মাধবকুন্ড জল প্রপাত।

লিখেছেন লিখেছেন জারা ৩০ মার্চ, ২০১৩, ০১:৩৫:৩৭ রাত

পাঠক আজ আপনাদের অসম্ভব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাবো, আমার তো ভালোলেগেছেই আশাকরি আপনাদেরও ভালোলাগবে। মাএ তিন বছর আগের কথা। এক সন্ধ্যায় আমার বর বাসায় ফিরলো অফিস থেকে, কিছুটা ক্লান্তি নিয়ে। কিছু সময় পরে ফ্রেশ হয়ে আমাকে বললো আগামী কাল আমরা অফিস থেকে সবাই মৌলভীবাজার মাধবকুন্ড জল প্রপাত দেখতে যাচ্ছি, তুমি যাবে? শুনে খুব খুশী হয়ে বললাম, কেন নয় ,শতবার যেতে রাজি আছি। আমার বর বললো যেতে চাইলে রাতের মধ্যেই প্রস্তুতি নিতে হবে। কাল ভোর ছটার মধ্যেই গাড়ি চলে আসবে। তখন আমার ছেলের বয়স মাএ দেড় বছর চলছে । ওর খাবার দাবার, ওর জন্য বাড়তি কাপড় চোপড় সব গুছিয়ে রাখলাম রাতের মধ্যেই যাতে খুব সকালে আমাকে তাড়াহুরো না করতে হয়। যথারীতি প্রতিরাতের মতো ঘুমিয়ে পরলাম। খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে আমার চখ্খু চরাগগাছে উঠলো। সিলেটে সেদিন ভোর রাত থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, এবং সেই সাথে মানুষ আতংকিত করার মতো ভয়ংকর

বজ্রপাতের গুরুম গুরুম পিলে চমকানো শব্দ। মুহুর্তের মধ্যে মন খারাপ হয়ে গেলো ভাবলাম যাওয়া আর বুঝি হলো না। কাল রাত থেকে যাওয়ার আনন্দটা ভন্ডুল হয়ে গেলো। আমার

বরও ইতিমধ্যে ঘুম থেকে জেগে উঠলো এবং আমার ব্যথিত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আর বাইরের তুমুল বর্ষনের শব্দে যা বোঝার বুঝে নিলো। সকাল আট ঘটিকার সময় বর্ষার বেগ কিছুটা কমে গেলে অফিস কলিগ সুফিয়ান ভাইয়ের মোবাইল আসলো আমার বরের কাছে , যাবে কিনা জানতে। সুফিয়ান ভাই আরো জানালো ওনার মিসেস গো ধরেছে যত বৃষ্টিই হোক না কেন ,সে যাবেই। এরকম একজন একজন করে দেখি সব ভাবীরাই সেদিন যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। তো আমি আর বাদ যাই কানো। আমার বরকে বললাম যাওয়ার কথা। ও শুনে বললো আমাদের বাবুটা অনেক ছোট ,বৃষ্টিতে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। বললাম গাড়িতেই তো যাচ্ছি , প্রয়োজনে ছাতা নিয়ে যাবো। শেষ পর্যন্ত

রাজি হলো। ঠিক সকাল সাড়ে নটায় গাড়ি আসলো, গাড়িতে চড়ার পর মনে হলো ,না এবার তাহলে আমরা যাচ্ছি। বৃষ্টি ভেজা দিন বেশ ভালোই লাগছে। আমাদের পথ চলা শুরু, আমাদের গাড়িতে আরো দুটা ফ্যামিলি , প্রত্যেকেরই বাচ্চা ছোট। পথ চলতে চলতে মোটামুটি সবার সাথে পরিচিত হলাম। একটা সময় আমরা মৌলভীবাজার চলে আসলাম। ওখান থেকে সোজা মাধবকুন্ডের পথ ধরলাম, সরু পথ । পথের দু ধারে উচু নীচু টিলা, টিলার উপরে কিছু বাড়ীঘরও দেখতে পেলাম। ভাবছি এত উচু টিলার উপর উঠানামা করা তো কষ্টকর। এরকম দেখতে দেখতে একসময় গাড়িটা বাক নিয়ে আরও সংকীর্ন একটা পথে ঢুকে গেল। আমরা দেখলাম অনেকগুলো পাহাড়ের গায়ে চায়ের বাগান। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজের সমারোহ। যেদিকে তাকাই দু চোখ জুরিয়ে

যায়। আর বৃষ্টির ছোয়ায় চা বাগানগুলো যেন সদ্য বিয়ে হওয়া নতুন বালিকা বধুর মতো পবিএ স্নিগ্ধতায় ভরপুর। কি যেন ডেকে ডেকে বলতে চাইছে এমনই এক মিষ্টি মধুর প্রাকৃতিক পরিবেশ। এরই মাঝে আমরা মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের প্রবেশ দ্বারে এসে পড়লাম। ভেতরে গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হয় না। আমরা সবাই এক এক করে গাড়ি থেকে নামলাম। বাইরে তখনও মৃদুমন্দ বৃষ্টি পড়ছিলো। তাই ঝটপট ছাতা বের করতে হলো। প্রবেশ পথে টিকিট কাটা হলে আমরা যে যার মতো এক এক করে চলতে শুরু করলাম। বৃষ্টিতে এমনিতেই পিচ্ছিল হয়ে গেছে পথ।( তখন রাস্তা পাকা করা হয়নি ,এখন অবশ্য রাস্তা ঠিক হয়েছে)

অনেকটা কর্দমাক্ত পথ ,সবারই পথ চলতে কষ্ট হচ্ছে। খুব দেখে শুনে পথ পাড়ি দিচ্ছি আমরা। কিছু পথ পার হওয়ার পরে দেখি আবার সেই চা বাগান। আরও সামনে খাসিয়া পল্লী। ওদের উচু উচু বাড়ীঘর । আমার কানে এমনি সময় ভেসে আসলো ,অনেক উপর থেকে পানি ঝরে পরার তীব্র অথচ মিষ্টি মধুর আওয়াজ। আরও একটু কাছে এগোতেই আমার আকাংখিত জল প্রপাতের দেখা পেলাম। প্রচন্ড বর্ষনে পানির স্রোত এত তীব্র যে মনে হচ্ছে আজ আর কারও রেহাই নেই ,সব কিছু সে ভাসিয়ে নিয়ে দুরের কোন অজানা পথের সন্ধান খুজছে। আর সেই সাথে কাকভেজা হয়ে কিছু অল্পবয়সী

ছেলে ছোকড়া ও মেয়েদের দল ঝর্ণা দেখে কলকল করতে করতে ফিরে যাওয়ার পথ ধরেছে। প্রায় সবার হাতেই ক্যামেরা। হয়তো আজকের এই স্মরনীয় দিনটাকে আরও স্মরনীয় করে রাখার তাগিদে কিছু ছবি তুলে নিয়েছে সাথে ।আমি আরও সামনে এগোতেই কিছু ভাড়াটে ফটোগ্রাফার ছুটে আসলো , ছবি তুলবো কিনা জানতে। আমাদের পখ্খ্য থেকে কে একজন বললো দরকার নেই , ক্যামেরা আছে। কিছু সময় পরই শুরু হলো সাথে আসা এক একটা ফ্যামিলির ফটোশেষন পর্ব।

আমি জল প্রপাতের কাছে না গিয়ে একটু দুর থেকেই দেখছি আর দেখছি। মনে হলো আল্লাহ তায়ালার কি অপার মহিমা । কত নিখুত ভাবেই না তিনি এই সুন্দর পৃথিবীটাকে তৈরী করেছেন। জলপ্রপাতের পানি অতি বৃষ্টির কারনে কাদা মাটির

প্রলেপে খুব ঘোলাটে রং ধারন করেছে। আর অনেক উচু থেকে পানি পরার শব্দ এত জোরালো যে, আমার কাছে এগোতে একটু ভয় ভয় করছে। জল প্রপাতের কাছে আমাদের গ্রুপ ছবি তোলার জন্য ডাকা হলো। গেলাম ওখানে। ছবি তোলা হলো। এত উচু থেকে জলপ্রপাতের জন্য আশেপাশে ধোয়ার মতো লাগছে, তার উপরে আবার বৃষ্টি তো আছেই।

প্রকৃতির এই ভয়ংকর সৌন্দর্য্য থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না, প্রকৃতি পুরোটাই আমাকে গ্রাস করে নিয়েছে। মনে হলো অনন্ত আদি কাল থেকে আমি বুঝি এরই অপেখ্খ্যাতে বসে আছি। আমি ধীরে ধীরে প্রকৃতির প্রেমে এতোটাই ডুবে গেলাম যে শত শত মানুষের চলার, কথা বলার শব্দ আমি বেমালুম ভুলে গেলাম। যেন আমি এই প্রকৃতির মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে দূর কোন অচেনা অজানা নামহীন অতি সুন্দর রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছি। একটা সময় আমার বর আমাকে সেই স্বপ্নের রাজ্যে থেকে ফিরিয়ে আনলো। বললো কি ব্যাপার কতসময় ধরে ডাকছি , বাবুটা কাদছে কখন থেকে। আমি দুহাত বাড়িয়ে আমার ছোট্র সোনামনিকে ওর বাবার কাছ থেকে নিয়ে এলাম । ফেরার সময় ঘনিয়ে আসলো । আসতে মন চাইছে না ,মনে হলো এখানেই থেকে যাই আমি, আমার সারাটি জীবন।

বিষয়: বিবিধ

১৯৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File