আমরা কি আবারও ফিরে যাচ্ছি জমিদারী আমলে?

লিখেছেন লিখেছেন আস্তিক ব্লগার ২০ আগস্ট, ২০১৫, ১০:০১:৪৩ রাত

ছোটবেলায় আমার বাবা ছিলেন আমার একমাত্র আদর্শ। বাবার সবকিছুই আমার ভালো লাগতো। কিন্তু বাবার একটি বিষয় আমি কোনভাবেই পছন্দ করতামনা, মেনেও নিতে পারতামনা। সেই বিষয়টি ছিল হিন্দুদের বিষয়ে কিছু হলেই দেখতাম তিনি রেগে যেতেন, বিরক্ত হতেন, এমনকি গালাগালির অভ্যাস না থাকলেও হিন্দুদের তিনি গালিও দিয়ে বসতেন।

আমাদের বাড়ীর আশেপাশে বেশকিছু হিন্দু পরিবার বাস করতো। তাদের কেউ কেউ ছিলেন অতিশয় ভদ্রলোক। তাদেরকে কারও সাথে কখনই আমি ঝামেলাও করতে দেখিনি। পাড়ার অনেক খারাপ মুসলিম প্রতিবেশীদের থেকে তারা অন্তত অনেক ভালো এটাই আমার বিশ্বাস। আমার বন্ধু বান্ধবদের মধ্যেও একই বিষয়। আমার অনেক হিন্দু বন্ধু অনেক মুসলিম বন্ধু থেকেও অনেক ভালো। সুতরাং ভালো মন্দ মানুষ ভেদে হয় ধর্ম বা এলাকা ভেদে নয় এটাই আমার বিশ্বাস। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাবাকে একজন আদর্শ বাবা হিসাবে মনে প্রাণে পছন্দ করলেও এই বিষয়টি আমার কাছে ছিল বড্ড খাপ ছাড়া। কিন্তু বাবার সামনে এই বিষয়ে কথা বলার সাহসও আমার ছিলনা। যদিও তিনি কখনই আমার সাথে রাগারাগি করতেন না।

যাই হোক কোনভাবে হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অথবা নিজের থেকেই বিষয়টি আমাকে জানাতে চেয়েছিলেন। একদিন বাবার সাথে মটর সাইকেলের পিছনে বসে আমাদের গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছিলাম। আমাদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে এক বিরাট হিন্দু জমিদার বাড়ি ছিল। ঐ জমিদার বাড়ি যখন পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম তখন বাবা সেই জমিদারদের কাহিনী আমাকে বলা শুরু করলেন।

তিনি বললেন, এক সময় ছিল এই হিন্দু জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে রোদের মধ্যে ছাতা মাথায় দেয়া তো দূরে থাক কোন মুসলমান স্যান্ডেল পড়েও যেতে পারতো না। শুধু তাই নয়, এই বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেক মুসলমান মাথা নুইয়্যে, কোমর বাঁকায়ে না গেলে বেয়াদবী হিসাবে গণ্য হতো এবং তাদের সাজা পেতে হতো। বাড়ির অন্দরে যাওয়ার চিন্তাও কেউ করতো না। বিচার, শালিসের জন্য আসলে মুসলমানদের আশ্রয় নিতে হতো কাছারী বাড়ির সামনের আঙ্গিনায়। বাড়ির কোন বস্তু নেয়া তো দূরে থাক ছোয়াও ছিল নিষেধ। সমগ্র এলাকাতে গরু জবাই ছিল নিষিদ্ধ। আমার দাদা না’ কি তার যৌবন কালে একবার গোপনে গরু জবাই করেছিলেন। জমিদার কোনভাবে বিষয়টি জানতে পেরে দাদাকে সেই আমলে মোটা অংকের জরিমানা করেছিলেন। বাবার কাছে সেই ইতিহাসগুলো শোনার পর বুঝতে পারলাম কেন বাবা হিন্দুদের উপর এতো ক্ষিপ্ত হতেন। ঐ ইতিহাসগুলো এখন আমরা আর কেউ জানিনা। মাত্র কয়েক পুরুষ আগের হিন্দু জমিদারদের সেই লোমহর্ষক জুলুম, নির্যাতনের ইতিহাসগুলো এখন ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। কিন্তু মুছে ফেললেই কি ইতিহাস মুছা যায়।

বাবার কাছ থেকে শুনার পর থেকেই হয়তো বিষয়গুলো মনের অজান্তেই খেয়াল করতাম। শরৎচন্দ্রের মতো একজন জনপ্রিয় লেখকের লেখায়ও দেখতাম সেই বিদ্বেষ। তার লেখনীতে দেখেছি তিনি লিখেছেন বাঙ্গালী আর মুসলমানের মধ্যে খেলা অর্থাৎ মুসলমানদেরকে তিনি বাঙ্গালীই মনে করতেন না। বঙ্কিম চন্দ্রের লেখায় এই বিদ্বেষ আরও বেশী ছিল। আর এখনও কলকাতার অনেক জায়গায় মুসলমানদের নেড়ী বা মোহামেডান বলে ডাকতে দেখা যায়। শেরে বাংলা এ কে এম ফজলুল হক বলতেন, যখন কলকাতার দাদারা আমার সমালোচনা করে তখন আমি মনে প্রাণে তৃপ্ত হই এজন্য যে, আমার মনে হয়, আমি দূর্ভাগা মুসলমানদের জন্য কিছু করতে পেরেছি।

শুধু তাই নয়, হিন্দুদের মধ্যে এখনও এই মুসলিম বিদ্বেষ যে কতো তা বুঝা যায় ভারতে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার ইতিহাসের দিকে তাকালে। ভারতের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে কোন একটি পেইজে নেতিবাচক একটি পোষ্ট দেখে একজন ভারতীয় ভদ্রলোক যিনি বিজেপির সমর্থক আমার এডমিন ইনবক্সে একটি ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মুসলমানদের শত্রু বিজেপি না কংগ্রেস এই সিদ্ধান্ত আপনারাই নিবেন কিন্তু নেয়ার আগে এই পরিসংখ্যানটা একটু দেখুন। সেই পরিসংখ্যানে ভারতের দাঙ্গার সাল, নিহতের সংখ্যা, সেই সময় ক্ষমতাসীন দল কারা ছিল তার উল্ল্যেখ ছিল। আমি পরিসংখ্যানটি যে সঠিক তা যাচাই করে দেখেছি। স্বাভাবিকভাবেই সেই পরিসংখ্যানে সবচেয়ে বেশী দাঙ্গা হয়েছে কংগ্রেসের আমলে এটাই ফুটে উঠেছে এবং ভদ্রলোক এটাই আমাকে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেছি ভারতে প্রতি এক দশকে একাধিকবার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হতে দেখে এবং সেই দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলিম পরিবারকে উজাড় হতে দেখে। অথচ এই বিষয়গুলো নিয়ে ভারতের মিডিয়াতো কোন কথায় বলেনা। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানী মিডিয়াতেও এই বিষয়ে কিছুই খুজে পাওয়া যায়না। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত একটিও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা না হলেও ভারতীয় মিডিয়া এবং বাংলাদেশী মিডিয়া হিন্দু জড়িত বিষয়গুলো এমন মর্মস্পর্শী করে তুলে যে, আমরা যেন হিন্দুদের কচুকাটা করছি। বাংলাদেশী মিডিয়া বর্তমানে এই বিষয়ে যেন বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেই ঘটনাগুলো থেকেই আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের মুসলমানরা যেন আবার সেই হিন্দু জমিদারী আমলে ফিরে যাচ্ছে।

বিষয়টি শুরু করা যেতে পারে ফরিদপুরের অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক প্রবীর সিকদারকে নিয়েই। প্রবীর সিকদারের এবারের প্রতিপক্ষ কোন ছোটখাটো ব্যাক্তি নয় বরং বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে প্রভাবশালী কয়েকজনের মধ্যকার দুইজন। এই দুই শক্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও কিন্তু প্রবীর সিকদারের জয় হয়েছে। ভারতের আনন্দ বাজার পত্রিকা তাই লিখতে পেরেছে “ সাংবাদিক গ্রেফতারে কোনঠাসা হাসিনা।“ অথচ মাহমুদুর রহমানের মতো সম্পাদককে তারা গিলে ফেলেছেন নিমেষেই।

এবার আসা যেতে পারে প্রধান বিচারপতি প্রসঙ্গে। যতদূর জানা যায়, শামছুদ্দীন মানিক প্রধান বিচারপতির দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও প্রিয়ভাজন। কিন্তু তারপরও তিনি প্রধান বিচারপতি হতে পারেননি। কারণ তাদের চেয়েও যে এখন ক্ষমতাবান দাদারা! তাইতো ঐ পদটা সিনহা সাহেবের বরাদ্দেই গেছে। শুধু তাই নয়, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন নির্বাহী প্রধান পদে হিন্দুদের যে দাপট দেখা যাচ্ছে তাতে মুসলিমদের ভয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। বর্তমানে হিন্দু ডিসি আছে ৬০ ভাগের উপরে। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় নির্বাহী পদ গুলো যাচ্ছে হিন্দুদের দখলে।

এরপর আসা যেতে পারে, নারায়নগঞ্জের আলোচিত হত্যাকান্ড নিয়ে। এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আরেক প্রভাবশালী আওয়ামিলীগের মন্ত্রী মায়ার জামাই এবং র‍্যাবের প্রভাবশালী একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। আরও জড়িত মহা ক্ষমতাবান শামীম ওসমানের কাছের লোকজন। কিন্তু বিধি বাম, নজরুলকে হত্যা করে তারা এমনিতেই পার পেয়ে যেতেন। কিন্তু তারা পার পেয়ে যাননি। দূর্ভাগ্য বসতঃ তাদের পরিকল্পনার বাইরে তারা একজন হিন্দু এডভোকেটকে হত্যা করে ফেলেছিলেন এই অধ্যায়ে। এর পরের ইতিহাস তো সকলেরই জানা।

গত কয়েক বছরে প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্রলীগের গুন্ডাবাহিনী হত্যা করে চলেছে একের পর এক। কখনও কুপিয়ে, কখনও পি্টিয়ে, কখনও গুলি করে আর র‍্যাব, পুলিশের গুম, হত্যা, ক্রসফায়ার তো লেগেই আছে। কোন হত্যার বিচার হওয়া তো দূরে থাক এখন পত্রিকা আর টিভিতেও আনা যাচ্ছেনা। অথচ এই দাপুটে ছাত্রলীগই ধরা খেয়ে গেল একই রকম একটি ঘটনায়। কারণ এবার তারা ভুল করে হত্যা করে ফেলেছে বিশ্বজিৎ নামক একজন হিন্দু ছেলেকে। এই বিশ্বজিৎ এর হত্যাকারী ছাত্রলীগের সেই ক্যাডার অবাক বিষ্ময়ে বলেছে এই ধরণের হত্যার জন্য গ্রেফতার হবো সেটা তো স্বপ্নেও ভাবেনি। তার কথায় ঠিক এই ধরণের কয়েক হাজার হত্যা করলেও তাদের বিচার হয়না। মিডিয়া মুখ খোলেনা। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি আমরা যে ফিরে যাচ্ছি দাদাদের সেই জমিদারী আমলে। যেখানে হিন্দুদের দাপটে মুসলমানরা নেড়ি কুত্তা হয়ে যায়।

বিষয়: বিবিধ

১৫৪৪ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

337210
২০ আগস্ট ২০১৫ রাত ১০:৪২
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..

যথার্থ বলেছেন,
জমিদারীর কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ . .
337211
২০ আগস্ট ২০১৫ রাত ১০:৪৭
আস্তিক ব্লগার লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
337234
২১ আগস্ট ২০১৫ রাত ০২:২০
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহামাতুল্লাহি ওবারাকাতুহু। রাজনীতি হইলো রাজার নীতি!!! ইচ্ছেমত যখন যেখানে যেভাবে যা হবে.... সবাই Big Grin হাসিররাজা....।
২১ আগস্ট ২০১৫ দুপুর ০১:৫৭
278980
আস্তিক ব্লগার লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ
337273
২১ আগস্ট ২০১৫ সকাল ১০:৩৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার পোষ্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। এই সত্যগুলি মুছে অনেক হিন্দু জমিদার কে বানান হচ্ছে দানবির।
২১ আগস্ট ২০১৫ দুপুর ০১:৫৮
278981
আস্তিক ব্লগার লিখেছেন : ইতিহাসকে সামনে আনার দায়িত্ব আপনার আমার সকলের। মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
337342
২১ আগস্ট ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:১৪
শেখের পোলা লিখেছেন : জমদারদের কাছারিতে মুসলমানদের বসতে দেওয়া হত খড়ের আঁটি আর অন্যদের জন্য ফরাস৷ আমার গ্রাম সেনহাটীতে জমীদার ছিলনা৷ ছিল কিছু উচ্চ পদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারী৷ এ গ্রামে মুসলমানদের বাসও ছিলনা৷ পিছনের গ্রামে ছিল মুসলমান৷পাড়ার দাদা বলতেন শহরে যেতে হলে মুসলমানদের এই গ্রামের মধ্যদিয়েই যেতে হত৷ জুতা হাতে আর ছাতা বন্ধ করে৷বাঙলার মানুষ আবারও এটাই চায়, কেননা কিছু বীজ হয়তো আজও রক্তে রয়ে গেছে৷ ধন্যবাদ৷
337429
২২ আগস্ট ২০১৫ রাত ০৪:২০
আস্তিক ব্লগার লিখেছেন : এই ইতিহাসগুলো আবারও সবার সামনে ভালোভাবে তুলে ধরার সময় এসেছে। বিষয়গুলো আরও বিস্তারিত জানুন এবং আমাদেরও জানান। ধন্যবাদ আপনাকে বিষয়টি শেয়ার করার জন্য এবং আমার ব্লগে ভিজিটের জন্য।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File