মহিয়সী নারী হযরত আছিয়া (আঃ) (নেফারতিতি)। -০৮
লিখেছেন লিখেছেন জারা ০৮ জুলাই, ২০১৩, ০৯:৩০:৫৫ রাত
ক্রমান্বয়েই দিন যেতে লাগলো। বালক মূসা দিন দিন বড় হতে লাগলেন। তাঁর শারীরিক বৃদ্ধি অন্যান্য বালকের চেয়ে দ্বিগুন। আছিয়াকেই মূসা মা বলে ডাকতেন এবং তাঁর আপন মাকে ধাত্রী মা বলে জানতেন। আছিয়া মূসার মায়ের হাবভাব দেখে বুঝতে পেরেছিলেন, এ ধাত্রীটিই মূসার প্রকৃত মা ,কিন্তু সে মূসার অমঙ্গল আশঙ্কায় মনের ভাব কারও কাছে প্রকাশ করতো না যে, মূসা তার গর্ভজাত পুত্র। আছিয়া ছিলেন বিদুষী মহিলা। তাই তিনি পালিত পুত্র মূসাকে গোপনে লেখাপড়া শেখাতে লাগলেন । বালক মূসার জ্ঞান ও স্মরনশক্তি ছিলো অসাধারন। তাই অল্পকালের মধ্যেই আছিয়ার কাছে শিক্ষা প্রাপ্ত হয়ে মহাপন্ডিত হয়ে ওঠেছিলেন। এরপর মূসা আস্তে আস্তে পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থ সমূহ পাঠ করতে লাগলেন। ফলে বালক মূসা অল্পকালের মধ্যে ধর্মের দিক দিয়েও গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর তীক্ষবুদ্ধি ও ধর্মীয় জ্ঞান দেখে আছিয়া খুবই আনন্দিত হলেন। এরপর থেকে মাতা পুত্র মিলে গভীর রাতে আল্লাহর ইবাদত করেন এবং গোপনে ধর্মালোচনাও করেন। কারন দিনের বেলা ইবাদত বা ধর্মালোচনা করা সম্ভব ছিলো না। মূসা মাঝে মাঝে ফেরাউনকেও নানারূপ ধর্মোপদেশ দিতে লাগলেন। তা শুনে ফেরাউন ক্রোধে ফেটে পড়তো। তার সন্দেহ উত্তরোত্ত্বর বেড়েই চললো। কারন জ্যোতিষী তার শত্রু সম্বন্ধে যে সব লক্ষনাবলী বর্ণনা করেছিলো ,তার সবগুলো লক্ষনই মূসার মাঝে প্রকাশিত হতে লাগলো। তাই দিনদিন ফেরাউনের শত্রুভীতি ক্রমেই প্রবল হতে লাগলো। মাঝে মাঝে ফেরাউন মূসাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, কিন্তু আছিয়ার জন্য পারে না। আছিয়া তাকে প্রান অপেক্ষাও বেশী ভালবাসতেন। এদিকে ফেরাউন পড়লো মহাসঙ্কটে। একদিকে মূসার ভয়ে সর্বদা কম্পমান থাকতে হয়। কিন্তু তা সত্বেও সে কাউকে খুলে বলতে পারে না। কারন তাতে তার দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে যায়। অন্যদিকে প্রজাদের কাছে সে স্বয়ং স্রষ্টা বলে পরিচিত। সুতরাং স্রষ্টা হয়ে সামান্য একটি যুবককে ভয় করা তার পক্ষে শোভা পায় না। এমনি চিন্তায় পড়ে ফেরাউন একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলো। এদিকে আছিয়া তার স্বামীকে সৎপথে আনার জন্য নানারূপ চেষ্টা করেন। ফেরাউন সবদেখে শুনে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেন। তাই মাঝে মাঝে সে আছিয়াকে অশেষ নির্যাতনও করেন। আছিয়া যতই তাকে সৎপথে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন, ততই ফেরাউনের নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে লাগলো। এমনিভাবে আরও বহু বছর অতিবাহিত হলো। পাপাত্মা ফেরাউনের দুশ্চিন্তার মাত্রা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। কারন এতোদিন মূসা তাকে ধর্মোপদেশ দিতেন। এখন রাজ্যের প্রজাদের কাছে গিয়েও মূসা হিতোপদেশ দেন এবং তাদেরকে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য অনুপ্রেরনা দিতে থাকেন। মূসার প্রচেষ্টায় এখন রাজ্যের অনেকেই তার বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। এমনকি অন্তরঙ্গ বন্ধু- বান্ধবগন এবং সভাসদগন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধাচরন করতে শুরু করেছে। তাই ক্রোধে উম্মাদ হয়ে একদিন ফেরাউন মূসাকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। সে মুহূর্তে কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মচারী এসে তাকে বাধাঁ দিলো এবং রাজসভায় এ বিষয় নিয়ে সভাসদগন তীব্র প্রতিবাদ জানালো। দিশেহারা হয়ে ফেরাউন ভাবতে লাগলো, মূসা নিশ্চয়ই যাদুকর । নইলে যে সমস্ত লোকেরা তাকে দেখে ভয়ে কম্পমান থাকতো । তাঁর সামনে দাড়িয়ে কথা বলতে সাহস পেতো না, আজ তারা কোন সাহসে তার কাজে প্রতিবাদ করে? সব অনর্থের মূলে মূসা ।এরই প্ররোচনায় তাদের দৌরাত্ম বেড়ে গেছে। যেমন করেই হোক মূসাকে শেষ করতেই হবে। আবার ভাবে মূসাকে শেষ করে দেয়াও এতো সহজ কথা নয়। আগে বাধা দিতো তার স্ত্রী আছিয়া। আর এখন রাজ্যের বহু আমীর ওমরাহ এমনকি সভাসদগনও এ কাজে বাধা দেয় এবং ঘোর প্রতিবাদ করে। সুতরাং তাদের বাধা অমান্য করলে অচিরেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে। একদিন একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী প্রকাশ্যে রাজসভাতে দাড়িয়ে ফেরাউনকে বললো- আপনার অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বনি ইসরাইলগনকে আপনি বিনা অপরাধে সীমাহীন নির্যাতন করছেন। বনি ইসরাইলগন যা করেছে ঠিকই করেছে , তারা কেনো আপনাকে স্রষ্টা বলে মানবে? আপনি কি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, আপনি কি তাদেরকে লালন-পালন করেছেন? নিশ্চয়ই করেননি। তা সত্বেও তাদেরকে কেনো নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করে চলেছেন? স্মরন রাখবেন,সবকিছুরই একটা মাত্রা আছে, সে মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে তার পতন অবশ্যম্ভাবী। অণ্যায়কারীকে আল্লাহ কখনও ক্ষমা করবেন না। আল্লাহর ক্ষমতার কাছে আপনার ক্ষমতা অতি নগন্য এবং তুচ্ছ। মূসা সত্য কথাই বলেছে। এখনও সময় আছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করুন। তাঁর আদেশ নির্দেশ মান্য করে চলুন। বলে লোকটি ক্রোধভরে রাজসভা ত্যাগ করে চলে গেলো। ফেরাউন বিমূঢ়ের মতো চেয়ে রইলো। লোকটিকে বাধা দেয়ার মতো সাহস তার হলো না। এরপর দুঃখিত মনে ফেরাউন মহলে প্রবেশ করলো এবং আছিয়ার কাছে মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য এলো। সে সময় সে শুনতে পেলো আছিয়া একটি চিরুনী উঠিয়ে নেবার সময় বলেন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। তা শুনে ফেরাউন ক্রোধে আরও জ্বলে উঠলো। বললো- আছিয়া, তোমাকে নিষেধ করেছি, আমার মহলে থেকে তুমি এই কথা কখনও উচ্চারন করো না। আছিয়া বলেন- ক্যানো শাহেনশাহ! এ কথা শুধূ আমি কেন, প্রত্যেকেরই বলা উচিত। কারন ত্রিভূবনের মালিক আল্লাহ খুবই সন্তুষ্ট হন এবং প্রত্যেক কাজেই বরকত দান করেন। শুনে পাপাত্মা ফেরাউন বাঘের মতো গর্জে উঠে। বললো-কাকে তুমি উপদেশ দিচ্ছো আছিয়া! তোমার কি প্রানের ভয় নেই? মনে রেখ , আমার একটি আদেশে তোমার মতো শত -সহস্র নারীর মস্তক ভূ-লুন্ঠিত হতে পারে। সুতরাং ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হয়ে যাও--বলে ফেরাউন বেরিয়ে গেলো।
# আছিয়ার প্রার্থনাঃ--
গভীর রাত। ফেরাউনের বিশাল রাজ্যের সবাই নিদ্রার কোলে আশ্রয় গ্রহন করেছে। জেগে আছেন শুধূ আছিয়া। একটি নির্জন কক্ষে বসে দু,চোখের অশ্রুতে বক্ষস্থল প্লাবিত করে দু, হাত তুলে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করছিলেন-দয়াময় প্রভু! আপনার ইচ্ছে আর আদেশ ব্যতীত একটি গাছের পাতাও পড়ে না, যখন যা ইচ্ছে তাই আপনি করতে পারেন। আপনার ইচ্ছায় বাধা দেয়ার সাধ্য কার আছে? হে সর্বশক্তিমান আল্লাহ ! আপনি আমাদেরকে মঙ্গলের পথে পরিচালিত করুন। আপনার ন্যায় ও সত্য পথের উপর অবিচল ও অটল থাকার সুদৃঢ় মনোবল দিন। আমরা যেন আপনার পবিত্র নাম জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত স্মরন করে যেতে পারি। আমাদের যদি মৃত্যু প্রদান করেন, যেন আপনার প্রতি সুদৃঢ় ইমান রেখে মরতে পারি। হে করুনাময় ! আমার অবুঝ স্বামীকে আপনি অতি হীন অবস্থা থেকে উন্নীত করে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী করেছেন, কিন্তু সে আপনার অসীম দয়াকে ভূলে গিয়ে আপনার বিরুদ্ধাচরন করছে। তার হৃদয়ে অহংকার আর দাম্ভিকতার দরুন আপনার প্রতি অবাধ্যতা প্রকাশ পেয়েছে! সে অবুঝ, নাদান। তাই এটা যে তার কত বড় অন্যায় তা সে মোটেই উপলদ্ধি করতে পারছে না। হে মহাপ্রভু! আপনি দয়া করে তার ভূল ভেঙ্গে দিন। তার হৃদয় থেকে পাপ কালিমা দূর করে দিন। হে রাব্বুল আলামীন ! আমার স্বামী নির্বোধ,অধম। তাকে জ্ঞান-বুদ্ধি বিবেক দিন। যেন সে আপনার অসীম কুদরতের মাহাত্ম্য উপলদ্ধি করতে পারে।
চলবেঃ---
বিষয়: বিবিধ
২১৬২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন