ভালো মানুষের খোঁজে
লিখেছেন লিখেছেন আস্তিক ব্লগার ২২ মার্চ, ২০১৩, ০৮:৪১:৩৯ রাত
বর্তমান বিশ্বে বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির মধ্যে যদি “ভালো মানুষ “ যুক্ত করা হয়, তাহলে মনে হয় বিশ্বের মানুষ খুব বেশী অবাক হবেন না। দূঃখের বিষয় অন্যান্ন বিলুপ্ত প্রজাতির ন্যায় সংরক্ষন না করার জন্য পৃথিবী থেকে যেন ভালো মানুষের সংখ্যা অতি দ্রুতই হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই সংখ্যা একেবারে শুন্যের কোঠায় পৌচেছে বলে যদি কেউ দাবী করেন তাহলেও হয়তো প্রতিবাদ করার জন্য কোন লোক খুজে পাওয়া যাবেনা। বর্তমান মিডিয়ার ভূমিকা এই অবস্থাকে যেন আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। মিডিয়া যাদেরকে ভালো মানুষ হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে, বাস্তবতা হলো তার পরিচিত মহলে এমনকি পরিবারের লোকেরাও হয়তো সেই ব্যাক্তিকে ভালো মানুষ হিসাবে মেনে নিতে কষ্ট পান। আবার যাদেরকে অতি খারাপ মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, সমাজের লোকেরা হয়তো তাকে ভালো মানুষ হিসাবেই জানে। এমন একটি গোলক ধাঁধায় সাধারণ মানুষের পক্ষে ভালো মানুষ খুজে বের করাই যেন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমনকি জটিল নাগরিক জীবণে চলতে যেয়ে কেউ যদি নিজেকে নিয়েই পর্যালোচনা করেন তাহলেও হয়তো দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যাবেন, আপনি আসলেই ভালো মানুষ কি’না? ভালো মানুষ কাকে বলে? ভালো মানুষের বিচারের মানদন্ডই বা কি হবে সেটিও যেন হয়ে পড়েছে আমাদের অজানা।
ভালো মানুষের বিচারের মানদন্ড তৈরী করার জন্য যে বিচার বুদ্ধির প্রয়োজন তা আমার আছে বলে আমি বিশ্বাস করিনা। এমনকি কেউ যদি অনেক গবেষণা করে এই মানদন্ডটি তৈরী করেন আমি হয়তো তার উপরও আস্থা রাখতে পারবো না। এ ব্যাপারে যদি একটু ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা যায়, তাহলে হয়তো সকলের কাছে সেটি সবচেয়ে বেশী গ্রহণ যোগ্যতা পাবে। আর সেই পন্থা হলো এই মানদন্ড কোন মানুষ নয়, মানুষের সৃষ্টি কর্তা যদি আসমানী গ্রন্থে এই ধরণের কোন মানদন্ড দিয়ে থাকেন তাহলে সেটিই হবে সবচেয়ে বেশী সঠিক মানদন্ড। এর পরপরই আমরা যে মানদন্ডটি গ্রহণ করতে পারি তা হলো, পৃথিবীর অসংখ্য গবেষক গবেষনার মাধ্যমে যাকে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছেন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ আখেরী পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবণী থেকে তার যে বৈশিষ্ট পাওয়া যায় সেই বৈশিষ্ট থেকে। এছাড়া অন্যান্ন মনিষীদের জীবণী থেকেও আমরা কিছু বৈশিষ্ট চিহ্নিত করে সেগুলোকেও এই মানদন্ড হিসাবে গ্রহণ করতে পারি।
নবুয়্যত লাভের একেবারে শুরুতেই রাসূল (সাঃ) এর কিছু বৈশিষ্ট আমরা তার প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদিজা (রাঃ) কাছ থেকেই জানতে পারি। হেরা গুহাতে হযরত জিবরাঈল (আঃ) এর সাক্ষাত পাওয়ার পর তিনি দারুণ চাপ অনুভব করতে থাকেন এবং পেরেশান হয়ে পড়েন। তাঁর মানষিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্লাসিক সিরাত গ্রন্থাকারগণ উল্ল্যেখ করেছেন যে, এমনকি তিনি পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে আত্নহত্যার চিন্তা পর্যন্ত করেছিলেন। যাই হোক এমন মানষিক অস্থিরতা নিয়ে তিনি তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে আসলেন এবং পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা খুলে বলে তিনি জানালেন যে, আমার কী হয়েছে? নিজের জীবণের আমি আশঙ্কা করছি। তখন বিবি খাদিজা (রাঃ) তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে অপমান করবেন না। আপনি আত্নীয় স্বজনের হক আদায় করেন, বিপদগ্রস্থ লোকদের সাহায্য করেন, মেহমানদারী করেন এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। বিবি খাদিজা প্রিয়তম স্বামীর যেসব বৈশিষ্টের কথা উল্ল্যেখ করেছেন একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য এই সকল বৈশিষ্ট গুলো সকল সময়ের সকল মানুষের জন্য আদর্শ মানদন্ড হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। এছাড়াও মুহাম্মদ (সাঃ) এর আরও দুইটি বৈশিষ্ট সেই সমাজে সর্বসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তা হলো এই যে, তিনি ছিলেন সেই সমাজের আল আমিন অর্থাৎ সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যাক্তি। আর দ্বীতিয়তঃ তিনি ছিলেন সেই সমাজের সবচেয়ে বেশী সত্যবাদী। আল্লাহর মনোনীত রাসুল হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার পূর্বেই রাসূল (সাঃ) এই ছয়টি বৈশিষ্ট ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকল জাতীর জন্য এবং সকল সময়ের জন্য আদর্শ মানদন্ড হিসাবে সর্বোসম্মতভাবে স্বীকৃতি পেতে পারে।
একইভাবে এমনই কিছু বৈশিষ্টের বর্ণনা ইতিহাস থেকে আমরা পাই হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) যখন মক্কা থেকে আবিসিনিয়ার উদ্দ্যেশ্যে হিযরতের জন্য বের হয়ে যান। রাসূল (সাঃ) এর অনুমতি নিয়ে আবিসিনিয়ার পথে মক্কা থেকে একদিন কি দু’দিনের পথ অতিক্রম করার পর ইবনে দাগিন্না নামক একজন কুরাইশ গোত্রপতির সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। গোত্রপতি আবু বকর (রাঃ)কে প্রশ্ন করেন আপনি কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) জানান, এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আমার সম্প্রদায় আমাদের নান দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত করে তুলেছে, এমনকি আমাদের জীবন সংকটাপন্ন করে ফেলেছে। তাই নিজের দেশ ছেড়ে আবিসিনিয়ায় হিযরত করতে বাধ্য হচ্ছি। তখন ইবনে দাগিন্না বলেন, আপনি আমাদের গোত্রের একজন সম্মানিত ও বিচক্ষন ব্যাক্তি। যিনি আমাদের গোত্রের একজন গর্ব। আপনি আমাদের গোত্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন, বিপদে সাহায্য করেন, সৎ কাজ করেন এবং দীন-দূঃখীদের জন্য অর্থ ব্যয় করেন। আপনি ফিরে আসুন, আপনি আমার আশ্রয়ে থাকবেন।
উপরের দুইটি ঘটনা যদি বিশ্লেষন করা যায়, তাহলে একটি নির্মম সত্য আমাদের সামনে ফুটে উঠে। সমাজে যারা ধর্মের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন, যারা রাজনীতির নামে জনসেবার কথা বলছেন, যারা সমাজ সেবার নামে সমাজ সেবক হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করছেন, যারা মানবতার সেবক হিসাবে গলা ফাটাচ্ছেন তারা নিজেরা নিজেদের কাছেই প্রশ্ন করে দেখুন তো আপনারা আপনাদের পরিবারের কাছে, আপনাদের সমাজের মানুষের কাছে এমন বিশেষ বৈশিষ্টে বৈশিষ্ট মন্ডিত কি’না? যদি না হন তাহলে আপনারা যতো আদর্শের কথাই বলেন না কেন? যতো মহৎ উদ্দ্যেশ্যই আপনাদের থাকুক না কেন? আপনারা তা প্রতিষ্ঠা করতে কখনই সক্ষম হবেন না। রাসূল (সাঃ) যথার্থই বলেছেন, তোমাদের মধ্য সেই সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যক্তি, যে তার পরিবারের নিকট উত্তম। সুতরাং আমরা যদি নিজেদেরকে সত্যিকার অর্থে ভালো মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই, আমরা যদি সত্যিকার অর্থে কোন আদর্শবাহী দলের আদর্শ সদস্য হয়ে সমাজে আমাদের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে সর্বপ্রথম আমাদেরকে আমাদের নিজেদের দিকেই তাকাতে হবে।
প্রথমেই নিজেকেই নিজে যে প্রশ্নগুলো করতে হবে তা হলো এই যে, আমরা কি আমাদের পরিবার ও সমাজের কাছে সত্যবাদী বলে প্রতিষ্ঠিত? আমরা কি আমানতের খেয়ানত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করি? ওয়াদা করলে সেই ওয়াদা পালনে সচেষ্ট থাকি? অর্থাৎ আমরা কি আমাদের সমাজে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত? আমরা কি আত্নীয় স্বজনের হক আদায় করি? বিপদগ্রস্থ লোকদের সহযোগীতায় কি আমরা এগিয়ে যাই? আমরা কি মেহমানদের জন্য যথেষ্ট আন্তরিকভাবে মেহমানদারী করি? সত্য প্রতিষ্ঠায় সহযোগীতা করার জন্য আমরা কি এগিয়ে যাই? আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠার পূর্বেই নিজেকে এইসব বৈশিষ্টে বৈশিষ্ট মন্ডিত করেছিলেন যার স্বীকৃতি স্বয়ং তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন। একইভাবে তাঁর প্রধান সহযোগী আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)ও যে একজন আদর্শ মানুষ হিসাবে তার সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তার স্বীকৃতি স্বয়ং তার একজন গোত্রপতিই দিয়েছিলেন। তার সেই বৈশিষ্টগুলোকেও আমরা আমাদের মানদন্ডের মধ্যে গ্রহণ করতে পারি। আর তা ছিল এই যে, তিনি সমাজের একজন যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সমাজ তাকে নিয়ে গর্ব করতো এবং সমাজ উন্নয়নে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখতেন। যিনি সৎ ভাবে জীবণ যাপন করতেন। বিপদগ্রস্থ মানুষকে সাহায্য করতেন। দীন-দূঃখীদের কে তিনি অর্থ সাহায্য করতেন। আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে এই বৈশিষ্ট গুলোও আমরা আমাদের জীবণে আনতে পেরেছি কি’না?
তবে সমাজের একজন ভালো মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য এই বৈশিষ্টগুলো যথেষ্ট হলেও আল্লাহর কাছে তা যথেষ্ট নয়। আল্লাহর কাছে একজন ভালো মানুষ হিসাবে যদি আপনি প্রতিষ্ঠা পেতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে মু’মিন হতে হবে। আর একজন মু’মিনের বৈশিষ্ট কি হবে সূরা আল মু’মিনুনে আল্লাহ রাব্বুল আল’আমিন তা পরিস্কারভাবে তুলে ধরেছেন। যে দশটি বিশেষ বৈশিষ্টের কথা আল কোরআনে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আল’আমিন তুলে ধরেছেন আসুন আমরা সেই গুনগুলো গুরুত্ব সহকারে জেনে নিই এবং গুনগুলো আমাদের চরিত্রের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালায়।
আল্লাহ সুবহান ও তায়ালা আল কোরআনে এভাবে বলেছেন, অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ। যারা বিনয় নম্র নিজেদের নামাজে। যারা অসার ক্রিয়া-কলাপ হতে বিরত থাকে। যারা যাকাত দানে সক্রিয়। যারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে। নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভূক্ত দাসীগণ ব্যতিত, এতে তারা নিন্দনীয় হবেনা। সুতরাং কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমালংঘনকারী। এবং যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। আর যারা নিজেদের নামাজে যত্নবান থাকে। তারাই হবে অধিকারী। অধিকারী হবে ফেরদাউসের, যাতে তারা স্থায়ী হবে।
সূরাঃ ২৩ আল মুমিনুন (আয়াত ১-১১)
এই আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর নবী (সাঃ) বলেন, এ সময় আমার উপর এমন দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে যে, যদি কেউ সে মানদন্ডে পুরোপুরি উতরে যায়, তাহলে সে নিশ্চিত জান্নাতে প্রবেশ করবে। সুতরাং কেউ যদি এই দশটি আয়াতের মানদন্ডকে তার জীবণে বাস্তবায়ন করতে পারে স্বয়ং রাসূল (সাঃ) তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দান করেছেন। আর রাসূল (সাঃ) এর ছয়টি ও আবু বকর (রাঃ) এর যে চারটি বিশেষ বৈশিষ্টের কথা উল্ল্যেখ করা হয়েছে এই দশটি বৈশিষ্ট যদি কেউ অর্জন করতে পারে তাহলে দুনিয়াতেও তিনি সফলতম ভালো মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাবেন বলে আশা করা যায়।
সুতরাং মিডিয়ার প্রপাগান্ডায় আমরা বিভ্রান্ত না হয়ে যদি আল্লাহ প্রদত্ত এই দশটি মানদন্ড ও রাসূল (সাঃ) ও আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর জীবণ থেকে নেয়া বাকী দশটী সব মিলিয়ে এই বিশটি মানদন্ডে যে যতো বেশী উত্তীর্ণ হবেন আমরা যদি শুধুমাত্র তাদেরকেই ভালো মানুষ বলে চিহ্নিত করে তাদের হাতে সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পন করি, তাহলে আর জনগণ প্রতারিত হবে না। আল্লাহর ইচ্ছাতে রাসূল (সাঃ) ও তাঁর খলিফাগণ যে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই খোলাফায়ে রাশেদিনের স্বর্ণালী সূর্য আবার উদিত হবে। সমস্ত জনগণ প্রশান্তি লাভ করবে। আবারও ভালো মানুষের আনাগোনায় পৃথিবী ভরে যাবে। আর আখেরাতে তাদের জন্য অপেক্ষা করবে চিরস্থায়ী সূখের আবাস জান্নাত। আল্লাহ আমাদেরকে এই বিশটি মানদন্ডের আলোকে ভালো মানুষ খুজে নেয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন...।
বিষয়: বিবিধ
১৫৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন