সংশয় ও অপনোদন: প্রসঙ্গ নামায, পর্ব ১

লিখেছেন লিখেছেন এ টি এম মোনাওয়ার ২৯ এপ্রিল, ২০১৩, ০৫:৫৬:০৪ সকাল

ইসলামের সূচলা লগ্ন থেকেই ইসলাম বিদ্বেষীরা ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন পন্থায় অনেক ধরনের ভুল ধারণা ও অপবাদ ছড়িয়ে যাচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে একদিকে ইসলাম সম্পর্কে মুসলিমদের বিশ্বাসকে সংশয়পূর্ণ করা এবং তাদের মনোবলকে দূর্বল করা। অপরদিকে যারা ইসলামক সম্পর্কে অধ্যয়ন করে এবং ইসলাম গ্রহণ করতে চায় তাদেরকে নিরোৎসাহিত করা। [এই বিষয়ে আধুনিক স্কলারদের মধ্যে সর্বপ্রথম মিশরের মুহাম্মদ কুতুব একটি বই লিখেছেন। যার বাংলা হচ্ছে “ভ্রান্তির বেড়াজেলে ইসলাম”। মিশরের মিনিস্ট্রি অব রিলিজিয়াস এনডৌমেন্ট এবিষয়ে একটি বিশ্বকোষ প্রকাশ করেছে] এমন একটি সংশয় হচ্ছে “নামাজ আজ ব্যর্থ হচ্ছে”। নিম্নে এই সংশয়টির ব্যখ্যা সহ অপনোদনের প্রয়াস চালাব। ইন শা আল্লাহ্‌। এই সংশয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে আরো যে ভূল বিষয়গুলো পরিলক্ষিত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে:

1. কবীরা গুনাহ সকল আমল নষ্ট করে ফেলে।

2. শিক্ষা বাস্তবায়ন না হলে সালাত আদায়ে কোনরকম ছওয়াবই পাওয়া যাবে না।

3. আনুষ্ঠানিক নামায মানে জামাআতের সাথে নামায আদায় বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

4. মসজিদ নির্মানে নিরুৎসাহিত প্রদান।

5. কোরআনে যা আছে হাদীছেও তাই আছে এবং হুবহু তারই ব্যাখ্যা করে।

6. বাস্তব উদাহরণ দেখে কুরআন বুঝতে হবে।

7. Common sense (ইসলামের আলোকে) সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রথম উপকরণ হিসেবে ব্যবহার।

8. কিয়াসের ব্যপারে ঐক্যমতকে ইজমা বলে।

9. শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ নয়।

10. কোরআনের জ্ঞান না থাকা সবচেয়ে বড় গুনাহ ইত্যাদি।

এগুলোর প্রত্যেকটি এমন বড় ভুল যেগুলো দ্বীনের একেকটি মৌলিক বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক। শিরোনামের সংশয়টি অপনোদনের মধ্য দিয়ে উপরোক্ত ভূলগুলো সংশোধনের চেষ্ঠা করা হবে। প্রথমেই প্রিয় পাঠকের মাইন্ডসেটের জন্য ভুমিকা সরূপ তিনটি বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়া জরূরী। সেগুলো হচ্ছে ইসলামী শরীয়ার মাকাসিদ, এর সার্বজনীনতা এবং মুসলিমদের জ্ঞানার্জনে সতর্কতা। প্রথমেই আলোচনা করা যাক মাকাসিদ সম্পর্কে।

১। ইসলামী শরীয়ার মাকাসিদ: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জাতির জন্য যে বিধিবিধান দিয়েছেন সেগুলোতে তাদের জন্য অফুরন্ত কল্যান নিহিত রেখেছেন। যদিও মানুষেরা তাদের স্বল্পজ্ঞানে তা উৎঘাটন করতে পারেনা। ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন, “নিশ্চয় শরীয়ত পুরোটাই ন্যয়পরাণয়তায়, অনুগ্রহ, প্রজ্ঞা এবং কল্যানে যে বিষয়টিই ন্যয়পরাণয়তা থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্যায্যে, অনুগ্রহ থেকে বিচ্যুত হয়ে নিষ্ঠুরতায়, প্রজ্ঞা থেকে অনর্থকতায় এবং কল্যাণ থেকে অকল্যাণে পরিণত হয়েছে সেটি সেখানে শরীয়তের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই যদি এগুলোকে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে শরীয়তের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়”। তবে এক্ষেত্রে তাদের কর্তব্য হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা ও বিধানদাতা হিসেবে আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলা। সাথে সাথে মূল রহস্য উৎঘাটন করতে পারলে তাহলে এগুলোর বাস্তবায়ন করবে এবং এতে তাদের আত্নতৃপ্তি ও প্রশান্তি আসবে। অন্যথায় রহস্য উৎঘাটনের লক্ষ্যে গবেষণা চালিয়ে যাবে। কিন্তু যেহেতু সেটি আল্লাহর বিধান তাই রহস্য জানতে না পারলেও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে। এটিই একজন সঠিক মুমিনের কাজ। শরীয়ী বিধিবিধানের এমন রহস্যকে আরবীতে ‘মাকাসিদ আল-শারীয়া’, ‘হিকমাহ’, ‘আসরার’, ‘মাসলাহাহ’, ইংরেজীতে ‘অবজেকটিভ অব শরীয়া’ এবং বাংলায় শরীয়ার মৌলিক উদ্দেশ্য, মূল শিক্ষা, গুঢ়তত্ত্ব, মূল রহস্য, বা ‘শরীয়া মাকাসিদ’ ইত্যাদি বলা যেতে পারে। ইসলামী বিধিবিধানের গুঢ়তত্ত্ব ও রহস্য নিয়ে স্কলারদের মাঝে কয়েকটি মতামত রয়েছে।

১। একদল গবেষক বলেন, ইসলামী বিধিবিধানের কোন মাকাসিদ বা অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য নেই। এটি তাদের দাবি যারা ইসলামী শরীয়াকে রসকষহীন, প্রাণহীন এবং এ যুগের অযোগ্য বলে বলে আখ্যা দেয়। তার বলেন শরীয়া প্রণেতা তথা আল্লাহ উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে তাকলীফ (কষ্ট) দেয়া। তাই তাঁর বিধান শুধু কষ্ট করেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এই মতটি সঠিক নয়।

২। আরেক দল বলেন, ইসলামের প্রতিটি বিধানের মাকাসিদ বা রহস্য রয়েছে। তবে যে বিধানের রহস্য নেই অর্থাৎ মানুষ সেটির রহস্য উৎঘাটন করতে পারেনি সেটি বাস্তবায়ন করার জরুরী নয়। এই মতটিও সঠিক নয়।

৩। ইসলামের প্রতিটি বিধানেরই অন্তর্নিহত উদ্দেশ্য ও মাকাসিদ রয়েছে। কারণ আল্লাহ তা’আলা মানব জাতির কন্যাণেই সকল বিধিবিধান প্রণয়ন করেছেন। এ সকল বিধিবিধানের বাস্তবায়ন মানুষ কর্তৃক এগুলোর গুঢ়তত্ত্ব বা হিকমাহ জানার কারণে নয়। বরং আল্লাহর নির্দেশ বিধায় আমরা পালন করতে হবে। অধিকন্তু, এগুলোর মৌলিক উদ্দেশ্য উৎঘাটন করতে পারলে সেগুলো অর্জনের প্রচেষ্ঠা চালানো জরুরী এবং এতেই আল্লাহ প্রদত্ত বিধিবিধানের বাস্তবায়ন শতভাগ সফল হয়। কিন্তু উদ্দেশ্য উৎঘাটন করতে না পারলে কিংবা জেনেও এগুলোর বাস্তবায়ন করতে না পারলে মূল বিধান অমান্য করার কোন সুযোগ নেই। বরং মূল নির্দেশ পালন করার সাথে সাথে এর মাকাসিদ/ গূঢ়তত্ত্বকে অনুধাবনের গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। যাতে মাকাসিদ উৎঘাটন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসলামের অনুপম সৌন্দর্য পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠে। এই মতটিই সঠিক। [মাকাসিদ বিষয়ে আরবীতে প্রচুর লিটারেচার রয়েছে তবে ইংরেজিতে ডঃ তাহা জাবের আলওয়ানী, ডঃ তাহের মাইসাবী, এবং ডঃ হাশীম কামালীর লিখিত কয়েকটি বই রয়েছে]

আবার যারা মাকাসিদের পক্ষে কথা বলেন তাদের কেউ কেউ নিজেদের ইচ্ছেমত সুবিধাগুলোকে মাকাসিদ ধরে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন যেটি কুরআন-হাদীস ও অকাট্য জ্ঞানের পরিপন্থী। তাই স্কলারগন মাকাসিদের কিছু শর্ত নির্ধারন করে দিয়েছেন। এগুলো পূর্ণ করলেই সেটি প্রকৃত মাকাসিদ হতে পারবে যার উপর ভিত্তি করে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। অন্যান্য ইবাদত ও বিধিবিধানের ন্যয় সালাতেরও অনেকগুলো মৌলিক মাকাসিদ বা শিক্ষা রয়েছে। যেগুলো বাস্তবায়ন হলে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে অনেক বয়ে আসবে। মূল শিক্ষার বাস্তবায়ন হলেই সালাতসহ অন্যান্য ইবাদত আরোপের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ফুটে উঠবে যেগুলো দেখে মানুষ ইসলাম গ্রহণে আকৃষ্ট হবে। [মাকাসিদ নির্ধারণে বাড়াবাড়ি এবং এর উৎঘাটনের সঠিক পন্থার বিষয়ে ডঃ ইউসুফ আল-কারদাভীর লিখিত একটি বই রয়েছে] চ্লবে >>> ভাল লাগলে শেয়ার করে অন্যকে পড়তে সহযোগিতা করুন।

বিষয়: বিবিধ

১২৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File