তিউনিশিয়া-মিশরে এক সপ্তাহ (এক) ক্বারুনের অভিশপ্ত সাম্রাজ্যে আধঘণ্টা
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ২৪ এপ্রিল, ২০১৮, ০১:৩৭:২৩ দুপুর
মিশর ভ্রমণের শেষ দিন কাটলো মাটির নিচে দেবে যাওয়া ক্বারুনের সাম্রাজ্য দেখে । রাজধানী কায়রো থেকে ১০৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ফাইয়ুম সিটিতে ছিলো ক্বারুনের সাম্রাজ্য । আজ থেকে ৩ হাজার বছর আগে আল্লাহ তায়ালা তার সাম্রাজ্যকে মাটির নিচে গেড়ে দিয়েছিলেন । অহংকারীর শাস্তির নিদর্শন সরূপ আজও সেখানে সেই ধ্বংসলীলা বিদ্যমান রয়েছে।
কোনো মানুষ অতিমাত্রায় কৃপন হলে তাকে 'ক্বারুন' বলা হয় । বাংলাদেশী সমাজে অতিশয় কৃপন ব্যক্তিকে 'কারুনের ঘরের কারুন' বলে গালি দেওয়ারও প্রচলন আছে । কিন্তু কারুন বলে গালি দেয়ার রহস্য কী? কে সেই ক্বারুন । কোথায় সেই কারুনের অট্রালিকা?
মিশর পৌঁছে জানলাম, সেই কারুনের বাড়ি রাজধানী কায়রো থেকে ১০৮ কিলোমিটার দূরে। মনস্থ করলাম, অবশ্যই ঐতিহাসিক কুরআনিক এই স্থানটি দেখতে যাবো।
১১ এপ্রিল বুধবার। সকাল ৮টায় ফাইয়ুম সিটির উদ্দেশ্যে আমাদের গাড়ি ছাড়লো রাজধানী কায়রো থেকে। জনমানবহীন বিস্তৃত মরুভূমির মধ্যদিয়ে ১০৮ কিলোমিটার পথ । অনিরাপদ রাস্তা। তাই মিশর সরকারের নিরাপত্তাবাহিনীর একজন লোক আমাদের গাড়িতে দেয়া হলো। সাথে পুলিশের একটি গাড়িও । অনেকটা বাংলাদেশী মন্ত্রীদের মতো। মন্ত্রী সাহেবের গাড়ি পেছনে, পুলিশের গাড়ি সম্মুখে। সায়রন বাজিয়ে মানুষকে জানান দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলা। আমাদের ভাগ্যেও এমন সফর জুটলো। তবে আমরা বৃটিশ প্রতিনিধিদল। তাই আমাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই এই বিশেষ আয়েজন।
মিশরের ঐতিহাসিক তাহরির স্কয়ারের কাছেই আমাদের হোটেল। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করলাম। ফাইয়ূম সিটিতে কারুনের বাড়িতে যাওয়ার পূর্বে পথিমধ্যে নবী ইউসুফ (আঃ) এর তদানিন্তন সাম্রাজে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। তাঁর খননকৃত নদী ও পানি সেচ ব্যবস্থাপনা এখনও সেখানে বিদ্যমান। সেখান থেকে যাত্রা শুরু কারুনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। পুলিশ প্রটোকল যথারীতি। আরো ঘণ্টা খানেকের মধ্যে গিয়ে পৌঁছলাম কারুনের ধ্বসপ্রাপ্ত সাম্রাজে।
মুল রাস্তা থেকে কারুনের এলাকায় প্রবেশ করতে একটি গেইট আছে। সেখানে বড় একটি সাইনবোর্ডে কারুনের সংক্ষিপ্ত বর্ণণাও আছে। গেইটে গিয়ে আমাদের গাড়ি থামলো। সেখানে একটি নিরাপত্তা চৌকি রয়েছে । চৌকি থেকে বেরিয়ে এলেন একজন নিরাপত্তাকর্মী । কোমরে পিস্তল ঝুলানো। ভেতরে প্রবেশের জন্য জনপ্রতি ফি চাইলেন ৬০ মিশরী পাউন্ড। বলা বাহুল্য, বৃটেনের এক পাউন্ডে মিশনের ২৪ পাউন্ড হয়। আমরা ৯জন যাত্রী । ৫৪০ মিশরী পাউন্ড পরিশোধ করলাম। এবার নিরাপত্তাকর্মী আরো একটি গাড়িতে ওঠলেন। আমাদের গাড়িটি ছুটলো তার গাড়িকে অনুসরন করে। ৫মিনিট চালানোর পর আমরা পৌঁছলাম কারুনের প্রাসাদের সম্মুখে।
সকলের মনেই যে কিছুটা ভয় কাজ করছে তা আঁচ করতে পারলাম। কারণ এটি একটি অভিশপ্ত জায়গা । আল্লাহ তায়ালা কারুনের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে সেখানে অভিশাপ দিয়েছেন। গোটা এলাকাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। কারুনের প্রাসাদগুলো মাটির নিচে গেড়ে দিয়েছেন। তাই সকলের মনেই কিছুটা সংশয়।
ভ্রমণসঙ্গী আইয়ূব খান সকলকে সতর্ক করে দিলেন। বেশি সময় থাকা যাবে না, থাকা ঠিক না। প্রাসাদটি চটজলদি দেখে এলাকা ত্যাগ করতে হবে। তিনি এও বললেন, রাসুল (সাঃ) অভিশপ্ত জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়াতে নিষেধ করেছেন। রাসুলের (সাঃ) জীবনের একটি ঘটনাও স্মরণ করিয়ে দিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একবার কয়েকজন সাহাবীকে নিয়ে একটি শাস্তির স্থানে উপস্থিত হয়েছিলেন । তখন তিনি খুব তড়িঘড়ি করে সঙ্গীদেরকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন ।
কারুনের প্রাসাদের সম্মুখে পৌঁছলে নিরাপত্তাকর্মী তার ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের দরজা খুলে দিলেন। বড় বড় প্রস্তখন্ড দিয়ে নির্মিত প্রাসাদটি। বিশাল প্রাসাদ। সম্ভবত তিনতলা হবে। আমরা ভগ্ন সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠে ঝটপট কিছু ছবি তুলে নিলাম । মূল ভবনটি দাঁড়িয়ে থাকলেও রুমের অনেক দেয়ালই ভাঙ্গা। দেখলেই বুঝা যায় এখানে শাস্তি নেমেছিলো । ভূমিকম্পে যেভাবে বড় বড় দালান ক্ষতিগ্রস্থ হয় তেমনি ভবনটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রাসাদের ছাদে দাঁড়ালে আশপাশে মরুভুমির মধ্যে আরো কয়েকটি ভবনের শুধু ছাদের অংশ দেখা যায়। ভবনগুলো মাটির নিচে দেবে গেছে। মূল প্রাসাদের উপর থেকে ভালোভাবে দৃষ্টি ফেলতে দেখা যায়, ওই ভবনগুলো এখন বালুর নিচে। শুধুমাত্র ছাদের অংশের দুচারটি ইট দেখা যাচ্ছে ।
আমরা হাঁটছি, দেখছি। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো মিথ্যাবাদীদের সাথে আমি কী ব্যবহার করেছি। তাই আমরা দেখছি কারুনের সাথে কেমন ব্যবহার করেছেন আল্লাহ তায়ালা। তিনি তার মূল প্রসাদটি একেবারেই মাটির নিচে দেবে দেননি। আংশিক ধ্বংস করে আংশিক রেখে দিয়েছেন যাতে ক্বেয়ামত পর্যন্ত মানুষ দেখতে পারে। জানতে পারে কারুন কে ছিলো। কেন তার উপর আল্লাহর অভিশাপ নেমেছিলো।
আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা কারুনের এলাকা থেকে বেরিয়ে এলাম। গাড়িতে বসে কারুনের ঘটনা আলোচনা হচ্ছিলো। পবিত্র কুরআনে সুরা ক্বাসাসের আয়াতের (৭৬ থেকে ৮২) আলোকে।
কারুন ছিলো মুসা (আঃ) এর চাচাতো ভাই। তার পুরো নাম ছিলো কারুন ইবনে ইয়াসার ইবনে কাহিস। সে ওই সময়ের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতের হাফিজও ছিলো। আল্লাহ তায়ালা তাকে এতোবেশি সম্পদ দিয়েছিলেন যে, তার ধনভান্ডারের চাবি বহনের জন্য একদল লোক কাজ করতো । তাদের কাজই ছিলো শুধু চাবি বহন করা। কারুন যখন কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতো তখন ধনভান্ডরের চাবিগুলো কাঁধে নিয়ে উপস্থিত হতো তার লোকজন । উদ্দেশ্য, লোকজনকে দেখানো সে যে এত বেশি সম্পাদের মালিক। সে শুধু সম্পদ বাড়াতেই থাকে। সম্পদ চাই, আরো চাই। কিন্তু কোনো মানুষকে দান করতো না।
তার সম্প্রদায়ের আলেমগন তাকে বারবার এই বলে সতর্ক করে দেন যে, তুমি সম্পদ নিয়ে অহংকার করোনা। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন। তুমি নিরহংকারী জীবনযাপন করো। অসহায় মানুষকে দান খয়রাত করো। জবাবে কারুন বলেছিলো, আমি এসব সম্পদের জন্য যোগ্য বলেই আল্লাহ তায়ালা আমাকে দিয়েছেন। এগুলো আমার অর্জন। সুতরাং আমি কী করছি, কী করতে হবে এ ব্যাপরে উপদেশের কোনো প্রয়োজন নেই। এভাবেই সম্পদ নিয়ে তার অহংকারী কর্মকান্ড চলতে থাকলো। কেউই থাকে থামাতে পারলো না।
একদিন কারুন নিজের লোকজনসহ সাজসাজ ভাবে শহরের দিকে বের হলো। তার সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ তাঁর সাজসাজ ভাব দেখে আক্ষেপ করতে লাগলো। বলতে লাগলো হায়, আমাদেরও যদি কারুনের মতো সম্পদ থাকতো তাহলে আমরাও এভাবে সাজসাজ রবে চলাফেরা করতে পারতাম । কিন্তু এর পরদিনই নেমে এলো আল্লাহ প্রদত্ত আজাব বা শাস্তি। হঠাৎ করেই ভুমিকস্পের মতো কারুনের প্রাসাদ মাটি নিচে দেবে যেতে লাগলো। তার মূল প্রাসাদকে ঘিরে ছিলো আরো ছোট বড় অনেকগুলো প্রসাদ । সবগুলো মাটির নিচে দেবে গেলো। শুধু মুল প্রাসাদটি ধ্বসে যাওয়া অবস্থায় থেকে গেলো। এই অবস্থা দেখে আগের দিন যারা সম্পদশালী হওয়ার জন্য আক্ষেপ করেছিলো তারা বললো, আমরা আর সম্পদ চাইনা। সম্পদ হলে আমরাও হয়তো অহংকারী হয়ে উঠতাম। আর এভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ নেমে আসতো।
তাইসির মাহমুদ
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল ২০১৮
বিষয়: বিবিধ
১১১৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন