মহিয়সী নারী হযরত আছিয়া (আঃ) (নেফারতিতি)।-১১
লিখেছেন লিখেছেন জারা ২৮ জুলাই, ২০১৩, ০৯:১৭:০৭ রাত
# আছিয়ার কারাবাসঃ--
আরম্ভ হলো আছিয়ার কঠোর পরীক্ষা। কয়েকদিন যাবত সাতটি ছেলেমেয়ে সহ কয়েদখানায় বন্দিনী হয়ে চোখের অশ্রুতে বুক ভাসাচ্ছেন আছিয়া। তাঁর নিজের জন্য নয়। অবুঝ অবোধ আর নিরাপরাধী ছেলে-মেয়েগুলোর জন্যই তাঁর দুঃখ । ক্ষুধা তৃষ্ঞায় সকলেরই প্রান ওষ্ঠাগত। অন্ধকার কারাগারে যে প্রকোষ্ঠে তারা বন্দী ,এর এক পাশে নিষ্ঠুর জালিমের দল একটি ভীষন দুর্গন্ধযুক্ত গলিত মৃতদেহ রেখে দিয়েছে। এর গন্ধে প্রান বের হতে চায়। তদুপরি কয়েকদিন যাবৎ পানাহার বন্ধ। দু,বছরের শিশুটির কন্ঠ শুকিয়ে গেছে। এখন আর কাঁদতেও পারছে না। তাই অবোধ শিশুদের ক্রন্দনে পাষানও বিগলিত হয়ে যেতে চাচ্ছে, কিন্তু মহাপাপী ফিরাউনের নিজের ওরসজাত সন্তানগুলোর জন্য একটুও দয়ামায়ার লেশ মাত্র নেই। ছেলে-মেয়েদের ভেতর যারা একটু বয়স্ক ,ভাল-মন্দ বুঝার শক্তি যাদের রয়েছে, তারা মায়ের মতোই ধৈর্য্যধারন করে চুপ করে রয়েছে। ক্ষুধার জ্বালায় প্রান বেরিয়ে যেতে চাইছে তবু এতটুকু দুঃখ প্রকাশ করছে না। দুঃখ ও বেদনার কোন ছাপই তাদের চেহারায় দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তারা যেন এর জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিলো। কোন শঙ্কা নেই, ভীতি নেই। সবাই নির্বিকার, ধীর স্থির। যে কোন বিপদের মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত। তৃষ্ঞায় ফেটে যাচ্ছে ,তবু তারা মায়ের মতোই ধীর স্থির অবিচল। কিন্তু দু,বছর বয়স্ক দুধের বাচ্চাটি কিছুতেই কান্না থামাচ্ছে না। পিপাসায় তার প্রান ফেটে যাচ্ছে। বারে বারে পানি চাচ্ছে, কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে পানি! এদিকে মায়ের স্তনের দুধও শুকিয়ে গিয়েছে। সুতরাং পিপাসায় শিশু বাচ্চাটি ছটফট করছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়ত তার প্রান বেরিয়ে যাবে, কিন্তু কি করবেন আছিয়া। নিরুপায় তিনি। পানি পাওয়ার কোন উপায় নেই। পাপাত্মা ফিরাউনের আদেশে কারাগারের রক্ষীরা ভুলেও এদিকে উঁকি দেয় না। কার কাছে পানি চাইবেন? আছিয়ার জৈষ্ঠ্য পুত্রটি মায়ের চোখের অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে বললেন-আপনি কাদঁছেন কেন মা? আমাদের অদৃষ্টে যা ছিলো, তাই হয়েছে, পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করলে মৃত্যু আছেই। যিনি আমাদের স্রষ্টা, তিনিই আমাদের জন্য এ দুঃখ কষ্ট নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে তাঁর কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত আছে। আছিয়া বললেন- না বাবা, আমি মৃত্যু ভয়ে কাদঁছি না। আমার মনে এ দুঃখ, তোমার পিতাকে সৎপথে দেখে যেতে পারলাম না। তোমার পিতার এ পাপ কাহিনী শুনে দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ কিয়ামত পর্যন্ত তাকে ধিক্কার দেবে। ছেলেটি বললো-সে জন্য দুঃখ করে লাভ নেই মা। যে যেমন কর্ম করবে, সে তেমনি ফল ভোগ করবে। এদিকে পাপাত্মা হামান প্রতিদিন কারাগারে এসে আছিয়ার সাথে সাক্ষাত করে এবং ফিরাউনকে স্রষ্টা বলে স্বীকার করে নেয়ার জন্য অনুরোধ করে। আছিয়া উত্তর দেন, আমাকে বৃথা অনুরোধ করে লাভ নেই! একমাত্র আল্লাহব্যতীত আর কাউকে আমি স্রষ্টা বলে মানতে রাজী নই। সেদিন পাপাত্মা ফিরাউন হামানের সাথে কারাগারে এসে উপস্থিত হলো। হামান বললো- বেগম সাহেবা! আপনি বুদ্ধিমতী নারী। মহামান্য বাদশাহ আপনার স্বামী । স্ত্রীর কাছে তার স্বামী ভক্তির পাত্র। স্বামীর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা প্রত্যেক স্ত্রীর একান্ত কর্তব্য। আপনার স্বামীকে খোদা বলে স্বীকার করলেই যদি তিনি খুশী হন, তবে আপনার তাই করা উচিত। ছেলে-মেয়ে অশেষ যাতনা ভোগ করছে। তাই আমি শেষ অনুরোধ করছি, আপনি মত পরিবর্তন করে বাদশাহকে স্রষ্টা বলে স্বীকার করে নিয়ে নিজে মুক্ত হোন, ছেলে-মেয়েদেরকেও রক্ষা করুন। শুনে আছিয়া বললেন-আর আমাকে বৃথা অনুরোধ করবেন না। আমার স্বামীকে যতটুকু ভক্তি-শ্রদ্ধা করার প্রয়োজন , তা আমি চিরদিন করে এসেছি, বেচেঁ থাকলেও করবো। কিন্তু বিশ্বজগতের স্রষ্টার আসনে আমি কিছুতেই তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো না। মানুষ কখনো স্রষ্টা হতে পারে না। এতোবড় মিথ্যা কথাকে আমি সত্য বলে কখনো মেনে নিতে পারি না। মনে রাখবেন আপনাদের শত অত্যাচার আমাকে দ্বীন বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।
# ইমানের এক চুড়ান্ত পরীক্ষাঃ--
অবশেষে পাপাত্মা ফিরাউন এসে আছিয়াকে বললো-শুন আছিয়া, শুধু তোমার অন্যায় জেদের জন্যই তোমার পুত্র-কন্যাদের আজ এ দুর্দশা। অন্তত এদের মুখের দিকে চেয়ে তোমার মত পরিবর্তন করো। নইলে আমার ক্রোধানল থেকে তোমরা কেউ রক্ষা পাবে না। শুনে আছিয়া সুদৃঢ়কন্ঠে বললেন-স্বামী মৃত্যু ভয়ে ভীত আমি নই। একমাত্র আল্লাহব্যতীত কাউকে ভয় করি না। তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। আমি এখনো আপনাকে অনুরোধ করছি, যদি আল্লাহর ভয়ঙ্কর গজব থেকে রক্ষা পেতে চান, তাহলে পাপের পথ পরিহার করুন। আপনার মত পরিবর্তন করুন। নতুবা আল্লাহর গজব থেকে কিছুতেই রেহাই পাবেন না। আছিয়ার কথা শুনে পাপাত্মা ফিরাউন ক্রোধে গর্জে বললো-এখনও তোমার তেজ কমেনি। উজির সাহেব! আপনি আর এ অকৃতজ্ঞ নারীকে বৃথা অনুরোধ করবেন না। আমিও একে দেখিয়ে দেবো, এর জেদ বড় , না ফিরাউনের ক্ষমতা বড়। আমি ঐ উত্তপ্ত তেলে সন্তানগুলোকে নিক্ষেপ করে এর এ জেদের উপযুক্ত প্রতিফল প্রদান করবো। পাপীষ্ঠ হামান তার কথা মতই বৃহৎ একটা ডেকচিতে তেল উত্তপ্ত করলো। জ্বলন্ত আগুনের তাপে ডেকচিতে তেল টগবগ করে ফুটঁতে লাগলো। ভয়াবহ এ দৃশ্য দেখার জন্য চারদিক লোকে লোকারন্য হয়ে গেলো। সবাই দুঃখিত। ভীত -সন্ত্রস্ত, কারও মুখে শব্দ নেই। প্রতিবাদ করার সাহস নেই। কারন ফিরাউনের আদেশ, আছিয়ার পক্ষে কেউ কোন কথা বললে, তাকেও ডেকচিতে নিক্ষেপ করা হবে। সেজন্য ইচ্ছে থাকলেও কারও কিছু বলবার সাহস ছিলো না। কেউ কেউ এসে চুপি চুপি আছিয়াকে অনুরোধ করলো-বেগম সাহেবা! আমাদের মুখের দিকে চেয়ে আপনি মত পরিবর্তন করুন। বাদশাহকে একবার মাত্র স্রষ্টা বলে স্বীকার করে নিজের এবং ছেলে-মেয়েদের প্রাণ রক্ষা করুন। কিন্তু সকলের অনুরোধই বিফলে গেলো। আছিয়ার কানে যেন কিছুই প্রবেশ করলো না। তিনি শুধু এক মনে যেন চিন্তা করছেন আর অস্ফুট স্বরে কি যেন বলছেন। পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে আছেন। সকল ভয় ভাবনার উর্ধ্বলোকে যেন বিচরন করছে তাঁর পবিত্র আত্মা!!
চলবেঃ--
বিষয়: বিবিধ
২৫৩৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন