নতুন পোপ ফ্রান্সিস - নতুন অধ্যায় আর নতুনত্ব নিয়ে সিস্টিন চ্যাপেলে বের হলো সাদা ধোঁয়া

লিখেছেন লিখেছেন আস্তিক ব্লগার ১৫ মার্চ, ২০১৩, ০৯:১৬:২৫ রাত

বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত, সবচেয়ে বেশী ১২০ কোটি মানুষের হৃদয়ের সবচেয়ে উচ্চতম, পবিত্র আর শ্রদ্ধার পদ বলে পরিচিত, বিশ্ব ক্যাথলিকদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু পোপ পদটি হঠাৎ করেই নাটকীয়ভাবে শুন্য হয়ে যায়, পোপ ষড়শ বেনডিক্ট এর পদত্যাগের মাধ্যমে। ৬০০ বছরের মধ্যে ৮৫ বছর বয়সী পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টই প্রথম পোপ, যিনি পদত্যাগ করলেন।২০০৫ সালে পোপ জন পল-২ এর মৃত্যুর পর তিনি কার্ডিনালদের সর্বোচ্চ ভোটে এই পদের জন্য নির্বাচিত হন। আট বছর পর তাঁর স্থলাভিসিক্ত যিনি হলেন ধারণা করা হয় তিনিই ছিলেন সেবারের ভোটে দ্বীতিয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া কার্ডিনাল। তবে এই নির্বাচনটিতেও ছিল যথেষ্ট নাটকীয়তা।

রোমান ক্যাথলিকদের ২৬৬তম পোপ নির্বাচিত করার জন্য বিশ্বের ১১৫ জনের কার্ডিনালরা ভোটে অংশ নেয়ার জন্য ভ্যাটিকান সিটিতে একত্রিত হন। প্রথা অনুযায়ী ভোটের ব্যালট পেপার পুড়িয়ে ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলের চিমনি দিয়ে বের করা হয় ধোয়া। চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হওয়ার অর্থ হলো কার্ডিনালরা এখনও সক্ষম হননি তাদের নতুন পোপ নির্বাচিত করতে। আর যদি বের হয় সাদা ধোয়া তাহলে অনুসারীরা বুঝতে পারেন তাদের নতুন পোপ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আর তাই মঙ্গলবার সকাল থেকেই সকলের দৃষ্টি ছিল এই চিমনির দিকেই। সকাল থেকেই চলতে থাকে কার্ডিনালদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক। দুই দুইবার চিমনি দিয়ে বের হয় কালো ধোঁয়া। উৎকন্ঠা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। অতঃপর সন্ধার দিকে পঞ্চমবারের মতো ভোটাভূটি হবার পর বের হয় সাদা ধোয়া। সিস্টিন চ্যাপেল চিমনি দিয়ে সাদা ধোঁয়া বের হওয়ার দৃশ্য দেখে সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে অপেক্ষমাণ লোকজন উল্লসিত হয়ে ওঠেন। সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ঘণ্টাটিও বেজে ওঠে। অপেক্ষমান সারা বিশ্বের মিডিয়া কর্মীরা ব্যাস্ত হয়ে পড়েন জানার জন্য কে অভিষিক্ত হলেন নতুন পোপ হিসাবে।

অবশেষে চমক হিসাবেই যেন ঘোষনা দেয়া হলো আর্জেন্টিনার কার্ডিনাল ইয়োর্গে মারিও বেরগোগ্লিও ক্যাথলিক চার্চের নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন।প্রথা অনুযায়ী তিনি তার নতূন নাম পছন্দ করেছেন ক্যাথিলিক ধর্মে বিশেষ অবদান রাখা বিশেষ ব্যাক্তিত্ব ফ্রান্সিসের নামটি। তাই তিনি পোপ ফ্রান্সিস নামে অভিহিত হবেন।প্রায় এক হাজার ৩০০ বছরের মধ্যে এই প্রথম ইউরোপের বাইরে থেকে কেউ পোপ নির্বাচিত হলেন।ষোড়শ বেনেডিক্টের উত্তরসূরি হিসেবে নতুন পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর গির্জার বারান্দায় এসে অনুসারীদের দেখা দেন বেরগোগ্লিও। সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে সমবেত দেড় লাখ মানুষ ও বিশ্বব্যাপী টেলিভিশনের পর্দার সামনে অপেক্ষারতদের সামনে দাঁড়িয়ে সমবেতদের আশীর্বাদ করার বদলে তাদের শুভকামনা চান এই ধর্মগুরু। উচ্ছ্বাস আর আবেগসিক্ত অনুসারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি আপনাদের সমর্থন চাইছি। আমার জন্য প্রার্থনা করুন। এ সময় আরেকটি পুরনো প্রথাও ভেঙে দেন পোপ ফ্রান্সিস। নতুন পোপ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময় যাজকদের চেয়ে উঁচুতে অবস্থানের জন্য একটি প্লাটফর্মে উঠে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এ বিষয়ে নিউইয়র্কের আর্চবিশপ কার্ডিনাল টিমোথি ডোলান বলেন, তিনি বলেছিলেন, আমি এখানেই দাঁড়াব। সবাইকে এক কাতারে দেখেন তিনি। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ও সবার জন্য শুভ কামনা করে দর্শনপর্ব শেষ করেন বেরগোগ্লিও। এরপর সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে চলে উল্লাস। আর উচ্ছাসে ফেঁটে পড়ে বুয়েন্স আয়ার্স সহ সমস্ত দক্ষিন আমেরিকার কোটি কোটি ক্যাথলিক ভক্ত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনসহ বিশ্ব নেতারা পোপ ফ্রান্সিসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এর পরপরই।

একটি হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া বেরগোগ্লিও আজ বিশ্বের ১২০ কোটি ক্যাথলিকের ধর্মগুরু।১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনেস আয়ার্সে এক গরিব ঘরে জন্ম নেন বেরগোগ্লিও।তার পূর্বপুরুষ এসেছে ইটালি থেকে। ইতালীয় বাবা বুয়েনেস আয়ার্সে রেলশ্রমিকের কাজ করতেন, মা ছিলেন গৃহবধূ। তারা ছিলেন সাত ভাইবোন।তার শিক্ষাজীবনের বেশীরভাগ কেটেছে আর্জেন্টিনাতে। রসায়নের ছাত্র বেরগোগ্লিও আর্জেন্টিনা ছাড়াও জার্মানিতে পড়ালেখা করেন। একটি ফুসফুস অকেজো হয়ে যাওয়ার এক দশক পর ৩২ বছর বয়সে ধর্মপ্রচারে মনোনিবেশ করেন। দেরিতে শুরু করলেও চার বছরের মধ্যে স্থানীয় জেসুইট সংঘের নেতৃত্বে চলে আসেন তিনি।১৯৯২ সালে বিশপ এবং ১৯৯৮ সালে বুয়েনেস আয়ার্সের আর্চ বিশপের দায়িত্ব নেন বেরগোগ্লিও।২০০৫ সালে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট নির্বাচিত হওয়ার সময়ও ক্যাথলিকদের নেতা হিসেবে তাকে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হচ্ছিল।

কার্ডিনাল বেরগোগ্লিওকে একজন রক্ষণশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যৌনতা প্রশ্নে তিনি একেবারেই প্রাচীনপন্থী। কিন্তু সামাজিক ন্যায়বিচার প্রশ্নে তিনি কঠোর। তিনি তার নম্র আচরণের জন্য সুপরিচিত। কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই তিনি আর্জেন্টিনায় কাটিয়েছেন। তিনি প্রায়ই বাসে চড়ে কর্মস্থলে যেতেন।প্রভাবশালীদের ছাড় না দেয়ার জন্য পরিচিতি রয়েছে বেরগোগ্লিওর। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ ক্রিশ্চনার এবং তার প্রয়াত স্বামী ও নেস্টর ক্রিশ্চনারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন তিনি।তবে সমকামী বিবাহ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণের অবাধ বিতরণের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন নতুন পোপ। ‘ঈশ্বরের পরিকল্পনা ধ্বংস করার চক্রান্ত’ অভিহিত করে সমকামী বিয়ের জোরালো বিরোধিতা করেন তিনি।২০০১ সালে আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় বিক্ষোভে পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদেও সোচ্চার দেখা যায় এই ধর্মগুরুকে। দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলে নিজের দেশে বিভিন্ন সময়ে তিনি আলোচনায় আসেন।দীর্ঘদিন ধরে চার্চের পাদ্রীদের যৌনতা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তার পরি্পেক্ষিতে পাদ্রীদের বিয়ে করার অনুমতি দিয়ে তিনি ক্যাথলিক ধর্মের যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে আবা্রও আলোচিত হবেন কি’না এখন সময়ই সেটা বলে দেবে। ১২০ কোটির অধিক ধর্মানুসারীদের সবচেয়ে পুরাতন এই ক্যাথেলিক ধর্মে আবারও তিনি পরিবর্তন আনবেন কি’না সেটাই যেন এখন সকলের প্রশ্ন।

বিষয়: বিবিধ

১২৯৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File