জিন্দাবাজার-টু-মিরাবাজার একজন রিক্সা ড্রাইভার এবং....
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ১৯ নভেম্বর, ২০১৭, ০৭:৪৯:৪৩ সকাল
২২ অক্টোবর ২০১৭। রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টা । হালকা গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি। জিন্দাবাজার থেকে রিক্সায় চড়ে মিরাবাজার হোটেল সুপ্রিম-এর সম্মুখে পৌঁছলাম । রিক্সা থেকে নেমে জানতে চাইলাম 'ভাড়া কত দেবো' । কিন্তু ড্রাইভার নাছোড়বান্দা। কিছুতেই ভাড়া বলবেন না। বারবার জানতে চাই- কত দেবো বলুন । জবাব একটিই, আপনি দিয়ে দিন।
প্রায় ১৫ বছর আগে সিলেট ছেড়েছি। জিন্দাবাজার থেকে মিরাবাজার একসময় ভাড়া ৪/৫টার বেশি ছিলো না। কিন্তু এখন মার্কেট-ফেয়ার কত জানিনা। তাই কত দেবো বুঝতে পারছিলাম না। পঞ্চাশ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম -ঠিক আছে তো? মৃদু হেসে জবাব, জ্বি হবে।
অন্ধকার রাত। সোডিয়াম বাতির আলোতে রিক্সা ড্রাইভারকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিল না। তাছাড়া, এতক্ষণ রুমাল দিয়ে মাথা ও মুখমন্ডল বাঁধা ছিলো। রুমাল সরালে দেখলাম- পরনে নীল রঙের পাঞ্জাবী, পাজামা। মুখে হালকা দাড়িও আছে। কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম, আপনি কি মাদ্রাসার ছাত্র? মৃদু সুরে জবাব, আমি কুরআনে হাফিজ। আর কী করেন? বললেন, শহরের একটি কওমী মাদ্রাসায় দাওরা (কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রী) পড়ি। বললাম, রিক্সা চালান কেন? বললেন, লেখাপড়া, থাকা-খাওয়ার খরচ লাগে না? তাছাড়া বাড়িতেও কিছু দিতে হয়। তাই রাতে রিক্সা চালাই। অবশ্য মাদ্রাসার কেউ জানে না।
কথাগুলো শুনে কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি । হাতে আরো কিছু টাকা ছিলো সেগুলো তুলে দিয়ে বললাম, কাজ করে খাওয়া ও লেখাপড়া করার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই। আপনাকে স্যালুট । ভালো থাকবেন। দোয়া চেয়ে বিদায় নিলাম।
পরদিন দুপুরে মিরবক্সটুলা রোড হয়ে হাওয়াপাড়ার দিকে যাবো । সাথে সিলেট শহরের সুপরিচিত ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেইন। একটি মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি। বিপরীত থেকে সফেদ পাঞ্জাবী, টুপি আর লুঙ্গি পরিহিত হুজুরবেশি এক ব্যক্তি পাশে এসে দাঁড়ালেন। সালাম পেশ করে জানতে চাইলেন, আমি কি নয়াসড়ক থাকি। বললাম, একসময় থাকতাম এখন থাকিনা। বললেন, এখন কি লন্ডন থাকেন? মাথা নেড়ে সায় দিলে তিনি আরো কাছাকাছি এলেন। দেরি না করেই বললেন, "আমার একটি মেয়ে খুবই অসুস্থ। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। আমাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করুন ।
লোকটার তাৎক্ষনিক আবদার আমার কাছে কেমন যেনো সন্দেহজনক মনে হলো। আমি কি লন্ডনী-তা জানার সাথে সাথে তাঁর মেয়ে অসুস্থ ও চিকিৎসার টাকা চাওয়ার ভঙ্গিমা আমার কাছে ভালো মনে হলো না ।
কিন্তু চলতি পথে এতসব অনুসন্ধান করার সুযোগ নেই। যেহেতু সন্দেহ তাই টাকা দিতে মন সায় দেয়না। কিন্তু বেছারা নাছোড় বান্দা । না দিয়ে রক্ষা নেই। বললেন, "আমি সাধারণত কারো কাছে এভাবে চাইনা। আপনার কাছে লজ্জা ভেঙ্গে চেয়েছি। আমাকে ফিরিয়ে দিয়েন না প্লীজ"। এমনভাবে তিনি আমাকে আগলে ধরলেন যে, তাকে কিছু টাকা না দিয়ে সরে আসার সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে কিছু টাকা তুলে দিলাম। তিনি টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে আর এক সেকেণ্ডও দাঁড়ালেননা। কোনো কথাও বললেনা। চটজলদি স্থানত্যাগ করলেন।
আমি হাঁটছি আর আগের দিন দেখা হওয়া রিক্সা ড্রাইভারের কথা ভাবছি। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরো বেড়ে গেলো । গতর খাটিয়ে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে পরিবার পরিজনকেও সাহায্য করছেন তিনি । হ্যা, আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তো কাজ করতেই বলেছেন। মানুষের কাছে হাত পাততে বলেননি।
রিক্সা ড্রাইভারকে যে সামান্য দান করি তার মধ্যে আমি একধরনের আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাই । কিন্তু ওই সফেদ পাঞ্জাবী, টুপিওয়ালা আতর-সুগন্ধী মাখা ব্যক্তিকে টাকা দিতে বাধ্য হওয়ায় নিজের বিবেকের কাছে অনুতপ্ত হই। কেন যেনো মনে হয়, আমি প্রতারিত হলাম।
তাইসির মাহমুদ
বেথনাল গ্রীন
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
রোববার, ১৯ নভেম্বর ২০১৭
রাত ১টা ৪৫মিনিট
বিষয়: বিবিধ
৯০৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তারা কারো কাছে চায় না খেটে রোজগার করে। অথচ আমাদের সমাজের চারপাশে খারাপ কাজের পরিমাণটা দিন দিন বেড়েই চলছে ।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন