মায়ের কাছে শেষ চিঠি

লিখেছেন লিখেছেন কামরুল হাছান মাসুক ০৭ মার্চ, ২০১৩, ০৯:৫৩:১৪ সকাল

মায়ের কাছে শেষ চিঠি

কামরুল হাছান মাসুক

মা, তুমি মনে হয় আমার প্রতি অনেক রাগ করে আছ। আমি তোমাকে কেন ফোন করি না, আমি কেন বাড়িতে আসি না। মা, সত্য বলছি। আমি চরম কান্তিলগ্ন সময় অতিক্রম করছি। আমি কি করছি তুমি যদি শুন তাহলে তোমার ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে পাগল হয়ে যাবে। তোমার ছেলেকে তুমি চিন। তোমার ছেলে মা বক্ত এটাও জান। কেন তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না তা ও হয়ত আন্তাজ করতে পারছ। আন্তাজ যদি না করতে পার তাহলে তোমাকে বলি, তুমি ইসলামকে অনেক পছন্দ কর। আল্লাহকে বিশ্বাস কর। নবীকে আদর্শ হিসেবে মান। তুমি যদি শুন তোমার ইসলামকে বিতর্কিত করা হচ্ছে। আল্লাহকে অপমান করা হচ্ছে। নবীকে নিয়ে হাসিতামাসা করা হচ্ছে তাহলে তোমার মনের অভিব্যক্তি কি হবে? আমি জানি তোমার মনের অভিব্যক্তি কি হবে? কাউকে কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু মনে মনে এত কষ্ট পাবে যেই কষ্ট কোন পাথরও যদি দেখত তাহলে সে গলে পানি হয়ে যেত। আজকে এগুলিই হচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করতে চাইছে না। কেউ বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাচ্ছে না। মা, আমি পারছি না। আমি আল্লাহ, রাসূল, ইসলামকে অপমান সহ্য করতে পারছি না। আমার বুকের ভিতর রক্তহরণ হচ্ছে। আমি কাউকে দেখাতে পারছি না। যেই ইসলামকে বুকে ধারণ করে রেখেছি, অন্তরের মনিকুঠরে আটকে রেখেছি, জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে যাকে অনুসরণ করেছি তাকে অপমানিত হতে দিতে পারি না। তাকে অপমানিত করলে মৃত্যু হওয়ার আগেই মৃত্যু বরণ করব। তুমি তোমার ছেলেকে কাপুরুষের মত মৃত্যু বরণ হতে দিতে পার না। মা, বলতে পার একটা ফোনত করতে পারিস? মা, তোমাকে কি বলব, তোমাকে যদি ফোন করি তাহলে গোয়েন্দারা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমাকে ধরে ফেলবে। আন্দোলনের নামার আগেই আমাকে মেরে ফেলবে। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। তবে একবার একটা শ্লোগান অন্তত দিয়ে যাই। আল্লাহু আকবর বলে একটা শ্লোগান দিয়ে যাই। কবরে গেলে আল্লাহ যদি ধরে তাহলে বলতে পারব, আল্লাহ তোমার জন্য একটা শ্লোগান অন্তত দিয়ে এসেছি। মা, কি বলব। তুমি যদি ঘটনা শুন, তাহলে অজ্ঞান হয়ে যাবে। আমাদের ভাইদের বুটের তলায় পৃষ্ট করে মেরে ফেলছে। চোখগুলো নখ দিয়ে তোলে ফেলছে। হাতুরি দিয়ে হাত, পাঁ থেতলে ফেলছে। জীবন্ত একটা মানুষকে মেরে তার উপর নিত্য করছে। তাজা রক্তে রাজপথ ভেসে যাচ্ছে। চারদিকে শুধু মানুষের চিৎকার। হাহাকার। লাশের গন্ধে বমি আসতে চাইছে। রাস্তায় রাক্তায় মানুষের হাত পাঁ, চোখ, নাক পরে আছে। যুদ্ধ পীড়িত রাষ্ট্রেও এমন ঘটনা দেখা যায় না। অবস্থা এতই খারাপ যে, যে সচক্ষে এই ঘটনাগুলি দেখতে সে স্থির থাকতে পারছে না। রাস্তায় নেমে আসছে। নিজের তাজা প্রাণকে বিলিয়ে দিচ্ছে। মা, জান আমাদের হাতে কোন অস্ত্র নেই, আমাদের হাতে ভারী কোন জিনিষও নেই। আমরা মোকাবেলা করছি শুধু শ্লোগান দিয়ে। আমাদের পাশে মা কেউ নেই। পত্রিকা, মিডিয়া, জনগণ। মা কেউ নেই। জনগণ হয়ত ইসলাম ভালবাসে। কিন্তু তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত। আমাদের নামে সবাই অবাস্তব জিনিষ ছড়াচ্ছে। আমরা কাউকে কিছু করছি না তবুও ছড়াচ্ছে। মা জান, আমাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলি যতটা সম্মান করি, অন্য ধর্মের উপসনালয়গুলোকেও ততটা সম্মান করি। তবুও ওরা নিজেরা অসম্মান করে আমাদের নাম দিচ্ছে। মা জান, আমাদের শক্তি নেই। আমাদের কিছুই নেই। আমাদের একটা জিনিষই আছে তা হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য। সেই সাহায্যর আসায় আছি। আমরা কারো কাছে সাহায্য চাচ্ছি না। শুধু একজনের কাছেই সাহায্য চাচ্ছি। আশা করি তিনি আমাদের সাহায্য করবেন। তিনিই একমাত্র স্রষ্টা যে মজলুমের পক্ষে থাকেন। তোমাকে যখন চিঠি লিখছি আমার মনে হচ্ছে আমার রক্ত দিয়ে তোমাকে চিঠিটি লিখছি। প্রতিটি লেখাতে এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে রক্ত ব্যয় হচ্ছে। মা জান, আমাদের সাথে যারা ছিলেন তারা অনেকেই নিহত হয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন তাদের কারো চোখ নেই। কারো হাত, পাঁ, বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ নেই। তাদের যদি শান্ত্বনা দিতে যাই তাহলে তারা বলে, ভাই শান্ত্বনা কেন দিতে এসেছেন? আমরা এই জীবনটা চেয়েছিলাম। আমরা বদর যুদ্ধ, ওহুদ যুদ্ধ দেখিনি, আমরা নবীর দন্ত মোবারক শহীদ হয়েছে তাও দেখিনি, পাথরের আঘাতে আঘাতে নবী ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন তাও দেখিনি। আমরা শুধু শুনেছি। শুনে চোখের জল ফেলেছি। আজ আমরা আল্লাহ, নবীকে অসম্মানের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছি। নবীর পক্ষে শ্লোগান দিচ্ছি। শহীদ হচ্চি। পঙ্গুত্ব বরণ করছি। এর চেয়ে খুশি পৃথিবীতে আর কি কিছু হতে পারে। মা, জান না। ওদের কথা শুনলে শরীলে বিদ্যুতের মত চার্জ আসে। কোথায় থেকে যে এত চার্জ আসে তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না। এ চার্জ অন্যরকম চার্জ। এ চার্জ আসলে মৃত্যুটাকে অনেক সুখের মনে হয়। অনেকেই মা আত্মহত্যা করতে চায়। জীবনটাকে অর্থহীন মনে করে আত্মহত্যা করতে চায়। মা, আমরা জীবটাকে অনেক ভালবেসে, শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য জীবনটাকে উৎসর্গ করতে চাই। কতটুকু পারব জানি না। তবে মনে হয় বেশি সময় নেই। জীবনের আয়ূ হয়ত শেষ হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর ঘন্টা চারদিকে বাজছে। তবুও বলি, মা আমার জন্য দোয়া করো। তুমি হয়ত ভাবছ, তোমার ছেলেকে এত বড় করলে তোমাকে কিছুই দিতে পারল না। তোমাকে আর্থিকভাবেও সাহায্য করতে পারল না। সারা জীবন শুধু চিন্তাই দিয়ে গেছে। মা, সত্যি বলছি। তুমি তোমার ছেলের জন্য যা করেছ তার সবটাই পাবে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি সব ফেরত দিব। ইহকালে হয়ত সম্ভব হবে না। পরকালে আমি সব তোমাকে ফেরত দিব। তুমি জান, আমি মিথ্যা কথা বলি না। এটাও কথার কথা না। এখন হয়ত বলবে, আমার স্ত্রী এবং সন্তানদের কি হবে? আমি জানি তারা অনেক কষ্ট পাবে। তাদের আর্থিকভাবে অনেক সমস্যা হবে। পৃথিবীটা কার এটা নিশ্চই জান। পৃথিবীটা হচ্ছে আল্লাহর। উনার কাছে আমি তাদের সবাইকে রেখে গেলাম। উনি তাদের দেখবেন। একজন এমপি মন্ত্রির কাছে যদি তাদের রেখে যেতাম, তাহলে সম্ভম খানির ঘটনা ঘটত। অন্য কারো কাছে রেখে গেলেও হয়ত এর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা ঘটত। এমন এক জনের কাছে রেখে গেলাম যে সবচেয়ে নিরাপদ। উনি যদি কারো দিকে তাকান তাহলে তার সব কিছু হয়ে যায়। আমি জানি, তোমার পুত্রবধূ সব গুছিয়ে নিতে পারবে। ওর একটা চাকুরি হয়েছে তা শুনেছি। চাকুরির টাকা দিয়ে ভাল করেই চলতে পারবে। ছেলেটা বরাবরের মত ভাল রেজাল্ট করছে তাও শুনতে পেরেছি। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে তা তোমাদের বলে বুঝাতে পারব না। তোমার কাছে একটাই আবদার, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। সবার কাছ থেকেই ক্ষমা চাচ্ছি। তোমার কাছ থেকেও চাইলাম। যদি কষ্ট দিয়ে থাকি ক্ষমা করে দিও। পৃথিবীতে যদি কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকি হয়ত তোমাকেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছি। জানি, তোমাকে পাহাড় পরিমান কষ্ট দিলেও তুমি মনে কিছু রাখবে না। তবুও মা, আমাকে ক্ষমা করে দিও। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ আল্লাহর হাতে। তবুও কেন জানি মনে হচ্ছে তোমার হাতে চিঠিটি পৌছার আগেই আমি মারা যাব। আমার জন্য কোন চিন্তা করো না। অনন্তকাল যে সুখের চিন্তা করে তার জন্য সত্তর আশি বছর কিছুই না। বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ হয়ে গিয়েছিল। আর কতদিনই বা বাঁচতাম। মা জান, অনেকে আরো আগেই মারা যায়। জন্মের সময়ও তো অনেক মানুষ মারা যায়। অনেকে এমনিতেই হঠাৎ করে হার্ড এ্যাটাকে মারা যায়। আমি মা, এমন একজনের জন্য মারা যাচ্ছি যিনি এই মহাবিশ্বের মালিক। আমার মত সুভাগ্যমান মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। আমি চিঠি পাওয়ার আগেই যদি শুন, আমি মারা গেছি তাহলে কাঁদবে না। জানি, যতই বলি কাঁদবে না। তবুও কাঁদবে। মা তোমাদের সকলের জন্য বলি, আমি এমন একটি জীবন নিয়ে মারা যাব যার দাম হয়ত পৃথিবীর কাছে এক বিন্দুরও দাম নেই। এটার যে কত দাম তা কবরে না গেলে বুঝা যাবে না। আমার জন্য মা দোয়া করো। আমার সময় শেষ। আমাকে এখন মিছিলে যেতে হবে। বিদায় মা।

কসবা, বি-বাড়ীয়া।

বিষয়: বিবিধ

২৭৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File