মার কথা না বলা
লিখেছেন লিখেছেন কামরুল হাছান মাসুক ০৯ মার্চ, ২০১৩, ১০:০৭:১৬ সকাল
মার কথা না বলা
কামরুল হাছান মাসুক
আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান। একমাত্র সন্তান হলে যা হয়। আদর দিয়ে মাথায় তুলে রাখে। আমাকেও তাই করা হয়েছিল। আমার কোন অন্যায় মায়ের কাছে অন্যায় মনে হত না। আমিও খানিকটা বেয়ারা হয়ে গিয়েছিলাম। খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পরে সিগারেট খাওয়া শুরু করলাম। কিছুদিনের মধ্যে গাঁজা টাজা ধরে ফেললাম। আমার মা বিষয়টা জানত না। আমার বাবা ছিল বিদেশে। বিদেশ থেকে বাবা কষ্ট করে টাকা পাঠাত। মা নিজের জন্য খরচ না করলেও আমার জন্য দিল ধরিয়া ভাবে খরচ করতেন। আমিও মায়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যা ইচ্ছা তা করতাম। ভাবতাম, আমি হচ্ছি আমার বংশের রাজা। আমাকে সবাই রাজা বলেই ডাকত। আমাদের বংশ অনেক বড় বংশ। সবাই আমাদের বংশকে বেপারী গোষ্ঠী বলে ডাকত। কেন বেপারী গোষ্ঠী বলে ডাকত তা জানতাম না। তবে বুক ফুলিয়ে বলতাম, আমি বেপারী গোষ্ঠীর ছেলে। বুক ফুলিয়ে বলতে হত না। সবাই জানত, বেপারী গোষ্ঠীতে একটা মাত্রই ছেলে আছে। সব মেয়ে। গোষ্ঠীর ভেতর আমার নামটা উচ্চারিত হত জুরে শুরে। আমিই নাকি গোষ্ঠীর প্রদীপের আলো। আমার যে কি ভাল লাগত তা ভাষায় বলে বুঝাতে পারব না। আমাকে সবাই দেখলেই আদর করত। যা চাইতাম তাই দিত। আমি এত কিছু পেয়ে খারাপের দিকে যেতে থাকি। গোষ্ঠীর কেউ বিষয়টা জানত না। আমার কোন কিছুর অভাব ছিল না। তবুও বন্ধুদের পাল্লায় পরে চুরি করতে লাগলাম। একবার ধরা খেলাম। আমাকে দেখে তারা ছেড়ে দেয়। আমি যে চোর তারা বিশ্বাস করল না। আমি ঠিকই চুরি করেছিলাম। মা শুনে অনেক রাগ করল। আমি যে চুরি করব তা মা কল্পনাই করতে পারে নি। মা বিশ্বাসও করল না। আমাকে খুব বকাযকা করল। গোষ্ঠীর লোকেরাও শুনে ক্ষেপে গেল। তাদের গোষ্ঠীর ছেলেকে চোর বলেছে কম কথা না। এত বড় সাহস এই গ্রামে কার আছে। আমার বন্ধুরা পরামর্শ দিল, এবার চুরি নয়। এবার ডাকাতি করতে হবে। ক্ষুদ খেয়ে পেট নষ্ট করতে নেই। পেট নষ্ট করতে হয় ভাল কিছু খেয়ে। ওদের কথায় ডাকাতিতে নেমে গেলাম। হাতে অস্ত্র থাকলে নিজেকে রাজা রাজা মনে হয়। আমাদের হাতে ভারী কোন অস্ত্র না থাকলেও চাইনিজ কুরাল এবং রামদা থাকত। এক রাতের ঘটনা, আমরা মালদার পার্টি ধরার আশায় বসে আছি। মালদার পার্টি আসছে না। বসে বসে মশার কামড় ক্ষেতেও ভাল লাগছে না। কি যে করি। মাথায় চুলগুলি ছিড়ছি। সাদা পাঞ্জাবি পড়া এক লোক আসতে দেখলাম। আমরা সবাই সতর্ক হয়ে প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। উনাকে দেখেই বুঝা গেল উনি সৌদি আরব থেকে এসেছেন। আমরা বড় দান পাবার আশায় উনাকে ধরলাম। উনি আমাদের দেখেই আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমরা উনার হাত থেকে ব্যাগ নিলাম। পকেট থেকে টাকা-পয়সা নিলাম। উনি কিছুই করলেন না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার মাথা তখন ঠিক ছিল না। আমার মাথায় শুধু ডাকাতির চিন্তা ছিল। বাড়ীতে এসে দেখি যাকে আমরা রাস্তায় ধরেছিলাম তিনি আমার বাবা। আমি আমার বাবাকে চিনি। ডাকাতির সময় সেন্স কোথায় ছিল বলতে পারব না। বাবাকে দেখেও কেন চিনলাম না বুঝেই পেলাম না। বাবা কিছু বললেন না। সবাই দেখতে আসল। কারো সাথেই তিনি কোন কথা বললেন না। সবাই ভাবল, বড় কোন দুঃসংবাদ হয়েছে তাই তিনি কারো কাছে বলতে চাচ্ছেন না। মা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলেন। মা বললেন, বাবা তকে আমি অনেক ভালবাসি। আজ থেকে তর প্রতি যত মায়া ছিল সব উঠে গেছে। তই যে আমার ছেলে তা বলতে আমার অনেক লজ্জা লাগছে। আশা করি তুই আমার সাথে কখনো কথা বলবি না। তর ভরণপোষণের কোন সমস্যা হবে না। কাজের ভূয়া আছে। সে তর সবকিছু দেখবে। তর সাথে আজকে আমার মা-ছেলের সম্পর্ক শেষ। তুই যদি আমাকে কখনো মা বলে ডাকিস অথবা আমার রুমে আছিস তাহলে তুই মানুষের বাচ্চা না। তুই হবি একটা কুকুরের বাচ্চা। আমি যতই খারাপ হই না কেন, আমার আতœসম্মান অনেক বেশি ছিল। আমার আতœসম্মানটা হয়ত আমার গোষ্ঠীই আমাকে শিখিয়েছে। মার সাথে এর পর কোন কথা বলি নি। মাকে দেখতেও যাই নি। ভূয়া আমাকে রান্না করে দিত। আমি খেয়ে চলে যেতাম। আমা রুমটিও ছিল আলাদা। আমার রুমে আমার ইচ্ছামত থাকতাম। বাবা মারা গিয়েছিল। বাবা কেন মারা গিয়েছিল আমি জানি না। তবে সবাই বলে, আমার জন্যই নাকি বাবা মারা গেছেন। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন আমার সাথে একটিও কথা বলেন নি। এমনকি আমার চেহারাও কোনদিন দেখতে আসেন নি। আমি যে তাদের একটা সন্তান এই কথাটাই তারা ভূলে গিয়েছিলেন। মার সাথে সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর থেকেই আমি ভাল হয়ে গিয়েছিলাম। সব খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করেছিলাম। তবুও সবাই আমাকে খারাপ চোখেই দেখত। গ্রামে বড় ধরণের ডাকাতি হল। পুলিশের কাছে আমার নামে রিপোর্ট গেল। আমাকে ধরতে পুলিশ বাড়িতে এল। আমাদের গোষ্ঠীর তারা কিছুতেই আমাকে পুলিশে দিল না। গোষ্ঠীর লোকেরা আমার পক্ষে নিল। পুলিশ আমাকে না নিতে পেরে চলে গেল। যারা আমার বিরোদ্ধে মামলা করেছিল তারা অনেক শক্তিশালী ছিল। তাই তারা রণে ইস্তফা দিল না। আমার গোষ্ঠীর লোকেরাও কম না। তারাও আমাকে পুলিশের হাতে তোলে দিল না। আমাকে পালা করে গোষ্ঠীর লোকেরা পাহাড়া দিতে লাগল। সর্বশেষ আমাকে ধরতে না পেরে বলল, মার সাথে কথা বলবে। মা যদি বলে তাহলে তার ছেলেকে মামলা থেকে খালাস দেওয়া হবে। সবাই ভাবল তাহলে কোন কথা নেই। মা তার ছেলের বিরোদ্ধে বলতে পারে না। যে যত বড় অপরাধীই হোক। তার ছেলেকে সে বাঁচাতে চাইবেই। মাকে আনা হল। মা বললেন, তার ছেলে ডাকাতি করতে পারে। থানা হাজতে নিয়ে যেন জিজ্ঞেস করা হয়। আমি এবং গোষ্ঠীর লোকেরা অবাক হল। পুলিশও অবাক হল। পুলিশ বলল, আপনি কি সুস্থ মস্তিষ্কে বলছেন। মা বলল, হ্যাঁ আমি সুস্থ মস্তিষ্কে বলছি। পুলিশ আমাকে নিয়ে চলে গেল। আমার মারাতœক মন খারাপ হল। মার সাথে কথা হয় না, দেখা হয় না ঠিক আছে। মা যে আমার বিরোদ্ধে সাক্ষি দিতে পারে তা আমার কল্পনাতেই আসে নাই। আমাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। আমি ডাকাতি করি নি। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে লাভ কি? আমাকে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিল। গ্রামের সবাই জানল আমি ডাকাতি করি নি। মার প্রতি আমার বিতৃষ্ণা বেড়ে গেল। মাকে অনেক অনুভব করতাম। ভূয়ার রান্না খাওয়া যায় না। উনার কাজ কর্মের মধ্যেই দেখতাম কৃত্রিমতা নিয়ে কাজ করতেন। মার ক্ষেত্রে এমনটা কখনো ঘটেনি। প্রথম প্রথম মাকে প্রচন্ড অনুভব করলাম। এতটাই অনুভব করতাম যে, বারবার ভাবতাম মার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেই। কয়েকবার গিয়েও ছিলাম। জেলে যাওয়ার পরে শরীলে আরও জিদ চেপে যায়। নিজেকে আরও খারাপ করতে চেষ্টা করি। কিছুতেই পারি না। খারাপ না হলে ভাল হতে হয়। মাঝামাঝি বলে কিছু থাকে না। আমি আমার ইচ্ছার বিরোদ্ধে ভাল হতে থাকি। পড়ালেখা থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই সফলতার স্বাদ পেতে থাকি। শহরে গিয়ে পড়ালেখা করি। পড়ালেখা করে ডক্টরেট ডিগ্রি পাই। নিউক্লিয়াসের উপর গবেষণা করে নোবেল পুরষ্কারও পাই। মা তবুও কথা বলে না। মার সাথে তবুও দেখা হয় না। এর মধ্যে মার সাথে অনেকবার দেখা করতে যাই। তিনি দেখা দেন না। আমাকে নিয়ে এখন আমার গোষ্ঠী অনেক সম্মানিত বোধ করে। আমাকে সারা দেশের মানুষ এখন চিনে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলে, তোমার মার মত সম্মানিত মহিলা এই দেশে আর নেই। তুমি জাতীর জন্য যা করেছ তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমাকে টিভিতে, পত্রিকায়, সংবাদপত্রে দেখায়। আমার মা কি আমাকে দেখে আমি জানি না। আমার মা কি আমাকে চিনতে পারবে তাও জানি না। মার সাথে দেখা হয় না সেই ছোট থেকে। বছর হিসেব করলে হাতের আঙ্গুল শেষ হয়ে যেতে পারে। বছর হিসেব করি না। করতেও ইচ্ছে করে না। হঠাৎ করেই মা মারা যায়। আমি মাকে দেখতে আসি। অনেক বছর পর মার রুমে প্রবেশ করি। রুমে দেখি একটা চিঠি লেখা। আমার খবর যতটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সব কটি পত্রিকার কাটিং আমি মার বিছানার তুষোকের নিচে পাই। মার মোবাইল ঘেঁটে দেখি, আমাকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়ার সময় সে ভিডিও গুলি তোলা হয়েছিল তার সব গুলো ভিডিও মায়ের মোবাইলে ছিল। চিঠিতেটা পড়ি। চিঠিতে লেখা বাবা, তকে আমি ক্ষমা করেছি। আমার বারবার মনে হয়েছে, আমি যদি তকে ভালবাসতে যাই, আদর করতে যাই তাহলে তুই খারাপ হয়ে যাবি। আমি আমার ছেলেকে খারাপ হয়ে যেতে দিতে পারি না। তাই অনেক আক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও তর সাথে কথা বলতে বা দেখতে যাই নি। আমি জানতাম, আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। তকে দেখতে মন চাইছিল। তকে ফোন করার জন্য নাম্বার নিয়ে হাজার হাজার ঘন্টা সময় ব্যয় করেছি তবুও ফোন করি নি। তুই যদি আবার খারাপ হয়ে যাস। বাবা, আমার শেষ অনুরোধ তুই যতটা সফলতা পেয়েছিস সেই সফলতাটা ধরে রাখিস। তর প্রতি আমার দোয়া রইল। আমি তকে অনেক ভালবাসি। তুই আমার কলিজা ছেড় ধন। তুই সুখে থাক এটাই আমি চাই।
কসবা, বি-বাড়ীয়া।
বিষয়: বিবিধ
৯৫৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন