তোতাইয়ার কবর
লিখেছেন লিখেছেন ানিক ফেনী ১৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:৫৩:১২ রাত
তোতা? কোন তোতা মরি গেল? আঁইতো হেতারে চিন্তাম হারি ন। হেতে কে-ও? চিননি? হাডারী, হুননি, মাইকে ঘোষণা কইত্তে আছে..........কদির বাপের চা দোকানের সামনে বেঞ্চে বসা কালু পাটোয়ারী আর আলিমুদ্দি। দু’জনেই চায়ের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষায়। লিকার ঢেলে টুং টাং চামচের শব্দে পটের দুধ মেশায় কদির বাপ। তার প্রশ্নে আলিমুদ্দি উত্তর খোঁজে কালু পাটোয়ারীর চোখে। পাটোয়ারী বেঞ্চে বাম পা তুলে তাকায় পূর্ব দিকের রাস্তায়। রিকশায় মাইকের চোঙ্গা দেখা যায়। পাটোয়ারীর কাছে জবাব না পেয়ে চোখ ঘুরায় আলিমুদ্দি কদির বাপের বাড়িয়ে দেয়া-চা-র কাপের দিকে।
মাঘের সকাল। কুয়াশা কাটলে গ্রামের মুরুব্বীদের চায়ের আড্ডা জমে কদির বাপের দোকানে। কাঠের একটা বেঞ্চ। ঠাসাঠাসি করে চারজনে বসতে পারে। সকাল বেলায় মুরুব্বীদের ভিড় একটু বেশীই হয়। গায়ে চাদর-মাথায় মাফলার, পট্টি মেরে ওরা নগদ বাকিতে গলাটা গরম করে আসর জমায়।
কদমতলা মসজিদের মোড়ে কদির বাপের টং দোকানে চা-বিস্কুট ছাড়াও আলু, ডাল, পিঁয়াজও পাওয়া যায়। পড়শিদের ঠেকার কাজ চলে। তবে দামটা বাজারের চেয়ে একটু বেশি।
সবাই জানে কদির বাপে বাটখারার কারচুপিতে পরিবারকে হারাম খাওয়াতে রাজি না। মুরুব্বীরা চলে গেলে আসে উঠতি বয়সের ছেলে-ছোকরদের দখল। তাদের চা-বিস্কুটের সাথে চলে-রাজা উজির মারার গল্প। কদির বাপে ওদের সাথেও হু-হা মেরে তাল দেয়। বেতাল হলেই বিপদ। এ অভিজ্ঞতা বহুবার হয়েছে কদির বাপের। বাবুলের কথার সাথে একবার অমত হতেই তার ফলাফল পেয়ে যায় পরের দিন সকালে।
ভোর রাতে সে দলবল নিয়েই দোকানের পাটাতনে বসে আসল কাজ সেরে যায়। তিনদিন দোকান খুলতে পারেনি দুর্গন্ধে। বারবার গরম পানি ঢেলে, ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়েও গন্ধমুক্ত করতে পারেনি। কাস্টমাররাও কদিন দোকানে ভিড়েনি। মনের গোস্বা যেন হজমি খেয়ে হজম করে সে। তবে এটা তার ভালভাবেই বুঝে এসেছে, ব্যবসা করতে হলে সব দিক সামলে চলতে হয়। কদমতলার মোড় ঘুরে মাইকের মুখ এবার দোকানের দিকে। পাটোয়ারী বাঁ হাতের ইশারায় সবাইকে চুপ থাকতে বলে।
একটি শোক সংবাদ! একটি শোক সংবাদ! বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা তোতা মিয়া গতকাল রাত সাড়ে এগারটায় ইন্তেকাল করিয়াছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া-ইন্না ইলাইহে রাউজেন।অদ্য যোহরের নামাজের পর মরহুমের জানাজা হাইস্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে এবং তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে।-প্রচারে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এমএ এমএ আতাউর রহমান,-বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা! কোনাইগার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। চিনো নিও তোমরা? আঁইতো নামও হুনি’ন। দিনে দিনে কত হুঁন্নুইম। যেতার জন্ম একাত্তর সালে অয়-ন, হেতেও বলে মুক্তিযোদ্ধা আছিল। কি-ও কদির বাপ, কথা কওনা কীল্লাই?ছাকুর কথার জবাব দেয় না কেউ। চায়ের কাপ হাতে কলা মুয়ার কাছে রোদে দাঁড়িয়ে সে। শরীরের ওম ওম ভাব ছাড়িয়ে গেলেই মাথার মাফলার খুলে কোমরে পেঁচিয়ে নেয়। ঘোষকের রিকশা দোকানের কাছাকাছি আসতেই অনেকটা দৌড়েই হুড ধরে পাটোয়ারী।
-এরি বা-জি! এরি বা-জি। এককানা খাড়া। তোতা! কোন তোতার কথা কও তোমরা? মুক্তিযোদ্ধা!
-ওম্মা কীয়া কন জেডা? তোতারে বুঝি আন্নেও চিনেন না। তোতাইয়া, আ-রে হাগলা তোতাইয়া-তৌবা আস্তাগফিরুল্লাহ। জেডা, আংগো তোতা ভাই। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা তোতা ভাইরে আন্নে না চিনেন ন, আ-রে তালতলার যুদ্ধে যে হেতনে একলাই সাতগা হাইঞ্জাবি ফিনিশ কইচ্ছে। আহ্হারেই বে-ক ভুলি গেছেন। বয়স তো আন্নের কম-ন। আন্নেগো চোক্ষের সামনেইতো বেকগিন ঘটছে। হাছা-ন’নি? কেন্নে ভুলি গেলেন বা-জি!
ততোক্ষণে ছাকু চায়ের কাপে শেষ চুমক দিয়ে পাটোয়ারীর পেছনে দাঁড়ায়। গায়ের চাদরটা খুলে এবার কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে বলে, বুইজ্জি হাগলা তোতাইয়া। হেতেতো বাজারে খরাত করি খাইতো। রাইতে হুতি থাকতো মিউনিসিপ্যালিটির বরিন্দায়। হেতে যে যুদ্ধ কইচ্ছে ইয়ান তো হুনি-ন। কীও কাকু, আন্নে জানেন নি?
কালু পাটোয়ারীর ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। রিক্সার হুড ছেড়ে দিয়ে পা বাড়ায় দোকানের দিকে। একটা বিষন্নতার ছায়া তার চেহারায় লেপ্টে থাকে।
মরি গেছে, এক্কারে ভালা অইছে। ইগিন হাগল ছাগল বাঁচি থাকনের দরকার কী? ছাকুর কথা শুনে ফিরে তাকায় পাটোয়ারী। কথার মধ্যে একটা অন্যরকম যুক্তি তার মনেও দাঁড়িয়ে যায়। যেন কাঁটাতারের বেড়ার ভিতর অচিন পাখি। তোতাইয়াতো পাগল, খাঁটি পাগল। একটা খালি পাগলের ভবিষ্যত কী? খালি খালি এ জগতের কতগুলো খাদ্যের দানা বিনাশ করা। পাগল-ছাগল মানেইতো জঞ্জাল। চলমান ময়লার একটা খোলা ডিব্বা। যেদিকে যায় একটা দুর্গন্ধ পিছু তাড়া করে। আসল কাজটিতো তোতাইয়া করে দিয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন কী দরকার তার! নিজের দিকে তাকায় পাটোয়ারী। কেমন লাগে নিজেকে? তোতাইয়ার মতো! না-কি কাছাকাছি একটা কিছু!
সেদিনের কথাগুলো খাব্লে খাব্লে মনে দাগ দিয়ে যায়। চাইনিজ রাইফেলের মাথায় খোলা বেয়নেট। কলিজে ছিদ্র করার মতো আঁৎকে উঠা ভয়। চিতার মতো পাঞ্জাবী সেনাদের দৃষ্টি। হিদু বলতো বাউরে বাউ, হেতাগো হলদ্ হলদ্ দেখলে মাইনষের হেডের গোডা ভাত হজম অই যায়। হেতাগো লগে ফাইট মাইচ্ছে এ দেশের নেংটা হোলাহাইনে।কালি বাড়ির এক যুদ্ধে হিদুও গেল। সে যুদ্ধেই তোতাইয়ার পায়ে গুলি লেগে দুই মাস হাসপাতালে। কেমন জানি দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে যায়।মাইকওলার রিকশা সামনের মোড় পার হয়। কী মনে করে কালু পাটোয়ারী আবার দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে রিকশার হুড টেনে ধরে।
-এরে বা-জি, এরে বা-জি, এককানা হুন। এরে জেডা, কার কথা কইলি যেন? এমএ এমএ আতাউর রহমান, হেতন কে-রে জেডা, আন্নে কে-ও? আন্নেতো এত বেক্কল নন। কীয়া জিগান আন্নে? আন্নে আংগো আতাভাইরে বুঝি চিনেন ন? আরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। এমএ এমএ আতা ভাই। আরে আইড্যা বাড়ির আতা ভাই। হীয়ার হরে জিগাইবেন হেতনে বাপের নাম কী? আঁই এতগিন কইতাম হাইত্তান্নো। তই হুনিরান, মাইনষের হাশ দি নামের শেষে এম, এ লাগায় আর হেতন নো নামের আগে ডবল এমএ লাগায়। বুইজ্জেন, ঠেলা আছে। আর বিরক্ত কইরেন না জেডা। আঁর দুইন্যাইর কাম হড়ি রইছে।কালু পাটোয়ারী আস্তে আস্তে দোকানের দিকে এগোয়। দোকানদার কদির বাপ তার চায়ের কাপ এখনও গামলার পানিতে ধোয়নি। কাপের তলায় এতটুকুন চা রয়েছে। কদির বাপ জানে পাটোয়ারী চায়ের কাপ চেটে চুটে খায়! তলানির চা-টুকু ফেলে দিলে বা নষ্ট করলে এর খেসারত আরেক কাপ চা দিতে হবে।
দোকানে ফিরে নিজের চায়ের কাপ মুখের কাছে ধরে পাটোয়ারী। কী মনে করে তলানির চা টুকু কলামুড়ার দিকে ছুঁড়ে মারে। ক’দির বাপের দিকে তাকিয়ে আরেক কাপ চা চায় পাটোয়ারী। কদির বাপ আলীয়াকে এক কাপ চা আর একটা কুকিজ বিস্কুট হাতে দিয়ে নিজেই আধকাপ চা নিয়ে চুমুক দেয়। পাটোয়ারীর জন্য নতুন করে কেতলিতে পানি চড়িয়ে চুলার আঁচ বাড়িয়ে দেয়।হাডারী যাইবানি জানাজায়?যাইয়্যুম। কদির বাপের প্রশ্নের জবাব দেয় পাটোয়ারী। দৃষ্টি তার চলে যাওয়া মাইকের নিশানায়।
-তুঁইওতো মুক্তিযোদ্ধা। মইল্লে রাষ্ট্রের সম্মান হাইবা। এ-রে হাডারী, কেন্নে সম্মান ঢালি দেয় দেখছনি কোন?
পাটোয়ারীর জবাব না পেয়ে আলীয়াকে জিজ্ঞাসা করে, তুঁই যাইবানিও জানাজায়? আলীয়া কাপে শেষ চুমুক দিয়ে মাথায় প্যাঁচোনো গামছা খুলে একটা ঝাড়ি দিয়ে বলে, আঁই মনে অয় সময় হাইতান্নো। ক্ষেতে হাল জুড়িদি আইছি। হে বেলা কাম নো কইল্লে শেষ কইত্তাম হাইতান্নো।পাটোয়ারী পানের খিলি বানিয়ে নাকে শুঁকে মুখে ঢুকিয়ে দেয়। কয়েকবার দাঁতের আড়মোড়া ভেঙ্গে পানের পিক পুত করে ফেলে কলামুড়ার দিকে। কদির বাপেরে বাকি খাতায় লেখার ইশারা করে বাজারের দিকে হাঁটে।তালতলা ঘুরে এক ভাগ পুঁটি মাছ নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই ঠেলা খায় বাইন্নার ছেলের গায়ে। দু’কদম এগুতেই আলিমুদ্দির ডাক শুনে পেছন থেকে।-হাডারী, হাডারী। আরে হুনি যাও। চা খাই যাও।-না-ও, অন খাইতান্নো। কদম ফেলতেই দৌড়ে আসে আলিমুদ্দি। পাটোয়ারীর কানের সাথে মুখ লাগিয়ে বলে, খেয়াল কইচ্চনি বাইন্নার হুতে তোঁর মুই কেন্নে গোঁতাই রেনি রইছে!হ-রে আলিমুদ্দি। মুক্তিযুদ্ধের বেক কথা এ গেরামের মাইনষ্যে ভুলি গেছে।এ গাছগার বুকে কয়েকশ’খানেক রাইফেলের গুলি গাঁথি রয় ন-নি? গাছের গোড়ার মাডি খুঁড়লে হাওন যাইবে আংগো গেরামের একত্রিশ গা যোয়ান হোলাহাইনের হাড্ডি গুড্ডি। এই রাজাকাররা গেরামের উঠতি হোলাহাইন-ছাকি ধরি ইয়ানো মারি খাদাইছে। কিচ্ছু মনে রায়’ন গেরামের মাইনষ্যে।
-ঠিকই কইছতরে আলিমুদ্দি। তই মনে রাখছে বাইন্নার হুতে। হেতার রাজাকার বাপেরে আঁই ইয়ানো এ গাছের লগে বান্ধি গুলি কইচ্ছিলাম।হোমুন্দির হুতে আঁর বাড়িগাঁও জ্বালাই দিছিলো।তোতার মরণের খবর শোনার পর থেকে একটা অস্থিরতা পাটোয়ারীর মনকে নেড়ে যাচ্ছে। তার মনের মধ্যে যেন শত শত শিং মাছ ঘাঁই মারছে। পুরানো কথা সব যেন ঠেলে উঠছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে।মাথার বিষ ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেহে। মনে হচ্ছে পুরানো গর্ত থেকে কাদা পানিতে বেরিয়ে আসছে শত শত শিং মাছ। তাদের কিলবিল অস্থিরতা কাতর করে তুলছে পাটোয়ারীকে একান্তে। সে জ্বালার ভাগ কাউকে দিতে পারছে না পাটোয়ারী।তোতাইয়া কি আসলেই পাগল ছিল! নাকি পাগলের ভং ধরছিল। আজ বড় দুঃখ জাগছে, একদিনও তার খোঁজ করেনি পাটোয়ারী। কাছে গিয়ে কোনদিন জানতে চায়নি তার কথাগুলো।তোতাইয়া ভাইপুতেরা সম্পত্তির লোভে তার স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে এক রাতে জবাই করে। বিচারে আসামিরা খালাস। সেদিন তোতাইয়ার চিৎকারে পুরা গ্রাম কেঁপে উঠেছিল।এইনি বিচার! এইনি বিচার!! সারা রাত তার চিৎকারে কেউ জাগেনি। পরদিন থেকেই তোতাইয়া পাগল।গোসল সেরে কালু পাটোয়ারী ঘড়ির কাঁটায় চোখ ফেলে। বারোটা বেজে গেল। দ্রুত গায়ে পাঞ্জাবিটা চাপিয়ে আয়নায় চোখ ফেলে। আয়নায় নিজের বাঁকা হাসি দেখে। নিজেকে নিজেই তিরস্কার করে আহহারে হাইঞ্জাবি। তোরাইতো ছিলি আংগো বড় দুশমন। দেশ ছাড়া অইলেও আমরা তোগোরে ছাড়তাম হারি’ন। অন্তাই তোগো ভূত আংগো কাঁন্দে চড়ি বই রইছে। নিজের এরূপ ভাবনায় নিজেই চমৎকৃত হয়।দেশ স্বাধীন হলো। কত কিছু উল্টে পাল্টে গেল। যুদ্ধে সময় শত্রু মিত্র চোখে দেখা যেত, এখন যায় না। দেখতে একই রকম অথচ আচরণ ভিন্ন। আশ্চর্য! সেই কালচক্রের বেড়াজাল দিনে দিনে কারেন্টের জালে রূপান্তরিত হলো।এখনো পারিনি স্বাধীন হতে আমরা।
-হাডারী, হুইনছনি একখান কথা?তোতাইয়ারে, তৌবা আস্তাগফিরুল্লাহ্। তোতা ভাইরে হেতার ভাতিজারা বাড়িতে মাডি দিতে দিতো ন।ইয়ান আর তাজ্জব কী?বটগাছ তলে হঠাৎ থেমে যায় পাটোয়ারী।তোঁর মনে আছেনি কদির বাপ। খালের হাড়ে আঁই, সাকু আর তোতা এম্বুশ কইছিল্লাম। পাক আর্মির জীপ একখান হুলে উডনের লগে লগেই তোতইয়া গ্রেনেড ছাড়ি দিল। হের হর আমরা এলএমজি মাইল্লাম।
-হ, হ, মনে কইল্লেই বেক জাগি উডে।পাকিগো হরের জীপ হলাইতে যাই হড়লো খালে। হিয়ার হরে গেরামের মাইনষ্যের মাইর। এককারে ছেচি হালাইছে হোমুন্দির হুতেগোরে, আহ্হারে হিয়ার হরে দলে দলে রাজাকারগো আগুন.....স্কুলের মাঠের দক্ষিণ কোণে মাঠে শুয়ে আছে তোতা। আতর লোবানের গন্ধ ছিটিয়ে পড়ছে বাসাতে। লাশের পাশে দাঁড়ানো রাইফেলধারী দু’জন পুলিশ। বেঁচে থাকতে তার পরণে ছিল ছেঁড়া লুঙ্গি আর ময়লা জামা। গায়ের দুর্গন্ধে কেউ তার কাছে যেত না। আজ সাদা ধবধবে কাফনে মোড়ানো পবিত্র দেহ। খোদ রাষ্ট্রের দায়িত্বে সমাহিত করা হবে তাকে। একটা চিৎকার ফেটে আসতে চায় কালু পাটোয়ারীর গলা দিয়ে। তোতাইয়া তুই কত ভাগিচ্যা! মাইনষের কান্ধে উঠবি। সরকারের স্বীকৃতি তোর কপালে জুটছে। তুই কী দেখস্, তুই কী জানস্, তোরে লই মাইনষ্যের কেইঁক্যা তোড় জোড়।ওসি আর ইউএনও মাগরিবের আগেই আসে। তাদের সাথে এমএ এমএ আতাউর রহমান। লাশের খাটের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায় ওসি। দু’জন পুলিশ এ্যাটেনশন।হারামীর বাচ্চাদের জ্বালায় আমাদের আরাম হারাম হয়ে গেছে। দু’দিন পর পর একটা একটা মরে। কবর বানাও, স্যালুট মার। এ পাগলের বাচ্চাও নাকি মুক্তিযোদ্ধা? ওসির ছিটিয়ে দেয়া ক্ষোভের মধ্যে এসিডের ফোঁটা পড়ে পাটোয়ারীর কলিজায়। তার পুরাতন শরীরে নতুন রক্তের স্রোত হুংকার তোলে।
পাটোয়ারীর প্রচণ্ড চিৎকারে জনতা থমকে যায়। পাল্টা চিৎকার করে ওসি।
কেরে তুই! আমাকে ধমক মারিস?
এবার এগিয়ে যায় কদির বাপ, ওসিসাব আংগো তোতাইয়া একজন খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা। হেতে ভেজাল ন’। আর এতন, কালু হাডারী। এতনও মুক্তিযোদ্ধা।হালারপো মুক্তিযোদ্ধা! ঢুকা হালারে স্কুল ঘরে। দে ছেচা।ইঙ্গিত পেয়ে দু’জন পুলিশ দ্রুত এগিয়ে যায় পাটোয়ারীর দিকে।মাঠের শ’ জনতা শুধু চেয়ে থাকে।পাটোয়ারীর যখন হুঁশ আসে তখন কোমরে, মাথায়, কাঁধে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। বাম হাত দিয়ে অনুভব করে রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ। মাথার উপর নিজের ঘরের ভাঙ্গা চাল। ভেতর থেকে শোনে স্ত্রীর কান্না। পাশে বসে আছে কদির বাপ আর ছাকু। শুনতে পায় এমএ এমএ আতাউর রহমানের ভাষণ।কে কয় আংগো তোতা ভাইর কবরের জায়গা নাই। হেতার জায়গা সারা বাংলাদেশে। আন্নেরা চিন্তা কইরেন না। তোতা ভাইর কবরের জায়গা আঁই দিউম। আঁই ছোড আইতাম হারি কিন্তুক বেঈমান ন’। আঁর বাপের কবরের কিনারাদি হেতার কবর খোঁড়া অইছে। আন্নেরা কন আলহামমুলিল্লাহ্।কালু পাটোয়ারী চিৎকার দিয়ে উঠে, না-না মানুষ বেক কিছু ভুলি যাইতে হারে ন’ একজন রাজাকারের কবরের লগে একজন মুক্তিযোদ্ধার কবর অইতে হারে না।
পাটোয়ারীর মাথার ব্যান্ডেজ ক্রমশ ভিজে লালের পরিধি বেড়ে ওঠে, যেন পতাকার কলজের রং।
বিষয়: বিবিধ
১২২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন