আড়াল হতে-হতে একসময় চির আড়াল
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ২৯ এপ্রিল, ২০১৭, ০৯:২১:৫৪ সকাল
বাবার দ্বিতীয় মৃতু্যবার্ষিকী ছিলো শুক্রবার। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি পরপারে বিদায় নেন। আকস্মিক অসুস্থতার খবর পেয়ে দেশে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁকে জীবিত পাইনি। হাসপাতালে পৌছার মিনিট পাঁচেক আগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চিরবিদায় নেন । কেবিনে ঢুকে দেখছিলাম তাঁর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চোখ দুটো তখনো খোলা, তবে জ্যোতিহীন-ফ্যাকাশে। দু'চোখ বুজে দিয়ে তাঁকে চিরদিনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম। তারপর গ্রামে নিয়ে গিয়ে দাফন-কাফন শেষ করে কিছুদিন কাটিয়েছিলাম তাঁর রুহানি খেদমতে । এরপর ফিরে আসতে হলো সাত সমুদ্রের এপারে।
মনে হয় এই তো সেদিন। কিন্তু এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে দুটো বছর। একদম টেরই পাইনি। মন চায় ছুটে যাই বাবার স্মৃতিমাখা বাড়িতে। কবরের পাশে দাঁড়াই। তাঁর রুহ আমাকে দেখুক- আমি তাঁকে দেখতে গেছি। কিন্তু চাইলেই কি পারা যায়। পারিনা । দুনিয়াবী জঞ্জালের জালে বন্দী হয়ে আছি।
আমি জানি, আমাকেও একদিন এভাবেই চলে যেতে হবে। আমি এখন সন্তানের বাবা। আমাকেও তারা কবরে বিদায় দিয়ে আসবে। তারাও আমার রুহানী খেদমতে কিছুদিন সময় কাটাবে। কিন্তু আমি যেভাবে আমার বাবাকে ভুলে যাচ্ছি, দুই বছর পেরিয়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছিনা, একসময় তারাও তেমনিই ভুলে যাবে। এটাই নিয়তি। এটাই চির সত্য। আমার বাবাও তাঁর বাবাকে ভুলেছেন। আমি আমার বাবাকে ভুলে যাচ্ছি। আমার ছেলেও তার বাবাকে ভুলে যাবে। এভাবেই একদিন সব সবকে ভুলে যাবে। কেউ কাউকে মনে রাখবে না। সকলেই আমরা হবো কবরবাসী।
নাহ, কবরতো সাময়িক। একসময় আমাদের কোনো কবরও থাকবেনা। সবকিছুই বিলীন হয়ে যাবে। থাকবেনা কোনো চিহ্ন। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আমাদের নাম-পরিচয়। শহর থেকে শহরান্তরে জীবনের পর্বতসম স্মৃতি সবকিছু মিলিয়ে যাবে। কেউ কারো কথা মনে রাখবে না। মনে রাখার কেউ থাকবে না।
ছোটকালে গ্রামের কবরস্থানে বাবা যখন জেয়ারতে নিয়ে যেতেন তখন আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলতেন, এই হচ্ছে তোমার দাদা-দাদির কবর। তখন দোয়া করতাম, হে আল্লাহ আমার দাদা-দাদীকে তুমি মাফ করে দাও। যখন নবম শ্রেনীর ছাত্র তখন আকস্মিক বিদায় নিলেন মা। তিনি শায়িত হলেন দাদা-দাদীর কবরের পাশে । তখন দোয়ার প্রাধান্য চলে গেলো মায়ের প্রতি। কারণ তিনি সদ্যপ্রয়াত। তাঁর জন্য বেশি দোয়া প্রয়োজন। কবরস্থান ধীরে ধীরে প্রশস্ত হতে শুরু হলো । আগে ছিলেন শুধু দাদা-দাদী। এখন মা। এরপর চাচী, চাচা বৃহত্তর পরিবারের আরো অনেকেই চলে গেলেন। এখন মায়ের কবর নতুন কবরের আড়ালে পড়ে গেছে। ঘাস-লতাপাতা গাছ-গাছালিতে ছেয়ে গেছে।
গোরস্থানে এখন বাবার কবরস্থানটি লেইটেস্ট (সর্বশেষ)। তিনিই সম্মুখে। তাই তাঁকে যেমন চোখে পড়ে, তেমনি মনেও পড়ে বেশি । তিনি সদ্যপ্রয়াত তাই তার জন্য বেশি দোয়া করা হয়। যখন আমরা (ছেলেরা) মারা যাবো তখন আমাদের কবরের আড়ালে পড়ে যাবে বাবার কবর । আমরা হবো তখন সদ্যপ্রয়াত। আমাদের জন্য দোয়া করা হবে বেশি বেশি। আমাদের ছেলে-মেয়েরা যখন মারা যাবে তখন তাদের কবরের আড়ালে পড়বে আমাদের কবর। এভাবেই একজনের আড়ালে আরো একজন। আড়াল হতে-হতে একসময় চির আড়াল। যে আড়ালে কেউ আর খুঁজে পাবেনা। নদী গর্ভে যেমন বিলীন হয়ে যায় জনবসতি তেমনি আমরা, আমাদের কবর- সব কিছুই বিলীন হয়ে যাবে। কেউ আমাদের মনে রাখবে না।
দোয়া চাই সকলের কাছে। প্লীজ, দোয়া চাই বাবা-মায়ের জন্য। দোয়া চাই আমরা আমাদের সকলের মা-বাবার জন্য। কেউ আগে গেছেন, কেউ পরে। সকলের জন্যই দোয়া দরকার। আল্লাহ তায়ালা যেনো মা-বাবাকে জান্নাতের সর্বোত্তম স্থানে সমাসীন করেন। আমীন।
তাইসির মাহমুদ
লন্ডন, যুক্তরাজ্য।
তারিখ: ২৯ এপ্রিল ২০১৭
লন্ডন সময় ভোর ৪টা
বিষয়: বিবিধ
৮০৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আর , কেন যে ছেলেমেয়েরা বাবা মাকে ফেলে বিদেশে বসতি গড়ে যে সময়ে বাবা মা তাদের সেবা পাবার জন্য কাতর হয়ে পড়েন !
মন্তব্য করতে লগইন করুন