নারী স্বাধীনতা ও ইসলাম

লিখেছেন লিখেছেন ফাহিম মুনতাসির ২৪ অক্টোবর, ২০১৩, ১২:৪৩:২৩ দুপুর

আধুনিক বিশ্বে এমন কোন মুসলিম দেশই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে দেশ পাশ্চাত্যের নারী স্বাধীনতাবাদীদের মারাত্বক প্রচারণার স্বীকার হয়নি এবং পর্দা প্রথাকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় বিধানরুপে চিহ্নিত করেনি, কিংবা তথাকথিত নারী স্বাধীনতাকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির অপরিহার্য অংশ হিসেবে মেনে নেয়নি। যেমন- ১৯৭৬ সনের ১৯শে অক্টোবর পাকিস্তান টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর মুহাম্মদ মুকাদ্দাম বলেন, “কোন দেশেই আধুনিকীকরণ করা সম্ভব নয় যদি না সে দেশের নারী সমাজকে ধর্মীয় গোঁড়ামী থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা যায়। প্রাচ্যের অনেক দেশেই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে দেরী হয়েছে নারী সমাজকে স্বাধীনতা দানের ব্যাপারে সে সকল দেশের জনগণের মাঝে প্রোথিত গোঁরামী ও আদিম বিশ্বাসের কারণেই। পৃথিবীর অপরাপর দেশের সাথে যদি তাল মিলিয়ে না চলতে পারি তাহলে আমরাও স্বাধীন জাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারবো না। এশিয়ার ও আফ্রিকার সকল উন্নয়নশীল দেশে নারী সমাজের ভূমিকা সুস্পষ্ট। দেশের উন্নয়নের জন্য তাদেরকে অবশ্যই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সকল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ জরতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো দেশের কিছু সংখ্যক লোক বিষয়টি বুঝতেই চায় না।”

১৯৭৬ সনের আগস্ট মাসে পাকিস্তান জাতীয় সংহতি পরিষদের উদ্যোগে লাহোরে অনুষ্ঠিত “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দু’দশকে নারী স্বাধিকার” শীর্ষক সেমিনারে উপরোক্ত বক্তব্যের ঠিক এইরূপ মন্তব্য করা হয়। যদি আমরা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করি এবং আমাদের এই দেশ গঠনের আদর্শিক ভিত্তি ইসলাম বলে মনে করি তবে কি এটা জানা আমাদের জন্য কর্তব্য হয় না যে, ইসলাম নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে আমাদের কি শিক্ষা দিয়েছে ?

নারী অধিকার সম্পর্কে মত প্রকাশ করতে গিয়ে সূরা নিসার ৩৪নং আয়াতে বলা হয়েছে, “পুরুষরা হচ্ছে নারীদের তত্বাবধায়ক। কারণ, আল্লাহ্‌ পুরুষদেরকে নারীদের চেয়ে বেশী যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং পুরুষেরা নারীদের জন্য তাদের অর্থ ব্যয় করে।

হাদিস থেকে জানা যায়, রসূল (স)-এঁর স্ত্রী হযরত আয়েশা (রা)-এঁর ছোট বোন হযরত আসমা (রা) একদিন পাতলা কাপড়ের পোশাক পরে রসূল (স)-এঁর সামনে আসলে মহানবী তাঁকে এই বলে তিরস্কার করেছিলেন যে, যখন কোন মেয়েলোক বয়ঃপ্রাপ্ত হয় তখন থেকে তার মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় ছাড়া কোন কিছুই প্রকাশ করা উচিত নয়। সূরা আল আযহাবের ৫৫নং আয়াতে মহান আল্লাহ্‌ নবী (স)-এঁর স্ত্রীদের ঘরে গায়রে মুহাররাম পুরুষ ও বেগানা মহিলাদেরকে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন এবং ৫৯নং আয়াতে মুসলিম নারীদেরকে আকর্ষণীয় পোশাক ও অলঙ্কারাদি পরে বাইরে বের হতে বারণ করা হয়েছে এবং জনসম্মুখে পোশাক ও আচরণে এমন কিছু প্রদর্শন কতে মানা করা হয়েছে যাতে তাদের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সৃষ্টি হতে পারে।

স্ত্রীলোকেরা পরিবারের মুহাররামা পুরুষ, চাকর ও দাসদের সাথেই কেবল খোলামেলা কথাবার্তা বলতে পারবে।

সূরা আযহাবের ৫৩ নং আয়াতে বিশ্বাসীগণকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে রসূল (স)-এঁর স্ত্রীদেরকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের এবং তাঁদের নিকট কিছু চাইতে হলে তা পর্দার বাহির থেকে চাইতে। ৫৯ নং আয়াতে যখন কোন কারণে কোন মুসলিম মহিলাকে ঘরের বাইরে যেতে হয় তখন তাকে তার পুরো দেহ একটি চাঁদর দিয়ে ঢেকে নিতে বলা হয়েছে, যাতে করে তাদেরকে ধার্মিক মহিলা হিসেবে চেনা যায় এবং যাতে তারা উত্যক্ত না হয়। কোরআন মহানবী (স)-এঁর স্ত্রীদেরকে এবং প্রয়োগিকভাবে সকল মুসলিম মহিলাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে যখন কোন জরুরী প্রয়োজনে কোন গায়ের মুহাররাম পুরুষের সাথে সাক্ষাত করতে হয় তখন যেন সে তার সাথে এমন আবেগময় ভঙ্গি ব্যাবহার না করে যাতে লোকটির মনে প্রেমাভাব উৎপন্ন হতে পারে। বরং কথাবার্তা যেন সাদামাটা ও প্রথাগত হয়। হাদিসে মুসলিম নারীদেরকে স্বামী এবং বিবাহ নিষিদ্ধ নিকটাত্মীয়দের ছাড়া অন্য কারো সাথে (অর্থাৎ মুহাররাম কোন পুরুষের পরিচালনা ব্যতিরেকে) একাকী দূর যাত্রায় বের হতে নিষেধ করা হয়েছে।

যেখানে অধিকাংশ সহীহ হাদিসে মুসলিম নারীদেরকে মসজিদে নামাজের জামায়াতে একত্রিত হতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং গৃহের নিভৃত কোণে নামাজ আদায় করাকেই খোদার কাছে অধিক পছন্দনীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে; সেখানে একজন মুসলিম মহিলার প্রাইভেট সেক্রেটারী, ব্যাংক ক্লার্ক, বিমান বালা, হোটেল পরিচারিকা, বিজ্ঞাপন মডেল, গায়িকা, ড্যান্সার এবং সিনেমা, টেলিভিশন ও রেডিওতে অভিনেত্রীর ভূমিকায় আসাকে কিভাবে বরদাস্ত করা যেতে পারে ?

সুরা আন-নুরের ১-২৪ নং আয়াতে যারা বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক রাখে তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন শাস্তি প্রদানের ভয় দেখানো হয়েছে। ইসলামে এ ব্যাপারে কোন দ্বৈত মাপকাঠির ব্যবস্থা নেই। যারা অবৈধ যৌন সম্পর্ক রাখে সে সকল নারী ও পুরুষের শাস্তির মধ্যে কোরআন ও হাদীসে কোন পার্থক্য করা হয়নি। উভয়ের জন্যই একই রূপ কঠিন শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআন ও হাদিসের এই প্রমাণ ছাড়া পর্দার সপক্ষে ইসলামের অধিক আর কি প্রমাণ দরকার হতে পারে ? মুসলিম মহিলাদের চলাফেরার ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র নারীদের প্রতিরক্ষা এবং পুরুষদেরকে তাদের প্রতি অশুভ পদক্ষেপ থেকে সংযত রাখার উদ্দেশ্যেই আরোপিত হয়েছে। পৃথিবীতে ইসলামই হলো একমাত্র ধর্ম যা শুধু অনৈতিকতাকে মন্দ বলেই ক্ষান্ত হয় না বরং অনৈতিকতাকে উদ্দীপ্ত করে এমন যে কোন সামাজিক কর্ম থেকে বিশ্ববাসীদেরকে ফিরে থাকতে আদেশ দেয়।

এ কথার তাৎপর্য হলো, কোন মুসলিম নারীই ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের জীবিকা অর্জনে বাধ্য নয় যতক্ষণ পর্যন্ত না তার জীবন ধারণের মত সামর্থ থাকবে, তার স্বামী মারা না যাবে কিংবা সে তালাক প্রাপ্তা না হবে অথবা তার ভরণপোষণ দেয়ার মত কোন পুরুষ আত্মীয় থাকবে।

কোরআনের শিক্ষা অনুযায়ী স্বামী তার স্ত্রীর জন্য বন্ধু ও কর্তা। স্বামীর কর্তব্য হলো স্ত্রীর প্রতি ন্যায়নিষ্ঠা, ভালোবাসা ও দয়া প্রদর্শন করা এবং এর প্রতিদানে স্ত্রীর দায়িত্ব হলো স্বামীর প্রতি বাধ্য ও অনুগত থাকা এবং স্বামী যাতে চরিত্রহীন হতে না পারে সে জন্য তার প্রতি অকৃত্রিম আস্থা নিবেদন করা।

কোরআনে স্বামীকে স্ত্রীর চেয়ে একমাত্রা ওপরে স্থান দেয়া হয়েছে এ জন্য নয় যে, সে নির্মম অত্যাচারী হবে, বরং তার দ্বারা পারিবারিক সুরক্ষা প্রতিষ্ঠিত হবে সে জন্যেই। যে পরিবারে স্ত্রী আর্থিকভাবে স্বয়ম্ভর সে পরিবারে স্বামী স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের কর্তৃত্বের ভূমিকা হারায়। পক্ষান্তরে পরিবারে মায়ের কর্তৃত্ব বেড়ে গেলে পিতার প্রতি সন্তানদের শ্রদ্ধাশীলতা হ্রাস পায়।

সুরা আন-নূরের ৩০-৩১ নং আয়াতে মুসলমান পুরুষদেরকে গায়ের মুহাররাম নারীদের প্রতি এবং মুসলিম নারীদেরকে গায়ের মুহাররাম পুরুষদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। পুরুষ ও নারী উভয়কেই বলা হয়েছে পরস্পরের চক্ষুকে অবনমিত রাখতে। মেয়ে লোকদেরকে মাথায় চাঁদর পরতে বলা হয়েছে এবং তার আঁচল দিয়ে মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশ ঢেকে রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদেরকে তাদের স্বামী ও বিবাহ নিষিদ্ধ নিকটাত্মীয়দের ছাড়া আর কারো সামনে নিজেদের সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করতে নিষেধ করা হয়েছে। প্রায়োগিক ভাবে এই আয়াত দ্বারা মুখমণ্ডলে কসমেটিক্স লাগানো এবং যৌন আবেদন সৃষ্টি করে এমন সব পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ হয়েছে।

নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম প্রবক্তা হচ্ছেন সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠাতা মার্কস ও এঙ্গেলস। ১৮৪৮ সনে প্রকাশিত তাদের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো বইয়ে তারা লিখেন, “গৃহ ও পরিবার একটি অভিশাপ ছাড়া কিছুই নয়। কারণ, এটি নারীদেরকে চিরস্থায়ীভাবে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখে।” তারা বলেন, “ নারীদেরকে পারিবারিক বন্ধন থেকে মুক্তকরে দিতে হবে এবং কল-কারখানায় সার্বক্ষনিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদেরকে পুরোপুরি অর্থনৈতিক স্বয়ংম্ভরতা অর্জনের সুযোগ দিতে হবে।” তাদের পরবর্তী নারীবাদী প্রবক্তারা সহশিক্ষা, ঘরের বাইরের একই কর্মস্থলে সহকর্মাবস্থান, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নারী-পুরুষের একত্র মিলন, অর্ধনগ্ন পোশাকে বিবাহপূর্ব প্রেম-অভিসার এবং যূথ সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে মদ্যপান, নেশাপান ও নৃত্যগানের মাধ্যমে নারী-পুরুষের অবাধ যৌনাচারের সুযোগদানের জন্য জিদ ধরেন। এক্ষেত্রে তারা সরকারি ব্যবস্থাপনায় জন্মনিরোধক সামগ্রী, বন্ধাকরণ ব্যবস্থা, অবাঞ্ছিত গর্ভের বিমোচন, অবৈধ সন্তানদের লালন পালনের জন্য রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নার্সারী ও বোর্ডিং- এর ব্যবস্থা রাখার দাবী করেন। এটাই হচ্ছে আধুনিক “নারী অধিকার” তত্ত্বের মূলগত ধারণা।

লাহোরের গুলবার্গ গার্হ্যস্ত অর্থনীতি বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তেহরান ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যাঞ্চেলর শ্রোতাদের এ কথা বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, “আধুনিক সভ্যতার যেটুকি খারাবী যোগ হয়েছে তা অতি উদ্বিগ্ন রক্ষণধর্মী প্রতিক্রিয়াশীল ধারণার চেয়ে অনেক কম।” কিন্তু এই ভীতির কারণগুলো কি কারো জানা আছে? দেখুন না, নারী স্বাধীনতার কি ফল পশ্চিমারা ভোগ করছে!

আমেরিকান এক ঐতিহাসিক ও কলামিস্ট ম্যাক্সলার্নার বলেন, “আমরা একটি বেবিলিনীয় সমাজে বাস করছি। ইন্দ্রিয় সেবার প্রতি গুরোত্বারোপ ও যৌন স্বাধীনতার ফলে সমাজের সকল পুরাতন নীতি-নৈতিকতার বন্ধন ভেঙ্গে গেছে।” কিছুদিন আগেও কি জনসম্মুখে প্রকাশ করা যাবে কিংবা যাবে না তা নির্ধারণ করতো চার্চ, রাষ্ট্র, পরিবার ও সম্প্রদায়। কিন্তু অধুনা এ সকল প্রতিষ্ঠানগুলো জনসাধারণের দাবির কাছে পরাজিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন দায়িত্ব দাঁড়িয়েছে শুধুমাত্র শোনা ও দেখা। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র দর্শকরা প্রতিদিন আর্ট গ্যালারী ও নাট্য গৃহসমূহে একত্রিত হচ্ছে উলঙ্গপ্রায় সুইডিশ নায়িকার ‘আমি এক নারী’ সিরিজের পর্ণ নাচ গান দেখে যৌন উত্তেজনা প্রবল করার জন্য। ইটালীয় সিনেমা পরিচালক ম্যাকিল্যানজেলো এন্টোনিওনি তার ‘ভেঙ্গে দাও’ ছায়াচিত্রে নগ্নতা বিরোধী সকল ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার মাথা খেয়েছেন। ফরাসী কৌতুক প্রিয় নায়িকা জেনফন্ডা সীমাহীন প্রলোভনধর্মী ছায়াছবি বারবারেলায় মুক্ত প্রেমাভিসারের গুণ কীর্তন করতে করতে একটি নগ্নতার দৃশ্য থেকে পরবর্তী অধিকতর আর একটি নগ্নতার দৃশ্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন। কমপক্ষে দু’ঘণ্টা স্থায়ী ‘জেসনের প্রতিকৃতি’ নামক ছায়াচিত্রে একজন নিগ্রো বেশ্যা পুরুষের বিকৃত আত্মার ভ্রমণ কাহিনী এখন আমেরিকার প্রায় সকল পেক্ষাগৃহগুলোতেই খোলাখুলিভাবে দেখানো হয়ে থাকে, যা মানব জীবনের দিকগুলোকে সংকুচিত করেছে। খৃষ্টীয় ধর্মতত্ত্ববিদ ফাদার ওল্টার জে. ওং বলেন, “আমরা শীঘ্রই জানা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অধিক মাত্রায় স্বাধীন জীবন যাপনের সুযোগ পাচ্ছি.....।” (রিডার্স ডাইজেস্টের ১৯৬৮ সালের এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত “সমাজ যেদিকে যাচ্ছে আমাদের সব কিছু সেদিকে যাচ্ছে” নামক নিবন্ধ থেকে)।

আসুন পাশ্চাত্যের এই সামাজিক অবক্ষয়ের কি প্রভাব মুসলিম দেশগুলোর ওপর পড়েছে তা দেখা যাক। নারী স্বাধীনতা ও নৈতিক অধঃপতনের একটি প্রধান ও কার্যকর মাধ্যম হলো সিনেমা। “লাহোরের হিরামন্ডি জেলার প্রতিটি মেয়েরই আকাংখা হচ্ছে অভিনেত্রী হওয়া। তারা সকলেই চাচ্ছে চিত্রনায়িকা হতে। এই ইচ্ছার বাস্তবায়নের জন্য তারা যে কোন প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে রাজী আছে। এদের একটি বিরাট সংখ্যক মেয়ে তাদের নায়িকা হওয়ার আকাংখা পূরণের শর্তে তাথাকথিত সিনেমা পরিচালক ও প্রযোজকদের খুশী করার জন্য যে কোন জায়গায় উপস্থিত হতে রাজী রয়েছে। সিনেমা শিল্পের দ্বারা খুব সহজে ও সাধারণভাবে বিভ্রান্ত মেয়েলোক এরাই। এদের অধিকাংশই টুকিটাকি কিছু অভিনয়ের সুযোগ পেলেই খুশী। অতিরিক্ত বেশ কিছু মেয়ে এভাবেই সিনেমার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়। এদের মধ্যে সামান্য কয়েকজন অবশ্যি প্রতিষ্ঠাও পায়। শহরের অনেক হোটেলেই “শুভ সময়” এর কাজে ব্যবহৃত হয়। কতিপয় হোটেল পরিচালক থাকে কোটনার ভূমিকায়। অধিকাংশ রেস্তোরাঁ ব্যবহৃত হয় খদ্দেরের সাথে নষ্টা মেয়েদের সাক্ষাতের স্থান হিসেবে। এ সকল মেয়ে লোকদেরকে নগরীর বাস স্ট্যান্ডগুলোতেও দেখা যায়। শহরের প্রেক্ষাগৃহগুলোও খদ্দের ধরার জন্য খুবই পরিচিত স্থান। প্রেক্ষাগৃহগুলো যে সিনেমা দেখা ছাড়া অন্য কোন কাজে ব্যবহৃত হয় না তাও নয়। এ সকল ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা খুবই শিথিল।” (১৯৬৮ সালের ২৯ ও ৩০শে মার্চ তারিখে ‘দি পাকিস্তান টাইমস’-এ প্রকাশিত ‘লাহোরে বেশ্যাবৃত্তি’ নামক প্রতিবেদন থেকে)

ক্রিস্টাইন কিলার অথবা মেরিলিন মনরোর মত মহিলা সেনাবাহিনী গঠন করা কি আমাদের জাতীয় উন্নয়নের অংশ হতে পারে?

নারী স্বাধীনতার পক্ষে পত্র-পত্রিকা, রেডিও এবং সিনেমার প্ররোচনা স্ত্রী ও সন্তানের মা হিসেবে নারীর ভূমিকাকে তাছিল্য ও খাটো করেছে। সন্তানের লালন-পালনের জন্য নারীদের গৃহে অবস্থানকে এই প্রচারণা জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অর্ধেক জনশক্তির অনুপস্থিতির ফলে অমার্জনীয় ক্ষতির কারণ বলে বর্ণনা করেছে।

রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে মুসলিম দেশসমূহে সহশিক্ষার দ্রুত প্রসারের ফলে ছেলে মেয়েদের মধ্যে অবাধ মেলামেশা ও যৌন অপরাধ প্রবণতা এমনভাবে বেড়েছে যে, তা অজস্র যুবক-যুবতীকে ধ্বংসের মুখোমুখি করে দিয়েছে এবং বিস্তর ঘটিয়েছে অসংখ্য পাপ কর্মের। সহশিক্ষা এই ভ্রমাত্মক ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে জন্মগত কোন পার্থক্য নেই, সুতারাং উভয়কেই একই কর্মক্ষেত্রে অভিন্ন কাজের জন্য নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। ফলতঃ যে সকল মেয়ে সহ-শিক্ষা গ্রহণ করে তারা খুবই খারাপভাবে নিজেদেরকে বিবাহ ও মাতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করে। এরপরও নারী স্বাধীনতাবাদীরা বলে থাকেন মেয়েদের প্রাথমিক দায়িত্ব স্বামীর গৃহেই। এ কথার অন্য অর্থ দাঁড়ায়, আধুনিক নারীদেরকে দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিজের জীবিকার জন্য সারাক্ষণ ঘরের বাইরে কাজ করার পরও ঘরে ফিরে তাকে সন্তানের লালন-পালন, ঘরদোর সাজানো ও স্বামীর প্রয়োজন পূরণের মত অসম্ভব প্রায় সব বাধ্যবাধকতা পালন করতে হবে। এটাও কি ন্যায় বিচার?

মুসলিম দেশসমূহে অধুনা পাশ্চাত্যের আইনের অনুরূপ যে পারিবারিক আইন পাশ করা হয়েছে, সে আইন কি বাস্তবিকভাবে আমাদের নারী সমাজের কোন উন্নয়ন ঘটিয়েছে? এই আইন সতর্কভাবে বিবাহের জন্য একটি বয়সসীমা নির্দিষ্ট করে দেয় বটে, কিন্তু এই বয়স সীমার নিচে ( বিবাহ নিষিদ্ধ বয়সে) ছেলে-মেয়েদের অবৈধ যৌন কর্মের ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা জারী করার বিষয়টি বেমালুম ভুলে যায়।

অধিকাংশ মুসলিম দেশে আধুনিকতাবাদীরা কোরআন ও সুন্নাহর আইন লঙ্ঘন, বহুবিবাহ প্রথাকে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, এমনকি নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছে। তারা কখনই এই মানসিক অবস্থাটা বুঝতে চাচ্ছেন না যে, একজন স্ত্রীর পক্ষে তার স্বামীর অন্য একজন স্ত্রী যিনি তার নিরাপত্তাধীনে রয়েছেন এবং তার সন্তানেরা পিতার ভালোবাসা ও যত্ন পাচ্ছেন তার সাথে স্বামীর ভালোবাসাকে ভাগাভাগি করে নেয়া ভালো, না দেশীয় আইনে বর্তমান স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে এবং তার সন্তানদের সহ তাকে তাড়িয়ে না দিয়ে অন্য কোন স্ত্রী গ্রহণে বাধা আছে বলে গোপনে কোণ মহিলার সাথে অবৈধ সম্পর্ক রেখে চলছে তা দেখা ভালো?

এটা কি সেই মহিলার জন্য কল্যাণকর নয়, যে তার স্বামীর সাথে ভালোভাবে থাকতে পারছে না, তাকে তার স্বামীর ব্যক্তিগতভাবে তালাক দিয়ে দিবেন এবং এই দম্পতি শান্তিপূর্ণভাবে পৃথক হয়ে গিয়ে আবার নতুন করে পছন্দমত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন? না, সেইটা ভালো যে, তাদের বিষয়টি কোর্টে যাবে এবং স্বামী এই বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কোর্ট নির্ধারিত ডিভোর্সের “প্রয়োজনীয় শর্ত” পুরণার্থে বাধ্য হয়ে স্ত্রীর ওপর অনৈতিক আচরণ ও পাগলামির মিথ্যা দোষারোপ করবে, যা মহিলাটির জন্য সামাজিক কলঙ্ক হয়ে দাঁড়াবে এবং বেচারিনীর সকল সুনাম সুখ্যাতি জীবনের তরে ধূলিস্ব্যাত করে দেবে?

প্রকিতপক্ষে নারী স্বাধীনতাবাদের প্রবক্তারা নারীর ব্যক্তিগত সুখ সুবিধার প্রতি আগ্রহশীল নয়। লাহোরে ‘নিখিল পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ আয়োজিত এক সিম্পোজিয়ামে পরিষদের এক সক্রিয় সমর্থক জনাবা সাতনাম মাহমুদ তার বক্তব্যে সরলতার সাথে এ কথা স্বীকার করেন যে, যদিও পাশ্চাত্যের মহিলারা বস্তুগত প্রাচূর্য এবং সামাজিক পূর্ণ স্বাধীনতা ও সম-অধিকার ভোগ করছে, তথাপি তারা কাঙ্ক্ষিত সুখে সুখী নয়। তিনি বলেন, যদি আত্মীক সুখই লক্ষ্য হয় তবে তার সমাধান তথাকথিত নারী স্বাধীনতার মধ্যে পাওয়া যাবে না। সুবিধাবাদী সমাজকর্মী এবং উক্ত মহিলা পরিষদের অন্যতম সদস্যা বেগম কাইসেরা আনোয়ার আলী তার বক্তব্যে যে সকল উচ্চ শিক্ষিতা মহিলা নিজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয় ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ তাদের বিষয়ে এমনভাবে নৈরাশ্য প্রকাশ করেন যে, তাদের সংগঠন মেয়েদের এই উন্নাসিকতার যে সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক তা যেন তিনি জানেনই না।

“সকল মুসলিম দেশেই নারী স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে”- এ প্রচারণার আসল উদ্দেশ্য কি? এটা আসলে একটি মারাত্মক ষড়যন্ত্র যা আমাদের সংসার, পরিবার এবং এমনকি গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিতে চায়। ‘নারী অধিকার’, ‘নারী স্বাধীনতা’ ও ‘নারী উন্নয়ন’ প্রভৃতি সস্তা স্লোগান শুধুমাত্র মূল উদ্দেশ্যকে কুহেলিকার আবরণে ঢেকে রাখার জন্যেই।

মুসলিম বিশ্বে নারী মুক্তি আন্দোলন সেই চরম পরিণতিই ডেকে আনবে যা বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এখন ঘটছে। যৌন বিষয়ে বিশ্বব্যাপী আজকের মানব সম্প্রদায় যে হারে ন্যাকারজনক আচরণে লিপ্ত হয়েছে তা বন্য পশুদের বিবেককেও হার মানায়। এই আচরণের অনিবার্জ পরিণতিতে সংসার ও পরিবার পদ্ধতিসহ সামাজিক সকল নৈতিকতার বন্ধন সম্পুর্নরূপে ভেঙ্গে পরবে এবং ব্যাপকভাবে কিশোর অপরাধ, দুর্নীতি, নির্যাতন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনের কার্যকরীহীনতা দেখা দিবে। অতীতের সকল ইতিহাসই এর যথার্থ সাক্ষী যে, যখনই কোন সমাজে পাপ ও অনৈতিকতার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে সে সমাজ আর বেশীদিন টিকে থাকতে পারেনি।

বিঃদ্রঃ বোন মরিয়াম জামিলার ইসলাম ও আধুনিক মুসলিম নারী বইটির অনুবাদ করেন মোফাচ্ছেল আহমেদ আর আমি ঐ বই হতেই এই লিখাটি আপনাদের সম্মুখে পেশ করি।

বিষয়: বিবিধ

১৪৬৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File