একটা অনুরোধ - রাখা সম্ভব কি?

লিখেছেন লিখেছেন এলোমেলো ১৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০৩:০৫:৫২ দুপুর

আমার প্রয়াত বাবা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার জন্মের পর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে আমি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে দেখেছি। আমি নিশ্চিত, জনসংখ্যার আনুপাতিক হারের মতই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া এবং এতে অংশ নেয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যক্তিই ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন (এবং এখনো যারা বেঁচে আছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও তাই)। আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলাম আর পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ কখনোই সাংঘর্ষিক ছিল না, হবেও না কখনো।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের নিয়ে ১৯৪৭ সালে জন্ম নেয়া ‘মুসলমানদের রাষ্ট্র’ পাকিস্তান এর, সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বে যারা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি তাদের আচরণ সবসময়ই ছিল সদ্য বিলুপ্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের মতই – ক্ষেত্র বিশেষে ব্রিটিশদের চেয়েও খারাপ। ইসলামের মহান আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে অবস্থান নেয়া অত্যাচারী পাকিস্তান সরকারের অবর্ণনীয় অত্যাচার আর নিপীড়ন এই অংশের জনগোষ্ঠীর (যার সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল ধর্মপ্রাণ মুসলমান) সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ (সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানসহ) নিজেদের জন্য একটা প্রশাসন, রাষ্ট্র ও পতাকার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। পাকিস্তান সরকার ও তার আজ্ঞাবাহী এক জঘন্য পশুতুল্য সামরিক বাহিনী আর এর দোসর রাজাকার, আল-বদর ইত্যাদির মাধ্যমে সংঘটিত ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ নানা অত্যাচার এই স্বপ্নে নতুন মাত্রা যোগ করে। বঙ্গবন্ধুর রক্তে আগুন ধরানো আহ্বান আর স্বাধীন দেশের স্বপ্ন আমাদেরকে দারুনভাবে অসম এক শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবার শক্তি যোগায়। এক পর্যায়ে আমার ধর্মপ্রান মুসলমান বাবা ও তাঁর মত সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রান মুসলমান মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রান মুসলমানদের দেশ ‘বাংলাদেশ’কে উপহার দেন। তবে তাঁদের সবার স্বপ্নের এই বাংলাদেশ ছিল বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে ভালবাসা আর সম্প্রীতির বাংলাদেশ। তাঁদের এই বাংলাদেশ ছিল মুসলমানদের ঈদে হিন্দু দাদা-দিদিদের সাথে আর হিন্দুদের পূজায় মুসলমান ভাই-বোনের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবার বাংলাদেশ। একেই বোধ হয় জ্ঞানের ভাষায় ‘অসাম্প্রদায়িক’ বা ‘সেক্যুলার’ বাংলাদেশ বলে আজকাল এত বিতর্ক হয়। (এই লেখাটায় ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান’ শব্দদ্বয়ের আধিক্য খেয়াল করুন। একাধিকবার ইচ্ছা করেই একে ব্যবহার করা হয়েছে। এতবার এর প্রয়োগে উপরের অংশটুকু অনেকের কাছেই ‘সাম্প্রদায়িক’ গন্ধ ছড়াতে পারে। কিন্তু এটাই সত্য। এটা অনস্বীকার্য। একাধিকবার এই শব্দগুচ্ছের ব্যবহারের কারণটা লেখার শেষে হয়তো পরিষ্কার হয়ে যাবে)।

এ কথাও অনস্বীকার্য যে, যতই ‘সেক্যুলার’ বলা হোক না কেন, যে দেশের প্রায় ৯২ ভাগ মুসলমান (এবং এঁদের মধ্যে অধিকাংশই ধর্মভীরু/ধর্মপ্রান), সে দেশে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কার্যকলাপে ইসলাম ধর্ম এবং ‘মুসলমানত্বের’ প্রভাব থাকবেই। আর প্রত্যাশিতভাবে থাকবে ইসলামের অন্যতম আদর্শ – অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সমীহ ও শ্রদ্ধা। যেটা আমাদের দেশে আছে বলে আমি বিশ্বাস করি – পরিমাণে কম-বেশী হতে পারে।

আমাদের দেশে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান, মহানবীর (সাঃ) সুন্নাহ মেনে দাঁড়ি রাখেন ও টুপি পড়েন। যারা তথাকথিত ‘সেক্যুলারিজম’ এর কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন এবং মুসলমান নামধারী হয়েও প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করেন, তাদেরও অনেক শ্রদ্ধার ব্যক্তি বা আপনজনেরা দাঁড়ি রাখেন ও টুপি পড়েন, তাঁরা ইসলামকে নিজের বেশভূষার সাথে জড়িয়ে গর্ব করেন। আমার প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবারও দাঁড়ি ছিল (মুক্তিযুদ্ধের আগে ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও), তিনি টুপি পড়তেন। আমার বাবার মতই অনেক মুক্তিযোদ্ধার দাঁড়ি-টুপি ছিল এবং আজও আছে। মাওলানা ভাসানী মনেপ্রাণে মুসলমান হলেও তিনি বাঙালী অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ভাসানীর দাঁড়ি ছিল – তিনি টুপি পড়তেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দাঁড়ি-টুপি ছিল না, তবে তিনি গর্বভরে প্রকাশ করতেন ‘আমি মুসলমান, আমি বাঙালী’। দাঁড়ি রাখা বা টুপি পড়া কিন্তু কোনভাবেই ধর্মীয় গোঁড়ামির পরিচয় বহন করে না। আর তাই, রাজাকার, আল-বদর সহ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া সকল ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে দাঁড়ি-টুপির প্রতীক ব্যবহার করা একজন ধর্মভীরু মুসলমান হিসেবে আমার কাছে দারুনভাবে বেদনাদায়ক। এই প্রতীকটি ইসলামের অংশ – এই প্রতীকটি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের শ্রদ্ধার অংশ। দুঃখজনকভাবে, স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে চিহ্নিত অপরাধীদের সবারই লেবাসে দাঁড়ি-টুপির ব্যবহার রয়েছে। একইভাবে, আমরা দেখেছি, আমাদের ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় অনুভুতিকে পুঁজি করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো ব্যক্তিরাও অনেক সময় দাঁড়ি-টুপি ব্যবহার করে থাকে। তাই বলে কি, দাঁড়ি-টুপির প্রতীককে প্রকারান্তরে, ইসলাম ধর্মকে স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী পরিচয়ে পরিচিত করা ঠিক হবে? সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে এটা কোনভাবেই ‘নৈতিক’ বা ‘শালীন’ নয়।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমরা দানবের আদলে ইয়াহিয়া খানের একটা ক্যারিক্যাচার ব্যবহার করতাম (ANNIHILATE THESE DEMONS)। অত্যাচারী ইয়াহিয়ার চরিত্র তুলে ধরতে এই ক্যারিক্যাচারটি আন্তর্জাতিকভাবে সফল হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধীদের চিহ্নিত করতে আমরা কি সেরকম কোন ক্যারিক্যাচার ব্যবহার করতে পারি না? এই ক্যারিক্যাচারে দাঁড়ি-টুপি নাহলে নাই বা ব্যবহার করলাম। এর পরিবর্তে ক্যারিক্যাচারে কোন প্রতীক (বা এমনকি চিহ্নিত অপরাধীর নাম) ব্যবহার করা যায়। এরও বিকল্প হিসেবে আমরা এসব চিহ্নিত অপরাধীদের হুবহু আলোকচিত্র/ফটো ব্যবহার করতে পারি। অথবা অন্ততঃপক্ষে, আমাদের আঁকা ক্যারিক্যাচারগুলো থেকে দাঁড়ি-টুপি সরিয়ে নিয়ে অপরাধীদের নির্দিষ্ট কোন আকৃতি/অবয়ব দিয়ে সকল জাতীয় আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারি।

ক্যারিক্যাচার, কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্রে ক্রমাগত দাঁড়ি-টুপির ব্যবহার আমাদের অনুজদের মনে তীব্র প্রভাব ফেলতে পারে (এর মধ্যে ফেলেছেও)। এটা আমাদের পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, দাঁড়ি-টুপি মানেই যুদ্ধাপরাধী নয়, দাঁড়ি-টুপি মানেই জামাত-শিবির নয়, দাঁড়ি-টুপি মানেই ধর্মান্ধ, জঙ্গি, উগ্রবাদী, ধর্ম-ব্যবসায়ী নয়।

(এই লেখাটি বেশ বছর দুই আগেই লেখার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল যখন একুশে টেলিভিশনের এই ভিডিওটা দেখেছিলাম। আরেকবার তাগিদ পেলাম আন্দোলনের প্রথম দিকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কয়েকজন যখন দাঁড়ি-টুপিসহ একাধিক ক্যারিক্যাচার নিয়ে লাফালাফি করছিল। এর সাথে হেফাজতে ইসলামের দাবীর মিল থাকলেও সংশ্লিষ্টতা নেই)

বিষয়: বিবিধ

১২১১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File