শিক্ষামন্ত্রীর সহনশীল মাত্রার ঘুষ গ্রহণের নসিহত ও একটি ঘুষের গল্প
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:১৭:৫২ সকাল
‘সহনশীল’ মাত্রায় ঘুষ গ্রহণের নসিহত প্রদান ও ঘুষ গ্রহণে বাধা দেয়ার সাহস নেই" বলে বক্তব্য দেয়ায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পদত্যাগ দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
শিক্ষামন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর তাঁর পদত্যাগের দাবী উঠতেই পারে। বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দার ঝড়ও আসবে । এটা খুবই স্বাভাবিক।
কিন্তু নুরুল ইসলাম নাহিদের এ বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাসহ প্রতিটি সেক্টরে ঘুষবাণিজ্যের একটি প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠেছে। শিক্ষাখাত, বিদু্যত ও বিমানসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ যে একটি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি সেই চিত্রই ফুটে ওঠেছে।
"শুধু অফিসাররাই চোর নয়, মন্ত্রীরাও চোর, আমিও চোর।" এমন বক্তব্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক মহলে বিরাজমান চৌর্যবৃত্তির বিষয়টিও পরিস্কার করে তুলে ধরেছেন। তিনি যদি তাকে চোর বলে স্বীকারোক্তি না দিতেন তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে মন্ত্রী-এমপিদের ততক্ষণে আন্দোলন শুরু হয়ে যেতো। জানিনা, তাঁর এ বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া কী?
আসলে বাংলাদেশে ঘুষ বাণিজ্য যেনো একটি সংস্কৃতি হিসেবে রূপ লাভ করেছে। কাজ আদায়ের জন্য ঘুষ দেয়াটা স্বাভাবিক, না দেয়াটা অস্বাভাবিক।
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। একবার সিলেট জেল রোডস্থ বিদু্যৎ অফিসে একটি কাজে গিয়েছিলাম। মামুলি একটি কাজ। সংশ্লিস্ট কর্মকর্তার কাছে যখন গেলাম, তিনি কাজের সাইজ দেখে বললেন, পনেরো শত টাকা লাগবে? জানতে চাইলাম- "টাকা কেন লাগবে। এই কাজ করে দেয়া তো আপনার দায়িত্ব। সরকার তো আপনাকে প্রতি মাসে মাইনা দেয়। তাহলে আমি দেবো কেন?"
আমার কথাবার্তা শোনে তিনি যেনো তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠলেন । ভাবখানা এমন যে, "এই বেয়াড়া লোকটি কী বলে? পনেরো শ' টাকা লাগবে বলার পর আবার লেকচার দেয়। বললেন, আপনার লেকচার শুনতে আমরা এখানে বসিনি। কাজ করাতে হলে ১৫শ টাকাই দিতে হবে। বললাম দেবো, তবে আপনাকে রিসিট দিতে হবে। বললেন, কীসের রিসিট। বললাম, এই যে ১৫শ' টাকা দেবো, আপনি কি তার রিসিট দেবেন না? তাহলে আমি ১৫শ টাকা কেন দেবো? তিনি আরো চটে গিয়ে বললেন, কেন দেবেন বুঝেন না আপনি? আমি তো বাংলায় বলছি। আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? বললাম, বাংলা তো বলছেন। তাতো বুঝতে পারছি। কিন্তু টাকাটা কেন দেবো? এটা ফি হিসেবে নিলে তো আপনি রিসিট দেবেন। রিসিটি কেন দেবেন না? এবার তিনি ক্ষোভে বেসামাল হয়ে বললেন, আপনি ঘুষ বুঝেন তো? এটা হচ্ছে ঘুষ । ঘুষ দেবেন। বললাম, তাহলে তাই বলুন। এটা ঘুষ।
এসময় পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকে জোহরের আযান ভেসে এলো। আজান শোনে তিনি ফাইলপত্র ঘোচাতে শুরু করলেন। বললেন, আমি নামাজে চলে যাবো। আপনি কাজ চাইলে ১৫শত টাকা দিয়ে যান। নামাজ পরে এসে নিয়ে যাবেন।
বললাম, এই পর্যন্ত সরকারী কোনো দপ্তরে ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে হয়নি। দেখি, চেষ্টা করি। আপনার কাছ থেকে ঘুষ ছাড়া কাজটি আদায় করে নিতে পারি কি-না? বললেন, প্রশ্নই আসেনা। ১৫শত টাকা ছাড়া এই কাজ অফিসে কেউ করে দেবে না। বললাম, ইনশাল্লাহ আপনি করে দেবেন এবং আজ বিকেল ৫টার আগেই । ক্ষুব্ধ হয়ে মুখ ভেঙ্গচিয়ে জবাব, "এরকম কথা অনেকেই বলে।"
ভাবছি কী করবো। বিদু্যৎ ভবনের চারতলায় নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়। সিড়ি ডিঙ্গিয়ে উপরে উঠলাম। সাথে আমার খালাতো ভাই। 'ম্যা আই কাম ইন স্যার'- বলে প্রবেশের অনুমতি চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী সদয় সম্মতি জানালেন। ভেতরে প্রবেশ করে চেয়ার টেনে বসলাম। তিনি পরিচয় জানতে চাওয়ায় সুবিধা হলো। বললাম, সংবাদকর্মী। জানতে চাইলেন- কোন পত্রিকায় আছি। এবার পরিচিতি পর্ব শেষ হওয়ার অগেই জানতে চাইলেন, কী খাবো। বললাম কিছুই না। বললেন, আরে অফিসে এলেন আর কিছু খেয়ে যাবেন না? তা কী করে হয়। কলিং বেল টিপে পিয়নকে দুটো কোক নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে দুই বোতল কোক চলে এলো। আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, নেন প্লীজ। আমরা কোক খেয়ে নিয়ে কিছুটা ঠাণ্ডা হলাম।
এবার জানতে চাইলেন, কী সাহায্য করতে হবে? তার কাছে পুরো কাহিনী বর্ণনা দিলাম । সব শুনে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, আপনারা একটু বসুন। আমি দেখছি। এই কাজ করে দিতে তো টাকা চাইতে পারেনা। তিনি ঘুষদাবীকারী কর্মকর্তাকে তলব করলেন। কর্মকর্তা এসে আমাদেরকে দেখেই কেমন যেনো ইতস্তবোধ করতে লাগলেন । নির্বাহী প্রকৌশলী তাকে ধমক দিয়ে বললেন, আপনি টাকা চেয়েছেন কেন? যান এক্ষুনে আধঘণ্টার মধ্যে কাজটি করে নিয়ে আসুন।
কোনো কথা না বলে ঘুষখোর চলে গেলেন। আধঘন্টার মধ্যে কাজ শেষ করে নিয়ে এলেন। নির্বাহী প্রকৌশলী কাজটি আমাদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আগামীতে কোনো কাজ হলে আমার কার্যালয়ে সরাসরি চলে আসবেন।
তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম । আমার জানা ছিলোনা এমনভাবে নির্লজ্জের মতো সরকারী অফিসারেরা ঘুষ দাবী করেন।
সংবাদকর্মীর পরিচয়ে সেদিন ঘুষ না দিয়ে কাজটি করিয়ে নিয়ে আসতে পারলেও এভাবে প্রকাশ্যে ঘুষদাবীর বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলে। সাধারণ মানুষ তো অসহায়। তাদেরকে তো ঘুষ দিতেই হবে।
ভাবি, নির্বাহী প্রকৌশলী কি জানেন না তার অফিসের কর্মকর্তারা ঘুষ খায়? তিনি কি এই ঘুষের ভাগ পাননা ? অবশ্যই তিনি ভাগ পান। নতুবা ওই কর্মকর্তা প্রকাশ্যে মাস্তান স্টাইলে ঘুষ চাওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারতেন না।
শিক্ষামন্ত্রীর কথাগুলোতে মুলত এই দৃশ্যই ফুটে ওঠেছে । সত্য কথাগুলো সোজাসাপ্টা বলে ফেলাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়ে। তিনি
যা বলেছেন, সাবৈভ সত্য। যে যাই বলুন, সত্য বলার জন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদই জানাবো।
তাইসির মাহমুদ
লন্ডন, যুক্তরাজ্য।
বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭
বিষয়: বিবিধ
৭৪২ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন