মাটির ব্যাংক
লিখেছেন লিখেছেন ানিক ফেনী ১৬ এপ্রিল, ২০১৩, ০৯:৪৬:৫৯ রাত
আমি তখন খুব ছোট। আমাদের গ্রামে বৈশাখী মেলা বসত। মেলাতে আমার সমবয়সী অনেকেই ঘুরে এসেছে। কে ক’বার গেল, এলো এই বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে গল্প বলার প্রতিযোগিতা চলত। মেলাতে কিছু কিনি বা না কিনি। এমনিতেই যেতাম প্রথম হওয়ার জন্য। শেষ বার মেলাতে প্রবেশ করে একটা জিনিস না কিনে পারলাম না। সেটা হলো কুমারের হাতের তৈরি করা মাটির ব্যাংক। বাড়িতে নিয়ে এলাম ব্যাংকটা।মা ব্যাংকটা দেখেই বলল,যাক আমার ছেলে এবার কাজের মত কাজ করেছে।আমি বললাম, কি এমন কাজে মত কাজ করেছি মা ?
মা বলল, তুমি টাকা সংগ্রহ কর। ব্যাংকটা ভর্তি কর তারপর বলব তুমি কি কাজের কাজ করেছ।দাদীমা বলল, এবার বাড়িতে চোরে উৎপাত বেড়ে যাবে!বললাম কেন?দাদীমা দু’হাত দিয়ে আমার দুই গাল টেনে ধরে বলল,মেলা থেকে ব্যাংকটা বাড়িতে নিয়ে আসতে কত মানুষ দেখেছে ?অনেক মানুষতো দেখেছে দাদীমা ।ঐ মানুষ গুলোর মধ্যে চোরও দেখেছে। কিছু দিন পর সেই চোর মাটির ব্যাংকটা চুরি করতে আসবে।আমি রেগে বললাম, আমার ব্যাংকের টাকা কে চুরি করেবে তাকে দেখে নেব। মাটির ব্যাংক মাটিতেই পুতে রেখে দেব।
দাদীমা বলল,‘মাটির ভেতর কি চোর নাই।অবাক হয়ে বলাম। মাটির নিচে চোর! কি ভাবে সম্ভব! মাটির নিচে আবার চোর থাকে!দাদীমা মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বলল আছে মানে অবশ্যই আছে।জোরে বললাম,বল দেখি সেই চোরের নাম কি?অবশেষে দাদীমা বলল,তার নাম ইঁদুর।ইঁদুরের নাম শোনা মাত্র ভাবলাম সত্যি তো ইঁদুর মাটির নিচেই থাকে। তবু দাদীমা কে বললাম ইঁদুর নরম মাটি কাটতে পারে। কিন্তু শক্ত মাটি কাটতে পারবে না। তারপরও পোড়া মাটি দিয়ে তৈরি ব্যাংক। ইঁদুরের দাঁত ভেঙে যাবে শক্ত মাটি কামড়াতে।দাদীমা বলল,আচ্ছা পুতে রাখ দেখা যাক বাস্তবে কি হয়।বাবা বলল,যাক এবার আমার সন্তান বুঝতে পেরেছে ভবিষ্যতের কথা।বাবা আর বেশি কিছু না বলে ধন্যবাদ দিল।বাবা কে প্রশ্ন করলাম আচ্ছা বাবা মাটির এই ব্যাংকটা এত সুন্দর করে কে তৈরি করেছে? বাবা বলল, পালপাড়ার কুমারেরা। বাবাকে বললাম,নিয়ে চলো না একদিন পালপাড়াতে। বেশ কয়েক দিন পর বাবার সঙ্গে পালপাড়াতে গেলাম। যে দেখি মাটির ঢিবি। কোথায় আবার কাঁদামাটি, চাকা ঘুরছে কলস তৈরি করছে। উচ্চ জায়গায় একটা ঘরে দেখি ধুয়া উড়ছে। আমি বললাম,বাবা ওখানে ধুয়া উঠছে কেন?বাবা বলল, ‘ওখানেই তো মাটির তৈরি জিনিস গুলো আগুনে পড়ানো হচ্ছে।পুরো পালাপাড়া ঘুরে এলাম বাড়িতে। এসেই দাদীমার সঙ্গে গল্প করতে করতে বাজি ধরলাম, বাজিটা হলো আমি যদি এক মাসের মধ্যে মাটির ব্যাংকটা টাকা দিয়ে ভর্তি করতে পারি তাহলে দাদীমা আমাকে ভরপেট মিষ্টি খাওয়াবে। মিষ্টি খাওয়া লোভ সামলাতে পারলাম না। কথা দিলাম। কিভাবে টাকা সংগ্রহ করা যায়। ভাবলাম বন্ধু বান্ধবীদের কাছে থেকে টাকা ধার নিব। পরে শোধ করে দিব। না থাক বন্ধুরাও তো আমার মত ছোট্ট মানুষ। অতিরিক্ত টাকা ওদের ও নেই। হঠাৎ বুদ্ধি পেয়ে গেলাম বাবার পকেট মারা। বাবা অফিস থেকে আসলেই পকেট মানি ব্যাগ যখন যেখানে রাখে সে খান থেকে টাকা সরিয়ে ব্যাংকে ঢুকিয়ে রাখতাম। বাবা ঠিক কি বুঝতে পারত। বুঝে না বঝার ভান করত। কখনো টাকা গুলো ভাংতি করে কয়েন সংগ্রহ করি দোকান থেকে । দাদীমার কাছে থেকে ও যে কোন ভাবে টাকা সংগ্রহ করি। মা তো চুপে চাপে আমাকে টাকা দেয়। সব মিলে এক মাসের দু’দিন বাকী থাকতেই মাটির ব্যাংকটা ভর্তি হয়ে গেল। পরের দিন সকালে ঘোষণা দিব আমার ব্যাংকটা ভর্তি হয়েছে। কিন্তু সে ভাগ্য আর আমার হলো না। সকালে ব্যাংকটা যে জায়গা রেখে ছিলাম দেখি সে জায়গায় আর নেই।দাদীমা বলল, তোকে না বলে ছিলাম। ইঁদুর মাটির ব্যাংকটা নিয়ে যেতে পারে।মা কোলে তুলে আদর করতে করতে বলল, কান্না করে না। সোনার টাকায় ভর্তি মাটির ব্যাংক এনে দেব।বাবা বলল, তোমাকে আবার পালপাড়াতে নিয়ে গিয়ে ব্যাংক কিনে এনে দেব।সবার কথা শুনে কান্না থামিয়ে চোখ মুছতে বললাম, মাটির ব্যাংকটি তো গেছে যাক। কিন্ত টাকাগুলো তো নষ্ট করে ফেলেছে ইঁদুর। সে টাকা গুলো কি হবো। টাকা গুলো তো তোমাদের কাছে থেকেই সংগ্রহ করে ছিলাম। ইঁদুর তো দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। কিন্তু কথা সেটা না। কথা হলো আমি যে দাদীমার সঙ্গে বাজিতে হেরে গেলাম। এতো কষ্ট করে বুদ্ধি খাটিয়ে মাটির ব্যাংকটা ভর্তি করেছিলাম অবশেষে হেরে গেলাম !হারানোর বেদনায় আবারও জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম ...। আমার কান্না দেখে দাদীমা দৌড়ে রুমে গেল ।ফিরে এসে শাড়ির আঁচলের নিচে থেকে ব্যাংকটা বের করে বলল, তুই হেরে যাস নি দাদু ভাই এই তো তোর টাকা ভর্তি মাটির ব্যাংক।মায়ের কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে মাটির ব্যাংকটা হাতে নিলাম। ব্যাংকটা হাতে পাওয়ার পর মনে হলো আমি যেন এভারেস্ট জয় করে ফেললাম। জোরে চিৎকার দিলাম। আমি জিতেছি। দাদীমা হেরে গেছে। কি মজা কি মজা উপস্থিত সবাই আমার আনন্দে হাসতে লাগল।
বিষয়: বিবিধ
১৪৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন