সংশয় ও অপনোদন: প্রসঙ্গ নামাজ- শেষ পর্ব
লিখেছেন লিখেছেন এ টি এম মোনাওয়ার ০৮ মে, ২০১৩, ১০:০০:৫৫ সকাল
৬। কোরআনে যা আছে হাদীসেও তাই আছে। কথাটি বাহ্যিক অর্থে সঠিক মনে হলেও সঠিক নয়; বরং হাদীসে আরো কিছু অতিরিক্ত বিধান আছে। এই ভুল দাবিটির দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথা বুঝানো যে, নির্দিষ্টভাবে কোরআনে যা নাই হাদীসে তা থাকলে গ্রহণ করা যাবে না। কারণ, এটি কোরআনের কন্টেন্টের অতিরিক্ত। হাদীস কোরআনের ব্যাখ্যা। কোরআন যে সকল বিষয়ে কথা বলে সে সকল বিষয়ের ব্যাখ্যাই হাদীস করে। অন্য কোন বিষয়ে হাদীস আসলে তা কোরআনের অনুকূলে নয় কারণ সে বিষয়টি কোরআনে উল্লেখ নেই। তাই এটিকে গ্রহণ করা যাবে না। এই দাবিটি তাদের যাদেরকে ‘কুরআনিঊন’ বলা হয়। এই শ্রেণীর কিছু মানুষ রয়েছে যারা হাদীসকে অস্বীকার করে। [ডঃ মুস্তাফা আল-সিবায়ীর এই বিষয়ে একটি বই লিখেছেন যার বাংলা হল সুন্নাতে রাসূলের আইনগত মর্যাদা। এই বইতে লেখক এসকল বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন] সুতরাং, কোরআনে যা আছে, হাদীসে তাই আছে এমন দাবি ১০০% অমূলক। এর মাধ্যমে আরো বুঝানো হচ্ছে, শুধু সুন্নাহর মাধ্যমে ইসলামের যেসকল বিধান সাব্যস্ত হয়েছে সেগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। এমন দাবিটিও বেশ প্রসিদ্ধ। এক্ষেত্রে সঠিক হচ্ছে কুরআনে যা আছে হাদীস তার ব্যাখ্যা আছে এবং তা সাহাবাদের কুরআন বুঝার উপর ভিত্তি করে। পাশাপাশি কুরআনে এমন কিছু বিষয়ের বিধানও হাদীসে রয়েছে। হাদিসকে মানতে কুরআনই নির্দেশ দিয়েছে। সবগুলোই আল্লাহর বিধান কারণ দুটিই ওহী। কুরআন হচ্ছে তিলাওয়াতকৃত ওহী আর হাদীস হচ্ছে তিলাওয়াতবিহীন ওহী।
৭। শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ নয়; বরং সবচেয়ে বড় গুনাহ হচ্ছে কোরআনের জ্ঞান না থাকা। এটি ১০০% ভুল। কারণ এটি কোরআন এবং সহীহ হাদীসের পরিষ্কার ভাষ্যের পরিপন্থী। [আগের ইংলিস লিখাটিতে বিস্তারিতভাবে এর আলোচনা করা হয়েছে]
৮। কোরআনের জ্ঞান না থাকা সবচেয়ে বড় গুনাহ। এই দাবিটিও ঠিক নয় কারণ, কোরআন স্টাডি করা, বুঝে পড়া ও অনুধাবন করা, এর শিক্ষা বাস্তবায়ন করা অবশ্যই দরকার। শিক্ষার বাস্তবায়ন করতে পারলেই সালাতের মৌলিক উদ্দেশ্য সাধিত হবে। এ কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রতিনিয়তই স্কলারদের থেকে এগুলো আমরা শুনে থাকি। কিন্তু এই মূল টপিকের অন্তরালে লুকিয়ে আছে কিছু সংশয় ও ভুল যেগুলো আমাদের অজান্তে আমাদের মনে ঢুকে পড়ছে। মূলতঃ কুরআনের জ্ঞান না থাকা কবীরা গুনাহও না। বরং অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় বিধানগুলো কোন জ্ঞানী ব্যক্তি থেকে জেনে নিয়ে বাস্তবায়ন করলেই জ্ঞানার্জনের ফরয রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয, ইবনু মাজাহ, ২২৪, সহীহ) আদায় হয়ে যায়। শুধুমাত্র ছোট একটি দল গভীর জ্ঞানে ব্যস্ত থাকলেই সবার দায়িত্ব আদায়ের জন্য যথেষ্ঠ। কুরআনের স্পষ্ট ভাষ্য এটিই। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “আর মুমিনদের সবার এক সাথে বের হয়ে পড়ার কোন দরকার ছিল না৷ কিন্তু তাদের জনবসতির প্রত্যেক অংশের কিছু লোক বেরিয়ে এলে ভাল হতো৷ তারা দীন সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতো এবং ফিরে গিয়ে নিজের এলাকার লোকদের কে সতর্ক করতো, যাতে তারা (অমুসলমানী আচরণ থেকে ) বিরত থাকতো, এমনটি হলো না কেন?” (তাওবা:১২২)। তবে সব মানুষই যদি অধিক জ্ঞানার্জন করে তাতে শুধু কল্যাণই নিহিত। এটি উত্তমতার বিষয়, গুনাহের বিষয় নয়।
৯। বাস্তব উদাহরণ দেখে কুরআনের বুঝতে হবে। এই কথাটি শুনতে খুবই সুন্দর কিন্তু এটি সঠিক নয়। এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে বড় এক অযৌক্তিক দাবির স্বীকারোক্তি যা একজন মুমিন কখনোই মেনে নিতে পারেনা। যুগ যুগ ধরণেই বাস্তব উদাহরণ দেখে শিক্ষা গ্রহণ করার গুরুত্ব রয়েছে। এজন্যই আজ কিছু কিছু মানুষ বলে থাকে কাদের থেকে ইসলাম শিখব। বক্তারাতো শুধু বলেন আমল করেননা। তাই মুসলিমরা আসলেই রোল মডেলের সংকটে ভুগছে। অপরদিকে রাসূল (সাঃ) ছিলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রোল মডেল। তাঁকে দেখেই সাহাবাগন ইসলাম শিখেছে এবং কুরআনের বাস্তবায়ন কিভাবে করতে হয় তা দেখে দেখে নিয়েছেন। রাসূলের (সাঃ) ইন্তকালের পর অনুকরণীয় ছিলেন সাহাবাগন এবং এর পরবর্তী যুগের সোনার মানুষেরা। তবে দিন দিন রোল মডেলদের মান কমেই আসছে।
পক্ষান্তরে কুরআন এতই বাস্তবমুখী যে বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এবং বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের নিমিত্তেই সুদীর্ঘ ২৩ বৎসরে কুরআন নাযিল হয়েছে। কুরআন ২৩ বছরে নাযিল হওয়ার এটিই সবচেয়ে বড় হিকমত। কিন্তু বাস্তব উদাহরণ দেখে কুরআনের অর্থ বুঝব এটি একটি ভুল দাবি। বাস্তবতার আলোকে কুরআন নাযিল হয়েছে বিধায় কুরআন এই পৃথিবীতে রাষ্ট্রও শাষণ করেছে। কুরআনের আবেদন বাস্তবতামুখী বিধায় এর আইন দ্বারাই কিয়ামত পর্যন্ত মানবতার মুক্তি আসতে পারে যেমনটি হয়েছে এর প্রাথমিক যুগে। কুরআনের আবেদন বাস্তবমুখী হওয়া আর কুরআনকে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শিখা এক কথা হয়। দুটির মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান রয়েছে। প্রথমটি ঠিক বিধায় কুরআন আইন বাস্তবায়িত হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি মোটেও ঠিক নয়। কারণ উদাহরণ এখন নেই। কোন বিধানটির সঠিক উদাহরণ এখন ১০০% বিদ্যমান যা দেখে আমরা কুরআন বুঝব। আবার বাস্তব উদাহরণ পাওয়াই যায় যদি তাহলে কুরআনের প্রয়োজন কেন? এখন কি সে যুগের সমতুল্য মানুষেরা আছে? যাদের জীবন পদ্ধতি দিয়ে কুরআনের অর্থ বুঝব না কি এখন আছেন। তারা নাই একথাটির দিকে নিয়ে যাওয়াই মূল উদ্দেশ্য। আর বাস্তবতার নিরিখে যখন দেখা যাবে যে বর্তমান পৃথিবীতে এমন মানুষ আর নেই তখন কুরআনের সঠিক অর্থ বুঝাও সম্ভব নয়। পরিশেষে এমন উপসংহারে পৌঁছানো যে কুরআন এই যুগের মানুষের উপযুক্ত নয়। কুরআন বর্তমানে মানবতার মুক্তি দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সুতরাং কুরআন বর্তমান যুগের জন্য অচল। (আল্লাহ্ আমাদের এমন দাবি মেনে নেয়া থেকে মুক্তি দিন)।
অপরদিকে বাস্তব উদাহরণ আছে পাশ্চাত্য সভ্যতায়। তাদের দেশে জুলুম নির্যাতন নেই। সবকিছু আইনমত চলে। সবাই আইন মেনে চলে। তাদের আইন কানুন কোরআনের সাথে মিল বেশী। এমন কথা বলে কুরআনের ব্যখ্যায় তাদের মতামতকে গ্রহণ করা। তাদের মধ্যে কুরআনের তাফসীর ও ব্যখ্যা করে এমন একদল লোক রয়েছে যেটি “ওরিয়েন্টালিস্টদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি” লিখাটি আলোচনা করা হয়েছে। এমন ব্যাখ্যার দাবিদার যারা তারদেরকে আধুনিক দর্শণের ভাশায় ‘মডারনিস্ট’ বলা হয়। আজকের প্রতারিত মুসলিমরা কুরআন বুঝা ও ব্যাখ্যার ব্যপারে তাদের মূল মেথডলজি ভুলে গিয়ে এই মডারনিস্টদের দুয়ারে ধরণা দিয়েছে। আর তাই কুরআনের ব্যাখ্যায় এখন আমরা অনেক বিভান্তির সম্মুখীন হচ্ছি।
১০। Common sense ব্যবহার করে যে কোন বিষয়ের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া। পরে কুরআনের সাথে মিলিয়ে দেখা। যদি এটি কুরআনের সাথে মিলে যায় তাহলে ভাল এবং তা আমরা এটি গ্রহণ করব, অন্যথায় গ্রহণ করবনা। এই পন্থা আমাদের দৈনিন্দিন বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষেত্রে যে কোন প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক। শুধু তাই এমন বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন বিক্লপ নেই। যে কোন সমস্যা, বিপদ, এক্সিডেন্ট, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ রকম প্রাথমিক সিদ্ধান্তের বিকপ্ল নেই। কিন্তু এটিকে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে ইসলামের আলোকে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে। এটি সম্পূর্ণ ভুল। কারণ রাসুল (সাঃ) তিনি নিজেই শিক্ষা দিয়েছেন: প্রথমে কুরআনে প্রয়োজনীয় বিষয়ের সরাসরি নির্দেশনা খুঁজতে হবে। কুরআনে না পেলে হাদীসে এবং হাদীসে না পেলে কোরআন-হাদীসের অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে গবেষণা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটিকেই ‘কিয়াস’ বলা হয়। এই তিনটি উৎস সাহাবাদের জন্য ছিল।
কিন্তু রাসুল (সাঃ) তাঁর সাহাবাদেরকে এবং পরবর্তী যে কোন যুগের জ্ঞানীদের পথকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই সাহাবাদের এবং তাদের পরবর্তী স্কলারদের সম্মিলিত মত ‘ইজমা’ কে কিয়াসের আগে স্থান দিতে হবে। এভাবে সাহাবা পরবর্তী যুগের মানুষদের গবেষণার উৎস ৪ টি। কুরআন, হাদীস ইজমা ও কিয়াস। আলোচিত কমন সেন্সকে আগে ব্যবহারের পদ্ধতিটি হাদীসের প্রমাণিত গবেষণা পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক। তাই প্রসিদ্ধ ইমামদের কথার আলোকে এটিকে ছুড়ে মারা দায়িত্ব হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, বরং এই পদ্ধতির প্রবক্তার স্টেইটমেন্ট অনুযায়ীও যেহেতু এই (নব আবিষ্কৃত) পদ্ধতিটি হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক সেহেতু প্রবক্তার নিজেই এটিকে ছুড়ে মারা আবশ্যক হয়ে পড়ে।
প্রিয় পাঠক! এমন একটি বিতর্কিত শিরোনামের অন্তরালে যদি এতগুলো বিভ্রান্তি বিতর্কিত পন্থায় আমাদের মাঝে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় তাহলে এমন জ্ঞান ও যুক্তিকে একজন সচেতন ও বুদ্ধিমান মুমিন কিভাবে গ্রহণ করবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে জ্ঞান অর্জনে সতর্কতা অবলম্বন করে বিভ্রান্ত পদ্ধতি ও সংশয় থেকে মুক্ত থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন।
শেষ। ভালো লাগলে শেয়ার করুন প্লিজ।
বিষয়: বিবিধ
১২৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন