মহিয়সী নারী হযরত আছিয়া (আঃ) ( নেফারতিতি)। পর্ব-৪
লিখেছেন লিখেছেন জারা ১৭ জুন, ২০১৩, ০৬:৪২:০৬ সন্ধ্যা
ফেরাউনের উক্ত দম্ভোক্তি ঘোষনা দেয়ার পরে বন্ধু হামান শিউরে উঠলো। বললো -এসব কি বলছো! তা কি করে সম্ভব? তখন পাপিষ্ট নরাধম ফেরাউন বললো- আমি অসম্ভবকেই সম্ভব করতে চাই হামান। হামান প্রতিউত্তরে বললো -এ বিশ্বের স্রষ্টা তো একজন আছেন। যিনি তোমাকে, আমাকেএবং বিশ্বভূবনের সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন। মানুষের হায়াত ,মউত, ধনদৌলত সবকিছুই তার কাছে , তিনিই তো বিধাতা। তুমি আবার বিধাতা হবে কি করে? পাপিষ্ট ফেরাউন তখন উত্তরে বললো-আমি তাই হতে চাই বন্ধু। আপাততঃসারা পৃথিবীর খোদা না হতে পারলেও এ মিসর দেশের খোদা আমিই হবো। হামান বললো - তা হয়না বন্ধু। এমন কখনোও বলো না! তুমি নিজেকে খোদা বললেও দেশের লোক কখনও তোমাকে খোদা বলে স্বীকার করবে না। কারন দেশের প্রায় লোকই নবী ইউসুফ (আঃ) এর সত্য দ্বীন পালন করে । তারা নিরাকারের ইবাদত করে। তুমি নিজেকে বিধাতা বলে ঘোষনা করলেও তারা কিছুকেই তোমাকে খোদা বলে মানবে না; বরং আরও বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। বিভিন্ন দিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে। এসব কথা শুনে ফেরাউন ক্রোধে জ্বলে উঠে বললো-এ সাম্রাজ্যে কার এমন শক্তি আছে, আমার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাড়াঁবে? আমি তাকে ধ্বংস করে দেবো। তখন প্রধানমন্ত্রী হামান ফেরাউনকে বললো-সারা দেশের লোক যদি তোমার বিরুদ্ধে ক্ষেপে যায় , তাহলে তুমি কতজনকে দমন করবে? আর ক,জনকেই বা শাস্তি দিবে? সুতরাং গায়ের বলে সাম্রাজ্য জয় করা যায়, কিন্তু মানুষের মন জয় করা যায় না। ফেরাউন হতাশ হয়ে বললো- তাহলে আমার এ উচ্চাভিলাষ কি পূর্ন হবে না? হামান তাকে অভয় দিয়ে বললো-কিন্তু তুমি যত সহজ ভাবছো, কাজটা তত সহজ নয়। এর জন্য কঠোর পরিশ্রম এবং সর্বোপরি ধৈর্য্যধারন করতে হবে।
মানুষ যত বেশী পায় , ততই তার আশাও বেড়ে যায়। ফেরাউনের আশাও তেমনি উত্তরোত্তর বেড়েই চললো। সামান্য কৃষকের ছেলে আজ এক বিশাল সাম্রাজ্যের কর্তা ও ভাগ্য বিধাতা হয়েও তার তৃপ্তি মেটেনি। আজ সে নিজেকে স্রষ্টা বলে দাবি করতেও লজ্জাবোধ করছে না। হামানের কথায় পাপাত্মা ফেরাউন বললো- তাহলে কি উপায়ে আমার আশা পূর্ন হবে, সে বিষয়ে আমাকে একটা পরামর্শ দাও। গভীরভাবে হামান চিন্তা করে বললো- তোমার সে আশা পূর্ন করতে হলে ,এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এবং ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে। ফেরাউন অজ্ঞের মতো জিজ্ঞেস করলো- সেটা কিরকম? হামান বললো- দেশের অধিকাংশ মানুষ আজ শিক্ষিত । তাদের ভালোমন্দ বুঝার শক্তি আছে। সুতরাং শিক্ষিত ও ধর্মপরায়ন লোকেরা সর্বশক্তিমান স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে কখনোই তোমাকে স্রষ্টা বলে মানবে না। কারন, তারা জানে তুমি তাদের মতোই একজন সামান্য মানুষ। সুতরাং তারা কিছুতেই তোমাকে তাদের উপাস্য বা স্রষ্টার আসনে স্থান দেবে না। অশিক্ষিত, অজ্ঞান ও মূর্খ সরল লোকদের তুমি যেভাবে বুঝাবে , তারা সেভাবেই চলবে, কিন্তু তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম । ফেরাউন চিন্তিত হয়ে বললো- তাহলে কি উপায়ে করা যায় তা খুজেঁ বের করো। হামান বললো- উপায় অবশ্যই আছে ,কিন্তু সে জন্য সময়ের প্রয়োজন । দেশে যতদিন পর্যন্ত শিক্ষিত আর জ্ঞানী লোক থাকবে, ততদিন পর্যন্ত তোমার উদ্দেশ্য সফল হবে না। ফেরাউন জিজ্ঞেস করলো- দেশের শিক্ষিত এবং জ্ঞানী লোকদেরকে কিভাবে নিরস্ত করা যাবে? তারাতো শিক্ষা-দীক্ষা পেয়ে ধীরে ধীরে দল ভারী করে চলেছে। হামান বললো- যত অনর্থের মূল হচ্ছে ঐ বনি ইসরাইল সম্প্রদায়। এরা নিজেরাও শিক্ষিত আর ধর্মপরায়ন । আর তাই অন্যান্য লোকদেরকে শিক্ষা দিয়ে তাদের মতোই জ্ঞানী-গুনী করে তুলেছে। আগে কিবতী সম্প্রদায় অশিক্ষিত আর মূর্খ ছিলো। এখন বনি ইসরাইলগন তাদেরকে লেখাপড়া শিখিয়ে, ধর্মোপদেশ শুনিয়ে প্রায় অনেককেই তাদের মতোই জ্ঞানী আর ধর্মপরায়ন করেছে। তাদের দেখাদেখি এখন সারাদেশের লোক বিদ্যা অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করেছে। সুতরাং মূর্খ লোকেরা তোমাকে স্রষ্টা বলে মানলেও শিক্ষিত লোকেরা কখনোই তোমাকে স্রষ্টা বলে মানবে না, বিশ্বাস করবে না। হামান আরও বললো- যারা শিক্ষিত ,জ্ঞানী তাদেরকে দমন করার প্রয়োজন নেই; তাতে বরং সুফলের চেয়ে কুফলই বেশী দেখা দেবে। এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য হবে দেশে যাতে ভবিষ্যতে কোন লোক শিক্ষিত না হতে পারে, আইন জারী করে দেশে সকল প্রকার শিক্ষা, ধর্মালোচনা বন্ধ করে দিতে হবে। ফেরাউন বললো- তাতে কি ফল হবে? হামান বললো- ফল অবশ্যই হবে । দেশের সর্বত্র লেখাপড়া বন্ধ হলে কয়েক বছরের মধ্যেই সব মানুষ মূর্খে পরিনত হয়ে যাবে। তখন তাদেরকে যা বুঝানো যাবে , নির্বিবাদে তারা তাই মেনে নেবে। ফেরাউন বললো- সেজন্য তো অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। হামান তাকে অভয় দিয়ে বললো- হ্যাঁ! একটু ধৈর্য্য তোমাকে ধরতেই হবে। একদিন দেখতে পাবে সারা দেশের মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। ভালো-মন্দ , হিতাহিত জ্ঞানও তখন তাদের থাকবে না। ঠিক সে মুহুর্তেই তোমার ইচ্ছা পূর্ন হবে। তখন প্রতিটি প্রজাই তোমাকে নির্বিবাদে স্রষ্টা বলে মেনে নিয়ে পূজা করতে থাকবে।
হামানের যুক্তি মতোই পাপাত্মা ফেরাউন কঠোর আইন জারি করে দেশের সর্বত্র ঘোষনা করলো- আজ থেকে মিসরের যাবতীয় শিক্ষা সম্পূর্নরূপে বন্ধ করে দেয়া হলো। সুতরাং এখন থেকে এদেশের লোকদের বিদ্যার্জন চিরদিনের জন্য বন্ধ। যদি কেই এই আদেশ অমান্য করে তাহলে তাকে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দেয়া হবে। এছাড়া আরও জানানো হলো যে -এবং আজ থেকে মিসর দেশে সকল প্রকার ধর্মীয় কাজ নিষিদ্ধ করা হলো। কেউ কখনো ধর্মালোচনা বা ওয়াজ নছিয়ত করতে পারবে না। এ আইন অমান্যকারীর শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড।
জালিম ফেরাউনের আদেশে দেশের লোক স্তম্ভিত হয়ে প্রান ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে টু শব্দটি করতে পারলো না। সবাই নীরব হয়ে গেলো। কারন ফেরাউন দেশের সর্বত্রই গুপ্তচর নিযুক্ত করে কড়া পাহারার বন্দোবস্ত করলো। ফলে দেশের শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেলো। ধর্মালোচনা , ওয়াজ নছিয়ত আর কোথাও কেই করতে পারলো না। বনি ইসরাইলগনও এ ঘোষনায় মহাবিপদে পড়লো। তবুও তারা ফেরাউনের নিষেধ অমান্য করে অতি গোপনে লেখা-পড়া, ধর্মালোচনা চালিয়ে যেতে লাগলো। এতেও বহুলোক ধরা পরে প্রান দিলো। এমনি করেই সুদীর্ঘ চল্লিশটি বছর অতিবাহিত হলো। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা না পেয়ে মানুষ অজ্ঞানতার তিমিরে নিক্ষিপ্ত হলো।
অধিকাংশ লোক এক নিরাকার আল্লাহকে ভুলে যার যা খুশী মতো নানা প্রকার দেব-দেবী , জড় পদার্থ , গাছ,পাথর, সাপ ইত্যাদির পুজা করতে লাগলো। পূ্র্বের শিক্ষিত ও ধার্মিক লোকদের মধ্যে অনেকে মৃত্যুমুখে পতিত হলো। যারা বেচেঁ রইলো তাদেরও মুখ বন্ধ। কারন আইন অমান্য করার অপরাধে অনেকের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। জ্ঞানের কথা ,ন্যায়-অন্যায়ের কথা এবং ধর্মের কথা বলা বা আলোচনা করার সাহস বা শক্তি কারও নেই। সারাদেশে আজ অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে। কারন এ চল্লিশ বছরের ভেতর যারা জন্মগ্রহন করেছে তারা শিক্ষা-দীক্ষার সাথে, ধর্মের সাথে, ন্যায়-অন্যায়ের সাথে কোন সম্পর্ক স্থাপন করারই সুযোগ পায়নি। তাই তাদের পাপ-পূন্যের জ্ঞান তো দূরের কথা, সাধারন সামাজিক আচার-বিচার ,ন্যায়-অন্যায় হিতাহিত জ্ঞান অর্জনের সুযোগও হল না। যাদের কিছু শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা বিদ্যমান ছিলো,প্রানের ভয়ে তারাও আজ নিশ্চুপ হয়ে আছে। জীবিত লোকও মৃতের মতো বেচেঁ আছে। মুখে কিছু বলার শক্তি নেই। সাথে সাথেই তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এভাবেই সারাদেশ অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। তখন একদিন জালিম হামান পাপাত্মা ফেরাউনকে বললো- বাদশাহ এবার আপনি নিজেকে স্রষ্টা বলে ঘোষনা করতে পারেন। কারন এখন সারাদেশে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ফিরাউন হামানের কথা শুনে আনন্দিত হলো।
চলবেঃ-
বিষয়: বিবিধ
৩৫৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন