ক্রসফায়ার

লিখেছেন লিখেছেন পদ্দ পাতার জল ২০ মার্চ, ২০১৩, ১১:৫৭:৩৬ সকাল

কানা রফিক যখন শহীদ ফারুক সড়ক

থেকে খানকাহ মসজিদের গলির

ভিতর ঝড়ের বেগে অদৃশ্য হয়ে যায়,

তখন সেখানে একটি লাশ

পড়ে থাকতে দেখে সবাই। আর

মুহূর্তের মধ্যে খালি হয়ে যায় পুরো শহীদ ফারুক সড়ক। সমস্ত

দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়

মুহূর্তেই। ঠিক সে সময়

হিনো এসি বাস

থেকে যাত্রাবাড়ীর

মাটিতে পা রাখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এলাকার

ছেলে শাহিনুল ইসলাম।

ব্যাগটা সামলে কাঁধে তুলে এক

নজর তাকায় তার আবাল্য পরিচিত

যাত্রাবাড়ী মোড়ের চারপাশটায়।

একটু ধাক্কা খায় সে। যে সড়কে তুমূল হরতালেও কোন

দোকান বন্ধ হয় না, সে সড়ক স্তব্ধ

কেন? কোন সমস্যা হয় নি তো? একটু

আনমনা হয়ে রিক্সার

তোয়াক্কা না করে হেঁটেই শহীদ

ফারুক সড়ক ধরে এগোয় সে। এই মিনিট পাঁচেকের পথই তো মাত্র!

বাম

কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে একবার।

ঠিক সাড়ে বারোটা বাজে।

মনে মনে হিসাব

করে দেখে বাসে সময় লেগেছে মাত্র সাড়ে চার ঘন্টা।

খুশি হয় সে। ভাবে,

মা'কে চমকে দেয়া যাবে। কারণ,

সব সময় সে ফোন করে জানিয়েই

বাড়ী ফেরে। কিন্তু এবার

কিচ্ছুটি জানায় নি। সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল শেষ হলো মাত্র

দু'দিন। থার্ড ইয়ারের ক্লাস শুরুর

আগে লম্বা ছুটি। বেশ মজা করেই

ছুটিটা কাটানো যাবে, ভাবে সে।

ভাবতে ভাবতে মাথা নীচু

করে হাঁটে শাহিন। শাহিনুল ইসলাম যদি রাস্তার

দিকে খেয়াল

করে এগুতো তাহলে হয়তো দূর

থেকেই আঁচ করতে পারতো বিপদটা।

কিন্তু যখন সে খেয়াল করল

লাশটা তখন তার মাত্র কয়েক হাত সামনে। প্রচন্ড ভয়ে সে প্রায়

লাফিয়ে ওঠে।

এতক্ষণে বুঝতে পারে রাস্তা ফাঁকা

হওয়ার কারণটা।

সে কি করবে না করবে বুঝে ওঠার

আগেই পশ্চিম দিক থেকে ঝড়ের বেগে এসে র্যাবের জিপটা হার্ড

ব্রেক করে ঠিক তার আর লাশের

সামনে। জিপ

থেকে লাফিয়ে নেমে মুহূর্তেই

র্যাব সদস্যরা ঘিরে ফেলে লাশ

আর তাকে। শাহিনদের বাড়ীর ঠিক

মাঝখানে বড়

আমগাছটা কাটি কাটি করে

কাটেননি শাহিনের বাবা।

গেলোবার যখন শেষবারের মত

তিনি স্ট্রোক করেন তখন নছিহত করেছিলেন, "আমার মৃত্যুর ঠিক পাঁচ

বছর পর গাছটা কাইটা ফালাইছ

রে শাহিন। তাইলে অর আর আমার

বয়স এক অইয়া যাইব।"

শাহিনের বাবা মারা গেছেন

প্রায় এক বছর হতে চললো। শাহিনের মা শোক কাটিয়ে ওঠার

পর থেকে একটু অবসর হলেই গাছের

নিচে পাতা ইজি চেয়ারটায়

গা এলিয়ে দেন। গাছের

ছায়াটাকে মনে হয় যেন মরহুম

স্বামীর স্নেহের ছায়া। তার শ্বশুর শখ করে চারা কিনে তার

স্বামীর হাত

দিয়ে লাগিয়েছিলেন যখন

শাহিনের বাবার বয়স পাঁচ বছর

তখন। এ জন্যই গাছটার

প্রতি একটা অবোধ মায়া পড়ে আছে তার।

আজও শাহিনের মা ভর

দুপুরে গাছের ছায়ায় বসে তসবিহ

টিপছিলেন। ঠিক তখনই মগডালের

একটা ডাল বলা নেই কওয়া নেই

হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়তে পড়তে আটকে যায়

অন্য ডালের সাথে।

অজানা আশঙ্কায় আঁৎকে ওঠেন

শাহিনের মা। গাছের ওপর

বসে থাকা কাকগুলো সমস্বরে কা কা

করে গাছের ওপর চক্কর মারতে থাকে। আর শাহিনের

মা ধড়ফড় করে উঠে চলে যান ঘরের

ভিতর।

সেই তখন থেকেই শাহিনের

মা কেমন যেন এক

অস্বস্তিতে ভুগতে থাকেন। বার বার তার মনে হয় কোন অঘটন

ঘটেনি তো! ভাবতে ভাবতে আবার

উঠানে আসেন।

ইজি চেয়ারে একবার বসেন, আবার

উঠে যান কি মনে করে। রাহেলার

মা'কে ডেকে বলেন, "খানা লাগাও তো রাহেলার মা।" আবার

উঠানে আসেন। আবার ঘরে ঢুকে বড়

মেয়ের বাসায় ফোন করেন।

মা'র কণ্ঠ শুনে মেয়ে কেমন ভয়

পেয়ে যায়। উৎকণ্ঠিত

কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, "কি হইছে মা, তোমার শরীর খারাপ

করছে না কি?"

"আরে না, তয় আমার মনডা খুব

বেতালা হইয়া গেছে।"

"ক্যান মা? কোন খারাপ খবর হুনছ

নি?" "না, তয় কতক্ষণ আগে হুদাহুদিই আম

গাছের আগার বড়

একটা ডালা ভাইঙ্গা পড়লো এমনে

এমনেই। হের পর থেইক্কাই

মনটা ছটফট করতাছে।"

মেয়ে একটু স্বস্তি পায়। স্বান্তনার সুরে মা'কে বলে,

"ডালা তো ভাংতেই পারে মা,

তুমি এইডা লইয়া খামাখা চিন্তা

কইরো না। আর শোন, আমি এক

ঘন্টার মধ্যেই তোমার

কাছে আইতাছি। ডরাইয়ো না তুমি।"

তার তিন মেয়েই এ রকম। মা'র একটু

অসুবিধা টের পেলেই

দৌড়ে এসে হাজির হবে মা'র

পাশে। শাহিনের

মা জানে বিকালের মধ্যেই তার ঘর ভরে যাবে তিন মেয়ে আর

নাতি-পুতিতে। বড় ছেলে তো লন্ডন

থাকে। আসে কয়েক বছর পর পর।

ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর

আসলো গতবার। মাসখানেক

থেকে গেলো। সে আর শাহিন যদি আসতে পারতো তাহলে তার ঘর

পূর্ণ হতো ষোলকলায়।

মেয়ের আশ্বাসে শাহিনের মা'র

অস্থিরতা একটু কমে।

টেবিলে লাগানো খাবার

দু'চারটা মুখে দিয়ে আবার এসে উঠানের ইজি চেয়ারটায়

গা এলিয়ে দেন তিনি।

র্যাবের হেড

কোয়ার্টারে জিজ্ঞাসাবাদ

চলছে শাহিনের। পাঁচ দিন পার

হয়ে গেছে এরই মধ্যে। র্যাব তন্ন তন্ন করে খোঁজ-খবর

নিয়েছে শাহিনের ব্যাপারে। না,

থানায় তার নামে কোন

মামলা বা ডায়েরী নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়েও তার

ব্যাপারে কোন অভিযোগ পাওয়া যায় নি। তার এলাকায়ও

খোঁজ-খবর নিয়েছে র্যাব। সবাই

ভালো রিপোর্ট দিয়েছে। কোন

হিসাব মিলাতে পারছে না র্যাব।

স্পট থেকে গ্রেফতার

করা হলো শাহিনকে, অথচ শাহিন কিছুই জানে না। তার বাসের

টিকিট এবং বাস কোম্পানীর

দেয়া তথ্য হুবহু এক।

তাহলে কি পরিস্থিতির শিকার

শাহিন? র্যাবের কাছে এ প্রশ্নের

উত্তর আসে শাহিনের পক্ষেই। কিন্তু তারপরও র্যাব

তাকে ছেড়ে দিতে পারে না। ঐ

খুনটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু

হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, খুন

হওয়া ব্যাক্তি প্রধান

বিরোধী দলের একজন প্রভাবশালী নেতা। এ

পরিস্থিতিতে যদি খুনিকে

গ্রেফতার করা না যায়

তাহলে সরকার বিরোধী আন্দোলন

চাঙ্গা হয়ে উঠবে। এ জন্য উপর

থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে কিছু একটা করার। হয় খুনিকে গ্রেফতার

করো, নয় গ্রেফতারকৃত

ব্যক্তিকে খুনি বানাও।

শাহিনের গ্রেফতারের খবর তার

মা ও বোনেরা জানতে পারে ঐদিন

রাতেই। অপরিচিত কে একজন বাড়িতে এসে খবর দিয়ে বখশিস

আদায় করে নেয়। শাহিনের

মা শয্যাশায়ী হন। তার বোন-

দুলাভাই চেষ্টা চালাতে থাকেন

শাহিনকে মুক্ত করতে। শাহিনের

জামিনের আবেদন আদালত কর্তৃক নামঞ্জুর হয়। তারা হতাশ

না হয়ে আবারো চেষ্টা চালান।

তার বড় ভাই ছুটে আসেন লন্ডন

থেকে।

শাহিনের গ্রেফতারের ছয়দিন পর

বিধ্বস্ত শাহিনের মা বড় মেয়েকে নিয়ে উঠানে এসে বসতেই

গাছের ডালে আটকে থাকা সেই

ভাঙ্গা ডালটা বাতাসের ধাক্কায়

গড়িয়ে পড়ে উঠানে। শাহিনের

মা স্তব্ধ হয়ে যান। শাহিনের

বোন জিজ্ঞেস করে, "কি হইছে মা, খারাপ লাগতাছে?"

তিনি কিছু বলেন না, বিষ্ফারিত

নেত্রে তাকিয়ে থাকেন ডালটার

দিকে। মেয়ের হাত শক্ত

করে আঁকড়ে ধরেন। বলেন, "কোন্

চ্যানেলে সংবাদ অয়রে অহন?" "ক্যা মা? তুমি দেখবা?"

মাথা নাড়েন তিনি।

মেয়ে মা'কে নিয়ে বসার

ঘরে গিয়ে বসে টিভি অন করে।

কিছুক্ষণ বসতেই শুরু হয়

প্রতি ঘন্টার সংবাদ। নিউজ হেডলাইন শুনতে শুনতে হঠাৎ

করে গগণ বিদারী চিৎকার

করে ওঠে শাহিনের বোন,

শাহিনের মা পাথরের মত নিশ্চল

হয়ে যান। বাড়ীর সবাই হন্তদন্ত

হয়ে ছুটে আসে বসার ঘরে। তখনই শুরু হয় পূর্ণ সংবাদ। ঘরের সবাই

একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়।

তারপরও তাদেরকে শুনতে হয়

সংবাদটি। সংবাদ পাঠক পড়ছেন,

"যাত্রাবাড়ীতে খুন

হওয়া বিরোধী দলীয় নেতার সন্দেহভাজন

হত্যাকারী গ্রেফতারকৃত

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শাহিনুল

ইসলাম আজ ভোর রাত

সাড়ে চারটায় ক্রস ফায়ারে নিহত

হয়েছেন। খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের জন্য ....."

সংবাদ পাঠক সংবাদ পড়েই চলেন।

আর শাহিনের

বাড়িতে জড়ো হওয়া স্তব্ধ

মানুষগুলোর চোখে অশ্রুর বান

ডাকলেও তা ক্রমশঃ বিক্ষোভে সংক্ষুব্ধ

ফেনায়িত সাগর তরঙ্গের

মতো ফুঁসতে শুরু করে।

[ঢাকা 22.05.05 - 10.06.05] আপত্তি জানান পছন্দের তালিকায় যোগ করুন

বিষয়: রাজনীতি

১২১৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File