আমার মা।

লিখেছেন লিখেছেন জারা ১৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০৩:০৩:৩৬ রাত

খুব ছোট্রবেলায় আমি আমার পাঁচ ভাইবোন মিলে মাতৃহারা হলাম। আমরা সব ভাইবোনই তখন একেবারে অবুঝ ও নিষ্পাপ শিশু। আমার একমাএ ছোট্রবোনটি মাএ দু,মাসের। সব্বাই পিঠেপিঠি বলা যায়। পবিএ রমজান মাসের কোন এক রাতে খাবার খেয়ে আমি আমার বড় ভাইয়া, মেজ ভাই, এবং ছোট্র ভাইটি ঘুমিয়ে পরেছি। কতসময় ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা, মনে আছে একটা সময় আমার বাবার প্রচন্ড কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিছানায় বসে দেখি খাটের একপ্রান্তে আমার মা বালিশ ছাড়াই ঘুমিয়ে আছে আর আমার বাবা রুনু রুনু বলে চিৎকার করে কাঁদছে। তখন রাত কটা বাজে জানিনা। ভাবছি বাবা এত কাঁদছে কেন। কিছুক্ষনের মধ্যে আমার নানাভাই, আমার বড় মামা, মামী, মেজমামা, আরও অনেক আত্বীয় স্বজনরা সবাই বাসায় চলে আসলো। মামাদের, নানাভাইয়ের আহাজারিতে ভারী হল আমার ছোট্র অবুঝ মন। মায়ের কি হয়েছে? সবাই এত কাদঁছে ক্যানো?

দেখলাম মাকে ধরাধরি করে বিছানা থেকে নামিয়ে নিচের ঠান্ডা ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে তার উপরে শোয়ালো। মায়ের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আলাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখলো। এরই মাঝে বড় ভাইয়া ঘুম থেকে জেগে গেলে ভাইয়াকে শুধোলাম ভাইয়া আম্মুর কি হয়েছে? আম্মুকে খাট ছেড়ে ফ্লোরে শুইয়ে রেখেছে ক্যানো? ভাইয়ার অবস্হাও তখন ঠিক আমারই মত।

ওর কাছে কোন সদুত্ত্বর না পেয়ে কাছেই দাড়ানো এক আপুকে প্রশ্ন করলাম । আপুর চোখে তখন পানিতে টলোমলো। লুকোবার জন্য পিছন ফিরে চোখ মুঝে নিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো। খালাম্মার কিচ্ছু হয়নি। বললাম তাহলে সবাই এত কাঁদছে ক্যানো? আপুটি বললো খালামনি অসুস্হ হয়ে পরেছে তো তাই। তখন মুরুব্বি গোছের কাছের কোন এক আত্বীয় বললো আমাদের সব ভাইবোনকে তার নিজ বাসায় নিয়ে যেতে। আমাদেরকে কোলে তুলে তখনই উক্ত আত্বীয়ের বাসায় নিয়ে যাওয়া হল। ছোট্র অবুঝ মন তবুও মানে না। কে যেন রাতে আমাদের ভাইবোনদেরকে খাটে শুইয়ে দিলো, আমার আর বড় ভাইয়ার অস্বস্থি লক্ষ্য করে কোমল কন্ঠে বললো তোমাদের মা আর বেচেঁ নেই। আর কখনও তাকে দেখতে পাবে না। শোনার পরও বুঝলাম না যে, কেন আর আম্মুকে দেখতে পাবো না। আমার মা যে না ফেরার দেশে চলে গেছে। শতবার চাইলেও মা আর ফিরে আসবে না। পরদিন সকালেই আমার মায়ের গোসল ,জানাজা, দাফন সম্পন্ন হল। তারপর থেকেই হলাম মাতৃহারা সন্তান। মায়ের কোমল হাতের একটু আদর , সিগ্ধ পরশের একটুখানি ছোয়া,অকৃ্িএম নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মধুর স্বাদ থেকে হলাম অবান্ঞ্চিত।

স্কুলে দেখতাম মায়েদের নিয়ে কত ছাএীদের আসতে। সব সন্তানের মুখেই কত তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠতো। শুধু একা আমিই নিজ কষ্টকে লুকিয়ে ওদেরকে দেখতাম আর ভাবতাম শুধু একটিবারের জন্য হলেও আমার মাকে যদি আল্লাহপাক ফিরিয়ে দিতেন তাহলে আমিও আমার মাকে স্কুলে নিয়ে আসতাম। সেদিনের কি অব্যক্ত আকুতি আমার। ধীরে ধীরে সময় তার নিজ গতিতে চলতে চলতে একটা সময় আবারও আমার মায়ের অনুভূতি জাগ্রত হল যেদিন আমি বিয়ের পিড়িতে বসলাম। খুব কষ্ট হল। মা নেই বলে শ্বশুড়বাড়ীর হাজারো গন্জ্ঞনা। মা না থাকার কারনে তাদের ছেলের যত্নআত্ত্বি কম হবে ইত্যাদি। কিন্তু আমার বাবা তার জামাইদের কখনই শাশুড়ীর অভাব বুঝতে দেননি। আমার মা বেচেঁ থাকলে তার মেয়ে জামাইদের জন্য যা যা করতো আমার বাবা ঠিক সেগুলোই তার দু,মেয়ে জামাইদের জন্য করে যাচ্ছেন। কোন প্রশ্ন না রেখেই। তারপরেও তো মা.... মা...ই। মায়ের জায়গা কেউ কখনও পূরন করতে পারে কি????

আমার বেবীটা যখন এই সুন্দর পৃথিবীতে আসবে তখন আমার বর আমাকে আমার একমাত্র খালামনির কাছে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। যাতে ওই সময়টা আমি আমার মায়ের গন্ধটা খালামনির কাছ থেকে পাই। খালামনিও যথেষ্ঠ করেছেন আমার মায়ের শূন্যতা পূরন করার জন্য। তবুও কিছু থেকে যায় তাই না। আজ আমি যেমন আমার একমাত্র সন্তানের জন্য যা করছি। হয়তো আমার মা আমাদের পাচঁ ভাইবোনের জন্য লক্ষ্যগুন বেশী কষ্ট করেছেন। আমার মা তার নিজ হাতে জামা সোয়েটার তৈরী করে আমাদেরকে পরাতেন। এমনকি আমার বাবা, মামাদের জন্যও সোয়েটার বুনতেন। তখনকার সময়ে মফস্বল এলাকা গুলোতে কেনা সোয়েটার খুব একটা পাওয়া যেত না। নিজের গায়ের চাদর নিজ হাতেই বুনে নিতেন। শুনেছি আমার মা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন। মাট্রিক পরীক্ষাতে অংক ও ইংরেজিতে লেটার মার্কস নিয়ে ফার্স্টডিভিশন পেয়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েটেও ওই একই রেজাল্ট। এবং তারপরেই আমার বাবার সাথে তার বিয়ে এবং সর্বোপরি সংসার জীবনে প্রবেশ। মাঝে আমার মা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা পদে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার বাবার বিরোধিতার মুখে পরে আমার মা চাকুরীতে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। আমার বাবার সাফ কথা ছিল , ঘরের বউ দিয়ে তিনি চাকুরী করাবেন না। হলো না আমার মায়ের আর শিক্ষকতা করা।

সবথেকে ছোট আদরের একমাত্র বোনটির বিয়ে। বাবার বাড়িতে অনেক লোকজনের সমাগম ,বিশেষ একটি দিন অথচ বড় ভাইয়ার দেখা নেই। মোবাইল করতেই বললো সিলেটে ওইদিনই নাকি অর্থমন্ত্রী আসছেন। নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকুও নেই। প্রশাসনের উচ্চ পদে আছেন। কি আর করা

একা আমাকেই সামাল দিতে হলো। খালামনি হজ্বে চলে গেছেন। সবথেকে করিৎকর্মা ছোটমামাও কাজের চাপে খুলনা থেকে আসতে পারেননি।

মেঝভাইটাও নেই। আমার বর ওই সময়ে অফিসের কাজে কক্সবাজার। নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়েছিলো আর সেই সঙ্গে কিছু মনে চেপে রাখা অসহনীয় কষ্ট। সেদিনও বারে বারে আমার হারিয়ে যাওয়া মায়ের কথাই মনে হচ্ছিলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো জোড় গলায় মাকে বলি , মা তুমি কোথায়? মা তোমার রেখে যাওয়া সবচেয়ে ছোট্রমনিটির আজ বিয়ে।

নিজের অজান্তেই সেদিন মায়ের রেখে যাওয়া কানের দুলটা পরেছিলাম।

বিষয়: বিবিধ

৩৬২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File