মহিয়সী নারী হযরত আছিয়া (আঃ) (নেফারতিতি)-অন্তিম পর্ব।

লিখেছেন লিখেছেন জারা ৩০ জুলাই, ২০১৩, ১০:৩৫:১০ রাত



এবার পাপাত্মা নিষ্ঠুর ফিরাউনের আদেশে তার অনুচরবর্গ আছিয়ার বড় ছেলেটিকে ধরে ডেকচির কাছে নিয়ে এলো। উহ! কি করুন আর হৃদয়বিদারক সে দৃশ্য! আল্লাহতায়ালার সৃষ্ট মাখলুকাত যেন থর থর করে কেঁপে উঠলো। পাপিষ্ঠের নির্দেশে জল্লাদ ছেলেটিকে ধরে নিয়ে উত্তপ্ত তেলপূর্ন ডেকচিতে নিক্ষেপ করলো। উহ! কি ভয়ানক সে দৃশ্য! দেখতে দেখতে ছেলেটির পবিত্র দেহটি গলে তেলের সাথে মিশে গেলো। দর্শকদের অন্তরাত্মাও ভয়ে আতংকে থর থর করে কেঁপে উঠলো। সবাই সে করুন দৃশ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো কিন্তু নিষ্ঠুর জালিম ফিরাউনের প্রানে এতটুকুও মায়া হলো না। নিজের ওরসজাত সন্তান উত্তপ্ত তেলের সাথে মিশিয়ে দিয়ে সে অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো। বড়ভাইয়ের দুর্দশা দেখে আছিয়ার অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা ভয়ে বিহবল হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। পাপীষ্ঠ হামান আবার আছিয়াকে অণুরোধ করলো-বেগম সাহেবা ! এখনও সময় আছে। আপনার মত পরিবর্তন করে অন্যান্য সন্তানগুলোকে রক্ষা করুন। আছিয়া জবাব দিলেন-যাকে আমি মিথ্যা বলে জানি,তাকে আমি সত্য বলে মেনে নিতে পারি না। আপনাদের কর্তব্য আপনারা করে যান। শুনে মহাপাপী ফিরাউন গর্জে বললো-উজির সাহেব ! একে আর বৃথা অনুরোধ করবেন না। বাকী ছয় ছেলে-মেয়েকেও ডেকচিতে নিক্ষেপ করুন। এরপর ফিরাউনের আদেশে নরপিশাচেরা আর একটি পুত্রকে এনে উত্তপ্ত তেলের ডেকচিতে নিক্ষেপ করলো। দেখতে দেখতে ছেলেটির পবিত্র দেহটি আগেরটির মতই তেলের সাথে মিশে গেলো। এরপর আর একটি। তারপর আর একটি। একে এক ছয় শিশুর পবিত্র দেহ উত্তপ্ত তেলের সাথে গলে গেলো। এখন শুধু বাকী সর্বকনিষ্ঠ দু,বছর বয়স্ক ছেলেটি। আছিয়া পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল, নিস্তব্ধ হয়ে শুধূ এ নিদারুন নির্মম দৃশ্য দেখছেন। তাঁর চোখেও একফোঁটা অশ্রু নেই। মুখেও বাক্যস্ফুরণ নেই। ফিরাউনের আদেশে জল্লাদ কচি শিশুটিকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আনতে গেলো। ছেলেটি ভয়ে চিৎকার করে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। আছিয়া অনেক আগেই ছেলেটিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু শিশুটি মায়ের গলা এমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো যে , জল্লাদ শত চেষ্টা করেও শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিতে পারলো না। বুঝি জল্লাদের হাতও অবশ হয়ে এসেছিলো। অনেক চেষ্টা করেও জল্লাদ ব্যর্থ হলো। তখন জালিম ফিরাউন এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালো শিশুটির দিকে। পিতার আহবানে অবোধ শিশুটি স্থির থাকতে না পেরে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার কোলে। হতভাগ্য অবোধ শিশুটি হয়ত ভেবেছিলো তার মা তাকে জল্লাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। পিতা হয়তো বা ওই নিষ্ঠুরদের হাত থেকে রক্ষা করবে। হায়রে হতভাগ্য অবোধ শিশু ! তুমি তো জান না তোমার পিতাই ওই নরপিশাচদের মধ্যে বড় নরপিশাচ! নিষ্ঠুর নির্মম পাষান। এরপর ? মহাপাপী নির্মম পাষান ফিরাউন নিজ ওরসজাত শিশু সন্তানটিকে নিজের হাতেই সে ভীষন উত্তপ্ত তেলের ভেতর নিক্ষেপ করলো। উহ! কি হৃদয়বিদারক কান্ড! পাপাত্মা নররূপী পশু উম্মত্ত হয়ে মহাপাপী ইবলিসকেও আজ পরাজিত করলো। শয়তানের শিরোমনি হামান আবারও আছিয়াকে বললো- বেগম সাহেবা! একবারের জন্য হলেও মহামান্য বাদশাহকে স্রষ্টা বলে স্বীকার করে নিন। তাহলে অন্তত আপনার প্রান রক্ষা হবে। আছিয়া জবাব দিলেন- আপনাদের যা ইচ্ছা তাই করুন। আমাকে বৃথা অনুরোধ করে বিরক্ত করবেন না। পাপীষ্ঠ ফিরাউন ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো-আর অনুরোধের দরকার নেই উজির সাহেব। একেও আমি পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেবো, কিন্তু উত্তপ্ত তেলের ডেকচিতে নিক্ষেপ করলে বিনা যন্ত্রনায় মুহূর্তেই ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এতে আমার মনের জ্বালা মিটবে না। একে আমি আস্তে আস্তে অধিক কষ্ট দিয়ে মারবো । আমি বুঝিয়ে দেবো-ফিরাউনকে খোদা বলে না মানার প্রতিফল কিরূপ ভয়াবহ।

#আছিয়ার মৃত্যুঃ--

যতদিন মানুষ ও জীব-জন্তু পৃথিবীর বুকে বিচরন করবে, ততদিন এ দুনিয়ার ইতিহাসে এ নররূপী পশু ফিরাউনের এ নিষ্ঠুর কলঙ্ক কাহিনী জ্বলন্ত অক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। সাতটি শিশু সন্তানের নৃশংস হত্যাকান্ড স্বচক্ষে দেখেও আছিয়া ধীর-স্থির অবিচল অটল । পাপাত্মা হামান আবার বললো-বেগম সাহেবা ! রাজ্যের প্রতিটি প্রজা আপনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছে। আমিও আপনার জন্য দুঃখিত। কিন্তু কি করবো? কর্তব্যের খাতিরেই আমাকে এ সব অপ্রীতিকর কাজগুলো করতে হচ্ছে। তাই আমি শেষবারের মতো আপনাকে আবার অনুরোধ করছি। স্রষ্টা বলে স্বীকার করে নিয়ে আপনার মহামূল্যবান জীবনটি রক্ষা করুন। কেন অহেতুক একটা জেদের বশবর্তী হয়ে স্বেচ্ছায় নিজের জীবনটাকে ধ্বংস করে দেবেন? পাপীষ্ঠ হামানের কথা শুনে আছিয়া বললেন--চুপ কর নরাধম পাপিষ্ঠ ! আমি তোর কোন কথাই শুনতে চাই না। সামান্য জীবন রক্ষার আশায় আমি মিথ্যাকে কখনও সত্য বলে মেনে নিতে পারবো না। তোর সহানুভূতির আমার দরকার নেই। আল্লাহর পবিত্রতা রক্ষার জন্য সাতটি সন্তানকে বিসর্জন দিয়েছি, এখন এ তুচ্ছ প্রানের জন্য কিসের মায়া মমতা ?

তবে আমিও তোমাদের শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি--ওই সর্বনাশা পাপের পথ থেকে সরে দাড়াঁও। আমার নিজের জন্য কোন দুঃখ নেই। আল্লাহ আমার সন্তানদের দান করেছিলেন, আজ আল্লাহর দান আল্লাহ ফেরত নিয়েছেন, এতে আমার দুঃখ করার কিছুই নেই, তবে আমার মনে একটি দুঃখ রয়ে গেলো-মৃত্যুর আগে স্বামীকে আমি সুপথে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত দেখে যেতে পারলাম না। আছিয়ার কথা শুনে পাপীষ্ঠ ফিরাউন চিৎকার করে বললো-মন্ত্রী সাহেব ! আমি আর এ অবাধ্য নারীর কোন কথাই সহ্য করতে পারছি না। ও কিছুতেই আমাকে স্রষ্টা বলে স্বীকার করবে না। তাই একেও আমি এ দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় করে দেবো। আপনি একটা পেষন যন্ত্র নিয়ে আসুন। ওই পেষন যন্ত্রের ভেতরে আবদ্ধ করে আমি একে তিলে তিলে দুঃখ যন্ত্রনা দিয়ে নিঃশেষ করে দেবো। দুনিয়ার মানুষ দেখবে ফিরাউনকে খোদা বলে স্বীকার না করার কি ভয়াবহ প্রতিফল। এরপরে পাপীষ্ঠ ফিরাউনের আদেশে একটি মজবুত পেষন যন্ত্র আনা হলো এবং আছিয়াকে তাতে আবদ্ধ করা হলো, ধীরে ধীরে পেষন যন্ত্র কষতে লাগলো। ভীষন যন্ত্রনায় আছিয়ার বাকশক্তি রুদ্ধ হয়ে গেলো। পাপীষ্ঠ হামান বললো-মাননীয় বেগম সাহেবা ! আপনার জন্য সত্যি আমার দুঃখ হচ্ছে। আপনি শুধু মৌখিক ভাবে খোদা বলে স্বীকার করুন। আপনাকে এ মহাযন্ত্রনা থেকে রেহাই দেয়া হবে। আছিয়া নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলেন। ফিরাউন গর্জে বললো-পেষন যন্ত্র আরও কষে দাও। হুকুম পেয়ে জল্লাদ ধীরে ধীরে পেষন যন্ত্র কষতে লাগলো। আছিয়ার দেহের মাংস পেশীগুলো ফেটে তা থেকে রক্ত ক্ষরন শুরু হলো। মর্মান্তিক যন্ত্রনায় নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলো আছিয়ার প্রানশক্তি। তিনি অতি ক্ষীণ কন্ঠে বলতে লাগলেন-ওগো দয়াময় আল্লাহ ! মূর্খ মানব অজ্ঞতাবশতঃ তোমার অবাধ্যতা করছে। তুমি তাদেরকে সুপথে পরিচালিত করো। নিশ্চয়ই তুমি গাফুরুর রাহীম, তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর। এরপরে আর কিছু বলতে পারলেন না আছিয়া। ধীরে ধীরে তার বাকশক্তি রহিত হয়ে গেলো। চিরতরে স্তব্ধ হলো প্রানশক্তি। অব্যক্ত কঠোর যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে প্রান সহসা বের হয়ে গেলো। যাবার আগে শুধু ক্ষীন কন্ঠে উচ্চারন করে গেলেন------লা -ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এরপর পবিত্র আত্মাটি দেহ ছেড়ে অসীম অনন্তে মিশে গেলো।

"ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন"

বিষয়: বিবিধ

৬৮২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File