ন্যায়বিচার ও বন্দীমুক্তি
লিখেছেন লিখেছেন সাইফুল ঈদগাহ কক্স ২৫ নভেম্বর, ২০১৫, ০৬:২৭:২০ সন্ধ্যা
যে কোন সময় যে কোন ক্ষেত্রে যে কোন সমস্যা হতেই পারে। তবে তার সমাধানও আছে। সমাধান আছে পরামর্শের মধ্যে এবং তার প্রয়োগ হবে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে। কিন্তু আমি যদি কারো সাথে কোন কথাই বলতে না পারি, তবে পরামর্শ করব কীভাবে এবং সমাধানও পাব কোথায়? সব সমস্যার সমাধান সবসময় যে আমার মাথার মধ্যে জমা হয়ে থাকবে, এমন কোন কথা নেই। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বিচার-বুদ্ধি থাকে। সবাইকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র নিজের বিচার-বুদ্ধির উপর নির্ভর করাটা মস্তবড় বোকামী। সব উকিল-ব্যারিস্টার বাদী-বিবাদীর পক্ষে থাকলে, বিচারকের পক্ষে থাকবে কে? কার সাথে বিচারক পরামর্শ করবেন? পরামর্শই যদি করতে না পারেন তবে বিচারক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন কীভাবে? এতে যদি বিচারক সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন তবে এর জন্য দায়ী কে? এভাবেই মামলার পর মামলা জমা হয়ে পাহাড়-পর্বতের আকার ধারণ করছে বিচারালয়ে। মানুষ হন্যে হয়ে ঘোরে বেড়াচ্ছে ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু ন্যায়বিচার পাবে কোথায়? বিচারক তো ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। যারা ছিলেন তারা ঠিকভাবে স্বাক্ষী দিতে আসে না। যারা তদন্ত করতে যায় তারা ঠিকভাবে রিপোর্ট দেন না। আবার অপরাধীকে বাচানোর জন্য বিচারকের চেয়েও বুদ্ধিমান উকিল-ব্যারিস্টারগণ হাজারো বুদ্ধি বের করেন। এমতাবস্থায় সময় পেছানো ছাড়া বিচারকের অন্য কোন উপায় থাকে না। পক্ষান্তরে তিনি নিজ বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী বিচার করতে পারেন না। বিচারকের বিবেক-বুদ্ধি আইনের হাতে বন্দী। তিনি যদি নিজ পিতাকেও হত্যা করতে কাউকে স্বচক্ষে দেখেন, তার পরও যথেষ্ট স্বাক্ষি-প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলে নিজ কলমেই খুনিকে বেকসুর খালাস দিতে তিনি আইনত বাধ্য। আবার অনেকেই যে বিনাবিচারে কারাগারে জীবন ফেলে দিচ্ছে তার হিসাব কে রাখে? ফলে অনেক নিরীহ লোক কারাগারে ঢুকে দুঃসাহসী হয়ে বের হয়, যাদের কারাভয় আর থাকে না। অবশ্য কারাভয় থাকা উচিতও না। কারণ কারাভোগ করা নবীগণের সুন্নাত। কারাগারে থাকা-খাওয়া বাবৎ ফি সিস্টেম চালু করলে এর মানও উন্নত হবে, দুর্নীতিও কমবে, শাস্তিও পরিপূর্ণ হবে, সরকার দেয়ার বদলে উল্টা নিতে পারবে।
আসলে আমাদের আইন বিচারপতিদের উপর আস্থাশীল নয়। ফলে সাধারণ জনগণের আস্থাও আইন-আদালতের উপর তেমন নেই। তদোপরী যথেষ্ট পরিমান বিচারকও নেই, বিচারালয়ও নেই, বিচারকদের পর্যাপ্ত স্বাধীনতাও নেই, নিরাপত্তাও নেই, সুযোগ-সুবিধাও নেই। বিচারকগণের ইনকামসোর্স সীমাবদ্ধ। এ সব সমস্যা থেকে মুক্তি চাইলে বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে প্রত্যক্ষদর্শীদের উপস্থিতিতে বিচার করলে রায় এক রকম হয়। আবার একই ঘটনার বিচার ভিন্ন সময়ে ভিন্ন স্থানে ভিন্ন পরিবেশে করলে রায় অন্য রকম হয়। বর্তমান আদালতে বিচার শুরু হতে হতেই আহত লোক সুস্থ হয়ে যায়, নিহত লোক পঁচেগলে শেষ হয়ে যায়। স্বাক্ষী হারিয়ে যায়। মামলার আলামত নষ্ট হয়ে যায়। বাদী ফতুর হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট স্বাক্ষী-প্রমাণের অভাবে মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে আসামীরা বেকসুর খালাস পায়। কিন্তু বিনা বিচারে যে যত দিন আটকে থাকল তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
সাধারণত মানুষ ধর্মকেন্দ্রে মিথ্যা বলতে ভয় পায়। তাই বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তির জন্য ধর্মকেন্দ্রকে বেছে নিলে কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। ধর্মকেন্দ্রে সকলের উপস্থিতিতে বিচার হলে স্বাক্ষী-প্রমাণেরও অভাব হবে না। সময়ও নষ্ট হবে না। অর্থও নষ্ট হবে না। সমাজের জ্ঞানীগুণী-বিবেকবান সবাইকে নিয়ে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বিচার হতে পারে। তবে সেখানে যাতে বিচারের নামে অবিচার হতে না পারে তার জন্য উপযুক্ত আইন থাকতে হবে। সর্বোচ্চ কী শাস্তি দেয়া যাবে বা কতটাকা জরিমানা করা যাবে তাও নির্ধারিত থাকবে। তবে যে কোন বিচার প্রথমে বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তিতে যাওয়া বাধ্যতামূলক করতেই হবে। সেখান থেকেই যাবে কোর্টে সেখানকার মূল্যায়ণ রিপোর্টসহ। এর ফলে কোর্টের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারগণ বিচার করতে পারলে তাদের চেয়েও জ্ঞানী-গুণী লোক সমাজে থাকতে পারে, তারা সবাই মিলে কেন বিচার করতে পারবে না। এ রকম স্থানীয় বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তিকারকদের উপর যাদের আস্থার ঘাটতি থাকবে, তাদের উপর জনগণের আস্থার ঘাটতি তার চেয়েও বহুগুণ বেশি থাকতে পারে। এক গবেষণায় প্রকাশ, নতুন মামলা যোগ না হলেও বর্তমান মামলাগুলো সমাধান করতেই আরো ৮৫ বছর লাগবে। তবে আর দেরি কেন? আজই বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তিকে ‘ফাস্ট কোর্ট’ ঘোষণা করি।
আদালতে যত মামলা তার অধিকাংশই জমি সংক্রান্ত। জমি সংক্রান্ত যত মামলা তার অধিকাংশই যথাসময়ে যথাযথ উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টন না করার ফলে। তাই “যে কারো মৃত্যুর পর সর্বোচ্চ ৪০ দিনের মধ্যে তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বা হিসাবপূর্বক তার শেয়ার উত্তরাধীকারীদের মধ্যে বণ্টন বাধ্যতামূল” করে আইন পাশ করা দরকার। তা হলে একদিকে এতীম ও নারীগণ নিজেদের অধিকার দ্রুত বুঝে পাবে, অন্যদিকে মামলাজটও ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। জমি সংক্রান্ত পারিবারিক ও আইনী ঝামেলা সুরাহা করে জমির যথাযথ উন্নয়নের জন্য পিপিপি সিষ্টেমে বেসরকারী ডেভলাপার কোম্পানীগুলোকে জাতীয় বা এলাকা ভিত্তিক দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। এতে ঐ কোম্পানী ৩য় পক্ষ বা শালিসের ভূমিকা পালন করতে পারবে। ফলে আদালতের চাপ কমে যাবে অকল্পনীয় হারে, যদি দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানী সৎ ও আন্তরিক হয়। এ ব্যাপারে “ল্যান্ড সলিউশন বাংলাদেশ” অত্যন্ত আন্তরিক।
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে কারাগারের নিয়ন্ত্রণ পরিপূর্ণভাবে বিচার বিভাগের কর্তৃত্বে ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ কারাগারে ঢুকাতেও বিচারকের অনুমতি লাগবে, বের করতেও তাই। বর্তমানে বের হতে লাগলেও ঢুকাতে বিচারকের অনুমতি লাগে না। ফলে যখন যাকে ইচ্ছা কারাগারে ঢুকিয়ে ফেলে রাখা হয় এবং রায় হওয়ার পূর্বের সময়গুলো হিসাবের মধ্যেই আসে না। এ অন্যায়কে হাজতী ও কয়েদী নামে ভাগ করে বৈধ করে দেয়া হয়। কিন্তু কারাগার বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আসলে ঢুকানোর সময়েই বিচারের প্রথমপর্ব হয়ে যাবে “কেন তাকে ঢুকাতে হবে” এ প্রশ্নের উত্তরে। তখন আসামীর কথাও শুনে বিবেচনা করে ঢুকানোর অনুমতি দেয়া হবে। কারাগারকে শোধনাগারে রূপান্তর করতে হবে। এ জন্য প্রত্যেক কারাগারে বড় বড় কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণ করে সেখানে সবাইকে একত্রে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার ও কুরআন-হাদীস শুনার সুযোগ করে দিতে হবে। ধর্ম ছাড়া চরিত্র সংশোধনের অন্য কোন ঔষধ নেই। কারা টু কারা চিন্নার ব্যবস্থা করলে আরো ভাল হয়। নিরীহ দরিদ্র কারাবন্দীদের মুক্তির জন্য প্রয়োজনে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে এবং সেটাই উত্তম। জাকাতের নির্ধারিত ৮টি ব্যয়খাতের মধ্যে রিকাব অর্থ বর্তমানে বন্দী বুঝাবে।
পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সর্বপ্রথম অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য জাকাত ব্যাংক অত্যন্ত সহায়ক শক্তি হবে দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকারত্ব নির্মুলে এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলে। জাকাত ব্যাংক-এর আয় ও ব্যয়খাত যথাক্রমে নিুরুপ।
আয়ের খাতসমূহ
জাকাত, অস্থাবর সম্পদের বার্ষিক ২.৫%
উশর, ভূমি উৎপাদনের ১০% বা ৫%
ফিৎরা, শরীরপ্রতি বার্ষিক ৩দিনের খাবার
কুরবানী, প্রাণপ্রতি বার্ষিক প্রাণ উৎসর্গ
খুমুছ, যাবতীয় খনিজ সম্পদের ২০%
ফাই, বিনাযুদ্ধে অর্জিত শত্র“ সম্পদ
লুকতা, বেওয়ারিশ ব্যক্তিগত সম্পদ
কাফ্ফারা, ধর্মীয় অপরাধের অর্থদন্ড
গনিমত, যুদ্ধলব্দ সম্পদের ২০%।
ব্যয়ের খাতসমূহ
ফকীর, যার কিছুই নেই (এ দেশী পরিভাষায়)
মিসকিন, যার যথেষ্ট পরিমানে নেই
আমেল, জাকাতকর্মী বা সমাজকর্মী
মুয়াল্লাফাতে কুলূব, মুসলিম বন্ধু-নও মুসলিম
রিকাব, গোলামীমুক্তি-বন্দীমুক্তি
গারেম, অসহায় ঋণগ্রস্থ, প্রকৃত দেউলিয়া
ফি সাবিলিল্লাহ, আল্লাহর পথে, যেটা যতবেশি
ইবনে সাবিল, নিঃস্ব পথিক-মুসাফির-পর্যটক।
মুসলিম ধনীর সম্পদে মুসলিম দরিদ্র পুনর্বাসন।
যে দেশে সর্বপ্রথম জাকাত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করবে সে দেশই হবে গোটা বিশ্বের জাকাতের কেন্দ্রবিন্দু এবং আগামী দিনে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বদাতা।
-----চলবে।
বিষয়: বিবিধ
৯৪৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন