হজ্বের শিক্ষা ও মুসলমানদের ব্যর্থতা
লিখেছেন লিখেছেন নূরা রাজাকার ২৭ মার্চ, ২০১৩, ০১:৫৩:৫০ রাত
শ্রেষ্ঠতম প্রশিক্ষণ
মুসলিম বিশ্বে বছর ঘুরে প্রতি বছর আসে হজ্ব। জিলহজ্ব মাসের ৮ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত লাগাতর নানা পর্বের মধ্য দিয়ে পালিত হয় হজ্ব। কিন্তু কি তার শিক্ষা? কি এর দর্শন ও তাৎপর্য? কেন বহু অর্থ ও বহু শ্রম ব্যয়ে বিশ্বের নানা দেশ থেকে তিরিশ লাখেরও বেশী মানুষ মক্কায় হাজির হয়? সামর্থবানদের উপর কেন এটি ফরজ? ক্বাবাকে ঘিরে কেন ৭ বার তাওয়াফ? কেন মিনায় তিন দিন অবস্থান? আরাফাতে কেন মহাজমায়েত? মোজদালেফায় খোলা অকাশের নিচে কেন শয়ন? শয়তানের স্তম্ভে কেন তিন দিন ধরে পাথর নিক্ষেপ? কেন সাফওয়া ও মারওয়ার মাঝে নারী-পুরুষ,যুবক-বৃদ্ধার দৌড়াদৌড়ি? সেটিও একবার নয়,সাতবার!কেন লক্ষ লক্ষ পশু কোরবানী? এগুলি কি নিছক আচার? এগুলির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ কোন দর্শন ও উদ্দেশ্য থাকলে সেটিই বা কি? এত অর্থব্যয়, শ্রমব্যয় ও সময়ব্যয় যে ইবাদতের পিছনে তা থেকে মুসলিম উম্মাহই বা কতটুকু লাভবান হচ্ছে? প্রতিবছর হাজী হয়ে ফিরছে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ,তাতেই বা কি কল্যাণ হচ্ছে তাদের? এগুলি অতিশয় ভাববার বিষয়। কিন্তু মুসলমানদের মাঝে সে ভাবনা কোথায়?
যে পাঁচটি খুঁটির উপর ইসলামের ভিত্তি তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি হলো হজ্ব। তাই হজ্বকে বাদ দিয়ে ইসলামের পূর্ণ ইমারত নির্মাণ করা যায় না। এবং ইসলামের এ বিশাল ইমারতটি ধ্বসিয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজন নেই পাঁচটি খুঁটির সবগুলি ধ্বংসের,যে কোন এই একটি খুঁটির বিনাশই সে জন্য যথেষ্ট? আল্লাহতায়ালার কাছে মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়,সে মহান আল্লাহর খলিফা। খলিফা রূপে তার দায়িত্ব পৃথিবীর বুকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের। মানুষ আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্ঠি শুধু এ পরিচয়ের কারণেই, দৈহিক শক্তি বা অন্য কোন গুণের কারণে নয়। আর সে পরিচয়ে বেড়ে উঠা ও টিকে থাকার জন্য চাই লাগাতর প্রশিক্ষণ। সে প্রশিক্ষণের পূর্ণ নির্দেশনা এসেছে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। ইসলাম সে প্রশিক্ষণেরই পূর্ণ প্যাকেজ। মহান আল্লাহতায়ালা চান,প্রতিটি ঈমানদার ব্যক্তি সে প্রশিক্ষন নিয়ে বেড়ে উঠুক। কারণ,একমাত্র সে ভাবে বেড়ে উঠার মধ্যেই মু’মিন ব্যক্তির সফলতা। তখন সে সফল হয় খেলাফতের দায়িত্বপালনে। আল্লাহপাক তো মু’মিনের জীবনে সে সফলতাটিই দেখতে চান। মু’মিন জান্নাত পাবে খেলাফতের দায়িত্ব পালতে সফল হওয়ার বিণিময়ে। যার মধ্যে সে প্রশিক্ষণ নাই,বুঝতে হবে তার মধ্যে আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্বপালনের সামর্থও নাই। আর সে প্রশিক্ষণের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো হজ্ব। তাই সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যার মধ্যে হজ্ব নাই,বুঝতে হবে তার মধ্যে আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনে আগ্রহ নেই। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “সামর্থ থাকা সত্বেও হজ্ব না করে যার মৃত্যু হলো সে খৃষ্টানরূপে না ইহুদীরূপে মারা গেল তা নিয়ে তাঁর কিছু যায় আসে না।” অর্থাং তার জন্য নবীজী (সাঃ)সুপারিশ করতে রাজি নন। বোখারী শরীফের হাদীসে বর্নীত হয়েছে, নবীজী (সাঃ) হযরত আয়েশাকে বলেছেন,হজ্বই তাঁর জন্য জিহাদ।
ইসলামে কোনটি শ্রেষ্ঠ এবাদত তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন। সে প্রশ্ন জেগেছিল ইমাম হযরত আবু হানিফার (রহ) মনেও। হজ্ব সমাপনের পর তিনি বলেছেন,হজ্বই শ্রেষ্ঠ ইবাদত। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (রহ) বলেছেন, যাদের মনে আল্লাহর প্রতি প্রবল ভালোবাসা,তারা তৃপ্তি পেতে পারেন হজ্বে গিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো,হজ্ব কেন শ্রেষ্ঠতম ইবাদত? কেনই বা এটি আল্লাহর আশেকদের আত্মতৃপ্তি লাভের মাধ্যম? ইসলামে ইবাদত মূলতঃ দৈহিক,শারিরীক ও আত্মীক। একমাত্র হজ্বেই ঘটে সবগুলোর সমন্বয়। হজ্বের শ্রেষ্ঠত্ব এতেই। কালেমায়ে শাহাদত উচ্চারনে দৈহিক কসরত নেই। এতে পাহাড়-পর্ব্বত, বিজন মরুভুমি, নদনদী বা সমুদ্র-মহাসমুদ্র অতিক্রমেরও প্রয়োজন পড়ে না। তেমন কসরত নেই জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নামায আদায়ে। এতটা কষ্টস্বীকার, অর্থব্যয় ও সময়ব্যয় হয় না রোজাতেও। যাকাতে অর্থব্যয় হলেও হজ্বের ন্যায় অর্থব্যয় নেই। শ্রমব্যয় এবং সময়ব্যয়ও নেই। বস্তুতঃ হজ্বের মধ্যে রয়েছে ইবাদতের সমগ্রতা তথা পূর্ণ প্যাকেজ। এযুগে বিমানযোগে হজ্বের যে সুযোগ সেটি সাম্প্রতিক। বিগত চৌদ্দ শত বছরের প্রায় সমগ্রভাগ জুড়ে মুসলমানরা হজ্ব করেছে পায়ে হেটে বা উঠ,ঘোড়া ও গাধার মত যানবাহনে চড়ে। তখন দৈহিক শ্রমের ভারে হজ্বে গিয়ে অনেকেই আর নিজ ঘরে ফিরে আসতেন না,পাড়ী জমাতেন পরপারে। তাই সে আমলে শেষ বিদায় নিয়ে দূর-দেশের লোকেরা মক্কার পথে বেরুতেন। হজ্ব পালনে যে প্রচন্ড শারিরীক কসরৎ তার মূল্যয়াণ করতে হবে সে আঙ্গিকেই।
হজ্ব গড়ে হিজরতের অভ্যাস ইসলামের আরেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো হিজরত।আল্লাহর খলিফা রূপে গড়ে তোলার এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণও। হিজরত এখানে নিজ ঘর,নিজ পরিবার-পরিজন,নিজ ব্যবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পদ পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম মক্কা ছেড়ে মদিনায় গিয়ে ঘর বেঁধেছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর জন্মভূমি ছেড়ে ফিলিস্তি,মিশর ও হিজাজের পথে পথে হাজার হাজার মাইল ঘুরেছেন। হিজরত করেছেন হযরত ইউসুফ (আঃ),হযরত ইয়াকুব (আঃ)ও হযরত মূসা (আঃ)এর ন্যায় আরো বহু নবী-রাসূল। নিজ দেশ,নিজ ঘর,নিজ ব্যবসা-বাণিজ্য ও পরিবার-পরিজনের বাঁধনে যে স্থবির জীবন তাতে আবদ্ধ হলে আল্লাহর পথে চলাটি অসম্ভব। হজ্ব গড়ে তোলে সে স্থবিরতা ছিন্ন করে হিজরতের অভ্যাস। ব্যক্তিকে তার আপন ঘর থেকে হজ্ব বাইরে নিয়ে আসে। জীবনে আনে গতিময়তা। হিজরত ছাড়া উচ্চচতর জীবনবোধ ও সভ্যতার নির্মান কি সম্ভব? ইতিহাসের সবগুলো উচ্চতর সভ্যতা তো মহাজিরদেরই সৃষ্টি। বলা হয়ে থাকে,‘সফর নিছফুল ইলম” অর্থঃ ভ্রমন হলো জ্ঞানের অর্ধেক। জ্ঞানার্জন ইসলামে ফরয। হজ্ব তো সফরকেও অনিবার্য করে তোলে। এভাবে সুযোগ করে দেয় অন্যদের দেখার এবং তাদের থেকে শেখার। হজ্ব দেয় নানা দেশের নানা জনপদের বিচিত্র পরিবেশে চিন্তাভাবনা ও ধ্যানমগ্নতার সুযোগ। সকাল থেকে সন্ধ্যা,সন্ধ্যা থেকে সকাল এরূপ বৃত্তাকারে ঘূর্ণায়নমান যে ব্যস্ত জীবন,সে জীবনে মহত্তর লক্ষ্য নিয়ে ভাববার অবসর কোথায়? অথচ জীবনের সঠিক উপলদ্ধি ও মূল্যায়নে চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।ইসলামে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। কোরআনে বহু আয়াত নাজিল হয়েছে শুধু এর গুরুত্ব বোঝাতে। মোজাদ্দিদ শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভি এবং বাংলার হাজী শরিয়াতুল্লাহ,দুদু মিয়া ও তিতুমীরের মত মহান ব্যক্তিবর্গ তাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবক ও জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা পেয়েছেন হজ্বে গিয়ে। হজ্ব শেষে তারা নিজ দেশে ফিরে এসেছেন এক ভিন্ন ও বিপ্লবী মানুষ রূপে। হজ্বে গিয়ে তারা পেয়েছিলেন আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনের এক মহৎ প্রশিক্ষণ।
যাদের জীবনে আল্লাহর পথে গতিময়তা এবং ভাবনা নাই,তাদের জীবনে সিরাতুল মোস্তাকিমপ্রাপ্তিও নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা,সন্ধ্যা থেকে সকাল এক আমৃত্যু চক্রে তারা বন্দী। এ বন্দীদশাতেই অবশেষে তারা একদিন মৃত্যুর পথে হারিয়ে যায়। অসংখ্য উদ্ভিদের ন্যয় এভাবেই এ অবধি হারিয়ে গেছে শত শত কোটি মানুষ। মহান আল্লাহতায়ালা এ ব্যস্ত মানুষকে সব ব্যস্ততা ফেলে তার ঘরে জমায়েত হওয়ার ডাক দেন। মিনা,আরাফাত ও মোযদাফিফার অবস্থান সে মারেফাত লাভ তথা ধ্যান মগ্ন হওয়ার সুযোগ করে দেয়। আল্লাহর ডাকে এভাবে তাঁর ঘরে গিয়ে লাব্বায়েক তথা ‘আমি হাজির’ বলার মাঝে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে যে একাত্মতা ঘটে তা কি আর কোন ইবাদতে সম্ভব? আর এ একাত্মতার মাঝে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাহর জীবনের মূল পাঠটি তার চেতনার মাঝে মিশিয়ে দিতে চান। সেটি হল আল্লাহর প্রতি হুকুমে লাব্বায়েক অর্থাৎ ‘আমি হাজির বলা। একজন একনিষ্ট গোলামের এর চেয়ে উত্তম আচরণ আর কি হতে পারে? এর বিপরীত হল অবাধ্যতা বা বিদ্রোহ,যা ব্যক্তির জীবনে পথভ্রষ্টতা এবং পরিণামে জাহান্নাম ডেকে আনে। কথা হলো,যে মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে আল্লাহর অবাধ্যতা,আল্লাহর সার্বভৌমত্ব যেখানে ভূলুন্ঠিত এবং প্রতিষ্ঠিত যেখানে মানুষের সার্বভৌমত্ব এবং মুসলমানের রাজনীতি,পোষাক-পরিচ্ছদ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি হলো যেখানে আল্লাহর বিরুদ্ধে অবাধ্যতার প্রতীক -সেখানে লক্ষ লক্ষ হাজীর মুখে লাব্বায়ক উচ্চারনের মূল্য কতটুকু? মহান আল্লাহ কি বান্দাহর এমন ফাঁকা বুলিতে খুশি হন?
দেয় আল্লাহর হুকুমে ‘লাব্বায়েক’ বলার বল
ঈমান হলো আল্লাহর ডাকে সর্বাবস্থায় ‘লাব্বায়েক’ (আমি হাজির) বলার সামর্থ।সে সামর্থটি না থাকলে আল্লাহর দ্বীন ও তাঁর নাযিলকৃত কোরআন বোঝা যেমন অসম্ভব,তেমনি অসম্ভব হলো সে কোরআনী হুকুমের প্রতিপালন ও পরিপূর্ণ মুসলমান হওয়া। মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ও সবচেয়ে বড় অসামর্থতা হল এটি। এই একটি মাত্র অসামর্থতাই মানব জীবনের সকল অর্জনকে পুরাপুরি ব্যর্থ করে দেয়। আজকের মুসলমানরা যে কোরআনকে বুঝতে ও তার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে তার মূল কারণ হলো আল্লাহর হুকুমে লাব্বায়েক বলার এ অসামর্থতা। তাদের সামনে আল্লাহর কোরআন আছে,কোরআনের হুকুমও আছে এবং নবীজী (সাঃ)র মহান সূন্নতও আছে, কিন্তু যা নাই তা হলো সে হুকুমের ডাকে লাব্বায়েক বলার সামর্থ। এমন অসামর্থতা আযাব ডেকে আনে। শুধু আখেরাতে নয়,দুনিয়াতেও। অশিক্ষা,দারিদ্র্য ও দুর্বৃত্তিতে মুসলমানগণ যে বিশ্বে রেকর্ড গড়ছে তার মূল কারণ তো এটি। ফলে মুসলিম বিশ্বে তেলগ্যাস ও ধন-সম্পদ বিপুল ভাবে বাড়লেও পরাজয় ও অসম্মান এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। নিছক কোরআন পাঠ ও কোরআনের মুখস্থ্য তেলাওয়াতে যেমন সে সামর্থ বাড়ে না। তেমনি বাড়ে না নিছক নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত পালনেও বাড়ে না। কোরআন-পাঠ ও নামায-রোযা পালন এমন কি মোনফেক,ফাসেক বা জালেমের পক্ষেও সম্ভব।
আল্লাহপাক চান,তাঁর প্রতিটি হুকুমের প্রতি ঈমানদারের আনুগত্য ও অঙ্গিকার প্রকাশ পাক তার প্রতিটি কথা,কর্ম ও আচরণে। ইসলাম সেটিকেই মোমেনের আজীবনের অভ্যাসে পরিণত করতে চায়। তাছাড়া যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম পালনে “লাব্বায়েক” বলতে পারে না সে ব্যক্তি তার নিজ বিবেকের ডাকে বা কোন ন্যায় কর্মে লাব্বায়েক বলতে পারে? আল্লাহর হুকুমে লাব্বায়েক বলার অভ্যাস গড়ে তোলার স্বার্থেই নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাতের ন্যায় ইবাদত পালনে রয়েছে বাধ্যবাধকতা। মু’মিনের জীবনে আনুগত্যপূর্ণ সে শ্লোগানটি হলো ‘লাব্বায়েক’। যেখানেই আল্লাহর হুকুম,সেখানেই সে হুকুমের প্রতিপালনে বলে উঠে “আমি হাজির”। সে যেমন আযানে লাব্বায়েক বলে,তেমনি জিহাদের ডাকেও লাব্বায়েক বলে।
ঈমানদারের পুরস্কার যেমন বিশাল,তেমনি দায়বদ্ধতাও বিশাল। সে বিশাল পুরস্কারটি হলো অনন্ত অসীম কালের জন্য অফুরন্ত নিয়ামত ভরা জান্নাতলাভ। আর দায়বদ্ধতা হলো,আমৃত্যু আল্লাহর সৈনিক রূপে কাজ করা। আল্লাহতায়ালা ঈমানদারের জানমাল কিনে নেন জান্নাতের বিনিময়ে। মহান আল্লাহর সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে,“নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনের জান ও মাল এ মূল্যে কিনে নিয়েছেন যে তাদের জন্য হবে জান্নাত।(এবং বিনিময়ে)তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে করে,সে যুদ্ধে তারা (শত্রুদের) হত্যা করে এবং (নিজেরাও শত্রুদের) হাতে নিহত হয়।” –(সুরা তাওবাহ, আয়াত ১১১)।
মু’মিন হওয়ার অর্থ তাই মহান আল্লাহর ক্রয় করা সৈনিকে পরিণত হওয়া। তখন তার উপর একমাত্র আল্লাহর মালিকানার প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। এমন সৈনিক তখন কোন রাজা, স্বৈরাচারি শাসক বা সেক্যুলার নেতার ডাকে লাব্বয়েক বলে না।তাদের ডাকে যুদ্ধও করে না। যুদ্ধ করে না কোন বর্ণ,ভাষা বা দেশের জন্য। বরং যুদ্ধ করে একমাত্র আল্লাহর দ্বীনের বিজয় আনতে। সে সৈনিকদের প্রতি হুকুমদাতা হলেন একমাত্র মহান আল্লাহ। আজকের মুসলমানদের প্রতি মহান আল্লাহর সে হুকুম আসেটি কোরআনী ফরমানের মধ্য দিয়ে। আল্লাহর ডাকে সর্বাবস্থায় লাব্বায়েক বলতে গিয়ে ইব্রাহিম (আঃ) পিতা-মাতা,ঘরবাড়ী,এমনকি দেশছাড়াও হয়েছেন। বিচ্ছিন্ন হয়েছেন একমাত্র পুত্র ঈসমাইল ও বিবি হাজেরা থেকে। আল্লাহর নির্দেশে তাদেরকে খাদ্য-পানীয়হীন অবস্থায় ছেড়েছেন জনবসতিহীন মক্কার মরুর প্রান্তরে। যখন হুকুম পেয়েছেন একমাত্র পুত্রের কোরবানীর,তখনও তিনি দ্বিধাদ্বন্দে পড়েননি। প্রবল ঈমানী বল নিয়ে সে হুকুম পালনে লাব্বায়েক বলেছেন। আল্লাহতায়ালার হুকুমে এভাবে লাব্বায়েক বলার ক্ষেত্রে ইব্রাহীম (আঃ) হচ্ছেন সমগ্র মানব ইতিহাসে এক মহান আাদর্শ। “লাব্বায়েক” বলেছেন হযরত ইব্রাহিম (আঃ)এর স্ত্রী বিবি হাজেরা এবং শিশু পুত্র ঈসমাইল(আ)ও। তাঁকেও যখন বলা হয়েছিল, আল্লাহ তোমার জানের কোরবানী চান তখন তিনিও সাগ্রহে বলেছিলেন, “লাব্বায়েক”। অথচ বাঁচবার স্বপ্নসাধ কার না থাকে? কিন্তু আল্লাহর ডাকে লাব্বায়েক বলার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ জীবনে আর কি থাকতে পারে? শিশু ঈসমাইলও সেটি বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন তাঁর মহান বিবি হাজেরাও। ফলে ঘরবাড়ী ও গাছপালা নেই, খাদ্য-পানীয় ও কোন প্রাণীর আলামত নেই -এমন এক মরুর বুকে শিশু পুত্রকে নিয়ে একাকী অবস্থানের হুকুম এলে তিনিও তখন লাব্বায়েক বলেছিলেন। অতি কষ্টে প্রতিপালিত একমাত্র সে শিশু ইসমাইলককে যখন কোরবানী করার হকুম হলো বিবি হাজেরা তখনও দ্বিধান্বিত হননি। আল্লাহর ডাকে লাব্বায়েক বলার চেয়ে বাঁচবার অন্যকোন উচ্চতর প্রেরণার কথা তিনি ভাবতেই পারেননি। তাই মহান আল্লাহর প্রতি নির্দেশে লাব্বায়েক বলেছেন সমগ্র অস্তিত্ব ও অঙ্গিকার নিয়ে। এভাবে আল্লাহর ডাকে সর্বাবস্থায় লাব্বায়েক বলার যে শিক্ষা ইব্রাহীম (আ) এবং তাঁর পরিবার রেখেছেন তা সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে আজও অনন্য হয়ে আছে। প্রতি যুগের মুসলমান বাঁচবে সে ইব্রাহীমী মিশন নিয়ে। আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং তাঁর পরিবারের মিশনে ও আত্মত্যাগে এতই খুশি হয়েছিলেন যে সেটিকে পবিত্র কোরআনে বার বার উল্লেখ করেছেন। তাঁর সে মহান সূন্নতকে আল্লাহতায়ালা হ্জ্ব রূপে ফরয করেছেন। এভাবে সুস্পষ্ট করেছেন,আল্লাহপাক মোমেনের কোন ধরণের আমলে অত্যন্ত খুশি হন সেটিও।
লাব্বায়েক শয়তানের ডাকে
স্রেফ নামায-রোযা পালনে বা কিছু অর্থদানে বা হজ্ব করে আল্লাহকে খুশি করার স্বপ্ন দেখেন ইব্রাহীম (আঃ)এর শিক্ষা থেকে তাদের বোধোদয় হওয়া উচিত। কারণ আল্লাহ চান, তাঁর হুকুমের প্রতি ব্যক্তির সর্বাবস্থায় ও সর্বসময়ে পূর্ণ-আনুগত্য। তাই শুধু হজ্বে গিয়ে লাব্বায়েক বলায় কল্যাণ নেই। আল্লাহর নির্দেশের প্রতি লাব্বায়েক বলতে হবে দেশের রাজনীতি,সমাজনীতি, অর্থনীতি,শিক্ষা-সংস্কতি তথা সর্বক্ষেত্রে। তাই যে দেশে আল্লাহর শরিয়ত ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা নেই এবং সে লক্ষ্যে কোন চেষ্টাও নেই –তখন বুঝতে হবে আল্লাহর হুকুমের ডাকে সেদেশে লাব্বায়েক বলার লোক নেই। সূদী ব্যবস্থা দেশের অর্থনীতি এবংপর্দাহীনতা,নাচ-গান,অশ্লিল যাত্রা-সিনেমা যে দেশের সংস্কৃতি সেখানে তো ঝান্ডা উড়ে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের। যে মহিলা হজ্ব করে অথচ বেপর্দা ভাবে জনসম্মুখে চলাফেরা করে,বুঝতে হবে হজ্বে গিয়ে লাব্বায়েক বলার মধ্যে সাচ্চা ঈমানদারি ছিল না। সেটিকে সে আচার রূপে গ্রহণ করেছিল মাত্র,আল্লাহর প্রতি ঈমানদারি রূপে নয়। এমন হাজীরা তো শয়তানের ডাকেও লাব্বায়েক বলে। তাদের জীবনে বেপর্দাগী এবং জাতিয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার রাজনীতি তো তারই আলামত। এমন ভন্ডদের কারণেই বাংলাদেশে মত মুসলিম দেশগুলিতে হাজীর সংখ্যা বাড়লেও আল্লাহর শরিয়তী বিধানের ডাকে লাব্বায়েক বলা লোকের সংখ্যা বাড়ছে না। বরং বিজয়ী তো তারাই যারা শয়তানের ডাকে লাব্বায়েক বলে। হজ্বকে এরা পালন করে নিছক ধর্মীয় আচার রূপে,আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের মিশনকে নিজ জীবনে গ্রহণ করার ব্রত নিয়ে নয়।
আল্লাহতায়ালা তো চান,বান্দাহ পুরাপুরি তার ইসলামে প্রবেশ করবে। যেমন পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,“উদখুলুস সিলমে কা’ফ্ফা” অর্থাৎ ইসলামে প্রবেশ কর পুরাপরি ভাবে। তাই শুধু নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত পালন নয়,বাঁচতে হয় মিথ্যাচর্চা,সূদ-ঘুষ,ব্যাভিচারি,বেপর্দাগীর ন্যায় সকল প্রকার অবাধ্যতা থেকেও। নইলে নেমে আসে কঠিন আযাব। মহান আল্লাহর সে কঠোর ঘোষণাটি এসেছে এভাবে,“তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখান কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির মধ্যে নিক্ষপ্ত হবে। তারা যা করে আল্লাহ সে সম্বন্ধে বেখবর নন।” -সুরা বাকারা, আয়াত ৮৫। ইসলামে পুরাপুরি প্রবেশের সে ছবকটি দেয় হজ্ব। সেটি লাব্বায়েক বলার সামর্থটি চেতনার গভীরে প্রথীত করার মধ্য দিয়ে। তখন মু’মিন ব্যক্তিটি শুধু আযানের ডাকে বা হজ্বের ডাকে শুধু লাব্বায়েক বলে না, জিহাদের ডাকেও লাব্বায়েক বলে। তখন বিজয় এসেছে আল্লাহর দ্বীনের।
আযাবের গ্রাসে
মুসলমানদের আজকের যে বিশ্বব্যাপী পরাজয়,পশ্চাদপদতা ও হীনতা,সেটি কি উপরে উল্লেখিত আয়াতকেই শতভাগ সত্য প্রমানিত করে না? এ হীনতা যে আল্লাহর প্রতিশ্রুত আযাব -তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে? মুসলিম বিশ্ব বস্তুত সে প্রতিশ্রুত আযাবের গ্রাসে। বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মুসলমানের মানসম্মান ও ইজ্জতের এখনো কি কিছু অবশিষ্ঠ আছে? স্রেফ খাদ্য-উৎপাদন,শিল্প-উৎপাদন,সড়ক-উন্নয়ন বা শিক্ষার হার বাড়িয়ে কি এ হীনতা ও অপমান থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? মুসলমানদের মাঝে ইসলামের আংশিক অনুসরণ করে তথা নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত পালন করে,এমন লোকের সংখ্যা আজ কোটি কোটি।কিন্ত মুসলিম সমাজে সূদখোর,ঘুষখোর,মদখোর ও ব্যাভিচারির ন্যায় আল্লাহর অবাধ্য মানুষের সংখ্যাও কি কম? মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের রাজনীতি, অথনীতি ও আইন-আদালতেও সবটুকু জুড়ে আল্লাহর অবাধ্যতা, সেখানে বাস্তবায়ন ঘটেনি শরিয়তের। অথচ পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণাটি হলো,“যারা আল্লাহর মার নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করে না তারা কাফের, …তারা জালেম ..তারা ফাসেক।” -সুরা মায়েদা,আয়াত ৪৪-৪৭)।” প্রশ্ন হলো,মুসলিম বিশ্বের কোথায় আজ আল্লাহর প্রতিটি হুকুমের পূর্ণ অনুসরণ? ইসলামের নামে মুসলমানদের মাঝে যা বেড়েছে তা তো আংশিক অনুসরণ মাত্র। এমন আংশিক অনুসরণই তো মহান আল্লাহর আযাব ডেকে আনার জন্য যথেষ্ঠ। সে আযাবের স্পষ্ট প্রতিশ্রুতিই তো শুনিয়েছে উপরুক্ত আয়াত।
যার মধ্যে ইসলামের পুরাপুরি অনুসরণ নেই তার জীবনে প্রবলতর হয় শয়তানের অনুসরণ। সে তখন শয়তানের ডাকে ‘লাব্বায়েক’ বলে। মুসলিম দেশগুলিতে আজ যে বিধান প্রতিষ্ঠিত সেটি আল্লাহর বিধান নয়,বরং সেকুলারিজম এবং মানুষের গড়া আইন।। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে আইনসিদ্ধ পতিতাবৃত্তি, সূদ-ঘুষ ও দূর্নীতির মধ্য দিয়ে যেটি প্রকাশ পায় সেটি আল্লাহর আনুগত্য নয়,বরং শয়তানের অনুসরণ। ইব্রাহীম (আঃ) ছিলেন আল্লাহর প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্যের প্রতীক,এমন ব্যক্তিকে বলা হয় হানিফ। তিনি হলেন মুসলিম উম্মাহ বা মিল্লাতের আদি পিতা। আল্লাহর প্রতি অবিচল আনুগত্য নিয়ে তিনিই উচ্চারণ করেছিলেন সেই বিখ্যাত বানী যা আজও অমর। তা হলো,‘‘ইন্নাস সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন।’’ অর্থঃ "নিশ্চয়ই আমার নামাজ,আমার কোরবাণী,আমার বেঁচে থাকা ও আমার মৃত্যু সবকিছুই রাব্বুল আলামীনের জন্য।" ইব্রাহীম (আঃ) এর মুখ থেকে বের হওয়া এ কথাগুলো মহান রাব্বুল আ’লামীনের এতই পছন্দ হয়েছিল যে সেগুলিকে তিনি কেয়ামত অবধি অক্ষয় করে রেখেছেন,এবং সেটি পবিত্র কোরআনে তাঁর নিজের কথার পাশে লিপিবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে। এভাবে এ কথাগুলোর অনুসরণ বাধ্যতামূলক করেছেন প্রতিটি মুসলমানের উপর। প্রতিটি পশু কোরবানীতে আজও কোরবানীদাতাকে কোরআনের এ আয়াতকে উচ্চারণ করতে হয়। তাই কোরবানী নিছক পশু কোরবানী নয়,বরং নিজের মধ্যে বেড়ে উঠা পশু-চেতনা তথা স্বার্থ-চিন্তার কোরবানী। মুসলমান যে নিজেকে খুশি করার জন্য বাঁচে না বরং বাঁচে মহান আল্লাহকে খুশি করার লক্ষ্যে হজ্ব ও ঈদুল আযহার পশু কোরবানীর মধ্যে দিয়ে সেটিই উচ্চারিত হয়। প্রতি ক্ষণে এটিই হতে হবে ঈমানদারের বাঁচবার মূল প্রেরণা। হজ্ব ও ঈদুল আযহা মূলতঃ সেটিই শেখায়।
আল্লাহর ইনষ্টিটিউশন
হজ্ব মূলতঃ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁর পরিবারের সূন্নত। এটি হল আদি পিতার আদর্শের সাথে পরবর্তীকালের মুসলমানদের একাত্মতার মহড়া। আল্লাহপাক তাঁর এই মহান বান্দাহ ও তাঁর পরিবারকে এভাবেই মহাসন্মানিত করেছেন।আল্লাহ চান তার অনুগত বান্দাহগণ হযরত ইব্রাহীমের (আ) আদর্শে গড়ে উঠুক। গড়ে তুলুক এমন এক বাহিনী যার প্রতিটি সৈনিক হযরত ইব্রাহীম (আ)এর মতই আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশে দ্বিধাহীন চিত্তে লাব্বায়েক বলবে। অনুগত বান্দাদের জন্য তিনিই শ্রেষ্ঠতম মডেল। ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) যে ভাবে এ মডেলকে অনুসরণ করেছিলেন সেটি ফরজ সকল মুসলমানের জন্যও। বস্তুতঃ হজ্ব হল সূন্নতে ইব্রাহীম (আ)এর আলোকে মানুষ সৃষ্টির ইনষ্টিটিউশন। আল্লাহতে আত্মসমর্পণের ছবকই এর মূল পাঠ। আল্লাহর অনুগত বান্দারূপে ঈমানদারের কি দায়িত্ব সে বিষয়ে ঘর থেকে বহুদূরে একান্ত নিবিড়ে নিয়ে মিনায়, আরাফায় বা মোজদালেফায় বসিয়ে ভাববার সুযোগ করে দেয়।
ইব্রাহীম (আঃ) এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্রের সূন্নতকে হাজীদের পালন করতে হয়। অন্যথায় হজ্ব হয় না। বিবি হাজেরা তার শিশু পুত্রের তৃষ্ণা মেটাতে যেভাবে পানির খোঁজে সাফওয়া ও মারওয়ার মাঝে দৌড়িয়েছিলেন আজও প্রতিটি হাজীকে -তা বৃদ্ধ হোক বা জোয়ান হোক,নারী হোক বা পুরুষ হোক,রাজা হোক বা প্রজা হোক -সকলকেই সেভাবে দৌড়াতে হয়। ‘সায়’ অর্থ প্রচেষ্ঠা। পানিহীন মরুভূমির মাঝেও হতাশ না হয়ে বিবি হাজেরা যেরূপ পানির খোঁজে স্বচেষ্ট হয়েছিলেন, তেমনি স্বচেষ্ট হতে হবে প্রতিটি মুসলমানকে তার জীবন-সমস্যার সমাধানে। তথা কল্যাণকর কাজে। মানব জাতির জন্য এটি এতই শিক্ষণীয় যে বিবি হাজেরার সে সূন্নত হজ্বের ফরজ রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সভ্যতা সভ্যতর হয় বা মানব-জীবন উন্নততর হয় তো কল্যাণ কর্মে এমন প্রাণান্তকর প্রচেষ্ঠার কারণেই। এ চেতনাতেই মুসলমান তাই ভিক্ষুক হয়না, হতাশও হয় না। বরং সর্বাবস্থাতে আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশে মেধা,শ্রম,সময় ও রক্ত বিণিয়োগ করে। অর্থাৎ “সায়” শুধু সাফা ও মারওয়ার মাঝে নয়,সেটি সারা জীবনভর করে।
বিবি হাজেরা ছিলেন একজন নগণ্য দাসী। তাই ইব্রাহীম (আ)এর নিঃসন্তান প্রথম স্ত্রী বিবি সারার আপত্তি ছিল না তাঁকে স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করায়। আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠাপূর্ণ আনুগত্যের কারণেই বিবি হাজেরা পুরস্কৃত হয়েছেন। আল্লাহপাক এভাবে সম্মানিত করেছেন এক নারীকে। এ মহা সম্মান কোন রাজাবাদশাহ ও সম্ভ্রান্ত বংশের কোন অভিজাতের ভাগ্যে জুটেনি,বরং পেয়েছে এমন এক বৃদ্ধা মা যিনি তাঁর একমাত্র সন্তানের কোরবানীর নির্দেশে নিঃসংকোচে লাব্বায়েক বলেছিলেন।। পিতা-মাতার সাথে একাত্ম হযে ইসমাইল (আঃ)যে ভাবে নিজেকে কোরবানী করতে লাব্বায়েক বলেছিলেন সেটিও সমগ্র মানব-ইতিহাসে অনন্য। পশু কোরবাণীর মধ্য দিয়ে তাঁরই আদর্শের সূন্নত পালন করতে হয় বিশ্বের মুসলমানদের। এটি না করলে হাজীদের হজ্বই হয় না।
হজ্ব নিজেই কোন লক্ষ্য নয়,মানুষকে একটি মহত্বর লক্ষে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া মাত্র। আল্লাহর চুড়ান্ত লক্ষ্য হলো তার দ্বীনকে বিজয়ী করা। পবিত্র কোরআনে যেমন বলা হয়েছে,"হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ তিনি তাঁহার রাসূলকে প্রেরণ করেছেন এ জন্য যে দুনিয়ার সকল দ্বীনের উপর এটি বিজয়ী হবে" -(সুরা ছফ, আয়াত ৯)। তবে এ বিজয় এমনিতে আসে না। এ কাজ ফেরেশতাদেরও নয়। বরং একাজ মানুষের। এ কাজ সমাধার জন্য ফেরেশতা হওয়ার যেমন প্রয়োজন নেই,তেমনি সুফি বা দরবেশ হওয়াও জরুরী নয়। বরং চাই জিহাদ। চাই সে জিহাদে অর্থদান,শ্রমদান, রক্তদান,এমনকি প্রাণদান। ইসলাম-বিরোধীদের নির্মূলে জরুরী হলো এমন এক বাহিনীর যারা আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশের প্রতি নিষ্ঠারসাথে লাব্বায়েক বলবে। যেমনটি হযরত ইব্রাহীম (আ) বলেছিলেন। নইলে বিজয় অসম্ভব। আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এমন একটি বাহিনী গড়তে পেরেছিলেন বলেই তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। মুসলমানরাই হচ্ছে এ কাজে তার একমাত্র বাহিনী। কোরআনে আল্লাহতায়ালা তাদেরকেই আখ্যায়ীত করেছেন ‘হিযবুল্লাহ’ বা আল্লাহর দলরূপে। তবে নিছক দলই যথেষ্ট নয়। এজন্য লাগাতর ট্রেনিংও অপরিহার্য। সে ট্রেনিং শুধু দৈহিক নয়; আর্থিক ও আত্মীক হওয়াটাও জরুরী। নইলে অর্থ, রক্ত ও অর্থদানের সামর্থ আসবে কোত্থেকে? হজ্বের মধ্যে সমন্বয় ঘটেছে সবগুলীরই। লাব্বায়েক হলো বস্তুতঃ এ বাহিনীর শপথ বাক্য। এখানে শপথ আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের। এটি হলো তাঁর লা-শরিক ওয়াহদানিয়াতের স্বীকৃতি এবং সদাসর্বদা আল্লাহর ডাকে লাব্বায়েক বলার। হাজীদের তাই বলতে হয়,"লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বায়েক লা-শারিকা লাকা লাব্বায়েক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকাওয়াল মুলক, লা-শারিকা লাকা লাব্বায়েক।"
উম্মূক্ত যাদুঘর
মহা বিজয়ের কাজ একার নয়,এ কাজ সমষ্টির। তাই প্রয়োজন, এ বাহিনীর অন্য সবার সাথে এক সাথে বসার। প্রয়োজন হলো,নানা বর্ণের ও নানা ভাষার এ বিশ্ববাহিনীর সৈনিকদের পারস্পারিক পরিচয়ের। প্রয়োজন হলো,একে অপরের সমস্যার অনুধাবনের এবং একসাথে চিন্তাভাবনা ও স্ট্রাটিজী প্রণয়নের। এজন্য জরুরী হলো বিশ্বভাতৃত্ব। তাই মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো প্যান-ইসলামিক চেতনায় দীক্ষা নেওয়া। বিশ্বভাতৃত্ব তাই মুসলমানের রাজনৈতিক শ্লোগান নয়,এটি তার ঈমানের আত্ম-চিৎকার। ফলে ঈমানদার ব্যক্তি পুতুল-পুজাকে যতটা ঘৃনা করে, ততটাই ঘৃনা করে বর্ণবাদ,গোত্রবাদ ও জাতীয়তাবাদকে। কারণ এগুলো হলো মুসলমানদের বিশ্বজনীন ভাতৃত্বের বিরুদ্ধে ঘাতক ভাইরাস। আজ মুসলমানেরা যেভাবে বিভক্ত,শক্তিহীন ও বিপর্যস্ত তা তাদের মাঝে কোন পুতুল পুজার কারণে নয়। বরং সেটি ভিন্ন ভিন্ন ভূগোল, ভাষা, বর্ণ ও গোত্র-ভিত্তিক জাহেলী চেতনার কারণে। হজ্ব সে পাপাচার থেকে দূরে এনে মুসলমানদেরকে এক মহা-সম্মেলনে হাজির করে। এখানে ধনি-দরিদ্র,রাজা-প্রজা,সাদা-কালো সবার পোষাক যেমন এক তেমনি আত্মার আকুতি ও উচ্চরণও এক। লক্ষ্য একটিই এবং সেটি হলো আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়া এবং তাকে খুশি করা। এমন এক মহা-সম্মেলনের লক্ষ্যেই আল্লাহপাক তার নিজের ঘর বায়তুল্লাহ গড়েছিলেন। সেটিও নির্মিত হয়েছিল ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আঃ)র হাত দিয়ে। এটি তাই ইতিহাসের কাদিম যাদুঘর,এবং সে সাথে ইন্সটিটিউশনও। এখানে পা রেখেছিলেন হযরত ইব্রাহীম,হযরত ঈসমাইল,বিবি হাজেরা,শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর বিখ্যাত সাহাবাগণ। এ নগরের প্রতিটি প্রান্তর,প্রতিটি অলিগলি,প্রতিটি পাথর এবং প্রতিটি ধুলিকণায় জড়িত রয়েছে মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের স্মৃতি। এখানে রয়েছে হাজরে আসওয়াদ,মাকামে ইব্রাহীম,আরাফা, মিনা ও মোজদালেফা। মারেফাতের তথা আল্লাহর সান্নিধ্যলাভের প্রানকেন্দ্র হলো এগুলি। আল্লাহর সৈনিকদের শপথ বাক্য উচ্চারণের এর চেয়ে পবিত্রতম আয়োজন আর কি হতে পারে? আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা মানব সভ্যতার এ শ্রেষ্ঠ ভূমিতে দাঁড়িয়েই আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশে লাব্বায়েক বলেছিলেন। ফলে গড়ে উঠেছিল ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর মানব। এ পবিত্র প্রাঙ্গণের প্রতিটি ধুলিকণা আজও মানুষকে সেই একই পথে চলতে নির্দেশ দেয়। এখানকার আলো-বাতাস প্রতিটি হাজীর কানে আজও একই সূরে “আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক”এর ধ্বনি শোনায়। ইতিহাসের সেই একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে একই শপথ উচ্চারন করে বিশ্বের নানা কোন থেকে আগত আজকের ঈমানদারগণও। আত্মীক উন্নয়নের এর চেয়ে পবিত্রতম স্থান এবং পবিত্রতম আয়োজন আর কি হতে পারে? এর চেয়ে উত্তম মারেফতি ধ্যান কি আর কোথাও হতে পারে?
যে কারণে শ্রেষ্ঠতম এবাদত
আন্তর্জাতিক এ মহাসম্মেলনের আয়োজক মহান আল্লাহতায়ালা খোদ নিজে। নইলে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এ সম্মেলনটি চৌদ্দ শত বছর ধরে সম্ভব হত না। নানা যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দুর্যগের মাঝেও এ বিশাল সম্মেলনটি সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। অন্যরা এখানে মেহমান, খোদ আল্লাহতায়ালা এখানে মেজবান। আল্লাহর উদ্দেশ্যে হওয়ায় এ সম্মেলনে যোগ হয় পবিত্রতা। লক্ষ্য যখন এক ও অভিন্ন,তখন দ্বন্দ থাকে না। দলাদলিও থাকে না। নানা বিভিন্নতা থেকে এসে এখানে এসে সবাই অভিন্ন হয়ে যায়।বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ এখানে ছুটে আসে নিজস্ব অর্থে। কারো অনুদানের প্রয়োজন হয়না। হেজাজের পুণ্যভূমি যখন বৈষয়িক সম্পদে দরিদ্র্য ছিল তখনও এ হজ্ব আয়োজিত হয়েছে মানুষের নিজস্ব উদ্যোগে। মক্কা হলো ইসলামের মূক্ত নগরী। এখানে আসার জন্য অনুমতিরও প্রয়োজন নেই। আসতে বাধা দেওয়াই চরম অধর্ম। বাধা দিলে সে বাধা অপসারণ করা সকল মুসলমানের ধর্মীয় দায়িত্ব হয়ে পড়ে। এভাবেই নিশ্চয়তা বিধান হয়েছে এ বিশ্ব সম্মেলনের।
আরাফার মহা জমায়েত, মোযদালিফায় রাত্রিযাপন, কাব্বার তোয়াফ এবং শয়তানের স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপের পর মুসলিম বিশ্বে আসে ঈদুল আযহা। আনে ঈদ তথা খুশি। প্রকৃত ঈদ বা খুশির প্রকৃত কারণটি নিজের বা অন্যের জন্ম নয়,বরং সেটি নিজের অর্জিত সাফল্য। নিজের জন্মে ব্যক্তির নিজের কোন কৃতিত্ব থাকে না,সে দানটি মহান আল্লাহর। ফলে জন্মদিনে কেন সে খুশি করবে? তাই খৃষ্টান ধর্মে এবং অন্যান্যে ধর্মে ধর্মীয় নেতার জন্ম দিবস পালনের রীতি থাকলেও ইসলামে সেটি নাই। তাই সাহাবায়ে কেরাম নবীজী (সাঃ)র জন্ম দিন পালনে করেছেন সে নজির নেই। মুসলমানের জীবনে প্রকৃত ঈদ মাত্র দুটি। একটি মাহে রমযানের,অপরটি ঈদুল আযহার। এ দুটি ঈদে উযপাপিত হয় ঈমানদারের জীবনের দুটি বিশাল বিজয়। একটি মাহে রমযানের মাসব্যাপী রোযা পালনের, অপরটি হজ্ব পালনের তথা আল্লাহর ডাকে লাব্বায়েক বলার সামর্থ অর্জনের এবং সে সাথে কোরবানী পেশের।
হজ্ব যেন রোজ হাশর বা বিচারদিনের মহড়া। সর্বত্র এক পোষাক,এক বর্ণ,একই আওয়াজ। সবার মধ্যে একই পেরেশানী। নানা দেশের নানা ভাষার মানুষ এখানে এক মানবসমুদ্রে লীন। মাথায় টুপি নেই, পায়ে জুতা নেই, গায়ে জামা নেই, আভিজাত্য প্রকাশের কোন মাধ্যমও নেই। দুই টুকরো সিলাই হীন কাপড় নিয়ে সবাই এখানে একই সমতলে। কাফনের কাপড় পরে লাশেরা যেন কবর থেকে লাখে লাখে বেরিয়ে এসেছে। সাদা-কালো,আমির-ওমরাহ,নারী-পুরুষ সবাই এখানে একাকার। সবাই ছুটেছে একই লক্ষ্যে। যেন রোজ হাশরের বিচার বসেছে। বান্দার সুউচ্চ লাব্বায়েক ধ্বনি আল্লাহর উপস্থিতিকে যেন স্মরন করিয়ে দেয়। আল্লাহর স্মরণেকেঁপে উঠে বান্দার দেহ, মন তথা সমগ্র অস্তিত্ব। এখানে ভয়, বিনয় ও আনুগত্যের ভাব সর্বত্র। সবাই ঘুরছে আল্লাহর ঘরকে কেন্দ্র করে। রোজ হাশরের দিনে মানুষ যে কত অসহায় হবে হজ্ব সেটিই স্মরণ করিয়ে দেয়। মৃত্যূবরণ না করেও যেন মৃত্যুর অভিজ্ঞতা। ফলে প্রেরণা মেলে সময় থাকতে জীবনের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের। গুরুত্ব পায় আল্লাহর কাছে হিসাব দেওয়ার আগে নিজেই নিজের হিসাব নেয়ার। পরকালীন সাফল্য লাভে এ মূল্যায়নই তো মূল। এমন উপলদ্ধি ছাড়া আল্লাহতে পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও শয়তানের দাসত্বমূক্তি কি সম্ভব? হজ্ব তো সে সুযোগই এনে দেয়। সম্ভবতঃ এ জন্যই এটি ইসলামের শ্রেষ্ঠতম এবাদত।কিন্তু সে শ্রেষ্ঠ ইবাদতের সে শিক্ষা আজকের মুসলমানের জীবনে কই? এটাই কি আজকের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা নয়?
বিষয়: বিবিধ
১৪৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন