মুসলিম বিশ্বে Uncle Tom - by তারিক মেহান্না " এ লেখাটি সকল মুসলমানের জন্য "
লিখেছেন লিখেছেন চির উন্নত মম শির ২১ এপ্রিল, ২০১৩, ০২:৫৪:১৮ রাত
পরম করূণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি
প্রথমেই জানিয়ে দিচ্ছি লেখাটি অনেক বড়, তবে কেউ যদি সময় নিয়ে পড়ে তবে সে উপকৃত হবে ইনশা আল্লাহ। এ লেখাটি পড়ার জন্য particularly আমন্ত্রণ জানাচ্ছি সকল ইসলামপন্থী, দা'ঈ, স্কলার, স্টুডেন্ট অফ নলেজ এবং ইসলাম-মানতে-মোটামুটি-আগ্রহীদেরকে। আর in general আমন্ত্রণ সকল মুসলিমদের প্রতি। সমসাময়িক ইসলামিক দা'ওয়াহকে ঘিরে মূসা (আঃ) এবং ফির'আউনের কাহিনীর আলোকে লেখা এই লেখাতে অনেকগুলো বিষয় এসেছেঃ হিকমাহ থেকে শুরু করে আল-ওয়ালা-আল-বারাহ।
মূল ইংরেজি লেখাটি তারিক মেহান্নার, যিনি সত্য বলার 'অপরাধে' আমেরিকান কারাগারে ১৭ বছরের জেল খাটছেন। লেখাটি পড়ে শেয়ার না দিলেও তার মুক্তির জন্য দু'আ করবেন।
-------------------------------
এই লেখাটি পড়ার আগে প্রথমে Uncle Tom বলতে কি বোঝানো হয় তা জেনে নেওয়া দরকার। Uncle Tom বলতে হীনমন্য প্রজাতির দাসভাবাপন্ন, বিনয়বিগলিত, সেবাতৎপর এক চরিত্রের দিকে নির্দেশ করা হয় যে কিনা শাসকশ্রেণীর প্রতি বাড়াবাড়ি প্রকারের অনুগত থাকে। ঐতিহাসিকভাবে এটি একটি কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্র যে নিজেদের নীচু জাত এবং সাদাদের উঁচু জাত মনে করে এবং তাদের চাটুকারিতায় লিপ্ত থাকে।
--------------------------------
তারিক মেহান্নার কাছে প্রশ্নঃ আসসালামু আলাইকুম, আমার আগের প্রশ্নটির বিশদ উত্তর দেয়ার জন্য আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরষ্কার দান করুন। কিন্তু আমি আপনার কাছে আরো কিছু বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা আশা করছি। আপনি আপনার আগের উত্তরে পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেক দা’ঈকে(যারা ইসলামের দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়) “uncle tom” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আপনার এ কথার সূত্র ধরে বলতে চাই, এমন অনেকগুলো ইস্যু আমাদের সময়ে আছে, যেসব বিষয় অনেক দা’ঈ জেলে যাবার ভয়ে এড়িয়ে চলেন, কথা বলতে চান না। এরকম একটি অবস্থায় এসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা উঠলে আপনি প্রকাশ্যে কিন্তু হিকমাহর সাথে কিভাবে ইস্যুগুলোকে address করবেন বলে মনে করেন ? অন্য কথায়, তাদের কি করা উচিত যারা এসব ব্যাপারে কথা বলতে ভয় করে ?
তারিক মেহান্নার উত্তরঃ
আমি এই ব্যাপারে আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করি যে কেবলমাত্র ভয় পায় বলে uncle tom সত্য কথা বলা থেকে বিরত থাকে। কেউ যদি ইসলামের কথা বলতে ভয় পায়, তাহলে সে বড়জোর চুপ করে থাকবে, ঠিক আছে। কিন্তু আমরা যখন দেখি uncle tom নীরবতাকে ছাড়িয়ে গেছেন, যখন আমরা দেখি এই আংকেল টম ইসলামকে মানুষের গলাধঃকরণ করানোর জন্য তাকে লঘু করে একটু শিথিল আর ঢিলেঢালা ভাবে হজমযোগ্য করে উপস্থাপন করছেন, এবং সেটা করছেন ইসলামের শত্রুদের সাথে এক টেবিলে বসে, তখন আমরা বুঝতে পারি, নিছক ভয়ের কারণে সে এমনটি করছে না, বরং সমস্যার মূল আরো গভীরে। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, ইসলামের উপর আদর্শিক আক্রমণ নতুন কোন ঘটনা নয়, বরং সেটা হয়ে আসছে বেশ কয়েক শতক জুড়েই, এবং প্রত্যেক আক্রমণের জবাবে স্কলারদের কাছ থেকে তিনটি ভিন্ন ধরণের সাড়া মিলেছে।
-এক নম্বর গ্রুপ, এরা এই আক্রমণের মুখে কার্যত নতি স্বীকার করেছে। যে সভ্যতার কাছ থেকে এই আক্রমণ এসেছে, তারা সেই সভ্যতার চোখ-ধাঁধাঁনো চাকচিক্যতায় বিমুগ্ধ হয়ে তাদের কাছে নিজেদের আত্মা এবং মন সঁপে দিয়েছে । ফলশ্রুতিতে তারা কাফিরদের মতো করে ইসলামকে বুঝার চেষ্টা করেছে, তাদের থেকে পরিভাষা ধার করে ইসলামের নব নব ব্যাখ্যা করতে উদ্যত হয়েছে।
-দুই নম্বর গ্রুপ, তারা মাঝামাঝি একটি পথ বেছে নিয়েছে, তারা কিছু বিষয়ে ছাড় দেয়, কিছু বিষয়ে নয় (balancing approach)।
-এবং ৩ নম্বর গ্রুপে আছেন এমন কিছু স্কলার, যাদের অবস্থান উপরের দুই গ্রুপের মত নড়বড়ে নয়, তারা কোন ছাড় দেননি এবং যেকোনো প্রকার বাঁধা-বিপত্তি এবং চাপের মুখে অবিচল থেকেছেন।
কাজেই, আংকেল টমের সমস্যাটা ভয়জনিত নয়, বরং uncle tom এর বাস্তবতা হচ্ছে, সে ইসলামের শত্রুদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আদর্শিক আক্রমণের সামনে মাথা নত করেছে, তার আত্মা-মনকেও সে তাদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছে, যেন সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা টিকে থাকে, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াতে না হয়। এটা ভাববেন না, আংকেল টম একাকী ঘরে বসে জালিমের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে না পারার যন্ত্রণায় কাপঁছে !! না, তার অবস্থা এমনটা নয় ! সে মানসিক দাসত্বের বেড়াজালে এতটাই আটকা পড়েছে যে সে শত্রুকেও আর শত্রু বলে মনে করে না, সে অত্যাচারীকেও আর অত্যাচারী বলে বিশ্বাস করে না ! [এই ধরণের মানসিকতাকে ভালভাবে বুঝতে চাইলে Stockholm syndrome লিখে সার্চ করতে পারেন, Stockholm syndrome এমন একটি মানসিক অবস্থা যেখানে জিম্মি বা অপহৃত ব্যাক্তি অপহরণকারী ব্যাক্তির প্রতি একধরণের অনুকম্পা বোধ করে !!! ]
কাজেই আপনি যখন জিজ্ঞেস করছেন, এসব আংকেল টমদের কি করা উচিত, আমি বলবো আপনি অপাত্রে দান করছেন, কেননা, প্রথমত তাদের জন্য এ প্রশ্নটা খাটেই না! আপনি ধরেই নিচ্ছেন তারা কিছু একটা করতে চায়! মনস্তত্ত্বের ভাষায় বলতে গেলে, বহু আগেই তারা পরাজয় স্বীকার করে বসে আছে। কাজেই যে প্রশ্নটি আসা উচিত এবং যা নিয়ে আলোচনা করা উচিত তা হল, আজকে আমরা যারা উম্মাহকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করছি, তিন নম্বর গ্রুপভুক্ত স্কলারদের যারা অনুসরণ করতে চাই,প্রথম দুটো গ্রুপের মতো না হবার জন্য তাদের কি করা উচিত ? বিশেষভাবে, আমরা যারা পশ্চিমা দেশে বসবাস করছি, যেখানে আজকে একটা অদ্ভূত, অস্বাভাবিক, আগন্তুক গোছের একটা জীর্ণশীর্ণ ইসলাম পালন করা হচ্ছে তাদের কি করা উচিত, যখন আজকে ইসলাম থেকে সম্মান আর গৌরবের চাদর খুলে ফেলে ইসলামের ইজ্জতহানি করা হচ্ছে ???
কুর’আনে এমন কিছু আয়াত আছে, যদি আমরা সেগুলোর উপর গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলে সে আয়াতগুলো আমাদের কিছু টিপস দেয়। নির্দিষ্ট করে বললে, মুসা (আঃ) এবং ফির’আউনের গল্পের দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত। এই গল্পটি কুর’আনে সবচেয়ে বেশিবার বর্ণিত, সবচেয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত এবং আমরা যে সময়ে বাস করছি তার সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ। আজকে আমরা হচ্ছি একটি বিশ্বাসী (মুসলিম) জাতি (বনী ঈসরায়েলের ন্যায়) যাদেরকে শাসন করছে একটি জুলুমবাজ (আমেরিকান) সরকার (ফির’আউনের ন্যায়), এবং একজন মুসলিম নেতার (মুসা (আঃ)) উপর এই মুসলিম জাতিকে রক্ষা করা এবং তাদেরকে ও তাদের শোষকদের ইসলাম শেখানোর গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। তাহলে , আল্লাহর প্রেরিত একজন নবী, একজন সুদক্ষ এবং কুশলী দা’ঈ,মূসা (আঃ) কিভাবে এরকম একটি মূহুর্তে উম্মাহর এই ব্যাপারটি deal করেছেন ?
প্রথমেই খেয়াল করবার মতো যে বিষয়টি আসে তা হল মুসা (আঃ) এর কাছে ইসলামের “ওয়ালা” এবং “বারা” এ দুটো ধারণা স্ফটিকস্বচ্ছ ছিল। ফির’আউন এবং মুসা (আঃ) এর মধ্যে সম্পর্কের দিকে লক্ষ্য করুন, এখানে কোনো লুকোচুরি নেই, কোনো রাখঢাক নেই, কে কোন পক্ষে আছে সেটা নিয়ে কোনোরকম অস্পষ্টতা নেই। দুটো দলকে মোটা একটি দাগ দিয়ে পরিষ্কারভাবে পৃথক করা হয়েছে।মূসা (আঃ) ফির’আউন এবং ফির’আউনের দলভুক্ত সকলকে বনী ইসরাইলের শত্রুরুপে পরিষ্কার, জলের মতো স্বচ্ছ ও স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। বনী ইসরাইলকে আশ্বস্ত করে মুসা (আঃ) তাদেরকে বলছেন,
''হতে পারে তোমাদের প্রভু তোমাদের শত্রুদের ধ্বংস করবেন, আর অচিরেই তোমাদেরকে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন” [সূরা আরাফঃ১২৯]
শত্রুর প্রতি মুসা (আঃ) এর মনোভাব কেমন ছিল তা তার ফির’আউনের বিরুদ্ধে করা তার আক্রমণাত্মক দু’আ থেকে আরও পরিষ্কার হয়।
আর মূসা বললেন -- ''আমাদের প্রভু! নিশ্চয় তুমি ফিরআউন ও তার পরিষদবর্গকে এই দুনিয়ার জীবনে শোভা-সৌন্দর্য ও ধন- দৌলত প্রদান করেছ, যা দিয়ে, আমাদের প্রভু! তারা তোমার পথ থেকে পথভ্রষ্ট করে। আমাদের প্রভু! বিনষ্ট করে দাও তাদের ধনসম্পত্তি, আর কাঠিন্য এনে দাও তাদের হৃদয়ের উপরে, তারা তো বিশ্বাস করে না যে পর্যন্ত না তারা মর্মন্তুদ শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। [সূরা ইউনুসঃ৮৮]
এবং মুসা (আঃ) এর কথা বর্ণনা করে তারপর আল্লাহ বলছেন,
অতঃপর ফেরাউন পরিবার মূসাকে কুড়িয়ে নিল, যাতে তিনি তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হয়ে যান। নিশ্চয় ফেরাউন, হামান, ও তাদের সৈন্যবাহিনী অপরাধী ছিল। [সূরা ক্বাসাসঃ৮]
মূসা (আঃ) ফির’আউনের প্রতি যে ধরনের মনোভাব এবং অনুভূতি পোষণ করতেন সেটা বোঝাটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই ধারণাটি যদি মনের মধ্যে পরিষ্কারভাবে প্রোথিত না থাকে যে প্রকৃত শত্রু আসলে কে, তাহলে নিজেকে এবং নিজের উম্মতকে শত্রুর ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সুপরিকল্পিত কোন স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। এ কারণেই কুর’আনে শয়তানের ব্যাপারে আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন,
নিঃসন্দেহ শয়তান তোমাদের শত্রু, কাজেই তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ কর![সূরা ফাতিরঃ৬]
আপনার শত্রু কখনোই আপনাকে তার পরিকল্পনা জানতে দেবে না। সে হবে খুব সুক্ষ, শঠতাপূর্ণ, কূটকৌশলী, স্মিতহাস্য, ধিরস্থির এবং ধূর্ত । আপনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপনাকে সে আঘাত করে চুরমার করে দেবে। এমনটা যে কেবল বাস্তব জগতে ঘটবে তা নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক জগতেও আপনি তার কাছে হেরে যেতে পারেন যুদ্ধে নামার আগেই, আপনার আত্মা ও মন শত্রুর দাস হয়ে পড়বে, এ যেন হারার আগেই হেরে যাওয়া। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের একটা সুপ্রসিদ্ধ কৌশল হল আপনার শত্রু আপনাকে বোঝাবে সে আপনার শত্রু নয় বরং বন্ধু, যেন আপনাকে ব্যবহার করে সে তার আসল শত্রুকে দমন করতে পারে। এই ফাঁদে পা দেয়ার অর্থই হলো নিজেকে এবং নিজেদের মানুষকে রক্ষা করার শেষ সুযোগটুকুও হারানো। এছাড়াও, আপনার ভাই এবং বোনদের জন্য আপনার বিশ্বস্ততার হাত না বাড়িয়ে সে হাত কাফিরদের সাথে মেলানো হলো মুনাফিক্বদের বৈশিষ্ট্য।
“এরা (মুনাফিক্বরা) দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলন্ত; এদিকেও নয় ওদিকেও নয়…” [সূরা নিসাঃ১৪৩]
কাজেই নিজে বাঁচতে এবং উম্মাহকে বাঁচাতে প্রথম যে ধাপ, হোক তা লেখায় কিংবা কথায় বা অন্য যেকোন উপায়ে, তা হল ওয়ালা’ এবং বারা’ এর ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং নিজেদের মনের ভেতর তা শক্তভাবে গেঁথে ফেলা, যেন আপনি আপনার শত্রু এবং বন্ধুর মাঝে একটি মোটা দাগ টেনে তাদেরকে পৃথক করতে পারেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা যে জগতে বাস করি সে জগতের জন্য এটা খুবই চিন্তা করার মতো একটি বিষয়।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি আমাদের খেয়াল করতে হবে তা হল বিভিন্ন শব্দ যেমন “মৌলবাদ”, “চরমপন্থা”, “সন্ত্রাসবাদ”, “উগ্রবাদ” এবং আরো যত “বাদ” আছে যত্রতত্র এসব শব্দের ব্যবহার। এই শব্দগুলো ধোকাঁবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়, গণমানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখাই এসকল শব্দচয়নের উদ্দেশ্য। মুসা (আঃ) কে রুখে দিতে ফির’আউন ঠিক একই কৌশল অবলমম্বন করেছিল !
“আর ফিরআউনের লোকদের প্রধানরা বললে -“আপনি কি মূসাকে ও তার লোকদের ছেড়ে দেবেন দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে এবং আপনাকে এবং আপনার দেবতাদের পরিত্যাগ করতে?”[সূরা আরাফঃ১২৭]
“ফেরাউন বলল; তোমরা আমাকে ছাড়, মূসাকে হত্যা করতে দাও, ডাকুক সে তার পালনকর্তাকে! আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে দেবে অথবা সে দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে” [সূরা গাফিরঃ ২৬]
এবং ফির’আউন নিজেকে প্রগতিশীল, সুশীল এবং উদারপন্থী হিসেবে দাবি করতো !!!
“ফেরাউন বলল, আমি যা বুঝি, তোমাদেরকে তাই বোঝাই, আর আমি তোমাদেরকে মঙ্গলের পথই দেখাই।” [সূরা গাফিরঃ২৯]
কিন্তু বাস্তবে ফির’আউন এই শব্দগুলোর (ফিতনাবাজ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারী) অবতারণা করেছিল মূসা (আঃ) যে দিকে মানুষকে আহবান করছিলেন সেটিকে বোঝাতে, কারণ মুসা(আঃ) অবস্থান নিয়েছিলেন ফির’আউনের বিরুদ্ধে। যেসব মিশরীয় মুসা (আঃ) এর ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের কথা থেকে আমরা বুঝতে পারি ফির’আউন কি mean করেছিল। তারা বলেছিলঃ
“বস্তুতঃ আমাদের সাথে তোমার শত্রুতা তো এ কারণেই যে, আমরা ঈমান এনেছি আমাদের পরওয়ারদেগারের নিদর্শনসমূহের প্রতি যখন তা আমাদের নিকট পৌঁছেছে।” [সূরা আরাফঃ১২৬]
ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের একটা মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে এই আয়াতটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত। ফির’আউন সকলের সামনে মুসার এমন একটি চরিত্র উপস্থাপন করতে চেয়েছিল যাতে মনে হবে মুসা একজন রক্তচোষা বিকারগ্রস্ত লোক, যে সমাজে ফিতনা-ফাসাদ করতে চায়!!! কিন্তু আমরা কুর’আনে দেখতে পাচ্ছি এমন কিছু বিশ্বাসী ছিলেন যারা ফির’আউনের এই মিডিয়া ক্যাম্পেইনে প্রলুব্ধ হয় নি, তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন মুসা(আঃ) সত্য বলছেন, আর ফির’আউন মিথ্যা। তারা জানতেন ফির’আউন মৌলবাদ, ধর্মীয় চরমপন্থা কিংবা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে না, বরং মুসা (আঃ) এর আহবান অর্থাৎ ইসলাম থেকে লোকজনকে দূরে সরিয়ে রাখতে এই ধরণের স্পর্শকাতর শব্দ ব্যবহার করছে। কেন ? কারণ, মুসা (আঃ) যে মেসেজটা মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন তা হল, আমরা কেবল আল্লাহর কাছে মাথা নত করবো, ফির’আউনের মত কোন অত্যাচারী জালিমের কাছে নয়। আর তাঁর এই কথাগুলো ফির’আউন যে মানুষগুলোকে এতকাল মানসিক দাসত্বের বেড়াজালে বন্দী করে রেখেছিল, তাদের মনে গৌরব, মর্যাদা এবং আত্মসম্মানের একটি চেতনা সৃষ্টি করে।
আর আজকেও আমরা দেখছি ইসলামের যেসব ভাবনা মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করবে, ইসলামের যেসব চেতনা মানুষের সামনে মুক্তির দুয়ার উন্মোচিত করবে, সেইসব বিষয়গুলোর সাথে খুব অপ্রীতিকর এবং নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টিকারী লেবেল জুড়ে দেওয়া হয়। তাই “ওয়ালা এবং বারা” হয়ে যায় 'মৌলবাদ', আত্মরক্ষার জিহাদ পরিণত হয়ে যায় 'সন্ত্রাসবাদে', কিংবা 'জংগিবাদে', আর শরীয়াহকে অপবাদ দেওয়া হয় 'চরমপন্থা' বলে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আপনি দেখবেন আমজনতাও কোনো চিন্তাভাবনা না করে এসব জিনিস খুব করে খাচ্ছে। এমনকি অনেক স্কলার এবং দা’ঈ পর্যন্ত তাদের কথায় এবং লেখায় কাফিরদের সাথে এক সুরে বাঁধা হয়ে এসব টার্ম ব্যবহার করছেন।
লেখার শুরুতে আদর্শিক আক্রমণের জবাবে কে কিভাবে রেস্পন্স করে সে আলোচনায় আমি এই ধরণের স্কলারদেরকেই ১ নম্বর গ্রুপভুক্ত করেছিলাম, তারা নিজেরাই নিজেদেরকে দাসত্বের জালে বন্দী করেছে। আজকে এই সকল স্কলাররা তাগুত সরকার আয়োজিত “Counter-radicalism conference” এ গর্বের সাথে যোগ দিচ্ছে, আপনি কি কল্পনা করতে পারেন, মূসা (আঃ) ফির’আউনের কাছে গিয়ে আর্তি জানাচ্ছে যেন বনী ইসরাঈলকে সুশীল করে গড়ে তোলা হোক, তাদের মধ্য থেকে মৌলবাদের বীজ নির্মূল করা হোক? কিংবা আমাদের রাসূল (সাঃ) স্পেশাল এজেন্ট আবু জেহেলকে দাওয়াত করে এনেছেন দারুল আরকামে সাহাবীদেরকে “চরমপন্থা দমনে কি করণীয়” তা নিয়ে লেকচার দেওয়ার জন্য? অবশ্যই না ! কাজেই আপনাকে সাবধান থাকতে হবে মুসা (আঃ) এর অনুসারীদের মতো যেন আপনি এ ধরণের শব্দের উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারে প্রতারিত না হন এবং এই শব্দগুলো ব্যবহার করা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেন।
আরো একটি ব্যাপার চিন্তা করার ব্যাপার রয়েছে তা হল হিকমাহ প্রয়োগ করা এবং নমনীয় হওয়া। আপনি আপনার প্রশ্নে হিকমাহ এর কথাটি জিজ্ঞেস করেছেন। আপনি দেখবেন, এই হিকমাহ প্রয়োগ করতে গিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করছেন, আবার কেউ এই হিকমাহকে একেবারে বর্জন করে বাড়াবাড়ির পরিচয় দিয়েছেন। একদল লোক শ্রোতার মেজাজ-মর্জির দিকে থোড়াই কেয়ার করে তাদের জ্ঞানের মাত্রার প্রতি নজর না দিয়ে কোনো রাখ-ঢাক ছাড়া কথা বলতে থাকে, আবার অনেকে এমন এক জাতের হিকমাহ প্রয়োগ করে যাতে কিনা ইসলামের মূল মেসেজের essence টুকুই নষ্ট হয়ে যায় বা হারিয়ে যায়। আপনি যদি মূসা (আঃ) এর দিকে দেখেন, তাহলে আপনি দেখবেন উনি এ দুটোর কোনোটিই করেননি। আমাদের মতো তিনিও ছিলেন সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের মতো তারও দুনিয়াবী শক্তির ক্ষেত্রে দুর্বলতা ছিল। আমাদের মত তাঁকেও এক কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছিল। আর আমাদের মতো, তাকে বিশেষভাবে আদেশ করা হয়েছিল যেন তিনি উম্মাহর ব্যাপারে নমনীয়তা অবলম্বন করে।
তোমরা উভয়ে ফেরআউনের কাছে যাও সে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে. অতঃপর তোমরা তাকে নম্র কথা বল, হয়তো সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে [সূরা ত্ব-হাঃ৪৩,৪৪]
আবার আপনি যখন অন্য আয়াতগুলোর দিকে তাকাবেন, তখন আপনি মূসা (আঃ) এর দা’ওয়াহ এর মধ্যে প্রজ্ঞার ছাপ দেখবেন। দা’ওয়াহ এর ক্ষেত্রে নমনীয়তা অবলম্বনের রীতিকে ঢাল বা সেন্সরবোর্ড রূপে ব্যবহার করে মূসা (আঃ) কখনোই অস্পষ্টভাবে সত্য বলার পথ বেছে নেন নি।
“আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে, তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার ব্যাপারে আমি সুদৃঢ়…” [সূরা আরাফঃ১০৫]
শুধু তাই নয়, নমনীয়তা অবলম্বনের মানে এই নয়, জুলুম-নির্যাতনের মুখে ভীরু এবং নরম-সরম হয়ে থাকতে হবে।
“অতএব তোমরা তার কাছে যাও এবং বলঃ আমরা উভয়েই তোমার পালনকর্তার প্রেরিত রসূল, অতএব আমাদের সাথে বনী ইসরাঈলকে যেতে দাও এবং তাদেরকে নিপীড়ন করো না। আমরা তোমার পালনকর্তার কাছ থেকে নিদর্শন নিয়ে তোমার কাছে আগমন করেছি। এবং যে সৎপথ অনুসরণ করে, তার প্রতি শান্ত। আমরা ওহী লাভ করেছি যে, যে ব্যক্তি মিথ্যারোপ করে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার উপর আযাব পড়বে”।[সূরা ত্ব-হাঃ৪৭,৪৮]
আসুন আমরা একটি মিনিটের জন্য থামি এবং এই আয়াতগুলোর দিকে মনোযোগ দিই। এখানে আমরা দেখছি মুসা (আঃ) একজন নবী, যিনি শক্তিধর কোন ব্যাক্তি তো ছিলেনই না, বরং তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানুষদের একজন। তিনি ছিলেন সংখ্যালঘু। বিশ্বের তত্কালীন পরাশক্তির সাথে নম্রতা অবলম্বন করতে আদেশপ্রাপ্ত মুসা তার সংকটাপন্ন উম্মাহকে উদ্ধার করতে তিনটি পদক্ষেপ নিলেনঃ
- তিনি ফিরাউনের অপকর্মের কথা খুব পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করলেন তার জাতির সামনে।
- তিনি খুব দৃঢ়তার সাথে দাবি করলেন যে ফিরাউনকে অবশ্যই তার দুষ্কর্মের ইতি টানতে হবে।
- তিনি ফিরাউনকে তার দৌরাত্ম্যের জন্য তার অশুভ পরিণামের ব্যাপারে হুমকি দিলেন।
আপনি দেখবেন, মুসা (আঃ) আত্মপক্ষসমর্থন করার চেষ্টা করেননি, কোনো কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করেননি, তার মধ্যে কোনো পরাজিত মানসিকতা ছিল না, তার কথায় কোনো অস্পষ্টতা ছিল না, তার মধ্যে ভীরুতা ছিল না। তার বস্তুগত শক্তিমত্তা ছিল না ঠিকই, কিন্তু এটা তার নৈতিক মনোবলে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি। বরং তিনি তা-ই বলেছিলেন, যা বলা উচিত, যেভাবে বলা উচিত, এবং যখন বলা উচিত। ইবনে ক্বায়্যিম হিকমাহকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবেই, “হিকমাহ হচ্ছে সে কথা বলা, যা বলা উচিত, সেভাবে বলা যেভাবে বলা উচিত, এবং তখন বলা, যখন বলা উচিত” (মাদারিজ আস-সালিকিন, ২/৪৭৯)।
মুসা (আঃ) মিনমিন করে কথা বলেননি, তার কথায় সাহস ছিল, তার মধ্যে আত্মমর্যাদার ছাপ ছিল সুস্পষ্ট, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, তিনি ছিলেন খুব স্পষ্টভাষী। ফির’আউনের প্রতিক্রিয়া দেখে আমরা এটা বুঝতে পারি। সে মুসাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা 'মৌলবাদ'-বিরোধী কনফারেন্সে আমন্ত্রণ করে নি, কিংবা মুসাকে তার সরকারের ‘সন্ত্রাসবাদ দমন বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে যোগ দিতে অনুরোধ করে নি! বরং ফির’আউন চেয়েছে মুসাকে হত্যা করতে, যেমন করে এই ফির’আউনদের অপকীর্তি প্রকাশ করে দেওয়ার কারণে মানবাধিকার এবং মুক্তিকামী নেতাদের যুগে যুগে গুপ্তহত্যা করা হয়েছে । এবং সেই একই ঘটনা ঘটে চলেছে আজ অবধি ...
আমাদের অধিকাংশই ভীতু। আমরা যেকোনো মূল্যে টেনশন/দুশ্চিন্তা পরিহার করে চলতে চাই, লোকের বিরোধিতার মুখে পড়তে চাই না, এবং আমরা চাই সবাই আমাদের পছন্দ করুক। তাই আমরা যদিওবা বুঝতে পারি একটা সাহসী পদক্ষেপ নেয়া খুব জরুরী, আমরা সেটা নিতে চাই না, কারণ সেটার ফলাফল নিয়ে আমরা আতংকগ্রস্ত থাকি, কিংবা লোকে আমাদেরকে কি ভাববে এবং সকলের দৃষ্টি আমাদের উপরে পড়তে পারে- এই ভেবে আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কেটে পড়ি। হ্যাঁ, আমরা আমাদের ভীরুতাকে “হিকমাহ” কিংবা “বিচক্ষণতা” বলে চালিয়ে দিতে পারি, কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এটা স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের মধ্যে যে ভয় আছে তা আমাদের নিজেদের হাতে গড়ে নেয়া অভ্যাস, এটা সহজাত নয়। নিজেকে টেনশন থেকে বাঁচাবার জন্য আমরা এর আশ্রয় নিই। ভয়কে নিজের জীবন থেকে উপড়ে ফেলুন, এবং সাহস দিয়ে একে প্রতিস্থাপিত করুন। ভীরুতার দরুণ আপনাকে যে মূল্য দিতে হবে তা সাহসের জন্য দেয়া মূল্য থেকে অনেক বেশি চড়া।
আপনার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে, সুফিয়ান আত-থাওরী, (তিনি একজন তাবে’ঈন, সাহাবীদের পরের জেনারেশন) চরম হতাশার চোটে রক্ত প্রস্রাব করতেন, যখন তিনি সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করতে গিয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে ব্যর্থ হতেন। কাজেই, যখন কিছু বলার সুযোগ পাবেন আপনি, চুপ করে থাকবেন না, দ্ব্যর্থকতার আড়ালে নিজেকে সুবিধাজনক অবস্থানে লুকিয়ে রাখবেন না, এটা করে আপনার কোনোই ফায়দা হবে না। মুসা (আঃ) কে অনুসরণ করুন, নামগুলো সুনির্দিষ্ট করে উচ্চারণ করুন ধরে ধরে, আমেরিকান সরকারের নাম বলুন, তুলে ধরুন প্যালেস্টাইন, ইরাক আর আফগানিস্তানের কথা, বোন আফিয়া সিদ্দিক্বা এবং এরকম যা কিছু আছে, যেন জালেমরা জানতে পারে তাদের কাজকর্ম নিয়ে আমরা কি ভাবছি। এটাকে চরমপন্থা কিংবা মৌলবাদ অথবা উগ্রবাদ বলে না, এটা হচ্ছে সত্যকে কোন ধরণের কাটাকুটি বা অস্পষ্টতা ছাড়া যেমন-আছে-তেমন-ভাবে প্রকাশ করে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা।
আর হিকমাহ মানে এই নয় যে, আমরা আমাদের দ্বীনকে মানুষের কাছে লুকিয়ে রাখবো শুধু এই কারণে যে দ্বীন ইসলামের কোনো একটি অংশ সমাজের চোখে অপছন্দনীয়, অনুচ্চার্য কিংবা অযাচিত বলে ঠেকে। ইসলামিক দা’ওয়াহ এর মূল কথাই হল সত্যকে প্রকাশিত করা, তাকে গোপন করে রাখা নয়।
আর স্মরণ করো! যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের থেকে আল্লাহ্ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন -- ''তোমরা নিশ্চয় এর কথা লোকেদের কাছে প্রকাশ করবে, আর তা লুকিয়ে রাখবে না। [সূরা আলে ইমরানঃ১৮৭]
“নিশ্চয় যারা গোপন করে, আমি যেসব বিস্তারিত তথ্য এবং হেদায়েতের কথা নাযিল করেছি মানুষের জন্য কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা করার পরও; সে সমস্ত লোকের প্রতিই আল্লাহর অভিসম্পাত এবং অন্যান্য অভিসম্পাতকারীগণের ও” [সূরা বাক্বারাঃ১৫৯]
এবং সেইসব লোক, যারা কোন প্রশ্নের উত্তর জানার পরেও নিশ্চুপ থাকাকে শ্রেয় মনে করে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাদের জন্য একটি কঠোর সতর্কবাণী রেখে গেছেনঃ “Whoever is asked about a piece of knowledge and hides it will be branded with a brand of fire on the Day of Resurrection.” হোক সে ব্যাপারটি আমাদের দ্বীনের ‘বিতর্কিত’ এবং সমাজের চোখে অযাচিত, অপছন্দনীয়, not-welcomed বিষয়গুলোর একটি। যেমন ধরা যাক জিহাদ। “আমার হাত বাঁধা, আমার কিছু বলার নেই”[১৭ই মার্চ, নিউ ইয়র্ক টাইমস] এরকম ভাব করে আছেন কেন ? ইসলামে জিহাদের সত্যিকার ধারণাটি কেমন সেটা ব্যাখ্যা করে দিলেই তো পারেন, এমন তো না আপনাকে কেউ বলছে যে তলোয়ার হাতে রাস্তায় নেমে পড়তে হবে!
যারা জানতে চান তাদেরকে শুধু জানিয়ে দিনঃ ইসলামের মূলধারার, সর্বজনগৃহীত, ক্ল্যাসিক্যাল চারটি মাযহাব জিহাদের ব্যাপারে কি বলছে। আপনি যদি সেই তথাকথিত “বাকস্বাধীনতার দেশ” এ পড়ে থাকেন আর এ কথা ঘোষণা করতে ভয় করেন যে, ইসলাম আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার শিক্ষা দেয়, সেক্ষেত্রে আপনার উচিত সেই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও হিজরত করা যায় কিনা সে চিন্তা করা, যেখানে এত স্বাভাবিক এবং মানবিক একটা বিষয়ে কথা বলার কারণে আপনাকে জেলে ছুঁড়ে ফেলা হবে না। আমাদের এই দ্বীনে এমন কিচ্ছু নেই, কুর’আন বা হাদীস একটা অক্ষর ও খুঁজে পাওয়া যাবে না যার জন্য আমাকে বা আপনাকে বিব্রত হতে হবে, লজ্জিত হতে হবে, কিংবা মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করতে ভয় পেতে হবে। সবকিছু বাদই দিলাম, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকানরা যে বিপ্লব করেছিল, যুদ্ধ করেছিল সেটা জিহাদ ছাড়া কি ? কিংবা নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে ফ্রেঞ্চরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সেটাকে জিহাদ ছাড়া আর কিই বা বলা যায় ? এসবের সাথে সেসব মুসলিমদের পার্থক্য কি যারা আমেরিকানদের সাথে লড়ছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ?
সবশেষে যে ব্যাপারটি আসে তা হল দা’ওয়াহ এর জন্য কষ্ট এবং যন্ত্রণা ভোগ (আমি আগেই বলেছি আংকেল টমের সমস্যা ভয় থেকেও বেশি কিছু), যে অজুহাতটি সকলে দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করে এবং যেকোনো কিছুকে জায়েজ করে ফেলে। হ্যা, মুসা (আঃ) এবং বনী ঈসরায়েল ও একটি আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে অবস্থান করছিল, এবং সে সময়টা ছিল আমাদের সময় থেকে আরো বেশি ভয়ংকর। মুসা (আঃ) এবং হারূন (আঃ) আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন,
“তারা বললঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আশঙ্কা করি যে, সে আমাদের প্রতি জুলুম করবে কিংবা সীমালংঘন করবে” [সূরা ত্ব-হাঃ৪৫]
“কিন্তু তাঁর সম্প্রদায়ের সন্তানসন্ততি ব্যতীত আর কেউ মূসার প্রতি বিশ্বাস করে নি ফিরআউন ও তাদের পরিষদবর্গের ভয়ে পাছে তারা তাদের নির্যাতন করে…” [সূরা ইউনুসঃ৮৩]
“অতঃপর মূসা মনে মনে কিছুটা ভীতি অনুভব করলেন” [সুরা ত্ব-হাঃ৬৭]
তারা কারাবন্দী হবার ভয়ে ভীত হয়েছিলেন,
“ফেরাউন বলল, তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে উপাস্যরূপে গ্রহণ কর তবে আমি অবশ্যই তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করব” [সূরা শু’আরাঃ২৯]
তারা অত্যাচারিত হবার আশংকা করছিলেন,
“ফেরাউন বললঃ … আমি অবশ্যই তোমাদের হস্তপদ বিপরীত দিক থেকে কর্তন করব এবং আমি তোমাদেরকে খর্জুর বৃক্ষের কান্ডে শূলে চড়াব …” [সূরা ত্ব-হাঃ৭১]
তাদের মধ্যে মৃত্যুভয় ছিল,
“নিঃসন্দেহে ফেরাউন তার দেশে উদ্ধত হয়েছিল এবং সে দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের একটি দলকে দূর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্র-সন্তানদেরকে হত্যা করত এবং নারীদেরকে জীবিত রাখত … “ [সূরা ক্বাসাসঃ৪]
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। আজকে FBI কিংবা MI5 আমাদের সাথে যা করছে, আমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর সাথেও তা করা হয়েছে, আর সত্যি বলতে কি আমাদের সময়টা তাদের সময় থেকে সহজ। কিন্তু এরকম একটি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি বিরাজমান থাকার পরেও, ফির’আউনের হাতে ভীষণভাবে অত্যাচারিত হবার সম্ভাবনা থাকলেও, আমরা দেখেছি মুসা (আঃ) কে সেই ত্রাসের দেয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে। তার সাথে আজকালকার uncle tom জাতীয় স্কলারদের পার্থক্য এখানে যে, তিনি তার ভয়কে জয় করার জন্য মনঃস্থির করেছিলেন, আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভর করেছিলেন এবং তার কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। তাই আল্লাহ তার জন্য সমুদ্রকে দু’ভাগ করে দিয়েছিলেন।
তিনি কেবল তার মনটাকে স্থির করেছিলেন। তার মতো যারা ছিলেন তাদের জন্যও অন্ধকার সমুদ্র দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল। সিয়ার আ’লাম আল-নুবালা (১০/২৫৭) এ বর্ণিত আছে, দ্বীন ইসলামের সাথে আপোসে আসতে অস্বীকৃতি জানানোর অপরাধে যখন ইমাম আহমদকে বাগদাদের কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় তখন তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন আল-মারওয়াদি। ইমাম আহমদ তাকে বললেন কারাগার থেকে বের হয়ে অমুক জায়গায় যাও এবং ফিরে এসে আমাকে জানাও তুমি কি দেখেছ। আল-মারোয়াদি সেখানে গেলেন এবং দেখলেন সেখানে যেন এক সাগর লোক কাগজ এবং কলম হাতে বসে আছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কি করছো ? তারা উত্তর দিল, আমরা ইমাম আহমদের জন্য অপেক্ষা করছি, তিনি এসে যা বলবেন আমরা সেগুলো লিখে রাখবো। আল-মারওয়াদি ফিরে এলেন এবং তিনি যা দেখে এসেছেন তা ইমাম আহমদকে জানালেন । ইমাম আহমদ কারাগার তার কক্ষ থেকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, তুমি কি চাও আমি এই লোকগুলোকে বিপথে পরিচালিত করি ? তিন বছর কারাগারে থাকার পর ইমাম আহমদকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
যিনি সত্যিকারের একজন আলিম, একজন বিশ্বাসী, তিনি তার ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার উপরে সত্যকে স্থান দেন। যখন রাসূল (সাঃ) আবু বকর (রাঃ) কে সাথে নিয়ে গুহাতে বন্দী ছিলেন, আপনার কি মনে আছে তিনি আবু বকরকে কি বলেছিলেন ? তিনি বলেননি, আবু বকর ভয় কোরো না, তিনি বলেছিলেন, আবু বকর দুঃখিত হোয়ো না। কারণ আবু বকর তার নিজের নিরাপত্তার ভয় করেননি। বরং তিনি দেখছিলেন যদি তারা মুশরিকদের হাতে মারা যান তবে ইসলামের এই আহবান, ইসলামের এই দা’ওয়াহ থেমে যেতে পারে। আবু বকর জানতেন, ইসলামের দিকে আহবান করলে তার ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে, কখনই এ দুটোকে পৃথক করা যাবে না।
এটা ছাড়া আর অন্য কোন গত্যন্তর নেই যে, কেউ যদি কোন প্রকার কাটা-ছেঁড়া ছাড়া নবীদের দা’ওয়াহকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে আগ্রহী হয়এবং একইসাথে সে একটা উপভোগ্য নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করতে চায় তাহলে সে ভ্রান্তির জগতে বসবাস করছে। আপনাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে, আপনাকে আরাম-আয়েশের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে হবে, যত যাই কিছুর মুখোমুখি হতে হোক না কেন। আপনি যেন ইতস্তত বোধ না করেন, ভয় যেন আপনাকে পেছনে টেনে না রাখে।
আশা করবো, উপরের আয়াতগুলো নিয়ে খুব মন দিয়ে চিন্তা ভাবনা করবেন এবং আয়াতের শিক্ষাগুলোকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করবেন। কথায় এবং লেখায় যেন আমরা মাটি থেকে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাতে পারি।
-সংগৃহীত
মূল লেখার লিংকঃ
Advice to the Du'at
http://kalamullah.com/uncle-tom.html
বাংলা অনুবাদের লিন্ক: Click here
বিষয়: বিবিধ
৩৫৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন