একটি মৃতু্য সংবাদ ও বাবার শুন্যতা
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ০৪ জানুয়ারি, ২০১৮, ১০:২৯:০১ সকাল
মৃতু্য বলে-কয়ে আসেনা। কিন্তু টিভি প্রেজেন্টার আজমাল মাসরুর এর পিতা মকবুল হোসেনের মৃতু্য যেনো জানান দিয়েই এলো। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আমাদের বায়তুস-সালাম মসজিদের ফান্ডরেইজিং ডিনারে মুল আলোচক ছিলেন আজমাল মাসরুর । উপস্থাপনার ফাঁকে ফাঁকে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে বারবার চোখ রাখছিলেন। বলেছিলেন, তাঁর পিতা হাসপাতালে শয্যাশায়ী। যেকোনো সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন। মোবাইলে মৃতু্য সংবাদ আসতে পারে। তিনি সকলের কাছে দোয়া চেয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শেষ করে হাসপাতালে পৌঁছার কিছুক্ষণ পরই মোবাইল বার্তায় তাঁর বাবার মৃতু্য সংবাদটি জানালেন। তিনি যেনো মৃতু্যর আগাম খবর পেয়ে গিয়েছিলেন।
বাবাকে হাসপাতালে রেখে অনুষ্ঠানে আসতে মন চায়নি তাঁর। কিন্তু যেহেতু আগে কথা দিয়েছিলেন তাই তাঁকে আসতে হয়েছিলো। তবে তাঁর মনে তেমন অনুশোচনা ছিলোনা, কারণ তিনি একটি চ্যারিটি কাজে ছিলেন । যে চ্যারিটি কাজের জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন তাঁর বাবা।
আসলে বাবার মৃতু্যর শুন্যতা প্রথমদিকে যেভাবে অনুভব করা যায়, দিন অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে তা আরো গভীর হতে থাকে। কারণ বাবা হচ্ছেন পরিবারে একটি বিশাল ছাতার মতো। তিনি পরিবার সদস্যদের ছাতার মতো আগলে রাখেন। দিন যতই যায়, সেই ছাতা নামক বাবার শুন্যতা ততই গভীর হতে থাকে।
আড়াই বছর আগে বাবাকে হারিয়েছি। অসুস্থতার খবর পেয়ে লন্ডন থেকে বাড়ি গিয়ে তাঁর জানাজা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ করি। সপ্তাহদিন তাঁর রুহানী খেদমতে কাটিয়ে ফিরে আসি। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন ছিলেন। তাঁর শুন্যতা খুব বেশি অনুভব হয়নি। কিন্তু এবার যখন বাড়িতে গেলাম তখন বুঝতে পারলাম বাবার শুন্যতা কতটুকু নিপীড়ক? মানুষের পদাচারনায় মুখরিত বাড়ি । কিন্তু কেমন যেনো এক শুন্যতা। পুরো বাড়িই মনে হয় শুন্য। মনে হয় বাড়িতে একটি বিশাল ছাতা ছিলো। যে ছাতাটি আমাদেরকে সুখ-দুঃখে আশ্রয় দিতো, সেটি আর নেই। কেমন আশ্রয়হীন এতিম এতিন মনে হয়।
বাবার কবরস্থানটি নীরব-নিস্তব্ধ। ঘাস ও লতাপাতায় ছেয়ে গেছে। চারপাশের বেড়া ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, মাত্র আড়াই হাত মাটির নিচে আমার সদাব্যস্ত বাবা ঘুমিয়ে আছেন। এই গোরস্থানের পাশ দিয়েই তিনি পাঁচ ওয়াক্ত মসিজদে নামাজে যেতেন। আজ তিনি এখানেই ঘুমিয়ে আছেন। আমরা তাঁর কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। কিন্তু তিনি নীরব, নিস্তব্ধ। কোনো সাড়া শব্দ নেই। ভাবি, আর তো বেশিদিন নয়। আমরাও তাঁর সঙ্গী হবো । আমাদের কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে আমাদের সন্তানেরা। এভাবেই একজনের পর একজন বিদায় নেবো। বাঁশের বেড়া ভেঙ্গে যাবে। কবরের পর কবর হবে। হারিয়ে যাবে আমার কবরও। কেউ মনে রাখবেনা। মনে রাখার কেউ থাকবে না।
বলছিলাম, আজমাল মসরুর এর পিতার কথা। বাবাকে অসুস্থ রেখে আমাদের ফান্ডরেইজিং ডিনারে আজমাল মাসরুরকে উপস্থিত থাকতে হয়েছে। তাঁকে আমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করায়, নিজেকে নিজের কাছে কেমন যেনো অপরাধী মনে হয়। কিন্ত একটি জায়গায় শান্তনা খুঁজে পাই। কারণ আজমাল মাসরুর তো একটি ভালো কাজে সময় দিতে এসেছেন । তিনি একটি মসজিদের জন্য ফান্ডরেইজ করতে এসেছিলেন। এ ধরনের চ্যারিটি কাজে সময় দিতেই তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন তাঁর পিতা।
অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে নিজের জীবনের একটি শিক্ষনীয় ঘটনা বলেছিলেন আজমাল মাসরুর। তাঁর বয়স যখন চৌদ্দ, তখন লন্ডনের একটি নিউজ এজেন্টে কাজ পেয়েছিলেন। বেতন প্রতি ঘণ্টা ১ পাউন্ড । প্রথম সপ্তাহ কাজ করার পর পেয়েছিলেন ১৭ পাউন্ড ৫০ পেন্স। এটি ছিলো তাঁর জীবনের প্রথম উপার্জন। আর এই উপার্জনের সবটুকুই তিনি পরম আনন্দে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর বাবার হাতে। বাবা পাউন্ডের প্যাকেকটি তাঁর পকেটে রেখে দিয়ে বলেছিলেন, আল-হামদুলিল্লাহ। আজমাল মাসরুর ভেবেছিলেন তাঁর বাবা খুশি হয়ে বেতনের পয়সাটুকু তাঁকেই ফিরিয়ে দেবেন। কিংবা কিছু রেখে বাকিগুলো তাঁকে দিয়ে দেবেন। কিন্তু ঘটলো উলটোটা। তিনি পুরো বেতনটুকুই তাঁর পকেটে পুরে রাখলেন। বেশ মনকষ্ট পেলেন আজমাল মাসরুর।
রাতে খাবার টেবিলে বাবাকে কষ্টের কথাটি জানানোর সুযোগ পেলেন। বললেন, "বাবা সারা সপ্তাহ কাজ করে জীবনের প্রথম উপার্জন আপনার হাতে তুলে দিলাম, আর আপনি একটি পেন্সও আমাকে ফিরিয়ে না দিয়ে সবটুকুই নিয়ে নিলেন।
তাঁর বাবা তখন জবাব দিলেন, "তুমি যখন প্রথম কাজে যাও তখন আমি মনস্থ করেছিলেন যদি তুমি পুরো সপ্তাহ কাজ করতে পারো তাহলে পুরো বেতনটুকুই চ্যারিটিতে দিয়ে দেবো। আমি তা-ই করেছি। তোমার পুরো বেতনটুকু চ্যারিটিতে দিয়ে দিয়েছি। তখন তিনি তাঁকে আরো একটি উপদেশ দিয়েছিলেন- "যতদিন বেঁচে থাকো চ্যারিটি ওয়ার্ক (আল্লাহর রাস্তায় দানের কাজ) করো"।
আজমাল মাসরুর বলেন, "সেই চৌদ্দ বছর বয়সে চ্যারিটি দিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম; আজ ৩৬ বছর বয়স পর্যন্ত চ্যারিটি ওয়ার্কই করে যাচ্ছি। যদিও এই মহূর্তে হাসপাতালে বাবার শয্যাপাশে থাকা উচিত ছিলো, তবে এই ভেবে আমি শান্ত্বনা পাই যে, তিনিই তো আমাকে চ্যারিটি কাজের জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন। আমি তাঁরই উপদেশ পালন করছি।
দোয়া করি, পুত্রের চ্যারিটি কাজের জন্য পিতাকে যেনো আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দেন। তাঁকে যেনো জান্নাতের সর্বোত্তম স্থানে সমাসীন করেন। আল্লাহ তায়ালা যেনো আমাদের সকলের পিতা-মাতাকে জান্নাতে স্থান দেন। রাবিবর হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা। আমিন।
তাইসির মাহমুদ
বেথনাল গ্রীন
পূর্ব লন্ডন, যুক্তরাজ্য
৪ জানুয়ারি ২০১৮
বিষয়: বিবিধ
৭৩০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন