সংশয় ও অপনোদন: প্রসঙ্গ নামায, পর্ব -৫
লিখেছেন লিখেছেন এ টি এম মোনাওয়ার ০৬ মে, ২০১৩, ০৭:৪৫:৫৬ সকাল
নামাযে অবশ্যই শিক্ষা রয়েছে। আর সেগুলোই সালাতের গূঢ় তত্ত্ব ও রহস্য। [সুযোগ ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কিছু লিখব ইন শা আল্লাহ্] জামাআতের সাথে সালাত আদায় এবং এর উপকারিতা জেনে বাস্তবায়ন করা মূলত দ্বিমাত্রিক একটি দায়িত্ব। বরং রহস্য উদঘাটন করতে না পারলে শুধুমাত্র জামাআতকে তার যথাযথ গুরুত্বেই রাখতে হবে। একে তুচ্ছজ্ঞান করার কোন অধিকার কারো নেই। সালাতের শিক্ষা ও উদ্দেশ্য ব্যাক্তিগত ও সামাজিক দুভাবে অর্জিত হয়। এটি সামষ্টিকভাবে প্রভাব ফেলার চূড়ান্ত পর্যায় হচ্ছে সুন্দর সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা যেটি মুসলিমদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। কিন্তু সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা না থাকার অর্থ এই নয় যে, সালাতের সকল সামষ্টিক শিক্ষা বাস্তবায়ন হচ্ছে না এবং এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে যে নামাজ ব্যর্থ হচ্ছে। ঈমানের পর আল্লাহর প্রদত্ত সর্বপ্রথম ইবাদতই যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আল্লাহর শরীয়ত এই যুগে মানবতার কল্যাণ সাধনে ব্যর্থ বলা এবং ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা নয় এমন অমুলক দাবিই মেনে নেয়া হবে। আজো আমরা মসজিদে দ্বীনি আলোচনা শুনি, যদিও তা তুলনামূলকভাবে কম। আজো আগের ধারায় মসজিদে কোরআনের শিক্ষা অব্যাহত আছে। আজো আমরা মসজিদে পারস্পরিক কুশল বিনিময় করি।
অপরদিকে ব্যাক্তিগত শিক্ষাগুলো কি সকল সালাত আদায়কারী হারাচ্ছে? অবশ্যই নয়; বরং যারা যথাসময়ে সঠিকভাবে সালাত আদায় করে তারাই নিজেদের জীবনে সালাতের গুরুত্ব অনুভব করে এবং এর শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করে। আর সমাজের যারা দুষ্কৃতি করে তারাতো নামাজি পড়েনা। অবশ্য নামাজ আদায়কারী একাংশ লোক বাস্তব সমাজে ইসলামকে মেনে চলেনা। এর অর্থ এই নয় যে নামাজ ব্যর্থ হচ্ছে। তাদেরকে ইসলাম পরিপন্থী কাজের জন্য নামাজের শিক্ষা বাস্তবায়ন না করার প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হবেনা বরং; এর জন্য আমর নাহি সংক্রান্ত ইসলামের অনেক বিধান রয়েছে সেগুলোর প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হবে। আল্লাহ্ তাআলা নামাজের সাথে সাথে অন্যান্য সকল বিধিবিধান বাস্তবায়নের ব্যপারেও আমাদের প্রচেষ্টার হিসেব নিবেন। সুতরাং অন্যান্য বিধিবিধানের নির্দেশ অমান্য করার চরম অপরাধকে লুকিয়ে রেখে সকল অনাচারের এবং ব্যর্থতার দায়ভার নামাজের উপর চাপিয়ে দিয়ে নামাজ ব্যথ হচ্ছে এমন দাবি করা অমূলক ও ভিত্তিহীন।
তাহলে বাস্তব জীবনে সালাতের শিক্ষা বাস্তবায়নের দিক থেকে জামাআতের সাথে নামাযের আনুষ্ঠানিকতাই সবচেয়ে বেশী গুরুত্বের দাবিদার। কিন্তু এর বিপরীতটাই যদি সত্যি হয় তাহলে কেউ কেউ দাবি করবে পাশ্চাত্য সভ্যতার লোকেরা সালাতের শিক্ষাকে তাদের বাস্তব জীবনে বেশী প্রয়োগ করছে। তারা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেই বাস্তবায়ন করছে। সুতরাং, জামাআতের আনুষ্ঠানিকতা বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়। তথাকথিত মডারেশনের প্রবক্তারা এমন দাবি সচরাচর করেই আসছে আর বলছে পাশ্চাত্যে ইসলাম না থাকলেও আইনের শাষন সুন্দর বাস্তবায়ন হচ্ছে। অপর দিকে মুসলিমরা ইসলামের কথা বলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। প্রকৃতপক্ষে এটি স্বজাতির মানুষদের জন্য পাশ্চাত্যের নিজস্ব পলিসি, অন্যজাতির জন্য নয়। এজন্যই তারা সারা মুসলিম বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টির সকল ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে এবং মুসলিমদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালাচ্ছে।
উপরের অমূলক দাবিটি মেনে নিলে এমন প্রশ্নের জবাব দেয়ার সুযোগ থাকেনা যে ওয়াক্তমত সালাত আদায় ছাড়াও যদি এমন শিক্ষা বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে সমাজে উৎকর্ষ সাধনের জন্য কোন মডেলটি বেশী কার্যকর সালাতভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা নাকি বিক্ষিপ্তভাবে শিক্ষার বাস্তবায়নকারী পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণ? ঈমানের পর দ্বীনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সালাত। এটিকে জামাআতের সাথে গুরুত্ব এত বেশী যে, এর সূচনাই হয়েছে জিবরাইলের ইমামতির মাধ্যমে। সালাতের সামাজিক শিক্ষা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ফরযে কিফায়া যা গুটিকয়েক মানুষের দায়িত্ব। যদি এটির বাস্তবায়নে কিছু লোক প্রচেষ্টা চালায় তাহলে যাদের উপর এটি ফরয না তারা কি সালাতকে ছেড়ে দিতে পারবে? কারণ, শিক্ষার বাস্তবায়নে তাদের কোন ভূমিকা রাখার প্রয়োজন নেই। মসজিদে জামাতের সাথে সালাত আদায় এবং বাস্তবজীবনের আনুগত্যের নিবিড় সম্পর্ককে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শায়খ আতিয়্যার উক্তিটি উল্লেখযোগ্য। তিনি ‘সাত জন ব্যক্তির আরশের ছায়া লাভ’ সম্বলিত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন: “মুসলিম সমাজে কিছু মানুষ (বিশেষতঃ যুবক) আছে যারা আল্লাহর আনুগত্য করে। এ সব যুবকের অন্যতম গুণ হচ্ছে তারা দৈনিক পাঁচবার মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতে এবং এই আসা যাওয়ার মাধ্যমে মাসজিদের সাথে তাদের এক নিবিড় সম্পর্কের সৃষ্টি হয় এবং তাদের হৃদয়টা মসজিদের সাথে যুক্ত হয়ে যায়, এ সকল মুসল্লী নামাজ পড়তে গেলে স্বাভাবতই মসজিদের অভ্যন্তরে পারস্পরিক পরিচিত হয় এবং কখনো কারো অবর্তমানে তার খোঁজ-খবর জানতে অভ্যস্থ হয়। এভাবে বারংবার সাক্ষাৎ ও খোঁজ-খবরের মাধ্যমে তাদের মাঝে এক প্রকার ভালবাসা সৃষ্টি হয় যা শুধু আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টির নিমিত্তেই। মসজিদে জামাতবদ্ধভাবে সালাত আদায় আর মুসল্লীদের পারস্পরিক ভালবাসার একটা ইতিবাচক প্রভাব সমাজে প্রতিফলিত হয় যেটি তাদের সামাজিক বন্ধন সৃষ্টিতে বিরাট ভুমিকা রাখে”।
ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য প্রাচ্যের একদল বড় শিক্ষিত লোক রয়েছে যারা তাদের পুরো জীবন দিয়েছে কোরআন সুন্নাহর গবেষণায়। তারা কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসকে তাদের প্রাসঙ্গিকতা ও সঠিক অর্থ থেকে আলাদা করে নিজস্ব একটি যুক্তির কাঠামো দাঁড় করায় এবং এর মাধ্যমে কোরআন হাদীসের অকাট্য জ্ঞান ও দলিলের সাথে সাংঘর্ষিক নতুন একটি কনসেপ্ট প্রমাণ করে। প্রমাণের বিভিন্ন স্তরে তারা অনেকগুলো সংশয় ছড়িয়ে দেয় যেগুলো মনের অজান্তে মুসলিমদের ব্রেনে ঢুকে পড়ে। তারা কোরআনের তাফসীর করে, হাদীসের ব্যাখ্যা করে, সীরাতের রাসূলের বিশ্লেষণ করে। এভাবে ইসলামের সকল বিষয় নিয়ে তারা আজীবন গবেষণা করে ইসলামকেই আবার আক্রমণ করে। এমন লোকদেরকে আরবীতে মুসতাশরিক, ইংরেজিতে ওরিয়েন্টালিষ্ট এবং বাংলায় প্রাচ্যবিদ বলা হয়। তাদের জন্ম ত্রয়োদশ শতাব্দীতে।
ফ্রান্সের রাজা ‘লুইস নবম’ মিশর আক্রমণ করে পরাজিত হয়ে মানসুরা শহরের দারুল আরকাম নামক স্থানে বন্দী হন। মুক্তিপণ দিয়ে তিনি ফ্রান্সে ফিরে যান। এরপর ইউরোপের উল্লেখযোগ্য নেতা ও স্কলারদেরকে নিয়ে কনফারেন্স করে অস্ত্রের যুদ্ধের বিরতি টেনে স্নায়ুযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন এবং গোটা ইউরোপ থেকে একদল মেধাবী ও শিক্ষিত লোককে মুসলিম বিশ্বের ইসলাম, মুসলমান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সম্পদ, শক্তি, দুর্বলতা এসকল বিষয়ে গবেষণা করে ইউরোপকে রিপোর্ট করতে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। সেখানে থেকে ওরিয়েন্টালিষ্টদের ইসলাম গবেষণার এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। তারা কখনও বলেন, শুধু আরবী ভাষা জানলেই কোরআনের তাফসীর করা যায়। এ দাবিটি অনেক প্রসিদ্ধ। আবার কখনও বলে থাকেন, শুধু অনুবাদ জানা থাকলেও কোরআনের গবেষণা করা যায়। কোরআন গবেষণা করতে উসূলে ফিক্বহের কোন প্রয়োজন নাই। অথচ, উসূলে ফিক্বহই গবেষণার মূল চাবিকাঠি। তারা নিজেরাই সুবিধামত কয়েকটি মাকাসিদ/ শিক্ষা ও উপকারিতা নির্ধারণ করে এর আলোকে বিভিন্ন মতামত দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। এমতাবস্থায় কিভাবে এ ধরনের সংশয়পূর্ণ আলোচনাকে স্বীকৃতি দেয়া যায়? জ্ঞানার্জন ও মেথডোলজী যদি ভুল ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়, তাহলে সঠিক উপসংহারে কিভাবে পৌছা সম্ভব? অথচ এমন ভুল মেথডোলজীর কারণের আমরা অনেকগুলো ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার দ্বারপ্রান্তে উপনীত গিয়েছি। যেমন:
চলবে>>> ভালো লাগলে শেয়ার করুন প্লিজ।
বিষয়: বিবিধ
১০৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন