহণ করেন। তার বৈজ্ঞানিক অনুশীলন শুরু হয় আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশীদের (৭৮৬-৮০৯ খৃ.) খিলাফত কালে। কুফায় তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা চলেছিলো। ঐতিহাসিক ফিহরিস্তের মতে, তার রসায়নাগারও এখানে স্থাপিত হয় এবং তার মৃত্যুর একশত বছর পরে কুফার প্রান্তে অবস্থিত দামাস্কাস গেটের নিকট নতুন রাস্তা তৈরী করতে কতোগুলো ঘর ভেঙ্গে ফেলার সময় ২০০ পাউন্ড ওজনের একটি সোনার তাল ও একটি খল পাওয়া যায়। অবশ্য হিট্টি এ ঘটনার সময় তার মৃত্যুর দুইশ বছর অতিবাহিত হয়েছিলো উল্লেখ করেছেন। ৭৭৬ বা ৮১৩ খৃ. দিকে তার মৃত্যু হয়েছিল।
জাবির বিন হাইয়ানের জীবনী আলোচকদের মধ্যে চতুর্দশ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ রসায়নবিদ আল জিলদাকীর (মৃ. ১৩৬০ খৃ.) রচিত ‘কিতাবুল বুরহান ফি আসরাবে আলমুল মিজান”এ সবচেয়ে বিজ্ঞান সম্মত আলোচনা করা হয়েছে। জাবিরের সর্বপ্রথম বিজ্ঞানসম্মত জীবনী আলোচক ঐড়ষসুধফ এর মতে ঃ আজদ বংশীয় জাবির কুফায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি রসায়ন শাস্ত্র শিক্ষার পর ইমাম জাফর সাদিকের নিকট গমন করেন এবং কার্য চালান। বারমাকী মন্ত্রী জাফরের সহায়তায় তিনি খলিফা হারুনুর রশীদের অনুগ্রহভাজন হন। তিনি খলিফার জন্য কিতাবুল জুহুর (ঞযব নড়ড়শ ড়ভ ইষড়ংংড়স) বা কিতাবুল নুহাস (ঞযব নড়ড়শ ড়ভ ঈড়ঢ়ঢ়বৎ) প্রণয়ন করেন। তারই উদ্যোগ দ্বিতীয়বারের জন্য গ্রীক গ্রন্থাবলী কনষ্টান্টিনোপল থেকে আনীত হয়। তিনি ৯০ বছরের ও অধিককাল জীবিত ছিলেন।” জাবিরের পিতা ছিলেন খ্যাতনামা চিকিৎসক। সেই সূত্রে চিকিৎসা বিষয়েও তার আগ্রহ ছিলো। এমনকি পিতার মতো চিকিৎসা ব্যবসা দিয়ে তিনি কার্যক্রম শুরু করেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি যে বহুমুখী বিদ্যার অধিকারী ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চিকিৎসা, ইউক্লিডও আল মাজেষ্টের ভাষ্য, দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা ও কবিতা বিষয়ে তিনি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তিনি গ্রীক ভাষাতেই সংশ্লিষ্ট লেখার সাথে পরিচিত হন। ইবনে নাদীমের মতে জাবির বিন হাইয়ান দু’হাজারের বেশী গ্রন্থ রচনা করেন। অতিশয়োক্তি মনে হলেও এতে আশ্চার্যের কিছু নেই। তার প্রাপ্ত গ্রন্থগুলোর অনেকগুলোর গড় পৃষ্টা ৮/১০ এর মতো এমনকি অনেকগুলোর পৃষ্টা মাত্র ২টি। জাবিরের গ্রন্থসমূহের বিষয় ও সংখ্যা মোটামুটি নিুরুপ ঃ
রসায়ন বিষয়ে রচনা -২৬৭টি ,কিতাবূত তাকদীর ধরনের গ্রন্থ -৩০০টি,দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ-৩০০টি,যুদ্ধাস্ত্র সম্বন্ধীয় গ্রন্থ -৩০০টি,চিকিৎসা সম্বন্ধীয় গ্রন্ত-৫০০টি,দার্শনিক যুক্তিখন্ডক বিষয়ক-৫০০টি,জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতি ও অন্যান্য- ৫টি।
রসায়ন বিষয়ক রচনা জাবির বিন হাইয়ানকে চির অমর করে রেখেছে (তিনি সর্বপ্রথম পার্ফিউম আবিষ্কার করেন)। এ বিষয়ে কয়েকটি শ্রেষ্ঠতম রচনা হলো ‘কিতাবুর রহমত; ‘কিতাবুত তাজমী’ এবং জিবাক্ উশ-শরকী। বিশ্বের বিভিন্ন মিউজিয়ামে রক্ষিত তার কিছু রসায়ন গ্রন্থের নাম হলোঃ কিতাবুর রহমত, কিতাবুর রাহা, কিতাবুর আবদাল। ইউরোপ,আমেরিকার দেশগুলিতে অতি উচ্চতর শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরকে তার কিতাবের পাঠ শেখানো হয়।
ইবনে আব্দুল মালিক আল কাছি ঃ
একটি মাত্র গ্রন্থ লিখে রসায়ন বিজ্ঞানে নিজের নাম যুক্ত করে নিয়েছেন একাদশ শতাব্দীর আবুল হাকিম মোহাম্মদ ইবনে আবদুল মালেক আল খারেজমী আল কাছি। তিনি বাগদাদে থাকতেন এবং ১০৩৪ খৃ. তার পৃষ্ঠপোষক আবুল হাসান ইবনে আবদুল্লাহর জন্য ‘আইওয়ানুস সানাহ’ ঊংংবহপব ড়ভ ঃযব অৎঃ ধহফ অরফ ড়ভ ড়িৎশবৎ' নামে এই গ্রন্থটি রচনা করেন। এর একটি অসমাপ্ত আরবী পান্ডুলিপী রামপুরের নওয়াব লাইব্রেরীতে পাওয়া যায়। ১৯০৫ সালে ডঃ স্টেপলটন এ পান্ডুলিপীটি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করেন। ১৯২৫ সালে তিনি হায়দ্রাবাদের নিজামিয়া লাইব্রেরীতে ফার্সীতে রচিত উক্ত গ্রন্থের একটি অনুবাদও পান। রসায়নে ‘আইনুস সানাহ’ গ্রন্থটি খুবই মূল্যবান সংযোজন। বড় ধরনের আলোচনা এখানে সম্ভব নয় শুধুমাত্র এর আলোচিত অধ্যায়গুলোর উল্লেখ করা হচ্ছে; গ্রন্থটি ৭ পরিচ্ছেদে বিভক্ত, প্রথম পরিচ্ছেদে তাদের গুণ এবং তাদের শ্রেণী ও রুহ নফস নিয়ে আলোচনা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তাদের গুণ এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে, তৃতীয় পরিচ্ছেদে কি পরিমাণ ও অনুপাতে জিনিস এতে ব্যবহার করতে হবে, চতুর্থ পরিচ্ছেদে যে সকল বস্তু সাদা এবং যে সকল জিনিস লাল এর উপযোগী তাদের মধ্যকার পার্থক্য পঞ্চম পরিচ্ছেদে-এতে যে সকল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় এবং এর জন্য যে সমস্ত যন্ত্রপাতির দরকার তার বর্ণনা, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে কোন জিনিস অপ্রাপ্তব্য হলে তার পরিবর্তে অন্য কোন জিনিস ব্যবহার করা যাবে কিনা সে সম্পর্কে এবং সপ্তম পরিচ্ছেদে যারা রসায়ন চর্চা করে লাভবান হয়েছে। রসায়নের প্রত্যেক প্রয়োজনীয় শাখার সরল ও সহজ পন্থা এতে সংক্ষিপ্ত ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক ইবনে সীনাও অনেকগুলো রসায়ন নিয়ে আলোকপাত করেছেন রসায়নকে প্রণালীবদ্ধ করায় তার সহযোগীতা স্মরনীয়। রামপুর লাইব্রেরীতে প্রাপ্ত ত্রয়োদশ শতাব্দীর রাসায়নিক সংগ্রহ গ্রন্থে ইবনে সীনার গ্রন্থ বলে একটি গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে। এতে অন্যান্য বিষয় ছাড়াও ১২ টি রাসায়নিক প্রক্রিয়া বিবরণ দেয়া হয়েছে।
১. এ বিজ্ঞানে ব্যবহৃত একটি প্রক্রিয়া (ঝড়ফরঁস ঐুফৎধঃব- এর সলিউশন),(২)গাদ্ আর রাগওয়াহ তৈরী প্রক্রিয়া (ঈধষপরঁস চড়ষুংঁষঢ়যরফব- এর সলিউশন),(৩)লাল এর জন্য পারদ ঘনীভূত (ঈড়ধমঁষধঃব করার প্রক্রিয়া),(৪)লাল তৈরী করতে যে ঘনীভূত পারদ ব্যবহৃত হয় তারই তাৎক্ষনিক চালানোর পন্থা।(৫)সোনা বা তামার ভস্মীভূতকরণ (ঈধষপরহধঃরড়হ),(৬)ভিটওল ও অন্যান্য লবণ দ্রবণ।(৭)গন্ধক থেকে আরক বের করা।(৮)দ্রবণ পদ্ধতি।(৯)আরক এর দক্ষতা সহকারে ব্যবহার। (১০)গাদের ব্যবহার বা শাসা গন্ধক তৈরী করার প্রক্রিয়া। (১১)ঘনীভূত করার (ঈড়ধমঁষধঃরড়হ) পদ্ধতি এবং (১২)কাজ কিভাবে সম্পন্ন হয় তার বর্ণনা ।
চলবে.....
বিষয়: বিবিধ
২০০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন