এসো হে বৈশাখ ! এসো এসো !!
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৩ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:১২:১০ রাত
ছোটবেলায় যেকোনো উৎস্যব আমার সাংঘাতিক ভাল লাগত। এটা স্বাভাবিক যে ছোটদের কাছে সকল উৎস্যবই অতি আনন্দের। তবে হালখাতা কোনো আনন্দ উৎস্যব কিনা তা বুঝতে না পারলেও আমি অতিরিক্ত খুশী হতাম হালখাতায়। আর এর কারণ ছিল খাওয়া দাওয়া সংক্রান্ত ব্যাপার সাপার।
বাকীতে পণ্যদ্রব্য কেনার একটা রীতি বাঙ্গালীদের মধ্যে সুদীর্ঘ সময় ধরে চলমান। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাকী উসুল করা হত আর সেসময় পাওনাদার আগতদের মিস্টিমুখ করাত। আমি অজও ভুলতে পারিনা মিস্টির রসে মাখা সেই লুচি,আলুর তরকারী,পানতোয়া,রসগোল্লা,সন্দেশ। পরবর্তীতে কখনও কখনও বিরিয়ানী অথবা সাদা ভাতের সাথে মাংস,কাবাব ইত্যাদী। কিন্তু হালখাতার কথা মনে হলে আমার মনে পড়ে লুচি-তরকারী,মিস্টি মিঠাইয়ের কথা। দোকানদাররা হালখাতার পূর্বরাত থেকেই ময়রাদের দিয়ে মিস্তি তৈরী করা শুরু করত। যতজন লোকের কাছে টাকা বাকী থাকত তাদের প্রায় দ্বিগুন লোক হালখাতায় উপস্থিত হত। আমি আর আমার ভাই যেতাম হালখাতায়,যদিও আমাদের কেউ লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলনা। আমার আব্বা পূর্বেই টাকা পরিশোধ করত কি করত না তা আমরা জানতাম না। আমাদেরকে বলে দেওয়া হত ওমুকের দোকানে হালখাতা । আমরা গেলে দোকানের মালিক আমাদেরকে খুব সমাদর করত। খানিক পরপর বড় বড় পাত্র ভর্তি মিস্টি নিয়ে একেরপর এক দিয়ে যেত। নিয়ম ছিল খেতে ইচ্ছা না করলেও ঠেসে ঠেসে খাওয়া। আমরা তা করতে কার্পন্য করতাম না। কেউ কেউ আবার আমাদের বাড়িতে হালখাতার খাবার পাঠিয়ে দিত। তখন আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না।
হালখাতা যে পহেলা বৈশাখ বা বৈশাখের অন্য তারিখে হত তা আমি জানতাম না । এটা বাংলা নববর্ষ সংক্রান্ত বিষয় কিনা তাও জানতাম না। আর পহেলা বৈশাখ যে একটি আনন্দ উৎসবের দিন তাও আমি জানতাম না। হালখাতার বিষয়টি আনন্দের হলে সেটা সকলের জন্যে নয়। আরও একটি ব্যাপার হল আমার জানা নেই যে- সেসময় ঢাকা শহরের কোথাও আজকের মত এমন আনন্দ উৎস্যব পালিত হত কিনা। পহেলা বৈশাখ বাংলা বছরের প্রথম দিন কিন্তু ইতিপূর্বে বঙ্গালীর আবালবৃদ্ধবনিতাকে এতটা আড়ম্বড়ের সাথে পালন করতে দেখা যায়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা পহেলা বৈশাখের কিছু রূপ দেখতে পাই। এই দিনে পুরুষেরা পাঞ্জাবী-পাজামা পরে। এবং সেসব পাঞ্জাবীর নকশায় ঢোল,একতারা,ঘুড়ি,তানপুরা,হাতি,ঘোড়ার ছবি থাকা বাধ্যতামূলক না হলেও এগুলি থাকে। পাঞ্জাবীর রং বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সাদা হয়। অপরদিকে নারীদেরকে শাড়ী পরতে হয়। শাড়ির রং সাদা,লাল বা শাড়িতে সাদার পরিমান বেশী। অন্য রঙের শাড়ীও পরা চলে, তবে শাড়ি পরা এক ধরনের অঘোষিত নিয়মের মধ্যে পড়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে তা আমার জানা নেই। আমি একবার এই শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলাম। সেসময় আমি আর আমার এক বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত এক গ্র“প থিয়েটারে ছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আড্ডাবাজি করা। অভিনয়ের প্রতি আমাদের কোনো মনোযোগ ছিলনা। সেসময় দেখেছি পাখি,ঘোড়া,হাতি,বাঘ,ভাল্লুক বা এদের মুখোশ পরে শোভাযাত্রায় অংশ নিতে হত(পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য এগুলোর সাথে দেব-দেবীর প্রতিকও ধারন করা হয়)। সামনে-পেছনে অনেকে ঢোল,বাশি বাজাতে বাজাতে নেচে নেচে অগ্রসর হত। সেবার দেখেছিলাম বিশাল একটা সাপ তৈরী করে তার মাথাটা বানানো হয়েছিল জিন্না টুপি ও দাড়ীওয়ালা একজনের। এটা ছিল রাজাকারের প্রতিরূপ । আমরা যখন চারুকলার সামনে ছিলাম তখন টেলিভিশনের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীও ছিল। সেসময় উলুধ্বনী করেও আনন্দ প্রকাশ করা হচ্ছিল। আমরা নানানভাবে নেচে গেয়ে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস ও বাইরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করলাম।
এ মঙ্গল শোভাযাত্রার অর্থ হচ্ছে-বছরের প্রথম দিনকে বরণ করা যাতে পুরো বছর মঙ্গলের সাথে কাটে,সকল অমঙ্গল দূর হয়(অনেকে অবশ্য কোনো কিছু মনে না করেই নাচানাচি করে আনন্দ উপভোগ করে,তার আচরণ তাকে কোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী করে সেটা তার বিবেচ্য বিষয় নয় বরং হেডোনিজমের মত সুখের পরিমানগত দিকটিই মূল ব্যাপার)।
এমন শোভাযাত্রার সাথে মঙ্গলের সম্পর্ক আছে কিনা সেটা ভেবে দেখার দরকার। বাঘ,ভাল্লুক,ঘোড়া,দৈত্য,দানব মঙ্গলের প্রতিক কিনা তা বিশ্বাসের ব্যাপার। তবে এ বিশ্বাস বাঙ্গালীর নামে মুসলিমের ওপর চাপানো ঠিক হবেনা,যদিও মুসলিমও বাঙ্গালী। কারণ এটি নির্ভেজাল হিন্দুদের ধৈর্মীয় বিশ্বাস। কোনো প্রদীপ প্রজ্জলিত করাকে মঙ্গলের প্রতিক মনে করা সু-স্পষ্ট শিরক,কোনো আনন্দ যাত্রাকে মঙ্গলময় মনে করা শিরক, কোনো প্রতিককে মঙ্গল বা কল্যানের আধার বা মাধ্যম মনে করা সু-স্পষ্ট শিরক।
ইতিহাস থেকে জানা যায় আর্যযুগে ভারতের নারীরা কোমরের ওপরের অংশে কাপড় পরিধান করত না। অষ্টম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন কাশিম যখন সিন্ধু বিজয় করেন এবং ভারতের কিছু অংশ বিজয় করেন তখনও এখানকার উচ্চ পদস্ত পরিবারের নারী ছাড়া বাকীরা একই পোষাক পরিধান করত। তারা শরীরের ওপরের অংশ ঢেকে রাখাকে সৌন্দর্য্যহানীকর মনে করত। এ অংশে ইসলাম প্রচারিত হবার পর নারীরা লম্বা পোষাকে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে শুরু করে। সেসময়ে মুসলিম নারীদেরকে তাচ্ছিল্য করে মুসলিম বলা হত-অর্থাৎ তারা এমন এক ধর্মের লোক যারা শরীর ঢেকে রাখে। হিন্দু ধর্মের বয়স পাচ হাজার বছরেরও অধিক। সুদীর্ঘ সময় পর্যন্ত তারা সাং®কৃতি চর্চা করার পর হঠাৎ ইসলামের আগমনে পুরোপুরি তারা পেছনের আচার আচরণ পরিত্যাগ করতে পারেনি। আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা বুঝতে পারেনি তারা কোন সাং®কৃতি পালন করছে। এ অংশের লোকেরা বরাবরই শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে ছিল।
মাত্র এক দশক আগেও বাংলাদেশে আজকের মত এভাবে পহেলা বৈশাখ দেশজুড়ে পালিত হতনা,হালখাতার ওই ব্যাপারটি ছাড়া। বর্তমানকালে আমাদের আবেগ অনুভূতিগুলো দীবস নির্ভর হয়ে পড়েছে। এর পেছনে আমি যে কারণ দেখী সেটি হল,পূর্বে আজকের মত ব্যপক শহরায়ন হয়নি। শহরেও অনেকটা গ্রামের অনুষঙ্গ থাকত। শহর নামপ খুপরীর মদ্যে তারা বসবাস করত না। সেখানে মানুষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত এবং নানাভাবে বিনোদনের সুযোগ পেত। খেলাধুলার মাধ্যমে তারা শরীর চর্চার সুযোগ পেত। যৌথ পরিবারের কারনে একই পরিবারের মধ্যে বিনোদন বা পারষ্পরিক সাহায্য সহযোগীতার পরিমান বেশী ছিল। প্রাইভেসীর বিষয়টা এতটা প্রকট না হওয়ার কারনে একজন আরেকজনের বিষয়,ঘটনার সাথে জড়িত ছিল। উম্মুক্ত বিচরনের কারনে একে অপরের সাথে সহজে মেলামেশা,মনের ভাব ব্যক্ত করার সুযোগ পেত। বেশীরভাগ মানুষ কৃষির সাথে যুক্ত থাকায় কৃষি সংক্রান্ত সামাজিক উৎসবে জড়িত ছিল। অর্থের প্রাচুর্য না থাকলেও জীবিকার এমন টানাপোড়েন ছিলনা। মানুষের অখন্ড অবসর ছিল। ফলে তারা তাদের জীবনে যথেষ্ট বিনোদন পেত। কিন্তু ব্যপক শহরায়ন শুরু হওয়াতে,জীবন-জীবিকার নানামুখী টানাপোড়েনে মানুষের রসবোধ কমতে শুরু করল। অবসর সময়ের পরিমান কমে গেল। প্রযুক্তির কারনে অনেক কিছু সহজসাধ্য হওয়াতে অপরের সহযোগীতার প্রয়োজনীয়তার পরিমান কমে আসল এবং মানুষ অনেকটা এককেন্দ্রীক হতে শুরু করল। বিনোদনের অধুনিক সরঞ্জামাদী আবিষ্কারের কারনে মানুষ ব্যক্তির চাইতে যন্ত্রের প্রতি বেশী আস্থাশীল হতে শুরু করল। একটি যন্ত্র একজন মানুষকে একাধীক মানুষের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মিটিয়ে দিতে থাকল। যন্ত্রের অপ্রয়োজনীয় বা মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হতে শুরু করল। কিন্তু মানুষ একটি সামাজিক জীব হওয়ায় শিঘ্রই এই প্রতিযোগীতাপূর্ণ,উৎকন্ঠিত,অতি যান্ত্রিক জীবন তাকে একাকিত্বের কঠিন দেওয়ালে আবদ্ধ করল। এখান থেকে বের হওয়া তার জন্যে জরুরী হয়ে দেখা দিল এবং তারই উপায় হিসেবে তার জন্যে বেশী বেশী উপলক্ষ্য বা দীবস আবিষ্কার ও তার ব্যবহার অবশম্ভাবী হয়ে উঠল। কারণ বিনোদন উপভোগে তারই মত ব্যস্ত অন্য মানুষদেরকে তার নিজের ইচ্ছামত একত্রিত করা অনেকটা দুস্বাধ্য ব্যাপার। এজন্যে জীবনের বা সমাজের আনাচে কানাচে যত দীবস ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবহেলায় অবস্থান করছিল,তাদেরকে নবরূপে তুলে আনা জরুরী হয়ে উঠল। এভাবে যদি এখানকার মানুষেরা আরও বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়ে বা আরও বেশী আত্মকেন্দ্রীক হয়ে পড়ে তাহলে তারা পাশ্চাত্যের মা,বাবা দীবসের মত পিতা-মাতাকে শুভেচ্ছা জানানোর দিনের মত ভাই,বোন,চাচা-চাচী,মামা-মামী,নানা-নানী দীবস চালু করবে। এভাবে ব্যস্ত মানুষেরা জীবনকে উপভোগ করবে কিছু দীবসের মধ্যে। যেহেতু জীবনের স্বাভাবিকতা উপভোগ্য নয় তাই নব নব দীবসের আমদানীতে জীবনকে সমৃদ্ধ করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।
প্রযুক্তির কল্যানে বিশ্বের বিভিন্ন সাং®কৃতির সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে। এছাড়া পাশ্চাত্য সাং®কৃতি আমদানীতে শুল্প-কর না থাকায় বরং উৎসাহ মূল্য ঘোষিত হওয়ায় সেটির প্রাচুর্য্য অত্যধিক। তাই সকল ধরনের দীবসের সারবস্তু এখন মোটামুটি একই ধরনের। পূর্বে নবান্যের উৎসবে ফসল তুলে পিঠা-পায়েস খেয়ে,মানুষকে খাইয়ে তা পালন করা হত। নতুন বছরে নতুন হিসাব নিকাশের খাতা তৈরী করে পুরোনো ক্রেতার পাওনা নিয়ে তাকে নবায়ন করা হত। মিস্টি মিঠাই উৎস্যব চলত। পুত্রের খৎনা অনুষ্ঠানে লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়ানো হত কিন্তু এখনকার সকল উৎসবের চরিত্র একই রকম। যে দীবসই হোক না কেন,এখানে নারী আর পুরুষকে সেজে গুঁজে পরষ্পরের কাছাকাছি এসে জড়াজড়ির পরিবেশ তৈরী করতে হবে। বাদ্য বাজনা বাজবে এবং সুর মিলিয়ে নাচতে হবে। নারী পুরুষের পারষ্পরিক আকর্ষণকে উসকে দিয়ে মজা করাটাই আজকের দিনের উৎসবের মূল লক্ষ্য হয়ে দাড়িয়েছে। ভাল মন্দের ভিত্তি হয়েছে নিজেদের মনোবৃত্তি।
এবার শুভ নববর্ষকে সারা বছর শুভ করা এবং সকল অশুভ-অপশক্তিকে দূর করার দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রতিবারের মত মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। বাঘ,ভাল্লুক,ঘোড়া,গাধা,জিরাফ,পাখি ছাড়াও একটি কিম্ভুত কিমাকার প্রাণী তৈরী করা হয়েছে। এ প্রাণীটি সম্পর্কে চারুকলার সম্মানিত অধ্যাপক টেলিভিশনে বলছিলেন-“এটি হল মানবতার শত্র“র প্রতিক,এটির মত প্রাণী বাস্তবে পৃথিবীতে নেই অর্থাৎ এটি স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট নয়। তারমানে হল যারা মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে তারাও স্রষ্টা কতৃক সৃষ্ট নয়।” তার কথা শুনে মনে হল মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু অরাজনৈতিক আনন্দ প্রকাশ করতে যাচ্ছে না। অবশ্য বাংলা নববর্ষকে রাজনৈতিক মনে করা হয়না।
নতুন বছরে বাংলার মানুষেরা সকল পাপ,তাপকে পরিত্যাগ করে নব-উদ্দমে সামনে এগিয়ে যাক। সততা,উচ্ছলতায় নি®কণ্ঠক হোক পথচলা। মন্দ বিতাড়িত হোক। সত্য প্রতিষ্ঠিত হোক। কল্যাণ হোক সকলের।
পুনশ্চঃ সম্রাট আকবর জনতার কাছথেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্তে কৃষকের ফসল ওঠার সময়কে নির্ধারণ করেন। এটিই ছিল ১লা বৈশাখ। এদিনকে তিনি বাংলা সনের প্রথম দিন হিসেবে নির্ধারণ করেন। অতএব ১লা বৈশাখকে বাঙ্গালীর শোক দীবস হিসেবে পালন করা উচিৎ।
বিষয়: বিবিধ
১৩৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন