বাসস্থান ও জমি
লিখেছেন লিখেছেন সাইফুল ঈদগাহ কক্স ২৪ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:৩১:২৪ বিকাল
বাসস্থান থেকে কবরস্থান সবখানে জমি দরকার। কিন্তু সে জমি একান্ত নিজের হতে হবে, এমন কোন কথা নেই এবং কোন জমিকে একান্ত নিজের করা সম্ভবও নয়। কারন আজকে যেটাকে নিজের বলে দাবী করছি, সেটাই কালকে অন্যের হয়ে যেতে পারে। অথচ এ জমি ও বাড়ীর জন্যই অধিকাংশ মামলা-মোকদ্দমা এবং সিংহভাগ দুর্নীতি। একটু চেষ্টা করলেই এ বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত হতে পারি অতি সহজেই।
সাধারণত মানুষ জমি ক্রয় করে ব্যবহার করার জন্য এবং বিক্রয় করে অর্থের জন্য। এতে সরকার ভাগ বসিয়ে ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়। ক্রয় না করেই যদি ব্যবহার করা যায়, বিক্রয় না করেই যদি অর্থ পাওয়া যায়, ব্যয় বাড়িয়ে না দিয়েই যদি ট্যাক্স পাওয়া যায়, তবে তাই করা উচিত নয় কি? এ জন্য একটু সমন্বয় করতে হবে শুধু।
জমিদার জমি দিয়ে, পুঁজিদার পুঁজি দিয়ে এবং শ্রমদার শ্রম দিয়ে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করলে ক্রয়-বিক্রয়ের দরকার নেই। জমি বিক্রয়ে জমিদার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কারন সাময়িক উপকার পেলেও স্থায়ী উপকার থেকে তিনি ও তার উত্তরাধীকারীগণ বঞ্চিত হন। জমি ক্রয়ে পুঁজিদার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কারন কাজ শুরু করার আগেই জমির পেছনে অনেক পুঁজি চলে যাওয়ার ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। আবার একদিকে সহজে কেউ জমি হাতছাড়া করতে চায় না, অপর দিকে কেউ সহজে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করে বড় ঝুঁকি নিতে চায় না। ফলে আশানুরূপ উন্নয়নও হয় না, বিনিয়োগও হয় না। তাই সরকারও কাক্সিক্ষত পরিমান ট্যাক্স ও ট্যাক্সদাতা পায় না। এমতাবস্থায় উক্ত ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
আপনার জমি আছে, জমি বিনিয়োগ করুন। আপনার জমিতে যা কিছু হবে তার কত অংশ আপনি চান বলুন। প্রথমেই যদি আপনার নগদ কিছু দরকার হয় তবে পরবর্তীতে আপনি কম পাবেন এবং প্রকল্প খরচও বেড়ে যাবে। ফলে আপনার জমি ও বাসাবাড়ীর চাহিদা কমে যাবে। আপনার পুঁজি আছে, জমি দরকার। আপনার কোন্ জমিটা পছন্দ তার মালিকের সাথে কথা বলুন। আপনি কী করতে চান এবং তাকে কী বা কত শতাংশ দিতে চান আলোচনা করুন। উভয়ে একমত হলে চুক্তি করেই কাজ শুরু করুন। আপনার জমিও নেই, পুঁজিও নেই। কিন্তু আপনার দুটুই দরকার। আপনি প্রথমে জমিদার ও পুঁজিদারের সাথে পৃথকভাবে কথা বলুন। অতঃপর নির্মাণের দায়িত্ব আপনি নিজে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করুন। কে কী দেবেন ও কী পাবেন তা স্পষ্ট উল্লেখ করুন। যাবতীয় উন্নয়ন ও উৎপাদনের এক দশমাংশ ১০% স্রষ্টার উদ্দেশ্যে সমাজসেবার জন্য রেখে অবশিষ্ট নয় দশমাংশ ৯০% তিন জনে ভাগ করুন।
যথাসম্ভব নতুনভাবে কৃষি জমি ভরাট না করে ভরাটকৃত জমিগুলোই পরিকল্পিত উন্নয়ন করা দরকার। কৃষিজমির উন্নয়ন হতে হবে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে। প্রত্যেক বাড়ীঘর হতে হবে উর্ধমূখী। যে জমিতে সর্বোচ্চ যত তলা নির্মাণ করা সম্ভব তত তলার ফাউন্ডেশন দেয়া হয়েছে কিনা তাই নিশ্চিত করা জরুরী। “বেশি কেন” এ প্রশ্ন না করে “কম কেন” এ প্রশ্নই করতে হবে নির্মাণকারীকে। কোন জমি মামলার কারণে উন্নয়ন বঞ্চিত হয়ে পরিত্যক্ত থাকবে কেন? মামলাও চলুক, উন্নয়নও চলুক। যিনি যখন রায় পাবেন তিনিই মালিকের জন্য নির্ধারিত অংশ পাবেন। উন্নয়নে বাধা সৃষ্টিকারী এমন কোন কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন নেই। সহযোগিতাকারী কর্তৃপক্ষই প্রয়োজন। কারা কিভাবে বাধা সৃষ্টি করে তাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী। মানুষ কেন কর্তৃপক্ষের পেছনে দৌড়বে? বরং কর্তৃপক্ষই মানুষের পেছনে দৌড়বে উন্নয়নে রাজি করার জন্য। প্রত্যেক অফিস ও অফিসারের ব্যাপারে সেবা গ্রাহকদের পছন্দ-পছন্দ সিস্টেম চালু করা উচিত। যার পক্ষে যত লাইক পড়বে তাকে তত বেশি পুরস্কার দেয়া হোক এবং যার বিপক্ষে যত আনলাইক পড়বে তাকে তত শাস্তি দেয়া হোক। কারন বর্তমানে উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাড়িয়ে আছে কোন কোন সরকারী অফিস বা অফিসার বা নীতি। তা চিহ্নিত হওয়া উচিত।
আজকের উন্নত বিশ্ব উন্নত হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমেই। এর প্রথম ধাপ হচ্ছে রাস্তা এবং শেষ ধাপ হচ্ছে বাড়ী। সর্বত্র পরিকল্পিত নগরায়ন অত্যাবশ্যক। শুধু ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি উন্নয়ন করাই যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয় ইত্যাদি সব ধরনের জমিই উন্নয়ন করতে হবে। এ জন্য পাবলিক প্রাইভেট পাটনার্শিপ বা পিপিপি সিস্টেমই সর্বাধিক উপযুক্ত। সরকার সহযোগিতা করলে এ লক্ষ্যে অনেক ডেভলপার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে জাতীয় বা এলাকা বা শ্রেণি ভিত্তিক। যেমন, প্রধানত ওয়াকফ জমি ডেভলাপের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ল্যান্ড সলিউশন বাংলাদেশ। ওয়াকফ জমি হস্তান্তর করা না গেলেও উন্নয়ন করে দীর্ঘমেয়াদে ভাড়া দেয়া যাবে। কারন তা ফেলে রাখার জন্য নয়, বরং উন্নয়ন করে জনস্বার্থে ব্যবহার করার জন্যেই ওয়াকফ করা হয়। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে রক্ষকরাই ওয়াকফসম্পদ উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা। নিজেরাও করে না, অন্যদেরকেও করার সুযোগ দিতে চান না।
প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন যদি হয় দ্বিমুখী, তবে প্রতিষ্ঠান স্বনির্ভর হতে পারে অতি অল্প সময়েই। একমুখ হবে একাডেমিক তথা ক্লাশরুম ও ছাত্রাবাস। অন্যমুখ হবে বাণিজ্যিক তথা দোকান, অফিস ও ভাড়া বাসা। প্রতিটি ভবনে থাকবে ডবল সিড়ি, যা দিয়ে উঠে ডানে-বামে দু’দিকের ক্লাশরুম বা বাসায় প্রবেশ করতে পারবে। প্রত্যেকটি ভবন হবে স্বতন্ত্র এবং সর্বনিু ৫ থেকে ৭ তলা বিশিষ্ট। একই পরিমান জমি, পিলার ও ব্যয়ে নির্মিত হবে বারান্দার বদলে দ্বিমুখী ভবন।
মাঠ-পার্ক বা পুকুর-লেক মাঝখানে রেখে চতুর্দিকে গোলাকার করে দ্বিমুখী ভবনসমূহ নির্মান করলে বাউন্ডারী ওয়ালের পরিবর্তে হবে রাস্তা। ছাদ থাকবে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত বাগানস্পেস। উত্তর-দক্ষিণ মূখী পূর্ব-পশ্চিম লম্বা ভবন হলে ভাল হয়, যাতে সকাল-বিকাল সূর্যের আলো প্রাপ্তিতে সমস্যা না হয়। তবে যে কোন ভবন জমির অবস্থা ও অবস্থানের আলোকেই উন্নয়ন করতে হবে। বাড়ীর শ্রেণীবিভাগ হতে পারে যথা, পরিকল্পিত নগরীতে পরিকল্পিত বাড়ী ১ম। পরিকল্পিত নগরীতে অপরিকল্পিত বাড়ী ২য়। কারন বাড়ী পুননির্মানযোগ্য। অপরিকল্পিত নগরীতে পরিকল্পিত বাড়ী ৩য়। কারন নগরী পুননির্মানযোগ্য নয়। অপরিকল্পিত নগরীতে অপরিকল্পিত বাড়ী ৪র্থ। নগরী পরিকল্পিত করতে হলে সবার আগে দরকার পরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট। পরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট করতে হলে খননমুক্ত পানি, গ্যাস, ক্যাবল ও নালা-নর্দমার স্থায়ী রাস্তা নিচে রেখে, উপরে মানুষ, সাইকেল, প্রাইভেট ও পাবলিক গাড়ির অংশ নির্ধাারণ ও নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পিত বাড়ী করতে হলে সবার আগে দরকার পরিকল্পিত ভিত্তি। পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে না পারলে তা হয় কল্পনাবিলাস মাত্র।
জমির আসল উন্নয়ন হচ্ছে কৃষি উন্নয়ন। কারন “খাদ্যহীন প্রাণ” ও “জমিহীন খাদ্য” দুটুই অকল্পনীয়। তাই বাড়ীঘর করতে হবে যথাসম্ভব ভরাট ও পাহাড়ী স্থানে। যে সকল পাহাড়ে ঘরবাড়ী নেই সেখানে সাধারণত গাছপালাও রক্ষা করা যায় না। প্রতিবছর নিচু জমিতে বন্যাক্রান্ত হওয়ার বিকল্প স্থান খুঁজতে হবে। নদী ভাঙ্গনকবলিত লোকজনকে দ্রুত সময়ে চরাঞ্চল ও পাহাড়ী এলাকায় জমি বরাদ্দ দিয়ে জমির আবাদী নিশ্চিত করতে হবে। জমি সংক্রান্ত যাবতীয় আইনী ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সমূলে বিনাস করা ছাড়া কোন উপায় নেই। একদিকে মানুষ বাস্তুহারা থাকবে, অন্যদিকে জমি অনাবাদী রয়ে যাবে, তা হতেই পারে না। জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি নতুন নতুন চরও জাগছে। এসব স্রষ্টার দান।
জমির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে “আইল”। উত্তরাধিকারসহ যত বন্টন বাড়ছে, তার জ্যামিতিক হারে জমির আইল বাড়ছে। হয়ত এমন এক সময় আসবে, যখন নতুন আইল দেয়ার জন্যও জমি খুজে পাওয়া যাবে না। অথচ এ সমস্যার সমাধান অতি সহজেই করা যায়। একটি গাড়ী বা একটি দোকান থাকলে সেটাকে কিন্তু উত্তরাধিকারীরা মাঝখানে ভাগ না করে তার শেয়ার ভাগ করে। জমির ক্ষেত্রেও তাই করতে পারে। কারো মৃত্যুর সাথে সাথে তার যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের শেয়ারনামা বন্টন করে দেয়া যায়। বিক্রি করলে শেয়ার বিক্রি করবে। এ ক্ষেত্রে সকল উত্তরাধীকারীর পক্ষে সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে একটি পারিবারিক কোম্পানী গঠন করা যায়, যা মৃতের নামেও হতে পারে। সহমত পোষণকারী সকল উত্তরাধিকারী পারিবারিক কোম্পানীর গর্বিত ডিরেক্টর থাকবে। ফলে জমিতে আইলও বাড়াতে হবে না, অন্যসব ভাগ করে গুরুত্বও কমাতে হবে না। তবে যা একান্ত ভাগযোগ্য ও প্রয়োজন তা ভাগ করতে কোন অসুবিধা নেই। পৃথিবীতে এরকম অনেক পারিবারিক বিখ্যাত কোম্পানী রয়েছে। এতে পারিবারিক কর্মসংস্থান, সম্পদ, ক্ষমতা, সম্মান, সুনাম ইত্যাদি সবই বৃদ্ধি পায়। এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে “একেজে গ্র“ফ অব কোম্পানীজ”।
আগে থেকেই সমতল, পাহাড়, চর সর্বত্র পরিকল্পিত প্লট তৈরী করে রেখে আগ্রহীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে বরাদ্দ দিতে হবে। কারন যার যখন যা প্রয়োজন হয় তখন তা কোন না কোন ভাবে ব্যবস্থা করে নেয়। আর একবার যে কোন ভাবে কোন কিছু হয়ে যাওয়ার পর তা পরিবর্তন করা অনেক কষ্টকর, বিরক্তিকর ও ক্ষতিকর। বুনা সহজ, টুনা কঠিন। যেখানে প্লট দেয়া সম্ভব নয় সেখানে আগে থেকেই ফ্লাট তৈরী করে রাখতে হবে। বিয়ের কাবিননামা রেজিষ্ট্রির সাথেই স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে ফ্লাট বরাদ্দও রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়া উচিত এবং একটি ফ্লাটের অর্ধেক মালিকানাই হবে স্ত্রীর আসল মুহরানা। কারন কাপড়চোপড় ও আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে যায় এবং স্বর্ণচাঁদি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। সাধারণত প্রত্যেকের এবং বিশেষত নারীদের একটি নিজস্ব স্থায়ী ঠিকানা অতীব প্রয়োজন। পারিবারিক ও জমি সংক্রান্ত মামলা-মোকাদ্দমা কমাতে হলে বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তিকে জনপ্রিয় ও কার্যকর করতে হবে সর্বস্তরে। আসল বিচারক হল মানুষের বিবেক। সে বিবেবকে জাগাতেই হবে। বিবেক জাগ্রত থাকবে একমাত্র নৈতিক শিক্ষা ও দীক্ষার মাধ্যমেই। প্রতেকেই বিবেকমত কাজ করলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যেক পাহাড়ও আবাদ করা যায়।
----চলবে।
বিষয়: বিবিধ
১২৭৩ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মাশাআল্লাহ্।
ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এ এর আগে এমন সুন্দর আর কিছু পড়িনি মনে হচ্ছে।
অসম্ভব ভাল ভাল চিন্তা। লজিক্যাল, ওয়াইজ চিন্তা।
অতিরিক্ত প্রশংসার মত শুনাবে - না হলে বলেই ফেলতাম - এমন থটস্ সমৃদ্ধ মানুষ বাংলাদেশের ভূমি / গৃহনির্মান কিংবা সমাজ সেবা মন্ত্রী-লেভেল এ থাকলে - দেশের মানুষ অসম্ভব রকমের উপকৃত হত।
বছর তিনেক আগে হলে আমি আপনার সাথে ব্যবসা করার নিয়তে পরিচিত হতে চাইতাম।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন