লন্ডন সেন্ট বার্থ হাসপাতাল : মৃতু্যপথযাত্রী মনোয়ার বদরুদ্দোজার সঙ্গে দেড় ঘণ্টা
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৮, ০৭:৪৮:১৩ সকাল
মনোয়ার হোসাইন বদরুদ্দোজা। সংগঠক, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী। বয়স পঞ্চাশের কোটায় হলেও তারুণ্যদীপ্ত । কয়েক সপ্তাহ আগে হঠাৎ জানলাম তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। বেঁচে থাকা অনিশ্চিত। বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্খীরা দলেদলে তাঁকে দেখতে যাচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিনই সচিত্র স্ট্যাটাস আসছে । ভাবছিলাম, শীঘ্রই দেখতে যাবো। কিন্তু যাবো যাবো করে আর যাওয়া হয়ে ওঠছিলোনা। এরই মধ্যে জানতে পারলাম তিনি হাসপাতালে চলে গেছেন। চিকিৎসা চলছে। কিন্তু গত সপ্তাহে হঠাৎ আরো একটি স্ট্যাটাস দেখে আতকে উঠলাম । তাঁর এক শুভাকাঙ্খী লিখেছেন, মনোয়ার হোসাইন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে গেছেন। ডাক্তার তাঁর আয়ূসীমা বেঁধে দিয়েছেন । বড়জোর সপ্তাহ-দশদিন বাঁচতে পারেন।
ভাবলাম আর দেরি করা চলবেনা । যেকোনো সময় তিনি চলে যেতে পারেন। আর চলে গেলে দেখতে না যাওয়ার বেদনা আজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। তাই আজই যাবো। এরই মধ্যে ফোনে ফোনে আরো দুজন সঙ্গীও পেয়ে গেলাম। একজন ব্যারিস্টার নাজির আহমদ। অন্যজন সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী । অল্ডগেইট থেকে পঁচিশ নাম্বার বাসে চড়লাম। যাবো সেন্ট বার্থ হাসপাতালে। সেন্ট পলস আন্ডার গ্রাউন্ড স্টেশনের পাশেই । বাসে মিনিট পনেরোর পথ । রাস্তায় ট্রাফিক কম থাকায় সময় মতোই গিয়ে হাসপাতালে পৌঁছলাম। হাসপাতালের প্রবেশ পথে পেলাম সাংবাদিক আব্দুস সাত্তার মিশু ও তৌহিদুল করিম মোজাহিদ ভাইকে। এক সঙ্গে নির্ধারিত কেবিনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম।
সাধারণত হাসপাতালে রোগী দেখতে গেলে রিসেপশনে গিয়ে নাম বলতে হয়। কর্তব্যরত কর্মর্কর্তা রোগীর কেবিন দেখিয়ে দেন। কিন্তু আমরা ভেতরে যাওয়ার পর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না । একজন নার্স আমাদেরকে মনোয়ার হোসাইনের কেবিনের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেলেন। বুঝতে পারলাম, চেহারার মধ্যে বাঙালিয়ানার ছাপ দৃশ্যমান থাকায় নার্স বুঝতে পেরেছেন আমরা মনোয়ার হোসাইনকেই দেখতে এসেছি। তাই তিনি আমাদেরকে কিছু না জিজ্ঞেস করেই এগিয়ে নিয়ে গেলেন।
ভেতরে ঢোকে দেখলাম কমিউনিটির পরিচিত অনেকেই রয়েছেন। একজন তাঁর শিয়রের কাছে বসে কপালের উপর ভেজা কাপড় চেপে ধরে রেখেছেন। মনোয়ার ভাই বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। শ্বাস নিচ্ছেন জোরে জোরে। ফ্যাকাশে মুখ। মাথার চুলগুলো প্রায় ঝরে গেছে। উসকো খুশকো দাড়ি । মলিন মুখ। নাভি পর্যন্ত চাঁদরে ঢাকা । বুকের উপর জামা নেই। শরীর শুকিয়ে পাজরের হাঁড়গুলো বেরিয়ে গেছে। দূর থেকেও হাঁড়গুলো গোনা যাচ্ছে। কংকালের মতো হয়ে আছে পুরো দেহ।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করছি তিনি চোখ খুললে আমাদের দেখবেন, চিনবেন। আমরা তাঁর সাথে কথা বলবো । এরই মধ্যে কেবিনে ঢুকলেন সাবেক কাউন্সিলার মোহাম্মদ মোস্তাকিম, মাওলানা রফিক আহমদ রফিক, ইস্ট লন্ডন মসজিদের ট্রাষ্টি মুহিব রহমানীসহ আরো বেশ কজন। কেবিনটি মানুষের উপস্থিতিতে পরিপুর্ণ হয়ে গেলো।
পিনপতন নীরবতায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি । হঠাৎ তিনি চোখ খুললেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে শরীরের সকল শক্তি খাটিয়ে ওঠে বসতে চেষ্টা করলেন । কিন্তু পারলেন না। ইশারায় বুঝালেন, কপালের উপর রাখা কাপড়টি যেনো আবারও ভিজিয়ে এনে স্বস্থানে রাখা হয়। সঙ্গে সঙ্গে নতুন আরো এক টুকরো কাপড় ভিজিয়ে এনে কপালে রাখা হলো। মনে হলো তিনি কিছুটা স্বস্তি পেলেন।
এবার থেমে থেমে ভাঙ্গা কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করলেন। প্রথম কথা- তাইসির ভাই, নাজির ভাই, মতি ভাই আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমার জীবনে অনেক ভুল করেছি। আপনাদের কষ্ট দিয়েছি। নাজির ভাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। শক্ত করে ধরে বললেন আমাকে কি মাফ করে দিয়েছেন? আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে মাফ করে দিয়েন। এরপর আবারও নীরব হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর একজন নার্স এসে ঢুকলেন। তিনি কানে কানে মৃদুকণ্ঠে জানতে চাইলেন, তাকে কি একটি প্যারাসিটামল দিবেন। মনোয়ার ভাই বললেন- ইয়েস, শিউর। আবার দুই আঙুল মোচড় দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, প্যারাসিটামল ট্যাবলেটটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে যেনো তাঁর মুখে দেয়া হয়। তিনি পানি দিয়ে গিলে নেবেন। এরপর খানিক ওঠে বসলেন। ট্যাবলেটটি মুখে দেয়া হলো। গিলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গলায় আটকে গেলো। কাশতে থাকলেন । দীর্ঘক্ষন চেষ্টা করলেন ট্যাবলেট টুকরোগুলো গিলে ফেলতে, কিন্তু কিছুতেই ভেতরে যাচ্ছিলোনা। অনেক কষ্টের পর অবশেষে গিলতে সক্ষম হলেন।
আমাদের সঙ্গে তাঁর একই কথা, আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমি অনেক ভুল করেছি। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বললেন, ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকেই আমি আল্লাহর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছি । রোগ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তায়ালা আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই অসুখ দিয়েছেন। তিনি ভালো মনে করলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন । নতুনবা নিয়ে যাবেন। এখানে আমার করার কিছুই নেই।
আমরা আরো কিছুক্ষন বসলাম। একদলের পর আরেকদল মানুষ আসছেন, যাচ্ছেন। তিনি চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছেন। শুধু একই কথা বলছেন, আমাকে মাফ করে দিয়েন। এভাবে ঘণ্টা দেড়েক বসার পর একসময় বিদায় নিয়ে ওঠে দাড়ালাম। বললাম আবারও দেখতে আসবো মনোয়ার ভাই।
জানিনা তাঁকে আবার দেখার সুযোগ হবে কিনা । ডাক্তারের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই কি তিনি পরাপারে পাড়ি জমাবেন। নাকি ফিরে আসবেন তাঁর প্রিয় কমিউনিটিতে। আমরা ফিরে এলাম জীবনের ব্যস্ততায়। কেউ কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার তাগিদে । কেউ নিজের ঘরে স্ত্রী,সন্তানের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে। কিন্তু মনোয়ার ভাই বিছানায় পড়ে থাকলেন সেই অনন্তকালের পথযাত্রী হয়ে। যে পথের পথিক আমরা সকলেই। এই বিশ্বে যা কিছু আছে সবই। কেউ দুদিন আগে, কেউ দুদিন পরে ।
লেখা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। ইতি টানতে চাই। শেষ করার আগে একটি ভালো লাগা ও খারাফ লাগা ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে চাই। মনোয়ার ভাইকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে দুটো কারণে মন ভরে ওঠলো। এক. তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা। দুই. হাসপাতালে তাঁর নিবীড় চিকিৎসাসেবা।
লন্ডনের হাসপাতালে একজন মৃতু্যপথযাত্রীর প্রতি ডাক্তারদের আন্তরিক চিকিৎসাসেবা দেখে মনে পড়লো আমার বাবার মৃতু্যর কথা । ২০১৫ সালের এপ্রিলে বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন । স্থানীয় ডাক্তারের পরামর্শে নিয়ে যাওয়া হলো সিলেট শহরের নয়াসড়স্থ একটি নামিদামী ক্লিনিকে। চিকিৎসা শুরু হলো। বাবাকে দেখতে আমার আট বছরের ছেলে জিবরিল ও ছোট ভাই মোহাম্মদ রহিমকে সঙ্গে নিয়ে বিমানে করে বাংলাদেশ রওয়ানা দিলাম । সিলেট পৌঁছে শুনলাম বাবার অবস্থা খুবই খারাফ। এয়ারপোর্ট থেকে দ্রুত ক্লিনিকে পৌঁছলাম। লিফটে মানুষের ভীড় ঠেলে উপরতলায় পৌছে যখন আইসিসিউতে ঢুকতে চাইলাম তখন কর্তব্যরত এক নার্স গতিরোধ করলেন। বললেন, সাধারণ মানুষ আইসিসিউতে প্রবেশ নিষেধ। বললাম, লন্ডন থেকে বাবাকে দেখতে এসেছি। তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় আছেন। আমাকে তাঁর কাছে যেতেই হবে। এরপর অনেকটা ধাক্কাধাক্কি করে আমি ও ছোট ভাই ভেতরে ঢুকলাম। কিন্তু আমার ছেলেকে তাঁরা ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। বৃটেনে জন্ম নেয়া ছেলেটি এই প্রথম দেশে গিয়েছিলো তার দাদাকে দেখতে। কিন্তু জীবিতাবস্থায় সে তাঁর দাদাকে দেখতে পারেনি । তাই সে আফাসোস করে বলেছিলো 'ওরা আমার দাদাকে দেখতে দেয়নি"। বাবাকে নিয়ে কখনো স্মৃতিচারণ করলে এখনও সে একই কথা বলে। তাঁর এই কথাটি শুনলেই আমার ভীষন কষ্ট হয়। মনে হয় সেদিন ওই ক্লিনিকের নার্সটি কতটা অমানবিক ছিলেন । ছেলেটি কখনো তাঁর দাদাকে দেখেনি। আর ইহজগতে কোনোদিন দেখবেওনা।
লন্ডনে মানুষের মৃতু্যর সময় তার কেবিনটি স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ভিজিটিং আওয়ারের সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়। আত্মীয় স্বজনকে বলা হয় রোগীর পাশে থাকুন। সময় দিন। এই সময়টাতে রোগী তাঁর স্বজনকে পাশে দেখতে চায় । কিন্তু বাংলাদেশে রোগীকে আইসিসিউতে বন্দী করে রাখা হয় । আপনজনকেও ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়না । আইসিসিউ নামক টাকা তৈরির কারখানায় হাপাতে হাপাতে যখন মৃতু্য নিশ্চিত হয়ে যায় তখনই স্বজনকে লাশ বুঝিয়ে দেয়া হয়। আর গুনে নেয়া হয় আইসিসিউর বড় অংকের বিল। আর বিল দিতে দেরী হলে লাশ বুঝিয়ে দিতেও দেরী হয়। হায় বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা। আমরা এ ধরনের অমানবিক চিকিৎসা সেবা থেকে কবে মুক্তি পাবো। তা কি আদৌ সম্ভব?
সে যাক। মনোয়ার হোসাইন ভাইয়ের জন্য কায়মনো প্রার্থনা । তিনি যেনো সুস্থ হয়ে আমাদের মধ্যে ফিরে আসেন। আর যদি আয়ু ফুরিয়ে যায়, তাঁকে চলে যেতে হয়, তাহলে ঈমানের সাথেই যেনো মৃতু্যবরণ করেন। আমিন।
উল্লেখ্য, মানবাধিকারকর্মী মনোয়ার হোসাইন বদরুদ্দোজার দেশের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার বায়মপুর গ্রামে। তাঁর মরহুম পিতা মকদ্দস আলী ছিলেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার খ্যাতনামা মুহাদ্দিস। তাঁর অনেক ছাত্র দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। মনোয়ার হোসাইন নব্বুইর দশকে বৃটেন পাড়ি জমান। লন্ডনে তাঁর একুশ বছরের এক ছেলে ও উনিশ বছরের এক কন্যা সন্তান রয়েছেন।
তাইসির মাহমুদ
সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
৯ ডিসেম্বর ২০১৮
বিষয়: বিবিধ
৮৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন